বেতার
টেলিগ্রাফি: নোবেল
পুরষ্কার
যে তড়িৎচৌম্বক
তরঙ্গ এবং বেতার যোগাযোগ নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন জগদীশচন্দ্র সেই বেতার
যোগাযোগে উন্নতি ঘটানোর জন্য ১৯০৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া
হয়েছে ইতালির গুল্মিয়েলগো মার্কনি এবং জার্মানির ফার্দিনান্দ ব্রাউনকে।
মার্কনি ও ব্রাউন
|
বেতার যোগাযোগের জন্য মার্কনির নোবেল পুরষ্কারের কথা উঠলে বাঙালিরা বলে উঠেন যে, এই পুরষ্কার আমাদের জগদীশচন্দ্রেরই প্রাপ্য ছিল, তাঁকে বঞ্চিত করে মার্কনি পুরষ্কার নিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে যখন পুরষ্কারটি দেয়া হয়েছিল, ততোটা শোরগোল কোথাও শোনা যায়নি। তখন নোবেল পুরষ্কারের ততটা খ্যাতি ছিল না। তাছাড়া জগদীশচন্দ্র নিজেও এই পুরষ্কার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। তিনি নিজেই তাঁর এক লেখায় মার্কনির গুণগান করেছেন। তাঁর অদৃশ্য আলোক প্রবন্ধে তারহীন সংবাদ অংশে জগদীশচন্দ্র লিখেছেন:
"১৮৯৫ সালে কলিকাতা
টাউনহলে এ সম্বন্ধে বিবিধ পরীক্ষা করিয়াছিলাম। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জি উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎ-উর্মি তাঁহার বিশাল দেহ এবং আরও দুইটি
রুদ্ধ কক্ষ ভেদ করিয়া তৃতীয় কক্ষে নানাপ্রকার তোলপাড় করিয়াছিল। একটা লোহার গোলা
নিক্ষেপ করিল, পিস্তল আওয়াজ করিল এবং বারুদস্তূপ উড়াইয়া দিল। ১৯০৭ সালে মার্কনি
তারহীন সংবাদ প্রেরণ করিবার প্যাটেন্ট গ্রহণ করেন। তাঁহার অত্যদ্ভুত অধ্যবসায় ও
বিজ্ঞানের ব্যবহারিক উন্নতিসাধনের কৃতিত্বের দ্বারা পৃথিবীতে এক নূতন যুগ
প্রবর্তিত হইয়াছে। পৃথিবীর ব্যবধান একেবারে ঘুচিয়াছে। পূর্বে দূর দেশে কেবল
টেলিগ্রাফের সংবাদ প্রেরিত হইত, এখন বিনাতারে সর্বত্র সংবাদ পৌঁছিয়া থাকে।"
তবে এটা ঠিক যে মার্কনি
অন্যের একটা যন্ত্রাংশ নিজের নামে প্যাটেন্ট করিয়ে নিয়েছিলেন - সেই যন্ত্রাংশটা কিন্তু
জগদীশচন্দ্রের ছিল না। মার্কনি বেতার যোগাযোগে জগদীশচন্দ্রের উদ্ভাবিত যন্ত্রও
ব্যবহার করেছিলেন। এবং সেই কারণেই আমরা মনে করি যে জগদীশচন্দ্রেরও নোবেল পুরষ্কার
পাওয়া উচিত ছিল। মার্কনি ঠিক কী করেছিলেন এবং কার গবেষণা নিজের নামে চালিয়েছিলেন
সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৯৮ সালে Proceedings of the IEEE, Vol. 86. No.1-এ প্রকাশিত দুটো গবেষণাপত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভি জে ফিলিপ্স "The "Italian
Navy Coherer" affair: a turn-of-the-century scandal" প্রবন্ধে[1] মার্কনি কার কাজ নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন তা
ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে বসে
জগদীশচন্দ্র যে রকম কাজ শুরু করেছিলেন সেই একই সময়ে বা তার একটু আগে বা পরে ইটালিতে
বসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা শুরু করেছিলেন মার্কনি। ১৮৯৯ সালে মার্কনি
দেখলেন যে রেডিও-ওয়েভ অনেকদূর পর্যন্ত পাঠানো সম্ভব। তিনি ফ্রান্সের Wimereaux থেকে সিগনাল পাঠিয়ে তা ১৩৫ কিলোমিটার দূরে
ইংল্যান্ডের Chelmsford-এ রিসিভ করতে পারলেন। এই ব্যাপ্তি আরো বাড়ানোর জন্য এবং বেতার যোগাযোগকে
বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে মার্কনি রয়েল নেভির সহযোগিতায় নৌবাহিনীর জাহাজ
থেকেও পরীক্ষাটা করে সাফল্য পেলেন। আরো বেশি দূরত্বে বেতার তরঙ্গ পাঠানোর কাজ চলতে
লাগলো।
১৯০০ সালে মার্কনি
সিদ্ধান্ত নিলেন আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারে বেতার তরঙ্গ পাঠানোর চেষ্টা করবেন
তিনি। ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর Cornwell-এর Poldhu থেকে মোর্স
কোড S এর তিনটি ডট পাঠানো হলো। আটলান্টিকের ওপারে
নিউফাউন্ডল্যান্ডে তা গৃহীত হলো। মার্কনি বেতার সঙ্কেত পাঠাতে সমর্থ হয়েছেন এ
ব্যাপারে কারো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মার্কনি নিজেই ভাবলেন - যদি ব্যাপারটা এমন হয়
যে তিনি আসলে সংকেত শুনতে পাননি, কিন্তু কল্পনা করছেন যে শুনতে পেয়েছেন। শ্রুতি
বিভ্রাট তো হতেই পারে।
১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি
মাসে তিনি পরীক্ষাটা আবার করলেন। এবার আরো বেশি দূরত্বে। এস এস ফিলাডেলফিয়া থেকে
সাফল্যের সাথে সিগনাল পাঠালেন ২০০০ মাইল বা ৩২০০ কিলোমিটার দূরে। সিগনাল পাঠানোর
জন্য যে ট্রান্সমিটার তিনি ব্যবহার করেছেন তা তৈরি করেছিলেন ডক্টর ফ্লেমিং। সেটা
নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু সংকেত গ্রহণ করার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন
বিতর্ক উঠেছে সেই রিসিভার বা গ্রাহক-যন্ত্র নিয়ে।
সেই সময় রেডিও-সিগনাল
রিসিভ করার প্রচলিত যন্ত্র ছিল কোহেরার। প্রফেসর অলিভার লজ চালু করেছিলেন
'কোহেরার' শব্দটি। অনেক বিজ্ঞানীই সেই সময় স্বতন্ত্রভাবে কোহেরার যন্ত্রের উন্নয়ন
ঘটিয়েছিলেন। ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রয়েল ইটালিয়ান নেভির লেফটেন্যান্ট সোলারি
একটি কোহেরার যন্ত্র মার্কনিকে দেন। সোলারি ছিলেন মার্কনির বাল্যবন্ধু। সোলারির
দেয়া কোহেরারে বেশ ভালো কাজ হওয়ায় মার্কনি নিজের নামে কোহেরারটির প্যাটেন্ট নেয়ার
জন্য আবেদন করেন ব্রিটিশ প্যাটেন্ট অফিসে। "ইটালিয়ান নেভি কোহেরার" নামে
কোহেরারটির প্যাটেন্ট পান মার্কনি। মার্কনির ট্রান্স-আটলান্টিক সাফল্যের কিছুদিন পরেই ইটালিয়ান প্রফেসর বান্টি গবেষণা
করে বের করেন যে কোহেরারটি সোলারির এবং শুধু তাই নয় ওটা সোলারির একারও নয়।
ফিলিপ্স তাঁর প্রবন্ধে
তথ্য-প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন যে সোলারি যে কোহেরারটি দিয়েছিলেন মার্কনিকে, সেটা তৈরি
করেছিল ইটালিয়ান নেভির একজন জুনিয়র অফিসার। আরো তদন্তে দেখা গেছে সেই অফিসারটিও
এটার ধারণা পেয়েছিলেন নাম-না-জানা কারো কাছ থেকে। অনেকের সমন্বিত চেষ্টার ফসল বলেই
এটার নাম ছিল ইটালিয়ান-নেভি-কোহেরার।
IEEE থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় আলোচ্য পেপারে IEEE-র সিনিয়র
মেম্বার প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তি দেন[2] যে সোলারি মার্কনিকে যে কোহেরার দিয়েছিলেন সেটা আসলে জগদীশচন্দ্রের
উদ্ভাবন। সোলারির অনেক আগেই ১৮৯৯ সালের এপ্রিলে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ
জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এ কোহেরার সম্পর্কে।
সে যাই হোক - যেহেতু
জগদীশচন্দ্র প্যাটেন্ট নেননি এবং মার্কনি যে গ্রাহক-যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন সেটা
যে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারই ছিল তা প্রমাণ করার কোন উপায় নেই, সেহেতু
জগদীশচন্দ্রকে নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে হা-হুতাশ করার মধ্যে কোন
যুক্তি নেই।
নোবেল পুরষ্কারের জন্য
নির্বাচনের যে পদ্ধতি - তাতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নোবেল বিজয়ীদের
কাছ থেকে মনোনয়ন আসতে হয় নোবেল কমিটির কাছে। জগদীশচন্দ্রকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার
জন্য কারো কাছ থেকে কোন মনোনয়ন আসেনি কোন বছর।
সম্প্রতি মার্কনির নাতি বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. ফ্রান্সেস্কো মার্কনি -কলকাতায় বসু বিজ্ঞান
মন্দিরে এসে বলেছেন যে নোবেল পুরষ্কার জগদীশচন্দ্র বসুরই প্রাপ্য ছিল।
জগদীশচন্দ্রের মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন ড. ফ্রান্সেস্কো মার্কনি
অপ্রাসঙ্গিক হতো না যদি রাশিয়ার পদার্থবিদ পোপভ এর কথাও কিছুটা উল্লেখ থাকত।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। আপনি ঠিক বলেছেন।
Delete