স্কুলে পড়ার
সময় যেসব ইতিহাস আমাকে পড়তে হয়েছিল সেগুলো আমি কখনোই পছন্দ করিনি। তার একটি কারণ হতে
পারে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক এবং পরীক্ষাপদ্ধতি। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর নাম, বাপের নাম
এবং সন তারিখ মুখস্থ করানোটাই ছিল ইতিহাসের জ্ঞান মাপার মাপকাঠি। তারপর আমাদের দেশীয়
রাজনীতির যে ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয়েছিল – পরে জেনেছি সেগুলো ছিল বেশিরভাগই মিথ্যা।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
লেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে। তাই সেরকম ইতিহাসের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মায়নি
সেভাবে। পরবর্তীতে বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখেছি বিজ্ঞানের
ইতিহাস আমার বেশ ভালো লাগছে। তার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসেরও কয়েকটা বই
পড়ার পর মনে হলো – না ইতিহাস শুধু সন-তারিখ কিংবা চরিত্রগুলোর নামের মধ্যে সীমিত নয়।
ইতিহাসের ঘটনা-পরম্পরা সামাজিক বিবর্তনের চলমান দলিল। ইতিহাস যে শুধু ইতিহাসের বইতে
থাকে তা নয়, ইতিহাস আশ্রয় করে সৃষ্টি হয় কত গল্পের, কত উপন্যাসের। সেরকম একটি উপন্যাস
ছায়ামানবী।
ছায়ামানবী উপন্যাসের
লেখক অঞ্জন নন্দী। প্রফেসর অঞ্জন নন্দী। পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ, আবার দক্ষ প্রশাসক
- সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ তিনি। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি সেমিনারে
অঞ্জন স্যার তাঁর লেখা এই বইটি আমাকে দিয়েছেন স্নেহের স্মারক হিসেবে।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু
যদি ইতিহাস হয় এবং তাও আবার চারশ বছর আগের পর্তুগিজদের ইতিহাস - ব্যাপারটা মোটেও সহজ থাকে না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা
কল্পনার ডানায় ভর করে উড়তে পারে, কিন্তু যে আকাশে উড়ছে সেই আকাশটা ইতিহাস অস্বীকার
করতে পারে না। যে পটভূমিতে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা দাঁড়ায় সেই পটভূমি ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত
চরিত্র এবং ঘটনাগুলোর পরম্পরাতে সম্পৃক্ত। তাই লেখক এখানে দায়বদ্ধ থাকেন ইতিহাসের কাছে,
সমসাময়িক স্থান-কালের বিজ্ঞানের কাছে। এই উপন্যাসে এই স্থান-কালের যুক্তিটা পরিপূর্ণভাবে
মেনে চলা হয়েছে। এখানেই লেখকের সার্থকতা।
মহসিন কলেজের
পাহাড়ের চূড়ায় চারশ বছরের বেশি পুরনো পর্তুগিজ ভবনটা অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু তার ভেতর
থেকে যে এমন একটা মানবিক প্রেম ও রাজনৈতিক গল্প বেরিয়ে আসতে পারে – তা ছায়ামানবী না
পড়লে বুঝতেই পারতাম না। এই পর্তুগিজ ভবনের রহস্যঘেরা এক কাল্পনিক জগতে লেখকের সামনে
কোন এক অলৌকিক প্রশ্রয়ে এসে পড়ে পর্তুগিজ ছায়ামানবী ইভা গনজালভেজ। এই তরুণী ইভার মাধ্যমেই
আমরা জেনে যাই পুরো ঘটনা। একে একে আবির্ভুত হয় পর্তুগিজ দস্যু স্টিভ গনজালভেজ। বিয়ের
আসর থেকে লুন্ঠন করে নিয়ে যাওয়া বাঙালি তরূণী স্বর্ণময়ীকে অপমান করার বদলে নিজের স্ত্রীর
মর্যাদা দেয় স্টিভ। স্টিভ আর স্বর্ণময়ীর সন্তান ইভা।
মানুষ আর অমানুষের
সংমিশ্রণ যে আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রেই থাকে – লেখক সেই চিত্র একেঁছেন সুনিপুনভাবে
এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রেই। এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে রবিন – ইভার প্রেমিক। বৃহত্তর
চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, গোয়া, কলকাতা – তথা এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও রাজনীতিতে
পর্তুগিজদের যে ভূমিকা এবং সেখান থেকে আমাদের যে ফিরিঙ্গি সমাজ তৈরি হয়েছে – তার নিপুণ
রেখাচিত্র হয়েছে এই উপন্যাসে। কল্পনা আর ইতিহাস মিলেমিশে এমন একটা টানটান বাস্তবতা
তৈরি হয়েছে এখানে যাতে পড়ার সময় একবারও মনে হয়নি যে এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস।
ঘটনার পাশাপাশি
লেখক বিভিন্ন চরিত্রের জবানিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দর্শনও প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি
লাইন এখানে উল্লেখ করা যায়:
বহুগামী শরীর
যদি অপবিত্র হয় তবে পরশ্রীকাতর, লোভী, লাম্পট্যভরা মন কি অপবিত্র নয়?” – পৃষ্ঠা ৩৯
গোয়ায় রবিবার
চার্চে যতো মানুষ যায় তার চেয়ে পতিতাপল্লীতে প্রতিদিন বেশি মানুষ আসা-যাওয়া করে। পৃষ্ঠা
– ৪৬
একটা ঘর পুড়লে
পাশের ঘরেও আগুন ছড়ায়, কিন্তু মনের ঘরে আগুন লাগলে, নিজেই পোড়ে, দোসর পায় না। পৃষ্ঠা
-৪৮
মানুষ যত ক্ষমতাবান
হয়, ততই সে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। একচ্ছত্র ক্ষমতা তাকে অন্ধ করে দেয়। চারপাশে সুখের
মৌমাছি তোষামোদি শুরু করে। ফলে সে ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝতে অপারগ হয়। পৃষ্ঠা - ৬৪
মানুষ বহুরূপী।
তার মুখোশ পাল্টাতে সময় লাগে না। পৃষ্ঠা - ৬৮
মানুষ স্বার্থের
ক্রীতদাস। সাপ শুধু নিজেকে রক্ষা করতে কাউকে ছোবল মারে। মানুষ সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
স্বার্থের কারণে কাউকে দংশন করতে দ্বিধা করে না। পৃষ্ঠা - ১১৪
কুকর্মের স্বাক্ষী
রাখতে নেই। পৃষ্ঠা - ১২৬
পথে নামলেই
অচেনা পথ চেনা হয়ে যায়। নিজের প্রয়োজনেই মানুষ পথ চিনে নেয়। পৃষ্ঠা - ১৩৩
দুটো মানুষ
সারাজীবন বিবাহিত জীবন কাটিয়েও হয়তো সুখী নয়। তাদের অজস্র যৌনস্মৃতি থাকতে পারে, কিন্তু
তাদের দুই হৃদয়ের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। কেউ কাউকে ভালোবাসে না। সুখে থাকার অভিনয়
করতে করতে অসুখী জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃষ্ঠা - ১৬০
সমসাময়িক ইতিহাসের
কোন বিকৃতি ঘটেনি এই উপন্যাসে – সেটাই লেখকের বড় কৃতিত্ব। দুটো ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক
হওয়া উচিত ছিল। যেমন - ইভা আর রবিনের বিয়ে হয় ২৪ জানুয়ারি ১৬৬৬। কিন্তু বলা হচ্ছে পরদিন
খ্রিস্টানদের বড়দিন। এই তথ্যটি সঠিক নয়। আরেকটি
ব্যাপার ঘটেছে যখন স্টিভ গোয়ায় যায় ভাইসরয়ের সাথে দেখা করতে। সেই ঘটনা ঘটে ১৬৬৫ সালের
দিকে। বলা হচ্ছে স্টিভকে থাকতে দেয়া হয়েছিল ডোনা পাউলা বিচের কাছে। আসলে ডোনা পাউলা
বিচের নামকরণ হয়েছে আরো প্রায় একশ বছর পর। ডোনা পাউলা ছিলেন জাফনাপটনমের পর্তুগিজ ভাইসরয়
-এর আত্মীয়। ডোনা ১৭৪৪ সালে গোয়ায় আসে। ১৭৫৬ সালে বিয়ে করে। ১৭৮২ সালে মারা যায়। স্টিভের
জানার কথা নয় ডোনার কথা। অথচ স্টিভ ভাবছে ডোনা পাউলার কথা। উপন্যাসে ডোনাকে বলা হয়েছে
একজন জেলের মেয়ে, বড় লোকের ছেলের প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। আসলে প্রচলিত কাহিনিটি
ছিল উলটো। ডোনা বড়লোকের মেয়ে – প্রেম করেছিল একজন গোয়ানিজ জেলের ছেলের সাথে। (পৃ১১২)
এই বইটি প্রকাশিত
হয়েছে এবারের বইমেলায়। প্রকাশ করেছে মুক্তধারা নিউইয়র্ক। মুদ্রিত হয়েছে চট্টগ্রামের
দি অ্যাড কমিউনিকেশন থেকে। এমন চমৎকার ছাপা এবং কাগজ অনেকদিন কোন বইতে দেখিনি। দীপক
দত্তের প্রচ্ছদ অসাধারণ – তবে প্রচ্ছদের ছায়ামানবীকে ভবিষ্যত পৃথিবীর কোন সাই-ফাই চরিত্র
বলে মনে হয়, ইভা গঞ্জালভেসের সাথে মেলানো যায় না।
সবশেষে আমি
লেখককে অভিনন্দন জানাতে চাই এই বলে যে ছায়ামানবীর মানবিক চারাগাছ বিকশিত হয়েছে পত্রপল্লবে।
অভিনন্দন।
আপনার এ বিষয়টা আমার খুব চমৎকার লাগে যে, আপনি আপনার ভালো লাগা বিষয়গুলো পৃষ্ঠাসহ তুলে ধরেন । আবার আপনি একজন physicist হয়ে বইয়ের ইতিহাসের ভুলগুলো ধরতে পারেন। আপনি যেন সুস্থ থেকে আমাদের জন্য লিখে যেতে পারেন এটা আশা করি ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি আনন্দের জন্য বই পড়ি। কিন্তু যদি দেখি কোন তথ্য ভুল আছে, তাহলে মনে হয় পাঠকরা এই ভুল তথ্যকেই সত্য বলে ধরে নেবে। তাই তথ্যের ব্যাপারে একটু যত্নশীল হতে বলি। এখন অনলাইনের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করা তো অনেক সহজ হয়ে গেছে। ভালো থাকবেন।
Delete