Tuesday, 31 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৮


নোবেল পুরষ্কারের পর

প্রতিবছর ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় নোবেল পুরষ্কার প্রদানের মহোৎসব। সুইডেনের রাজার কাছ থেকে নোবেল পদক ও সনদ গ্রহণ করেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীরা। (একই দিনে নরওয়ের অস্‌লোয়  অনুষ্ঠিত হয় নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান।) নোবেল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরুষরা পরেন বিশেষ ডিজাইনের কালো স্যুটের সাথে সাদা বো-টাই, আর মহিলারা পরেন আনুষ্ঠানিক সান্ধ্যকালীন পোশাক। নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে যাঁরা সাধারণত আটপৌরে পোশাক পছন্দ করেন, তাঁরাও এদিনে এই বিশেষ নোবেল-পোশাক পরেই পুরষ্কার নিতে যান।
          কিন্তু ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। মঞ্চে বসা নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে দেখা গেলো একজনের পোশাক সম্পূর্ণ অন্যরকম। কালো লম্বা গলাবদ্ধ কোটের সাথে সাদা সালোয়ার পরনে, পায়ে জরির নাগরা জুতো, আর মাথায় সাদা পাগড়ি। হলভর্তি অতিথিদের সবার চোখ এই অন্যরকম পোশাকের অন্যরকম মানুষটির দিকে- যাঁর নাম আবদুস সালাম, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম।

শেলডন গ্ল্যাসো, আবদুস সালাম, ও স্টিভেন ওয়েনবার্গ

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে প্রফেসর আবদুস সালামের সত্যিকারের বিচরণ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে যখন তিনি কেমব্রিজে পড়তে আসেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৯ - এই বত্রিশ বছর ধরে যাঁরা চেনেন তাঁকে, পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁরা মোটেও অবাক হননি। কিন্তু সবাই খুব অবাক হয়েছেন নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে তাঁর পোশাক দেখে। কারণ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই প্রফেসর আবদুস সালাম দামী থ্রি-পিস স্যুট পরতে অভ্যস্ত। তাই বিশেষ দিনে বিশেষ পোশাকের পেছনে এই বিজ্ঞানীর নিশ্চয়ই বড় কোন যুক্তি আছে।
          প্রফেসর আবদুস সালাম জানেন তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে নোবেল পুরষ্কারের মূল্য কতখানি। তিনি দেখেছেন পৃথিবীতে উন্নত-বিশ্ব ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে সম্পদের বিশাল ব্যবধানের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীও উন্নত-বিশ্বের মেধাহীনদের চেয়েও পিছিয়ে পড়ে। তাই তিনি এই অনুষ্ঠানে উন্নত বিশ্বের কাছে নিজের দেশের পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন পোশাকের মাধ্যমে।
          পোশাকের নাটকীয়তার গুরুত্ব ঠিক কতটুকু তা জানার উপায় নেই। তবে এই নাটকীয়তার উপাদান জোগাড় করার জন্য তাঁকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে পাগড়ি পরেছিলেন, তাও অন্যের সাহায্যে। এত বছর পর পাগড়ি পরতে গিয়ে দেখা গেলো পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় তা তিনি জানেনই না। সুইডেনের পাকিস্তান দূতাবাসে খোঁজ নেয়া হলো। সেখানেও অফিসারদের কেউই স্বদেশী পোশাক পরেন না। সুতরাং পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় জানার প্রশ্নই ওঠে না। খুঁজতে খুঁজতে দূতাবাসের রাঁধুনিদের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যে পাগড়ি পরতে জানে। তাকে নিয়ে আসা হলো প্রফেসর আবদুস সালামের পাগড়ি বেঁধে দেয়ার জন্য। তার পরানোর ধরন দেখে প্রফেসর সালাম বুঝতে পারলেন রাঁধুনিটি এসেছে পাকিস্তানের অন্য একটা প্রদেশ থেকে- যে প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের সাথে তাঁর নিজের প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের মিল নেই। কিন্তু কী আর করা যাবে। ভুল-পাগড়ি মাথায় নিয়েই হাজির হলেন নোবেল-অনুষ্ঠানে।
    নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই পুরষ্কার ও পদকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো আবদুস সালামের। অসংখ্য পুরষ্কারের পাশাপাশি বিশ্বের পয়ঁত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে পরবর্তী কয়েক বছরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে তাঁর অংশগ্রহণ বেড়ে গেলো। সারা পৃথিবী থেকেই তাঁর নিমন্ত্রণ আসতে শুরু করেছে।
          প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে আবদুস সালাম খুব গর্বিত। মুসলিম দেশগুলো আবদুস সালামকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গর্ব বোধ করতে শুরু করেছে।
          ট্রিয়েস্তের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের সুনাম বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। সেন্টারের জন্য তহবিল সংগ্রহ অনেকটাই সহজ হয়ে গেলো। আই-সি-টি-পিকে কেন্দ্র করে আবদুস সালাম গড়ে তুললেন আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেস (TWAS)। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যেই গঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। আবদুস সালাম হন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।


নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আই-সি-টি-পিতে আবদুস সালামকে অভিনন্দন

১৯৮৮ সালে ট্রিয়েস্তে প্রতিষ্ঠিত হয় থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক অব সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশান্‌স (TWNSO)। তৃতীয় বিশ্বের মৌলিক বিজ্ঞান ও উচ্চ-প্রযুক্তির উন্নয়নে সাহায্যের জন্য গঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড হাই টেকনোলজি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে আই-সি-টি-পি'র নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শাখার ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৯৩ সালের ২২ মে ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফর ডেন্সলি পপুলেটেড রিজিয়ন্‌স (ICSTED)'র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
          ১৯৮৪ সালে আবদুস সালামের দেশ, সমাজ, অর্থনীতি, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা-বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'আইডিয়েলস অ্যান্ড রিয়েলিটিস' প্রকাশিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুদিত হয়।
          আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের পর অনেকেই মন্তব্য করেছেন পুরষ্কারটা W Z বোসন আবিষ্কারের আগেই দিয়ে দেয়াটা কতটুকু যুক্তিসংগত হয়েছে? অনেকে এমনও বলেছেন যে যদি W Z  বোসন পাওয়া না যায় তাহলে কি সালামরা নোবেল পুরষ্কার ফেরত দেবেন? কিন্তু সেরকম অঘটন ঘটেনি। তাঁদের তত্ত্বে যে W Z বোসনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল তা সার্নের পরীক্ষাগারে আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৩ সালে কার্লো রুবিয়ার নেতৃত্বে। এজন্যে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯৮৪ সালে।


