বৈজ্ঞানিক
সফর - ৩
১৯০৭ সালের ৫ই
সেপ্টেম্বর অবলাকে নিয়ে ইওরোপে যাত্রা করলেন জগদীশচন্দ্র। জার্মানি হয়ে নভেম্বরের
শেষে লন্ডনে পৌঁছলেন তাঁরা। নিবেদিতা
তাঁদের সাথে দেখা
করলেন জার্মানিতে। সেখান থেকে সারা
বুল সহ সবাই
ঘুরে এলেন আয়ারল্যান্ড- নিবেদিতার
নিজের গ্রাম।
এবার দেশের বাইরে আসার আগে
রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করে আসতে পারেননি জগদীশচন্দ্র। লন্ডনে এসে খবর পেলেন
রবীন্দ্রনাথের ছোটছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে। জগদীশচন্দ্রের মনটা কেঁদে উঠলো
বন্ধুর এই শোকে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন:
"তোমার এই শোকের
সময়ে কেবলমাত্র আমার হৃদয়ের বেদনা জানাইতেছি। তোমার সুখ-দুঃখের সাথী আমি। কী করিয়া
তোমাকে সান্তনা দিব জানি না। আমাদের দুজনেরই অনেক প্রিয়জন পরপারে। সুতরাং সে দেশ
আর দূরদেশ মনে হয় না।"
ইংল্যান্ডে শত কাজের মাঝেও নিবেদিতা জগদীশের পেপার লিখে দেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার খসড়া তৈরি
করে দেন।
১৯০৮ সালের ৮ এপ্রিল জগদীশচন্দ্র খবর
পেলেন যে ভারতসচিব তাঁকে এক বছরের ডেপুটেশান মঞ্জুর করেছেন।
৪ সেপ্টেম্বর ডাবলিনের
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানে 'Mechanical and Electrical
Response in Plants' শীর্ষক বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র।
তার কিছুদিন পর লন্ডন থেকে আমেরিকা
যান জগদীশ ও অবলা। নিবেদিতা ও
সারা বুলও তখন আমেরিকায়। ১৯০৮
সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমেরিকার বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন জগদীশ। ইলিনয়,
অ্যান আর্বার, উইস্কন্সিন ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, বোস্টন মেডিকেল সোসাইটি,
বোটানিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকা, শিকাগো অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, আমেরিকান
অ্যাসোসিয়েশান ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর আমন্ত্রণে জগদীশচন্দ্রের
বক্তৃতাগুলো আমেরিকান বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা পায়। এই
বক্তৃতাগুলোর জন্য যোগাযোগ,
আয়োজন ইত্যাদিতে খুব সাহায্য
করেন নিবেদিতা এবং সারা
বুল।
সেই সময় রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ
ঠাকুর আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশচন্দ্রের
বক্তৃতা প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথের নিজের বর্ণনা আছে "আচার্য জগদীশচন্দ্র আমার
বাল্যস্মৃতি" প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন:
"আমি যখন আমেরিকায়
কলেজে পড়ছি, জানতে পারলুম জগদীশচন্দ্র আমেরিকা-পরিভ্রমণে আসছেন। কয়েকটি
ইউনিভার্সিটি বক্তৃতা দেবার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ করেছে। এই খবর পেয়ে আনন্দে
উৎফুল্ল হয়ে উঠলুম। তখনই ছুটলুম আমার কলেজের ডিনের কাছে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে
তাঁকে আনতেই হবে আমার এই সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁকে জানালুম। ডিন ড্যাভেনপোর্ট পন্ডিত
মানুষ, বিজ্ঞানজগতের যথেষ্ট খবর রাখেন। আমি তাঁর ক্লাসে পড়ি, ছাত্র হিসেবে আমাকে
যথেষ্ট স্নেহ করতেন। সহাস্যে বললেন, তুমি যা চাও তাই হবে। সেই শুনে আমিও
জগদীশচন্দ্রকে চিঠি লিখলুম যে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ পেলে তিনি যেন
উপেক্ষা না করেন; হার্ভার্ড ইয়েল প্রভৃতির মতো বিখ্যাত না হলে তিনি এই অপেক্ষাকৃত
ছোটো বিদ্যায়তনে সমজদার শ্রোতা হয়তো বেশি পাবেন। মোট কথা তাঁর আসা চাইই। জবাব
পেলুম তিনি শীঘ্রই আসবেন। আমি তখন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান মহলে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার
সম্বন্ধে মহা উৎসাহে প্রচার করতে লেগে গেলুম। এত উৎসাহ, এত আনন্দ, এত আয়োজনের পর
যখন আচার্যের আসবার সময় নিকটবর্তী হল, আমি পড়লুম অসুস্থ হয়ে। ডাক্তার পাঠিয়ে দিলেন
একটা আরোগ্যভবনে পনেরো দিন ধরে তাদের ব্যবস্থাধীনে নিরাময় হবার জন্য। সাত দিন
সেখানে থেকে আমি পালিয়ে এসে সটান হাজির হলুম স্টেশনে।, জগদীশচন্দ্র ও তাঁর
সহধর্মিণীকে অভ্যর্থনা করে তাঁদের নির্দিষ্ট বাসস্থানে নিয়ে যাবার জন্য। তার
পরদিনই বক্তৃতা। সকালবেলায় জগদীশচন্দ্র আমাকে বললেন:
'আমার বক্তৃতার সঙ্গে যে experimental
demonstrations থাকবে তাতে তোমাকে সাহায্য করতে হবে। চল, সায়েন্স লেকচার হলে যন্ত্রগুলি
খাটিয়ে রাখি ও তোমাকে দেখিয়ে দিই কী করতে হবে।' আনন্দে অধীর হয়ে উঠলুম, আর সঙ্গে
সঙ্গে মনে হতে লাগল আমার সহপাঠীরা কী ঈর্ষার চোখেই না আমাকে এরপর দেখবে। নানারকম
অত্যাচার উপদ্রবে গাছগাছড়া কিরকম সাড়া দেয় সে-সব দেখাবার জন্য জগদীশচন্দ্র কয়েকটি
অত্যাশ্চর্য যন্ত্র প্রস্তুত করেছিলেন। লজ্জাবতীর পাতায় কোনোরকম আঘাত লাগলে তার
পাতা গুটিয়ে যায়, তা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু যে-কোনো গাছেই আঘাত লাগলে তার
আর্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া আছে, যদিও আমরা তা দেখতে পাই না। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত
যন্ত্রের সাহায্যে, গাছ কিসে কিরকম সাড়া দেয় কালো পর্দার উপর একবিন্দু আলোর কম্পন
দেখে আমরা তা অনায়াসে বুঝতে পারি। বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি যখন কোনো experiment দেখাবার জন্য থামতেন- আগ্রহের সঙ্গে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। যে
মুহূর্তে আলোর রেখা আশানুরূপ নেচে উঠত তিনি উল্লসিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠতেন:
'There,
there, there!' আমিও তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতুম - ভুলচুক কিছু
করিনি।"[1]
জগদীশের এটা
প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ। ম্যাচাসুচেট্স-এর কেমব্রিজে সারা বুলের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন জগদীশ ও অবলা। তখন নিবেদিতা ছিলেন নিউইয়র্কে। ১৯০৮ সালের
১৬ অক্টোবর ছিল ভারতে রাখী-বন্ধনের দিন। জগদীশ
সেদিন নিবেদিতাকে একটি চিঠি
লিখলেন। চিঠিতে কোন সম্বোধন
বা স্বাক্ষর কিছুই ছিল না। জগদীশ
সেখানে নিজের হাতে লেখেন:
"…The heart is filled to overflowing. May all the
loved ones be in His safe
keeping. God bless you…."[2]
প্রশ্ন
হলো সম্পর্কের কোন গভীরতায়
জগদীশের মতো বিজ্ঞানী
এরকম সম্বোধন ও স্বাক্ষরহীন
চিঠি লেখেন। অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসুর মতে,
“অতি গভীর আত্মিক
সম্পর্কের জন্যই জগদীশচন্দ্রের পক্ষে সম্বোধন করা বা স্বাক্ষর দেওয়া সম্ভব হয়নি। যার অর্থ,
জগদীশচন্দ্রের হৃদয়ে প্রতিভাত মার্গারেট নোবলকে কোনো নামেই
প্রকাশ করা সম্ভব
নয়।”[3]
জগদীশচন্দ্র
ও অবলা যখন আমেরিকাতে তখন নিবেদিতার সাথে তাঁদের দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। সারা
বুলের বাড়িতে তিনজন থেকেছেনও অনেকদিন। নিবেদিতা সেই সময় রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে
জগদীশ ও অবলার মন বিষিয়ে দেন। বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিবেদিতা যে
মতাদর্শে বিশ্বাস করেন রবীন্দ্রনাথ তা করেন না, শুধু সেই কারণেই নয়, রবীন্দ্রনাথের
সাথে জগদীশচন্দ্র ও অবলার মধুর সম্পর্কের কারণেও হয়তো নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথকে
পছন্দ করতেন না। জগদীশচন্দ্র নিবেদিতার চেয়েও রবীন্দ্রনাথকে বেশি বন্ধু মানেন এটাও
একটা কারণ হতে পারে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে অবলা বসুর
তিক্ততার শুরু হয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের ছাত্র অরবিন্দমোহন বসুকে
নিয়ে। অরবিন্দ ছিলেন আনন্দমোহন বসুর ছেলে এবং জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগনে। অরবিন্দকে
ছোট রেখে আনন্দমোহন বসুর মৃত্যু হলে অরবিন্দকে মানুষ করার দায়িত্ব নেন মামা
জগদীশচন্দ্র। সন্তানহীন অবলাও মাতৃস্নেহে বড় করেন অরবিন্দকে। কিন্তু অরবিন্দ ছিল
ভীষণ ডানপিটে এবং পড়াশোনায় অমনযোগী। তাকে মানুষ করার জন্য ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। সেখানে শিক্ষকরা অনেক কষ্টে পড়াশোনার প্রতি
মনযোগী করে তোলেন অরবিন্দকে। অরবিন্দকে নিবেদিতাও খুব স্নেহ করতেন। তিনি চাইতেন না
যে অরবিন্দ শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করুক। নিবেদিতা নিজে কোনদিন শান্তিনিকেতনে
যাননি। কিন্তু তাঁর ধারণা অরবিন্দ সেখানে থাকলে মানুষ হবে না। শান্তিনিকেতনের
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। অবলা প্রভাবান্বিত হন নিবেদিতার
কথায় এবং রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেন যে অরবিন্দকে নিজের কাছে এনে রাখবেন। অরবিন্দকেও
তিনি একটা চিঠি লেখেন যেখানে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনেরও সমালোচনা করা হয়।
অরবিন্দ সেই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন।
রবীন্দ্রনাথ খুবই ক্ষুব্ধ হন তাঁর
বন্ধুপত্নীর এমন আচরণে। তিনি বুঝতে পারেন যে কোথাও কলকাঠি নাড়াচ্ছেন নিবেদিতা।
রবীন্দ্রনাথ অবলা বসুকে কিছু না লিখলেও অরবিন্দকে লিখলেন:
"তোমার মামীর চিঠি পড়ে দেখলুম।
তিনি আমার সম্বন্ধে এতটা বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে আমার 'মত' কী তা ভাল করে পড়েও
দেখেননি। আমি কোনো প্রবন্ধে কোনো জায়গাতেই বলিনি যে 'বয়কট' বন্ধ করা উচিত। আমি
কোথাও আভাসে মাত্রও বলিনি যে ভারতবর্ষে সব জাতিকেই ঠিক একই ধর্ম গ্রহণ করতে হবে -
পৌত্তলিকতার দোষগুণ সম্বন্ধে আমি কোনো কথা এ পর্যন্ত উত্থাপন করিনি। আমি কেবল এই
কথাটুকু বলেছি যে বয়কটই করি আর যাই করি অন্যায় অসত্য অধর্মকে অবলম্বন করে চললে
কিছুতেই আমাদের শ্রেয় হবে না। ... ...
তোমার মামী যে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে
উঠেছে তা কেবল বর্তমান সময়ের উত্তেজনাবশত। এই জন্যই আমার উপরে অনেক বিরক্ত হয়েছেন।
এ সমস্তই আমাকে গ্রহণ করতে হবে।"
জগদীশচন্দ্র অবলা বসুর এই চিঠি লেখার
ব্যাপারে কোনদিন কিছু না বললেও এই ঘটনার পর রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সম্পর্ক
কিছুটা হলে শীতল হয়ে যায়।
১৯০৯ সালের ১৬ জুলাই ভারতে ফিরে আসেন জগদীশ, অবলা ও নিবেদিতা। বোম্বে জেটিতে জাহাজ থামার পর নিবেদিতাকে গ্রেফতার করার সম্ভাবনা ছিল। নিবেদিতা তাই তাঁর সন্ন্যাসিনীর বেশ বদলে আধুনিকা ইংরেজ তরুণীর বেশেই নেমেছিলেন জাহাজ থেকে। সেই আধুনিকা ইংরেজ তরুণী পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোম্বে থেকে ট্রেনের রিজার্ভ কামরায় কলকাতায় পৌঁছলেন ১৮ জুলাই।
[2] Letters of sister Nivedita,
Vol. II., editor Sankari Prasad
Basu, Nobabharot publishers, Calcutta, 1982. Page
941
No comments:
Post a Comment