বৈজ্ঞানিক সফর
- ৪
১৯১৪ সালে
চতুর্থবার বৈজ্ঞানিক সফরে ইওরোপে যান জগদীশচন্দ্র। অনেক যন্ত্রপাতির সাথে
লজ্জাবতীর মতো স্পর্শকাতর অনেক গাছপালাও নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ সেই সময় ইওরোপে
শীতকাল এবং প্রচন্ড বরফে অনেক উদ্ভিদই প্রায়-নির্জীব হয়ে যায়। কিন্তু নিয়ে যাবার
সময় জাহাজে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে যায়। জগদীশ ইংল্যান্ডের মেইডা ভেইলে একটি অস্থায়ী
গবেষণাগার গড়ে সেখানে গাছগুলির পরিচর্যা এবং আরো অনেক পরীক্ষা করেন।
এবারের সফরে তিনি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন
তাঁর দু'জন সহকারী বশীশ্বর সেন ও জ্যোতিপ্রকাশ সরকারকে। জগদীশচন্দ্রের
গবেষণা-জীবনে এই দু'জন ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
২০/৫/১৯১৪ তারিখে তিনি অক্সফোর্ড
ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দেন "On the electrical investigation of the
irratibility of plants" বিষয়ে। ২৯/৫/১৯১৪ তারিখে রয়েল ইন্সটিটিউশানে বক্তৃতা দেন "On plant autographs and revelations" বিষয়ে। রয়েল
ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেবার পর রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিনের সভায়ও বক্তৃতা দেন তিনি। সেই
বক্তৃতার বিষয় ছিল "Action of drugs on
plants"।
সেই সভায়
ডারউইনের সহযোগী স্যার লডার ব্রানটন মন্তব্য করেছিলেন যে “বিগত ৫০ বছরের
মধ্যে শারীরবৃত্ত একটি নতুন বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে, কিন্তু এ প্রসঙ্গে যতসব পরীক্ষা
নিরীক্ষা আমি এ পর্যন্ত দেখেছি তা আপনার আবিষ্কারের প্রদর্শনের সাথে তুলনা করলে
অনেক পরিণত এবং স্থূল মনে হয়। আপনার এই প্রদর্শনে আপনি উদ্ভিদদেহের প্রতিক্রিয়ার
সঙ্গে প্রাণিদেহের প্রতিক্রিয়ার বিস্ময়কর সাদৃশ্য উদ্ঘাটন করে দেখালেন।”
বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের
প্রশংসার পাশাপাশি ইওরোপের সংবাদপত্রেও ব্যাপক প্রচার পেলেন জগদীশচন্দ্র। লন্ডনের
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা তাঁকে 'উদ্ভিদ-বিজ্ঞানের ডারউইন' বলে অভিহিত করে। লন্ডন
থেকে ভিয়েনা, ফ্রান্স ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বক্তৃতা দেন
জগদীশচন্দ্র। আগস্টে জার্মানিতে আরো কিছু বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে তাঁকে জার্মানি ত্যাগ করতে হয়।
লন্ডন থেকে আমেরিকায় পৌঁছেন জগদীশচন্দ্র
২২/১১/১৯১৪ তারিখে। সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও গবেষণা-পরীক্ষণ
দেখাতে দেখাতে ব্যস্ত সময় কাটে তাঁর। ১৯০৮ সালে যখন প্রথমবার আমেরিকায় এসেছিলেন
তখন সারা বুলের ভাই জে জি থ্রপের সাথে পরিচয় হয়েছিল। থ্রপ ছিলেন বস্টনের প্রভাবশালী মানুষ। ইতোমধ্যে সারার
মৃত্যু হলেও মিস্টার থ্রপ ভুলেননি জগদীশ ও অবলাকে। তিনি তাঁদেরকে নিয়ে গেলেন তাঁর
বাড়িতে। সেখানে বস্টন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় হয়
জগদীশচন্দ্রের।
আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে
জগদীশচন্দ্র তাঁর আবিষ্কৃত উদ্ভিদের বৃদ্ধিমান যন্ত্র (ক্রেস্কোগ্রাফ) প্রদর্শন
করে বক্তৃতা দেন। জগদীশচন্দ্রের উদ্ভাবিত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে
উদ্ভিদের বৃদ্ধির পরিমাপ করা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং বাইরের যে কোন প্রভাবে
বৃদ্ধির মানের যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে তাও মাপা যায়।
ক্রেস্কোগ্রাফ। P- গাছ, প্রথম লিভারের গোড়ায় যুক্ত; প্রথম লিভারের ডগা দ্বিতীয় লিভারের গোড়ার সঙ্গে যুক্ত। G- কালিমাখানো কাচ ঘড়ি C-দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
|
সূক্ষ্ম
অক্ষদন্ডের সাথে লাগানো দুটি লিভারের সাহায্যে ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রটি নির্মিত
হয়েছে। প্রথম লিভারের গোড়ার দিকে পরীক্ষাধীন উদ্ভিদটি সংযুক্ত থাকে এবং এই লিভারের
অগ্রভাগ দ্বিতীয় লিভারটির গোড়ার দিকে লাগানো থাকে। দ্বিতীয় লিভারের বাঁকানো
অগ্রভাগ কালি মাখানো কাচের প্লেটের সামনে থাকে। প্লেটটি ঘড়ির সাথে লাগানো। ঘড়ির
সময়ের সাথে প্লেটটি ক্রমশ ডান থেকে বাম দিকে সরতে থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর
পর প্লেটটিকে স্পর্শ করে। এভাবেই প্লেটের উপর উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক বিন্দুর সারি
লিপিবদ্ধ হয়। এই যন্ত্রে উদ্ভিদের বৃদ্ধি দশ হাজার গুণ বর্ধিত আকারে প্রকাশ পায়।
এ যন্ত্র সম্পর্কে ‘সায়েন্টিফিক
আমেরিকান’ লিখেছিলো - “ডক্টর বসুর
ক্রেস্কোগ্রাফ বা বৃদ্ধিমান যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলে আলাদীনের গল্প এবং তার
আশ্চর্য প্রদীপও ম্লান হয়ে যায়। এক ঘন্টার এক চতুর্থাংশেরও কম সময়ের মধ্যে
উদ্ভিদদেহে সার, খাদ্যাদি, বৈদ্যুতিক প্রবাহ এবং বিভিন্ন উদ্দীপক বস্তুর ফলাফল
সম্পূর্ণরূপে নিরুপণ করা যেতে পারে”।
শিকাগোতে জগদীশ্চন্দ্র ও অবলা বসু (১৯১৫)
|
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের কারণে আমেরিকা থেকে আর ইওরোপে আসা গেলো না। ফেরার পথে তাই জাপানে চলে
গেলেন জগদীশচন্দ্র। ২০/৩/১৯১৫ সালে সানফ্রান্সিস্কো থেকে জাহাজ ছাড়ে। সেই জাহাজ
জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরে পৌঁছায় ৭ই এপ্রিল। জাপানের বিপুল সমাদর পান জগদীশ।
১/৫/১৯১৫ সালে জাপানের ওয়াসেদি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন তিনি। টোকিয়ো সহ
জাপানের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখে শ্রীলংকায় যান। সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতের
বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখেন জগদীশচন্দ্র।
ভ্রমণ করতে খুব ভালোবাসতেন জগদীশচন্দ্র।
তাঁর সাথে থাকতো সেই সময়ের দামী দামী ক্যামেরা। ছবি তোলার শখও ছিল তাঁর। যেখানেই
যেতেন অনেক ছবি তুলতেন। নিজের পরীক্ষাগারেই সেই সব ছবি পরিস্ফূটন করতেন। ফটোগ্রাফি
নিয়ে তাঁর গবেষণার কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment