Friday, 17 April 2020

জগদীশচন্দ্র বসু - পর্ব ১৫


নিবেদিতার মৃত্যু

আমেরিকা থেকে ফেরার পথে ছদ্মবেশ ধারণ করে পুলিশের গ্রেফতার এড়িয়ে কলকাতায় আসার পর শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে নিবেদিতা সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন ফলে তাঁর হাতে আরো কিছুটা সময় এলো তখন তিনি দীনেশচন্দ্র সেনেরHistory of the Bengali Language and Literatureসংশোধনের দায়িত্ব নিলেন আর জগদীশচন্দ্রের বই পেপার লেখা তো আছেই           
মাঝে মাঝে সময় পেলে জগদীশ অবলাকে সাথে নিয়ে বেড়াতে চলে যান নিবেদিতা ১৯০৯ এর ডিসেম্বরে গেলেন অজন্তা ১৯১০এ কেদার-বদরী ২৫মে থেকে শুরু করে ৪৮ দিন ধরে জগদীশচন্দ্র ও অবলাকে নিয়ে কেদারবদ্রি ভ্রমণ করেছেন, তীর্থ ভ্রমণ ভারতের ঐতিহ্য দর্শন, ঐক্য দর্শন ভাষাগত, জাতিগত, বর্ণ-বিদ্বেষ কিছুই নেই সেখানে কেবল মানুষ আছে ৪৮ দিনের মধ্যে ৪২ দিন ধরে কেবল হাঁটা আর হাঁটা নিবেদিতা আতঙ্কিত ছিলেন অবলা জগদীশকে নিয়ে তাঁর উৎকন্ঠা ধরা পড়ে মিসেস উইলসনকে লেখা চিঠিতে:
          “বিজ্ঞানের মানুষটিকে সুস্থ, সবল, জ্যান্ত অবস্থায় কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে পেরে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছি বেচারা বউই কেবল অসুস্থ হয়ে পড়েছিল- সে এখন আবার ভালো হয়ে গেছে
          এই কেদার-বদরী ঘুরে এসেই জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধভাগরথীর উৎস সন্ধানে
          ১৯১০ এর শরৎকালে নিবেদিতা জগদীশ অবলা দার্জিলিং- গেলেন সেই সময় খবর এলো সারা বুল খুব অসুস্থ নিবেদিতা সময় নষ্ট না করে চলে গেলেন আমেরিকা ১৫ নভেম্বর সারা বুলের সাথে দেখা হলো নিবেদিতার সারার তখন খুব খারাপ অবস্থা
          ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর থেকেই আস্তে আস্তে ভেঙে পড়েছিলেন সারা। তাছাড়া তাঁর একমাত্র মেয়ে ওলিয়ার মেয়ে এডুইনার অকাল মৃত্যুতে একেবারেই ভেঙে পড়েন সারা। মাত্র ৬১ বছর বয়সেই তিনি মৃত্যুশয্যায়। নিবেদিতা সারার সেবায় লেগে গেলেন
          জগদীশের জন্মদিন খুব মর্যাদার সাথে পালন করতেন নিবেদিতা এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ভোলেননি ৩০ নভেম্বর জগদীশচন্দ্রের জন্মদিন। সে উপলক্ষে খুব আবেগপূর্ণ ভাষায় নিবেদিতা চিঠি লিখলেন জগদীশকে:
          “When you receive this it will be our beloved 30th, the birthday of birthdays…..”[1]
          আরো লিখেছিলেন:
          আমাদের পরম-প্রিয় তিরিশ তারিখটি- শ্রেষ্ঠ জন্মদিনটি দিনেই এই পত্র তোমার কাছে পৌঁছবে অনন্ত পুণ্যে পূর্ণ হোক এই দিন নিজ প্রসারিত মাধুর্যে আর্শীবাদে সম্পূর্ণ হয়ে আর্বিভূত হোক বারবার এই মহাদিন!--- জয়ী হোক, চিরজয়ী মানুষের সামনে হও আলোক, পদতলে হও প্রদীপ আর শান্তি, গভীর শান্তি পাও তুমি- তুমি নুতন ভবনের আবিষ্কর্তা চেতনা সমুদ্রের হে মহান নাবিক!”
          নিবেদিতাও এই চিঠিতে কোন সম্বোধন বা স্বাক্ষর করেননি
          ১৯১১র জানুয়ারি মাসে সারার মৃত্যু হয় শোকে মূহ্যমান নিবেদিতা ভারতে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন- এমন সময় এক অভাবনীয় সমস্যায় পড়ে গেলেন তিনি
          সারা বুলের মৃত্যুর পর জানা গেলো যে তিনি তাঁর সম্পত্তির বেশিরভাগ (১৯১১ সালে যার অর্থমূল্য ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ডলার) উইল করে দান করে গেছেন বেদান্ত সমিতি, নিবেদিতার বাগবাজারের স্কুল এবং জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনার খরচের জন্য ১৮৯৮ সালে ইউইয়র্কে বেদান্ত সমিতি গঠন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
          সারার মেয়ে ওলিয়া মেনে নেনি তার মৃত মায়ের উইল। তিনি মামলা করেন তাঁর অভিযোগ ছিল হিন্দুরা জাদুটোনা করে তার মাকে পাগল বানিয়ে ফেলেছে পাগল হয়ে তিনি সব হিন্দুদের দিয়ে দিয়েছেন সারার মৃত্যুর সময় সারাক্ষণ কাছে ছিলেন নিবেদিতা। ওলিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়লো নিবেদিতার ওপর। তিনি সরাসরি নিবেদিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে নিবেদিতা তার মায়ের মনকে ভারতীয় কালোজাদুতে মোহগ্রস্থ করে এই উইল করিয়ে নিয়েছেন
          আদালতের রায়ে একটা আপোসরফা হয় যার বেশিরিভাগই সারা মেয়ের পক্ষে যায় মায়ের বেশিরভাগ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন লিয়া কিন্তু জানা যায় যেদিন মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার নোটিশ পান আদালত থেকে, সেদিনই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু নিবেদিতা ততদিন অপেক্ষা করেননি।
          ক্ষোভে অপমানে বিধ্বস্ত হয়ে গেলেন নিবেদিতা এত পরিশ্রম এত ছোটাছুটি এত ভালোবাসা এত ত্যাগের পরিণাম হলো এই বদনাম! তিনি দ্রুত ফিরে এলেন কলকাতায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো কয়েক মাসেই যেন তাঁর বয়স বেড়ে গেছে দশ বছর
          নিবেদিতার ভগ্ন স্বাস্থ্য, ভাঙা মন কিছুটা শান্ত করার জন্য জগদীশ অবলা তাঁকে নিয়ে গেলেন দার্জিলিং- সেখানে তাঁরা উঠলেন অবলার ভগ্নিপতি দ্বারকানাথ রায়ের বাড়িরায় ভিলা সেখান থেকে সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের কিন্তু তা হলো না খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা প্রচন্ড জ্বর, রক্ত-আমাশয় ডাক্তার নীলরতন সরকার তখন দার্জিলিং- ছিলেন তিনি নিবেদিতার চিকিৎসা শুরু করলেন
          কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হতে লাগলো জগদীশ অবলা যথাসাধ্য করছেন জগদীশ নিবেদিতার বিছানার পাশ বসে নিবেদিতার প্রিয় বই, কবিতা বা অন্য কিছু পড়ে শোনান অবলাও যতক্ষণ পারেন নিবেদিতার শয্যাপাশে বসে থাকেন সেবা করার চেষ্টা করেন কিন্তু কোন চেষ্টাতেই কোন চিকিৎসাতেই কিছু হলো না ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর রাত আড়াইটায় মারা যান নিবেদিতা
          নিবেদিতার মৃত্যুতে খুব মুষড়ে পড়েন জগদীশ নভেম্বর ১৯১১ মিসেস উইলসনকে তিনি লিখেন:
          “the book which she was helping me to write is staring me in the face….”[2]
          এই চিঠিতে বাগবাজারের স্কুলের ভবিষ্যৎ, নিবেদিতার শেষ ইচ্ছে ইত্যাদি নানা বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও একবারও নিবেদিতার নাম লিখেননি কোথাওsheবলেই তিনি নিবেদিতাকে বুঝিয়েছেন নিবেদিতার নাম উচ্চারণে এত সংকোচ কেন জগদীশে? অথচ এদিকে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছেন প্রবাসী পত্রিকায় নিবেদিতার স্মরণে প্রবন্ধ লেখার জন্য জগদীশের অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ লিখেনভগিনী নিবেদিতা
          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর প্রবাসী পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ সংখ্যায় স্বীকার করেছেন, তাঁর কাজে রচনায় উৎসাহদাত্রীরূপে মূল্যবান সহায় তিনি পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে জগদীশচন্দ্রের জীবনের ইতিহাসে এই মহনীয়া নারীর নাম সম্মানের সাথে রক্ষার যোগ্য[3]