১৯৮৩ সালে সার্নে পরীক্ষামূলক প্রমাণের পর

ওয়েনবার্গ, সালাম আর গ্ল্যাশোর তত্ত্ব থেকে W Z কণার ভর হিসেব করে বের করা যায়। তখন প্রশ্ন জাগে বস্তুর ভরের আসল উৎস কী? আমরা সম্প্রতি এ প্রশ্নের উত্তর জেনেছি। হিগ্‌স বোসনই যে বস্তুর ভরের জন্য দায়ী তা আমরা জেনেছি। ২০১২ সালে হিগ্‌স বোসন পাওয়া গেছে সার্নের ল্যাবোরেটরিতে। হিগ্‌স বোসনের ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন পিটার হিগ্‌স ও ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট।
          নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর আবদুস সালামের নিজের দেশ পাকিস্তানে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো। যখন বলা হলো আবদুস সালাম প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী, অস্বস্তিতে পড়লেন মিলিটারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। কোনরকমে একটা রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনার আয়োজন করতে হলো আবদুস সালামের জন্য। রাষ্ট্রীয় খেতাব নিশান-ই ইমতিয়াজ দেয়া হলো আবদুস সালামকে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জিয়াউল হককে আবদুস সালামের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গেছে। জিয়াউল হকের জন্য ব্যাপারটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। জুলফিকার আলি ভুট্টো সৌদি আরবসহ আরো কিছু মুসলিম দেশের সমর্থন পাবার জন্য, পাকিস্তানের ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে রাখার জন্য আইন করেছিলেন আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে। আহমদিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা করেছিলেন ভুট্টো। জিয়াউল হক একদিকে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছেন, অন্যদিকে আহমদিয়াদের ওপর আরো কঠিন হয়েছেন।
          জিয়াউল হক আইন করেছেন কোন আহমদিয়া যদি কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে তাকে ছয় মাস পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু টিভি ক্যামেরার সামনে আবদুস সালামের সাথে জিয়াউল হকের কথোপথনের সময় আবদুস সালাম কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন অনেকবার। টিভিতে প্রচার করার সময় সালামের কথার মাঝখান থেকে কোরানের আয়াতগুলো সব এডিট করে বাদ দেয়া হলো।
          কিন্তু সমালোচনা থামানো গেলো না। পাকিস্তানের অনেকগুলো উগ্র মৌলবাদী সংবাদপত্রে লেখা হলো আবদুস সালামের মত একজন আহমদিয়াকে নোবেল পুরষ্কার দেয়াটা পশ্চিমাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র। বলা হলো নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় সুদের টাকায়। তাই নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করা হারাম। মৌলবাদীদের কুযুক্তির অভাব হয় না। তাদের অর্থপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা বের করলেন ১৯৭৯ সাল হলো আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী। আইনস্টাইন ইহুদি। এই ১৯৭৯ সালেই আবদুস সালামকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার অর্থ হলো সালামের সাথে ইহুদিদের আঁতাত চলছে।
          আবদুস সালাম অবশ্য এসবে খুব একটা বিচলিত হলেন না। তিনি লাহোরে গিয়ে দেখা করলেন তাঁর শিক্ষক প্রফেসর সিরাজুদ্দিনের সাথে। সিরাজুদ্দিন লাহোর কলেজে থাকাকালীন আবদুস সালামকে নানাভাবে হেনস্তা করেছিলেন। আবদুস সালাম সে সব মনে রাখেননি।
          স্বাধীনতার পর লাহোর ছেড়ে সব হিন্দুদের ভারতে চলে যেতে হয়েছে, ঝাং স্কুলের গণিত শিক্ষককেও। তাঁর সাথে দেখা করতে ভারতের পাঞ্জাবে গেলেন আবদুস সালাম। বৃদ্ধ হতদরিদ্র শিক্ষকের গলায় তিনি তাঁর নোবেল মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন।
          আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের অর্থমূল্য ছিল দুই লাখ ছেষট্টি হাজার সুইডিশ ক্রোনার যা ৬৬ হাজার আমেরিকান ডলারের সমমানের। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাথে সাক্ষাতের সময় আবদুস সালাম প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, "আমি আমার পুরষ্কারের পুরোটাই পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য দিয়ে দিতে পারি একটি শর্তে।"
          "কী শর্ত?"
          "যদি পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের শিক্ষাবৃত্তির জন্য এক মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে।"
          "আমি ব্যাপারটা নিয়ে আমার উপদেষ্টাদের সাথে কথা বলে আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যে জানাবো।"


আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের চেক

কয়েকদিন পরে জানানো হলো আবদুস সালাম যত দেবেন পাকিস্তান সরকার ঠিক ততটাই দিতে রাজি আছেন। খুব রেগে গেলেন আবদুস সালাম। বললেন, "তাহলে আমার টাকা দিয়ে আমি নিজেই বৃত্তি দেবো। পাকিস্তান সরকারের সাহায্য দরকার নেই।"
           আবদুস সালাম তাই করলেন। একটা ফান্ড করে নোবেল পুরষ্কারের পুরোটাই সেই ফান্ডে দিয়ে দেন। প্রতি বছর সেই ফান্ড থেকে তরুণ (৩৫ বছরের কম বয়সী) পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানীদের 'আবদুস সালাম পুরষ্কার' দেয়া হয়।
          প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে আরো একটা ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন আবদুস সালাম, "আমি শুনেছি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কর্মচারি কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। আপনি যদি তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন।"
          "অবশ্যই। আপনি আমাকে কমিশনে কর্মরত আহমদিয়াদের একটা তালিকা পাঠিয়ে দেবেন। আমি ব্যবস্থা করবো যেন আর কখনো তাদের ওপর কোন অনিয়ম না হয়।"
          প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের এমন আশ্বাস পেয়ে খুশি হয়ে আহমদিয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের তালিকা জোগাড় করে প্রেসিডেন্টের অফিসে পাঠিয়েছিলেন আবদুস সালাম। ক'দিন পর আবদুস সালাম খবর পেলেন তালিকাভুক্ত সকল আহমদিয়াকে পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
          নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আবদুস সালাম বহুবার বলেছেন নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলমান হিসেবে তাঁর গৌরবের কথা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককেও বলেছেন এই কথা। পাকিস্তান টিভিতে তা প্রচারিত হবার পর মৌলবাদীরা সেটা নিয়েও হৈ চৈ শুরু করলো। আবদুস সালাম নাকি আহমদিয়াদের মুসলমানত্ব ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন!
          নিজের দেশ পাকিস্তানে আবদুস সালামের সমালোচনা আর অপমান চলছে তো চলছেই। এর মধ্যেই ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবরোধ ভাংচুর করে এবং প্রফেসর সালামকে হত্যা করার হুমকি দেয়। ১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মিশরের আনোয়ার সাদাত। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী। ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে মিশরের মৌলবাদিরা। মিশরের প্রধানমন্ত্রী হয়েও মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পাননি তিনি। তাই আবদুস সালামকে হত্যার হুমকিকে উপেক্ষা করা গেলো না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সালামের সম্মানে অনুষ্ঠানটি  সরিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের একটি রুমে।
          আবদুস সালাম পাকিস্তানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে বাধা দিয়েছেন এই 'অপরাধে' সালামকে পাকিস্তানের 'গাদ্দার' বলে মিছিল করেছে উগ্রপন্থীরা। আবদুস সালাম যখন পাকিস্তানের বিজ্ঞান গবেষণার উন্নয়ন ঘটাচ্ছিলেন তখন ভুট্টো চেয়েছিলেন পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা বানাতে। কিন্তু আবদুস সালাম আর পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর উসমানি বোমা বানানোর প্রকল্প হাতে নিতে রাজি হননি।
          ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে সুদানের খার্তুম ইউনিভার্সিটি আবদুস সালামকে সম্মানসূচক পিএইচডি দেবার জন্য একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জানুয়ারির নয় তারিখে অনুষ্ঠানটি হবার কথা। অনুষ্ঠানের দুদিন আগে সৌদি রাষ্ট্রদূত সুদানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জাফের নামেরির সাথে দেখা করে অনুষ্ঠানটি বাতিল করার অনুরোধ জানান। সৌদি সরকার চান না যে 'আবদুস সালাম  আহমদিয়া'কে সম্মান জানানো হোক।
          সেদিনই প্রেসিডেন্ট নামেরি খার্তুম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে ডেকে এনে সৌদি সরকারে আপত্তির কথা জানালেন। সুদানের সামরিক সরকার সৌদি আরবকে চটাতে চান না। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর প্রেসিডেন্টের কথায় সাথে সাথে সম্মতি দিলেন না। তিনি বললেন, "আমাকে একাডেমিক কাউন্সিলের সাথে কথা বলতে হবে।"
          সেদিন সন্ধ্যায় একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা বসলো। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আত্মসম্মান তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। "সারা পৃথিবী যেখানে আবদুস সালামকে সম্মান জানাচ্ছে, একবারও কেউ আবদুস সালামের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না সেখানে আমরা মুসলমানরা এসব কী শুরু করেছি? সত্যিকারের গুণীর কদর করতে আমরা পিছপা হচ্ছি?"
          একাডেমিক কাউন্সিলের সবাই ঘোষণা দিলেন সমাবর্তন বাতিল করা হলে সবাই একযোগে পদত্যাগ করবেন। পরদিন সকালে খার্তুম ইউনিভার্সিটির সকল ডিন ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা সামরিক জান্তা নামেরির মুখোমুখি হয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। সুদানের ইতিহাসে এটা একটা অভিনব ঘটনা। সামরিক একনায়কের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো না থাকাটাই স্বাভাবিক। জেনারেল নামেরি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাহস দেখে অবাক হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ব শাসনকে অসম্মান করলেন না। তিনি সমাবর্তন অনুষ্ঠান চালিয়ে নেবার অনুমতি দিলেন এবং নিজেও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। 
          ১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সাথে দেখা করার জন্য দু'দিন ইসলামাবাদে অপেক্ষা করেছিলেন আবদুস সালাম। কিন্তু বেনজির ভুট্টো তাঁর সাথে দেখা করেননি। সালামের তখন মনে পড়েছিলো কয়েক বছর আগে তাঁর ভারত সফরের কথা। ১৯৮১ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজের হাতে চা ঢেলে দিয়েছিলেন আবদুস সালামের পেয়ালায়। উন্নয়নশীল বিশ্বে বিজ্ঞানের উন্নয়নে দেশের রাজনীতিবিদরা যে কী ভূমিকা রাখেন তা আবদুস সালাম হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts