প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান
অধ্যাপক ফসেটের
চিঠি নিয়ে লর্ড রিপনের সাথে দেখা করলেন জগদীশচন্দ্র। ফসেটকে খুব সম্মান করেন লর্ড
রিপন। ফসেট তাঁর চিঠিতে লর্ড রিপনকে অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে
জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা অধ্যাপনার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। লর্ড রিপন
জগদীশচন্দ্রের সাথে বেশ আন্তরিকভাবে কথা বললেন। তিনি জগদীশচন্দ্রকে প্রতিশ্রুতি
দিলেন যে তিনি শিক্ষাবিভাগকে প্রয়োজনীয় আদেশ দিয়ে দেবেন।
লর্ড রিপন
|
লর্ড রিপন
জগদীশচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য
সুপারিশ করে চিঠি পাঠালেন শিক্ষাবিভাগের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফ্টের কাছে।
লর্ড রিপনের সুপারিশ পেয়ে খুবই বিরক্ত হলেন স্যার ক্রফ্ট। ভারতীয়দের প্রতি তাঁর
মনোভাব খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয়রা আধুনিক
বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না। বিজ্ঞান শিক্ষার কোন উচ্চপদে কোন ভারতীয়কে নিয়োগের ঘোর
বিরোধী ছিলেন স্যার ক্রফ্ট। জগদীশচন্দ্র যে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে পারবেন সে
ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই তিনি খুব বিরক্ত হলেন জগদীশচন্দ্রের ওপর। কিন্তু
লর্ড রিপনের সুপারিশ তাঁর কাছে আদেশের সমতুল্য।
স্যার ক্রফ্ট জগদীশচন্দ্রকে বললেন, “মিস্টার বোস, ইম্পেরিয়াল
এডুকেশান সার্ভিসে কোন চাকরি খালি নেই। আপনি ইচ্ছে করলে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ
দিতে পারেন।”
জগদীশচন্দ্র জানতেন যে ইম্পেরিয়াল
সার্ভিসে কোন ভারতীয়কে নিয়োগ দেয়া হয় না। ১৮৪৮ সাল থেকেই এই অর্থনৈতিক বৈষম্য শুরু
হয়েছে। প্রথম ভারতীয় বিলেত ফেরৎ ডাক্তার হিসেবে ডাক্তার ভোলানাথ বসু ও ডাক্তার বি
এন শীল ইংল্যান্ড থেকে এম-ডি পাস করে দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু তাঁদেরকে কোন
উঁচু-পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ভারতীয়দের জন্য শুধুমাত্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসই বরাদ্ধ
ছিল। প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসের বেতন ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ।
স্যার ক্রফ্ট যে ইচ্ছে করেই তাঁকে অপমান করছেন তা বুঝতে পেরে জগদীশচন্দ্র
প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে এলেন।
আলফ্রেড ক্রফ্ট মিটিং করলেন
প্রেসিডেন্সি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ চার্লস টনির সাথে। চার্লস টনিও চান না যে
জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক হোন। কিন্তু তাদের যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও
জগদীশচন্দ্রকে ঠেকিয়ে রাখা গেলো না। কিছুদিন পরে লর্ড রিপন গেজেটে জগদীশচন্দ্রের
নাম দেখতে না পেয়ে খবর নিয়ে সব জানলেন। ক্রফ্টের উপর তিনি খুব বিরক্ত হলেন তাঁর
আদেশ মানা হয়নি দেখে। তখন স্যার ক্রফ্ট বাধ্য হয়ে ইম্পেরিয়াল সার্ভিসের অধীনে
প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে জগদীশচন্দ্র বসুকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেন।
তরুণ অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র
|
১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মজীবন শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের। শুরুতেই তাঁর মনে হলো একটা
কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেছেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের
মধ্যে বিরোধ চলছিল। সেই অবস্থায় ক্লাসে পড়ানো খুব একটা সহজ ছিল না। আর ঠিকমতো
পড়াতে না পারলে চাকরি স্থায়ী হবে না। এই সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র পরে লিখেছেন:
"উচ্ছৃঙ্খল
ও দুর্বিনীত বলে এই কলেজের ছাত্রদের সম্বন্ধে তখন বেশ অখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
কলেজের দু'জন অধ্যাপক ও ছাত্রমহলের মধ্যে বিরোধ এতটা সাংঘাতিক হয়ে উঠেছিল যে সরকার
এক তদন্ত কমিশন বসাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমার ভাবী ছাত্রদের এই ছিল প্রকৃতি। বয়সের
তুলনায় আমাকে তখন বেশ তরুণ দেখাতো। এক নিরীহ, ভীরু মেষকে হিংস্র নেকড়ে বাঘের
খপ্পরে ফেলে স্যার আলফ্রেড ক্রফ্ট সেদিন নিশ্চয়ই বেশ কৌতুক ও আনন্দ উপভোগ
করেছিলেন।"[1]
প্রথম মাসের বেতন নিতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র
আরেকটি অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হলেন। দেখলেন একই পদে চাকরি করেও একজন শ্বেতাঙ্গ যে
বেতন পান, একজন ভারতীয় পান তার দুই তৃতীয়াংশ। আর চাকরি স্থায়ী না হলে পান তারও
অর্ধেক। সেই সময় একজন
শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক বেতন পেতেন মাসে তিন শ' টাকা। একজন ভারতীয়কে দেয়া হতো মাসিক দুই
শ' টাকা। অস্থায়ী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবার কারণে জগদীশচন্দ্রকে বেতন দেয়া হচ্ছে তাঁর
সমমানের পদের জন্য ব্রিটিশরা যত পাচ্ছেন তার এক তৃতীয়াংশ - অর্থাৎ মাসে একশ' টাকা
মাত্র। এই ব্যবস্থা চরম অপমানজনক বলে মনে হলো জগদীশচন্দ্রের। এই বৈষম্য মেনে নেয়া
সম্ভব হলো না তাঁর পক্ষে। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। কিন্তু
তাতে কতৃপক্ষ কোন কানই দিল না। চাকরিক্ষেত্রে আত্মমর্যাদা
রক্ষার দাবিতে জগদীশচন্দ্র নতুন এক অহিংস প্রতিবাদের সূচনা করলেন। তিনি বেতন ছাড়াই
কাজ করে যেতে লাগলেন মাসের পর মাস।
পর পর তিন বছর তিনি বিনাবেতনে কাজ করে
গেলেন। সংসারে ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ করার কথা
তিনি ভাবতেও পারেননি। জগদীশচন্দ্রের বাবা
ভগবানচন্দ্রের শরীর ভেঙে পড়েছে। তাঁর চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু
ঋণ শোধ করা হয়নি তখনো। জগদীশচন্দ্র ইংল্যান্ডে পড়ার সময় ভেবেছিলেন দেশে ফিরে একটা
চাকরি পেলেই আস্তে আস্তে বাবার সব ঋণ শোধ করে দেবেন। কিন্তু চাকরি পাবার পর যে
বেতন নিতে পারবেন না, তা তো তিনি জানতেন না। ঋণের বোঝা সুদে-আসলে দিনে দিনে ভারী
হচ্ছে। বাবার সঞ্চিত অর্থে তাঁকে চলতে হচ্ছে এখনো। তাই তিনি ঠিক করলেন বিক্রমপুরের
গ্রামের বাড়িতে বাবার যে সম্পত্তি আছে তা বিক্রি করে ঋণ শোধ করে ফেলবেন।
আত্মীয়-স্বজনদের বাধা
উপেক্ষা করে জগদীশচন্দ্র তাঁর বাবার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেন। কিন্তু তাতেও
সব ঋণ শোধ হলো না। মায়ের গয়নার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও বিক্রি করে দিলেন। কিন্তু
তাতেও সব ঋণ শোধ হলো না। বাবার ঋণ শোধ করার ব্যাপারে জগদীশচন্দ্রের আন্তরিকতা দেখে
পাওনাদাররা অবশিষ্ট ঋণ এমনিতেই ছেড়ে দেবেন বললে জগদীশচন্দ্র তাতে রাজি হলেন না।
কারো দয়া নিতে তিনি অভ্যস্ত নন। নইলে এক্ষেত্রে তিনি তাঁর জামাইবাবুদের সাহায্য
নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কীভাবে ঋণ শোধ করছেন তা বিশেষ কাউকে জানতেও
দেননি।
জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্রাবস্থাতেই ১৮৭৬
সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান
ফর দ্যা কালটিভেশান অব সায়েন্স”। ভারতীয়
জনসমাজকে বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ডাক্তার মহেন্দ্র লাল
সরকার এই অ্যাসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা জাগানোর
পক্ষে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময়ের বাঙালি বিজ্ঞানী
হিসেবে যারা স্বীকৃতি লাভ করেছেন তাঁদের অনেকেই অ্যাসোসিয়েশানের সঙ্গে কোন না কোন
সময়ে যুক্ত ছিলেন।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার
|
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে জানলেন এবং নিজে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচিত হলেন। দৃপ্ত ভারতীয়দের প্রতি মহেন্দ্রলাল সরকারের শ্রদ্ধা ছিল অসীম। তিনি জগদীশচন্দ্রকে ডেকে নিলেন তাঁর অ্যাসোসিয়েশানে। জগদীশচন্দ্রও খুব খুশি হলেন মহেন্দ্রলাল সরকারের সাথে পরিচিত হয়ে এবং মোহিত হয়ে গেলেন সমাজে বৈজ্ঞানিক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য মহেন্দ্রলাল সরকারের চেষ্টা দেখে। ১৮৮৫ সালে জগদীশ বসু অ্যাসোসিয়েশানে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। মহেন্দ্রলাল সরকার তারজন্য উপযুক্ত সম্মানী দিতেন।
কলেজে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তত্ত্ব পড়ান আর
নিজের তৈরি যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন পরীক্ষা ছাত্রদের দেখান জগদীশচন্দ্র।
অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষক হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। তাঁর বাবা অবসর গ্রহণ
করার পর তিনি বউবাজার স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে মা-বাবার সাথে থাকেন। চাকরি আছে
কিন্তু বেতন নেন না। সংসার চলছিলো মা-বাবার সঞ্চয়ের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেগুলো
দিয়ে।
[1] শ্রী মনোজ
রায় ও শ্রী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রথম খন্ড,
বসু বিজ্ঞান মন্দির, কলকাতা, ১৯৬৩, পৃ: ২৫।
No comments:
Post a Comment