বৈজ্ঞানিক
গবেষণার সূচনা
পদার্থবিজ্ঞানের
প্রতি জগদীশচন্দ্রের ভালোবাসা জন্মেছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় ফাদার
লাঁফোর সংস্পর্শে এসে। তারপর তা আরো গভীর হয়েছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়।
কেমব্রিজে প্রফেসর লর্ড র্যালে ছিলেন তাঁর প্রিয় অধ্যাপক। লর্ড র্যালের পড়ানোর
এবং বোঝানোর স্টাইল জগদীশচন্দ্রও প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর অধ্যাপনা জীবনে। লর্ড র্যালের
আগে কেমব্রিজে পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।
জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল
ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক সংক্রান্ত সমীকরণগুলো পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমীকরণ। এই সমীকরণগুলো থেকেই পাওয়া গেছে বিদ্যুৎ ও চুম্বকের চিরায়ত সম্পর্ক, আলোর গতির মান এবং সর্বোপরি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরণ। কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে সংরক্ষিত ম্যাক্সওয়েলের তাত্ত্বিক কাজ জগদীশচন্দ্র নিজের চোখে দেখে এসেছেন।
আলো কী? এই প্রশ্নের
উত্তরে পদার্থবিজ্ঞানের যে কোন শিক্ষার্থীই সহজে উত্তর দেবে - আলো হলো বিদ্যুত-চুম্বকীয়
তরঙ্গের দৃশ্যমান অংশ। আলো, এক্স-রে, গামা-রে, রেডিও-ওয়েভ, মাইক্রো-ওয়েভ সবই যে
বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ তা আজ আমরা জানি। কিন্তু ঠিক কখন থেকে তা জানি তা দেখতে
হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। কত পেছনে? এক শতাব্দীরও বেশি পেছনে।
তরুণ জার্মান
বিজ্ঞানী হেনরিখ হার্টজ ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুসরণ করে ১৮৭৯ সাল থেকে ১৮৮৭ সাল
পর্যন্ত কঠোর গবেষণা করে পরীক্ষাগারে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ উৎপন্ন করতে সমর্থ হন। ১৮৮৮
সালে হেনরিখ হার্টজ তাঁর পরীক্ষা-লব্ধ ফলাফল প্রকাশ করার পর জানতে পারলাম যে
দৃশ্যমান আলোর ধর্ম আর রেডিও-ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গের ধর্ম একই।
হেনরিখ হার্টজ
রেডিওওয়েভ আবিষ্কৃত হবার
কয়েক বছরের মধ্যেই এই তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যাপারে আশাবাদী
হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। আলো সরলরেখায় চলে। তাই রেডিওওয়েভ সরলরেখায় চলবে এরকম ধারণা
তখন প্রতিষ্ঠিত। তাই বেতার তরঙ্গ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধা দেখা দিলো অনেক।
সমতলভূমিতে তেমন অসুবিধে নেই, কিন্তু পাহাড়-পর্বত সামনে পড়লেই তরঙ্গ বাধাগ্রস্ত
হবে। তখন কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের কথা জানা ছিল না কারো।
আয়নোস্ফিয়ার আবিষ্কারের পর রেডিওওয়েভ পাঠানো অনেক সহজ হয়ে গেলো। কারণ বায়ুমন্ডলের
সেই স্তরে তরঙ্গ বাধা পেয়ে ফিরে আসে পৃথিবীতে। তবে সেটা আরো অনেক দিন পরের ব্যাপার
এবং অন্য প্রসঙ্গ।
হার্টজ যে তরঙ্গ তৈরি করেছিলেন সেই
তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ছিল অনেক বেশি, ফলে শক্তি ছিল খুব কম। কোন রকমের তার ছাড়া
তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণ করতে হলে তার শক্তি হতে হবে অনেক বেশি। আর শক্তি
বাড়াবার প্রধান উপায় হলো তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা। তাছাড়া তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য বেশি
হওয়াতে সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য বিশাল আকারের যন্ত্রপাতির দরকার হতো। যেমন
হার্টজ যে প্রিজম নিয়ে কাজ করেছিলেন সেই প্রিজমের একেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল এক
মিটারেরও বেশি।
হার্টজ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে
অসাধারণ কাজ করেছেন। তাঁর নামানুসারে তরঙ্গের কম্পাঙ্কের এককের নাম রাখা হয়েছে
হার্টজ। হার্টজ্-এর তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গের পরিচলন বিষয়ে গবেষণামূলক বই এর মূল
জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদ "Electrical Waves being searches on the propagation of electric action
with finite velocity through space" প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ সালে ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে।
জগদীশচন্দ্র তড়িৎচৌম্বক
তরঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হন হার্টজের বই পড়ে। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বিনাতারে প্রেরণ ও
গ্রহণের মাধ্যমে বিনাতারে যোগাযোগের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা হচ্ছিলো অনেকদিন থেকেই।
হার্টজ তাঁর ল্যাবোরেটরিতে সৃষ্ট তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে
সমর্থ হচ্ছিলেন। ১৮৯৩ সালে হার্টজ তাঁর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ৫৪০ সেন্টিমিটারে নামিয়ে
আনতে সমর্থ হন। এটাকে আরো কমিয়ে আনার আগেই ১৮৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি মাত্র ৩৬ বছর
বয়সে মারা যান হার্টজ। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হার্টজই প্রথম তৈরি করেছিলেন বলে এই
তরঙ্গকে তখন হার্টেজিয়ান ওয়েভও বলা হতো।
১৮৯৪ সালের জুন মাসে হার্টজের স্মরণে
রয়েল ইন্সটিটিউটে "the Work of Hertz
and Some of His Successors" শিরোনামে বক্তৃতা দেন স্যার অলিভার লজ। প্রফেসর অলিভার লজও হার্টজের
পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বেতার তরঙ্গের
ডিটেক্টর তৈরির অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন অলিভার লজ। বেতার যোগাযোগ প্রযুক্তির
একটা প্রধান প্যাটেন্ট ছিল স্যার অলিভার লজের। তিনি হার্টেজিয়ান ওয়েভের প্রেরক ও
গ্রাহক যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন 'কোহেরার'। অলিভার লজের পেপারটি পড়ে হার্টজ ও লজের
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ এবং বেতার যোগাযোগ বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ সৃষ্টি হয় জগদীশচন্দ্রের।
জগদীশচন্দ্র হিসেব করে
দেখেন যে হার্টজ বয়সে তাঁর চেয়ে মাত্র এক বছরের বড় ছিলেন। ছত্রিশ বছর বয়সে হার্টজ
মারা গেছেন। জগদীশ ভাবলেন নিজের ৩৬ বছর বয়স পূর্ণ হবার দিন থেকেই তিনি তাঁর
বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করবেন পাকাপাকি ভাবে। ১৮৯৪ সালের ৩০
নভেম্বর তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিনে নিজের ডায়েরিতে লিখে বিজ্ঞানের সেবায় আত্মনিবেদন
করার ঘোষণা দিলেন জগদীশচন্দ্র। এর আগপর্যন্ত তাঁর গবেষণা ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত,
কোন গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়নি। তবে এটাও ঠিক যে তিনি অনেকদিন থেকে গবেষণার
প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, নইলে ঘোষণা দেয়ার দু'বছরের মধ্যে এত বেশি কাজ করে ফেলা সম্ভব
হতো না।
অলিভার লজ
|
জগদীশচন্দ্র পরীক্ষণ-পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণার জন্য ল্যাবোরেটরি দরকার, যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য ওয়ার্কশপ দরকার। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে তার একটাও নেই। তিনি দেখলেন কীভাবে কী করা যায়। নিজের হাতে ল্যাবোরেটরি তৈরি করার মতো কোন উপযুক্ত ঘর পেলেন না। বাথরুমের পাশে খুব ছোট একটা গুদামঘরের মতো পরিত্যক্ত ঘর পাওয়া গেলো। জগদীশচন্দ্র সেটা পরিষ্কার করে কোন রকমে কাজ চালিয়ে যাবার মতো করে একটা ল্যাবোরেটরি স্থাপন করলেন সেখানে। দেশীয় কাঁচামাল থেকে নিজের হাতে তৈরি করে নিলেন অনেক যন্ত্রপাতি। কলেজ থেকে গবেষণার জন্য একটা টাকাও পাওয়া গেলো না। এমনকি গবেষণার জন্য আলাদা কোন সময়ও তাঁকে দেয়া হলো না। প্রাতিষ্ঠানিক সমস্ত কাজ করার পর তিনি গবেষণা করেন। নিজের বেতন থেকে বেতন দিয়ে একজন দেশীয় মিস্ত্রী নিয়োগ করলেন যন্ত্রপাতি তৈরিতে তাঁকে সাহায্য করার জন্য।
সামান্য যা কিছু আছে তা কাজে লাগিয়ে কাজ
করে যাবার মনের জোর ছিল জগদীশচন্দ্রের। গবেষণার প্রাথমিক পর্বের প্রতিকুল পরিবেশ
সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র পরবর্তীতে বলেছেন:
"ভারতবাসীরা
কেবলই ভাবপ্রবণ ও স্বপ্নাবিষ্ট, অনুসন্ধান-কার্য কোনদিনই তাহাদের নহে - এই এক কথাই
চিরদিন শুনিয়া আসিতাম। বিলাতের ন্যায় এদেশে পরীক্ষাগার নাই, সূক্ষ্ম যন্ত্র
নির্মাণও এদেশে কোনদিন হইতে পারে না, তাহাও কতবার শুনিয়াছি। তখন মনে হইল, যে
ব্যক্তি পৌরুষ হারাইয়াছে, কেবল সে-ই বৃথা পরিতাপ করে। অবসাদ দূর করিতে হইবে,
দুর্বলতা ত্যাগ করিতে হইবে। ভারতই আমাদের কর্মভূমি, সহজপন্থা আমাদের জন্য নহে। ...
... এই সকল কথা স্মরণ করিয়া একজন তাহার সমগ্র মন, সমগ্র প্রাণ ও সাধনা ভবিষ্যতের
জন্য নিবেদন করিয়াছিল।"[1]
পরবর্তী দু'বছরের মধ্যে
সারা পৃথিবী দেখলো যে ভারতের প্রসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র তড়িৎচৌম্বক
তরঙ্গের উপর যুগান্তকারী গবেষণা করে চলেছেন। ১৮৯৫ সালের মধ্যেই জগদীশচন্দ্র প্রমাণ
করলেন যে হার্টজ যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ তৈরি করেছেন সেই তরঙ্গের ধর্মের সাথে
দৃশ্যমান আলোকের ধর্মের কোন প্রভেদ নেই। আলোও যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের অংশ তা
প্রমাণিত হলো। এই গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধ আকারে লিখে ১৮৯৫ সালের ১লা মে তারিখে তিনি
কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম
ছিল "On polarisation of electric
rays by double refracting crystals"। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ডক্টর রুডল্ফ হর্নলে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও
সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন।[2] এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক
আলেকজান্ডার পেডলার। ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোসাইটির বার্ষিক অধিবেশনে তিনি
জগদীশচন্দ্রের গবেষণার ভূয়সি প্রশংসা করেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্রটি এশিয়াটিক
সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে।
তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ এবং
দৃশ্যমান আলোর ধর্মের উপর গবেষণার ভিত্তিতে দুটো গবেষণাপত্র ইংল্যান্ডের জার্নালে
প্রকাশের জন্য কেমব্রিজের লর্ড র্যালের কাছে পাঠিয়ে দেন জগদীশচন্দ্র। লর্ড র্যালে
প্রবন্ধদুটো পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার মৌলিকত্ব সম্পর্কে
নিশ্চিত হয়ে তিনি গবেষণাপত্র দুটো ইলেকট্রিশিয়ান জার্নালে পাঠিয়ে দেন প্রকাশের
জন্য। ১৮৯৫ সালেই প্রকাশিত হয় সেগুলো। ১৮৯৫-৯৬ সালের মধ্যে চারটি গবেষণাপত্র
প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। প্রথম গবেষণাপত্র “On polarization of electric rays by double refracting crystals” প্রকাশিত হয়
এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর জার্নালে। রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হয় “On the determination of the index of refraction of
sulphur for the electric rays”। ইংল্যান্ডের ‘The Electrician’ জার্নালে
প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্র - “On a new electro-polariscope” ও “On double refraction of the electric ray by a strained
dielectric”।
১৮৯৫ সালে
উইলহেল্ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের পর পদার্থবিজ্ঞানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ
আবিষ্কারের পথ খুলে যায়। পরমাণু-বিজ্ঞান, বেতারে বার্তা পরিবহন, তেজষ্ক্রিয়তা,
অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার এসময় বৈজ্ঞানিক মহলে বিরাট
প্রভাব ফেলে। এ সময় জগদীশ বসু অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত বার্তা
প্রেরণের গবেষণায় বেশ সাফল্য লাভ করেন। হেন্রিখ হার্ট্জ, ও গুগ্লিয়েল্মো
মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি ১৮৯৫ সালে
সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলীও নির্ধারণ
করেন।
অদৃশ্য তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ প্রেরণের
সাহায্যে বিনাতারে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন হার্টজ, অলিভার লজ প্রমুখ।
জগদীশচন্দ্রও গবেষণা শুরু করলেন এ বিষয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেশ সাফল্য অর্জন
করলেন এ ব্যাপারে। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণাগার ছাড়াও তাঁর বাসাতেও তিনি এ নিয়ে
কাজে মেতে থাকেন। স্যার অলিভার লজের কোহেরার যন্ত্রের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন
জগদীশচন্দ্র।
১৮৯৬ সালে কলকাতা সফরে এলেন বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির
ক্যাভেন্ডিজ ল্যাবের এই বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছে পড়াশোনা করেছেন জগদীশচন্দ্র। কাজেই
তিনি তাঁর প্রিয় অধ্যাপককে নিমন্ত্রণ করলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। লর্ড র্যালের
হাতে বেশি সময় ছিল না। তিনি যেদিন সময় দিতে পারলেন সেদিন ছিল ছুটির দিন।
জগদীশচন্দ্র সেই ছুটির দিনে লর্ড র্যালেকে নিজের কলেজ, নিজের গবেষণা, ল্যাব
ঘুরিয়ে দেখালেন। এত সীমিত সুযোগের মধ্যেও জগদীশ যে এত কাজ করছেন - দেখে খুব খুশি
হলেন লর্ড র্যালে। জগদীশের
গবেষণার কোন ফান্ড ছিল না। নিজের খরচে এত বড় গবেষণা চালানোর সামর্থ্য নেই জগদীশের।
লর্ড র্যালে জগদীশকে রয়েল সোসাইটিতে ফান্ডের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দিলেন।
জগদীশচন্দ্র আবেদন করেছিলেন এবং সেই আবেদন মঞ্জুর হয়েছিল। লর্ড র্যালে ছিলেন
তৎকালীন রয়েল সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক। জগদীশচন্দ্রই ছিলেন প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী
যিনি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান সংস্থা থেকে গবেষণার জন্য অর্থ সাহায্য পান।
জগদীশচন্দ্রের এই সাফল্য এবং স্বীকৃতির
প্রেক্ষিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে কলকাতার ইংলিশম্যান পত্রিকা ১৮ জানুয়ারি, ১৮৯৬ সালে
সম্পাদকীয় ছাপিয়েছিল যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:
"বৈজ্ঞানিক গবেষণায়
ভারতীয় ছাত্রদের বিতৃষ্ণা ও মৌলিকত্বের অভাব সম্পর্কে যে অভিযোগ করা হয় তা আর
বেশিদিন যুক্তিসঙ্গত মনে হবে না। অধ্যাপক বসু যদি কোহেরার যন্ত্রটিকে আরো নিখুঁত
করতে পারেন তবে একদিন দেখা যাবে প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে একাকী কর্মরত
বাঙালি বিজ্ঞানীর আবিষ্কার চিরায়ত আলোক ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে।"[3]
জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রিয় শিক্ষক ফাদার
লাঁফোর অনুপ্রেরণায় সাধারণ জনগণের জন্যও বিজ্ঞান বক্তৃতা ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা
করলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বেতার তরঙ্গ প্রেরণের পরীক্ষা করে দেখান জগদীশচন্দ্র।
সেই পরীক্ষায় অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের রুম থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ প্রেরণ
করলেন জগদীশচন্দ্র। সেই অদৃশ্য তরঙ্গ দেয়াল ভেদ করে অধ্যাপক পেডলারের রুমে গিয়ে
ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। কয়েক মাস পরে ছোটলাট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির উপস্থিতিতে
কলকাতা টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তুপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের
উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশানের সাহায্যে।
টাউন হলে নিজের চোখে জগদীশচন্দ্রের
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও কার্যকলাপ দেখে তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রতি খুব
শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন স্যার ম্যাকেঞ্জি। তাঁর সুবাদে বাংলার প্রাদেশিক সরকার
জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য এককালীন এক হাজার টাকা মঞ্জুরী দেয়। এ প্রসঙ্গে
ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে:[4]
"This is a step in
the right direction... What we most need in India is scientific and technical
education. There was a time when the neglect of Physical Science by our
countrymen was very much deplored, and it was also thought that the people of
India had not that in them which would qualify them to enter with any degree of
success into the domain of science. But the remarkable success of Professor J.
C. Bose as a Professor of Science in the Calcutta Presidency College, has
negatived such a supposition. In future the education system to be in force in
this country, should not only be literary but also include a course of scientific,
technical and commercial instructions. Sir Alexander Mackenzie will have a
cherished place in the hearts of the people of Bengal, if he be pleased to see
such reforms introduced in the educational system in the provinces over which
he rules aas would enable our youth to receive an all-round solid education."
১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে যেসব
বৈজ্ঞানিক গবেষণা জগদীশচন্দ্র করেছেন সেগুলোর একটা সারসংক্ষেপ সংকলন করে একটা
পুস্তিকা প্রকাশ করেন জগদীশচন্দ্র। পুস্তিকার শিরোনাম ছিল: An account of experimental researches carried out at the Physical
Laboratory of the Presidency College in the year 1895. পুস্তিকাটি তিনি কেমব্রিজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে
এবং রয়েল সোসাইটিতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন
তখন রয়েল সোসাইটির সভাপতি পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি জগদীশচন্দ্রের
গবেষণা-পুস্তিকাটি পেয়ে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন জগদীশচন্দ্রের গবেষণার ব্যাপারে।
নিজের গবেষণাপত্রগুলোর কপি তিনি পাঠিয়ে দিলেন জগদীশচন্দ্রকে।
বিশ্ব-পদার্থবিজ্ঞানের
জগতে আসন পাবার উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন জগদীশচন্দ্র। তাঁর গবেষণা নিয়ে কথা হচ্ছে রয়েল
সোসাইটিতে। অথচ তিনি তখনো ডক্টরেট করেননি। প্রফুল্লচন্দ্র ডিএসসি ডিগ্রি নিয়ে
এসেছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রফুল্লচন্দ্র জগদীশচন্দ্রকে পরামর্শ দিলেন
ডক্টরেটের জন্য কাজ করতে। জগদীশচন্দ্র তাঁর নিজের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে একটি
থিসিস লিখে ফেললেন: On the determination of the wavelength of
electric radiation by diffraction grating. থিসিসটি তিনি পাঠিয়ে দেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৮৯৬ সালের ২৬শে মে থিসিসটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহীত হয়। এই থিসিসের ভিত্তিতে
জগদীশচন্দ্রকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর থিসিসের অন্যতম
পরীক্ষক ছিলেন ইলেকট্রনের আবিষ্কাররক জে জে থমসন ও লর্ড কেলভিন।
শিক্ষাবিভাগ এবং নিজের
বিভাগেরও অনেকেই জগদীশচন্দ্রের এই সুনাম ও উন্নতি ভালো চোখে দেখছিলেন না। তাঁদের
মতে জগদীশ তাঁর নিজের কর্তব্য না করে গবেষণা করছেন - যার কোন দরকারই নেই ভারতে।
কিন্তু জগদীশচন্দ্রের গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন অনেকেই। ডিএসসি ডিগ্রি
লাভের পর জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি জগদীশচন্দ্রের জন্য বিশেষ
পদমর্যাদায় শিক্ষাবিভাগে একটি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করলেন ডেপুটি গভর্নর আলেকজান্ডার
ম্যাকেঞ্জি। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে জগদীশচন্দ্রের কাজ হবে সরকারী কলেজে বিজ্ঞান
গবেষণাগারগুলোর উন্নতি সাধনে পরামর্শ দেয়া এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে শুধুমাত্র গবেষক
ছাত্রদের তত্ত্বাবধান করা। তাতে জগদীশচন্দ্রের সপ্তাহে যে ছাব্বিশটি ক্লাস নিতে হয়
তা আর নিতে হবে না এবং গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় তিনি পাবেন। কিন্তু শিক্ষাবিভাগ
ম্যাকেঞ্জির প্রস্তাবে কোন সাড়া দেয়নি এবং জগদীশচন্দ্রের জন্য আলাদা কোন সুযোগও
সৃষ্টি হয়নি। তবে শিক্ষাবিভাগ জগদীশচন্দ্র গবেষণার জন্য নিজের বেতন থেকে যা খরচ
করেছিলেন তা তাঁকে মিটিয়ে দিতে সম্মত হলো। সে হিসেবে জগদীশচন্দ্রকে বার্ষিক আড়াই
হাজার টাকা মঞ্জুর করা হলো।
ইওরোপে তখন
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় জোয়ার এসেছে। কত বহুমুখী আবিষ্কার হয়ে চলেছে সেখানে।
ভারতে বসে সেই সব খবর পেতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। জগদীশচন্দ্র বুঝতে পারছেন তাঁর ইওরোপে
যাওয়া দরকার। নিজের গবেষণা বিশ্বের দরবারে হাজির করতে না পারলে বুঝবেন কীভাবে যে
তিনি কোথায় আছেন এবং ঠিক করছেন কী ভুল করছেন। তাঁর ইচ্ছের কথা জানিয়ে তিনি চিঠি
লিখলেন লর্ড র্যালের কাছে। র্যালেও তাঁকে সমর্থন করলেন এবং তৎকালীন ভারত-সচিব জর্জ
হ্যামিলটনকে একটা চিঠি লিখলেন। তিনি চিঠিতে অনুরোধ করলেন, যেন জগদীশচন্দ্রকে ইওরোপে
যাবার ব্যাপারে সহায়তা করা হয়। লর্ড র্যালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের সম্মেলনে
যোগদান করার জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ইওরোপ যাবার ব্যাপারে
দৃঢ়সংকল্প হয়ে সরকারের কাছে ছুটির দরখাস্ত করলেন জগদীশচন্দ্র। তিনি ইওরোপে যাবার
উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখলেন - ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগদান এবং সেখানে
নিজের গবেষণাপত্র উপস্থাপন। তারপর ইংল্যান্ড ও ইওরোপের প্রধান প্রধান গবেষণাগার
পরিদর্শন।
শিক্ষাবিভাগের প্রধান
স্যার আলফ্রেড ক্রফ্ট প্রথম দিকে জগদীশচন্দ্রের ওপর বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না।
কিন্তু তাঁর কাজের অগ্রগতি এবং ইংল্যান্ডে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা দেখে জগদীশের ইওরোপ
যাবার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য বাংলা প্রাদেশিক সরকারের সেক্রেটারিকে চিঠি দেন।
১৮৯৬ সালের ৬ই জুন তারিখের চিঠিতে তিনি লেখেন:
From the above, I hope,
it will be clear that Prof. Bose is an investigator of exceptional originality
and power, and that he deserves all the arrangements that the Government can
give him. In advocating his deputation to Europe on duty, I have in mind not
merely his own personal benefit, but also the resulting advantage to science."
শিক্ষাবিভাগের প্রধানের সুপারিশ নিয়ে স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির সাথে
দেখা করেন জগদীশচন্দ্র। স্যার ম্যাকেঞ্জি আগে থেকেই উচ্ছ্বসিত ছিলেন জগদীশের কাজের
ব্যাপারে। তিনি আলফ্রেড ক্রফ্টের চিঠিতে ৩০ জুন ১৮৯৬ তারিখে নিজের সুপারিশ লিখে
দিলেন:
"The Lieutenant Governor
strongly advocates the grant of the concession asked for. His Honour has done
what he could to encourage and advance Mr. Bose's researches, as he thinks it
is the duty of a great Government to do when it has a man of such exceptional
qualifications on its staff, and he gives much importance to Mr. Bose visiting
Europe and confering with the leaders of scientific inquiry there."
চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য
চিঠিটি পাঠানো হলো ভারত-সচিব হ্যামিলটনের অফিসে। লর্ড র্যালে আগেই হ্যামিলটন
সাহেবকে চিঠি লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্রের ব্যাপারে। এখন শিক্ষাবিভাগের প্রধান ও
ছোটলাটের সুপারিশ পেয়ে হ্যামিলটন জগদীশচন্দ্রের ছয় মাসের ডেপুটেশন মঞ্জুর করে
দিলেন। সরকারি খরচে ছয় মাসের জন্য ইওরোপ যাবার ব্যাপারে জগদীশচন্দ্রের আর কোন বাধা
রইলো না। ১৮৯৬ সালের ১৬ জুলাই ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলো:
"It has been settled that Prof. Bose should
proceed at once on deputation to England to be present at a meeting of the
British Association."
১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই এস এস
ক্যালোডোনিয়া জাহাজে করে বোম্বাই থেকে ইংল্যান্ড যাত্রা করলেন জগদীশচন্দ্র বসু ও
অবলা বসু।
No comments:
Post a Comment