          নিবেদিতার বইThe Web of Indian life’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৪- তারপরে নিবেদিতা জগদীশকে অনুরোধ করেছিলেন বইটির একটা ভূমিকা লিখে দিতে জগদীশ সেই অনুরোধ রাখলেন নিবেদিতার মৃত্যুর পর ১৯২৮ সালে নিবেদিতারThe web of Indian life’-এর নতুন সংস্করণে জগদীশের ভূমিকা অন্তর্ভূক্ত হয় 
          মৃত্যুর এক মাস আগে ১৯১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে মিস ম্যাকলাউডকে লিখেছিলেন:
          “শেষ চিঠিতে বে-আন সম্বন্ধে যা বলেছ, কী প্রাণদীপ্ত সত্য কথাগুলি! তুমি বলেছো তুমি বসুর জন্য গর্বিত, কারণ বিজ্ঞানে অপারদর্শী ভারত তাতে পারদর্শী হয়েছে  . বসুর কাজের মূল্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে ভারতে আরও যেসব মহান ব্যক্তি আছেন ভারতের সেবার দ্বারাই তাঁরা মহান; সীমাবদ্ধ এক গোষ্ঠীর মধ্যেই তাঁরা কাজ করেন কিন্তু ধর্মে বিবেকানন্দ এবং বিজ্ঞানে বসু পৃথিবীর জন্য দান রেখেছেন
          ১৯০০ থেকে ১৯১০ - এই দশ বছরে নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রে প্রকাশিত চারটি বইয়ের প্রায় আড়াইহাজার পৃষ্ঠা হাজার খানেক নক্সা তৈরি করেছেন অথচ জগদীশ তাঁর যথযথ সম্মান দেয়া তো দূরের কথা কোথাও স্বীকার পর্যন্ত করেননি নিবেদিতার এই কাজ নিবেদিতার মৃত্যুর পরে জগদীশচন্দ্র আরো সাতটি বই লিখেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে নিবেদিতাকে ছাড়া অতগুলো বই এবং গবেষণাপত্র জগদীশ কীভাবে লিখলেন? সত্যি কথা হলো প্রথম চারটি বইয়ের ভাষার যে সাবলীলতা ছিল, পরের সাতটি বইয়ে তা অনুপস্থিত।
          সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে জগদীশচন্দ্র নিবেদিতার সাথে পরিচয়ের আগে যে স্টাইলে লিখতেন- নিবেদিতার লেখার পূর্বের স্টাইলের সাথে তার কোন মিল নেই নিবেদিতার মৃত্যুর পর জগদীশের নিজস্ব লেখার স্টাইল আবার ফিরে এসেছিলো[4]
          জগদীশের জীবনী লিখতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা কিন্তু ভয়ও ছিলো তিনি হয়তো তা করার সুযোগ পাবেন না ১৯১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সারা বুলকে তিনি লিখেছিলেন:
          “I am so afraid that I shall not be these to write his life… Of course no one will ever see him as I have done.”
            প্যাট্রিক গ্যাডিস তাঁর লেখা জগদীশচন্দ্রের জীবনীর অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন নিবেদিতার কাছ থেকে
          নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রকে যেমন খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন- জগদীশও দেখেছিলেন নিবেদিতাকে অথচ নিবেদিতা যখনই সুযোগ পেয়েছেন জগদীশের নাম কীর্তি প্রকাশে সচেষ্ট থেকেছেন কিন্তু জগদীশচন্দ্র কোথাও নিবেদিতার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি



[1] Letters of sister Nivedita, Vol. II., editor Sankari Prasad Basu, Nobabharot publishers, Calcutta, 1982. page 990
[2] Letters of sister Nivedita, Vol. II., editor Sankari Prasad Basu, Nobabharot publishers, Calcutta, 1982. page 1253
[3] রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৫শ খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
[4] শিলাদিত্য জানা, Sister Nivedita's Influence on J.C.Bose’s writing. Journal of the association for Information Science and Technology, 66, 645-650, 2015.

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts