সম্মান
ও সম্বর্ধনা, আশা ও হতাশা
জগদীশচন্দ্র
ফিরে এসেছেন ভারতবর্ষে নিজ কর্মক্ষেত্রে। ভারতবর্ষেই অধ্যাপনার সাথে সাথে নিজের
চেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় উদ্ভিদের সাড়া মাপার জন্য
নিজের ওয়ার্কশপেই তৈরি করেছেন স্ফিগমোগ্রাফ, ফটোমিটার, ফটোসিন্থেটিক বাব্লার
প্রভৃতি যন্ত্র। এ সব যন্ত্রপাতি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাধারণ বাঙালি
মিস্ত্রিরাই। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উপাদান হিসেবে তিনি সাধারণ চটের বান্ডিল, মানুষের
মাথার চুল, শজারুর কাঁটা পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।
১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে লংম্যান্স,
গ্রিন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের প্রথম বই 'Response
in the Living and Non-Living'। বইটির বৈজ্ঞানিক তথ্যের
পাশাপাশি ভাষার সাবলিলতারও ব্যাপক প্রশংসা পায়। রিভিউ অব রিভিউজ, ডেইলি ক্রনিকল,
ইলেকট্রিশিয়ান প্রভৃতি পত্রিকা ও জার্নালে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয় এই বইয়ের।
জগদীশচন্দ্র খুবই খুশি তাঁর বইয়ের পাঠকপ্রিয়তায়।
নিবেদিতাও পড়েছেন বইয়ের রিভিউগুলো।
বইয়ের যে সাহিত্যমূল্যের প্রশংসা করা হচ্ছে, ভাষাশৈলীর প্রশংসা করা হচ্ছে - তা তো
নিবেদিতারই প্রাপ্য। কিন্তু জগদীশচন্দ্র একবারও যোগাযোগ করেননি নিবেদিতার সঙ্গে। আশাহত নিবেদিতা বুঝতে চেষ্টা করলেন জগদীশচন্দ্রের রাগের কারণ। নিবেদিতা
মনে করেন যে কাজ করা হয়ে
গেছে তার রেশ
বহন করে চললে
সন্ন্যাসিনী হওয়া যায়
না। নিজেকে বোঝান - জগদীশের
জন্য যা তিনি
করেছেন তা কর্ম
এবং তার ফলের
আশা না করেই
তিনি করেছেন। তবুও কেন
জগদীশের ব্যবহারে তিনি কষ্ট
পাচ্ছেন!
নিবেদিতা তাঁর
কষ্টের কথা সারা
বুলকে জানান। সারা বুল
জগদীশের মায়ের মত। জগদীশ
এখনো সারা বুলের
অর্থ-সাহায্য নিচ্ছেন। জগদীশকে দিয়ে আমেরিকায়
একটি ও ইংল্যান্ডে
দুটি প্যাটেন্টের দরখাস্ত করিয়েছেন সারা। তিনি জগদীশকে বোঝালেন নিবেদিতার কষ্টের কথা। আর জগদীশও বুঝতে পারলেন নিবেদিতার সাহায্য ছাড়া তিনি
এখনো চলতে পারছেন
না। একদিন সকালে নিবেদিতার বাসায় গিয়ে দেখা
করলেন জগদীশচন্দ্র।
১৯০২ সালের ৪ জুলাই বিবেকানন্দ মারা যাবার পর নিবেদিতাকে
রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে
চলে আসতে হয়েছিল। নিবেদিতা ভারতের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেই রামকৃষ্ণ মিশন কতৃপক্ষ বিবেকানন্দের
মৃত্যুর পর নিবেদিতাকে আর সেখানে রাখতে চায়নি। নিবেদিতা বাধ্য হয়ে এক রুমের একটা
বাসা ভাড়া করে থাকেন।
অনেক কথাবার্তা বোঝাপড়ার পর নিবেদিতা
ও জগদীশের সম্পর্ক আবার আগের
মতো হয়ে গেল। সন্তানসম্ভবা অবলাকে সাহায্য করার জন্য
এগিয়ে এলেন নিবেদিতা।
১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি দিল্লীর দরবারে
সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক-বার্তা ঘোষণা উপলক্ষে বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি
হিসেবে ভারত সরকার জগদীশচন্দ্র বসুকে সি-আই-ই (Companionship of the Indian Empire) উপাধিতে ভূষিত
করেন। এ প্রসঙ্গে সেদিনই রবীন্দ্রনাথকে লেখেন জগদীশচন্দ্র:
"আজ কাগজে এক সংবাদ দেখিয়া
চক্ষুস্থির। আমার একটি পুচ্ছ সংযোগ হইয়াছে।"
দেশে ও বিদেশে
জগদীশচন্দ্রের সম্মানলাভ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে জগদীশচন্দ্রকে
সম্বর্ধনা দেয়ার আয়োজন করা হয়। সঙ্গীত-সমাজ কর্তৃক ২/২/১৯০৩ তারিখে আয়োজিত
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কুচবিহারের মহারাজা। অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রনাথ 'জয় তব
হোক জয়' গানটি রচনা করেছিলেন।
জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য প্রচুর সময়
দরকার। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনায় তাঁর গবেষণা
ব্যাহত হচ্ছে। দেশীয় রাজাদের সহায়তা আদায়ে নিবেদিতা এখনো চেষ্টা
করে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে অনুরোধ করেছিলেন জগদীশ বিজ্ঞান গবেষণায় ঠিক কী কী আবিষ্কার করেছেন, এখন কী করছেন, কীভাবে তাঁর কাজে
বাধা আসছে, কী কী লাগবে এই বাধা
দূর করতে ইত্যাদি
বিষদভাবে লিখে দিতে। ১৯০৩ সালের ১৮ এপ্রিল
বেশ লম্বা একটা চিঠি
নিবেদিতা লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে- যেখানে জগদীশ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার পর নিবেদিতা
তীব্র ভাষায় লিখেছেন, “হে ভারত! ভারতবর্ষ! তুমি কি তোমার শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাটুকুও দিতে পারো না? না আরামে দিন কাটাবার স্বাধীনতা নয়, সেই স্বাধীনতা যেখানে প্রচন্ড সংগ্রাম এবং উগ্রতম প্রতিযোগিতার মাঝে তোমার জন্যই যুদ্ধ করতে পারবে। যদি তুমি অক্ষম হও, যদি নিজের সন্তানকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার সামর্থ্য তোমার না থাকে, তাহলে কী দরকার তোমার ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার?”[1]
এদিকে অবলার সন্তান হবার
দিন ঘনিয়ে আসছে। সেটা নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত নিবেদিতা। উৎসুক মিস ম্যাকলাউডকে
নিবেদিতা লিখেছে:
“তোমাকে বলেছি কি, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে মিসেস বসুর সন্তান হতে যাচ্ছে! অপূর্ব নয় কি ব্যাপারটি!” “it will be the beginning of a new life and hope.”[2]
আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন:
“তোমার ভালবাসা বে-আনকে দিয়েছি, তোমাকে সে তার ভালবাসা জানাচ্ছে। সে প্রায়ই তোমার কথা বলে। ছোট্ট বউটি, বলব কি মাতৃত্বে একেবারে জ্যোতির্ময়ী। যেকোন দিনই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। তার দর্শন পেতে আমার ব্যাকুলতার কথা কি করে বোঝাই বল।”
এপ্রিলের শেষের
দিকে অবলার ভবিষ্যত সম্পর্কে আশার কথা
লিখেছেন নিবেদিতা:
কিন্তু
দুর্ঘটনা ঘটলো। ১৫ মে ১৯০৩ মধ্যরাতে
অবলা এক মৃত
কন্যাসন্তান প্রসব করলেন। তাঁর নিজের
জীবন নিয়েও টানাটানি চললো। এই দুঃসময়ে মায়ের মতো স্নেহের
পরশ নিয়ে অবলাকে
আগলে রাখলেন নিবেদিতা।
নিবেদিতা, সিস্টার ক্রিস্টিন, শার্লট সেভিয়ের, ও অবলা বসু
|
মাস তিনেক পরে কিছুটা মানসিক শান্তির জন্য জগদীশচন্দ্র
অবলাকে নিয়ে দার্জিলিং
বেড়াতে গেলেন। নিবেদিতা গেলেন তাঁদের সাথে। সেখানে
জগদীশের পেপার লেখার পাশাপাশি নিজের দ্বিতীয় বই “web of Indian life” শেষ করলেন নিবেদিতা। জগদীশচন্দ্র নিজের হাতে পান্ডুলিপির
উৎসর্গ পাতায় লিখে দিয়েছেন
নিবেদিতার গুরুর কথা।
১৯০৩-০৪ সালের মধ্যে উদ্ভিদ দেহে নানা
উত্তেজনার সাড়া পরিমাপ করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করার পাশাপাশি পাঁচটি
গবেষণাপত্র রচনা করে প্রকাশের জন্য পাঠান রয়েল সোসাইটিতে। কিন্তু গবেষণাপত্রগুলোতে
উল্লেখিত ‘response’ শব্দটি গ্রহণ
করতে চাইলেন না রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দাবি করলেন উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘response’ এর বদলে ‘reaction’ই হবে উপযুক্ত
বৈজ্ঞানিক শব্দ। কিন্তু জগদীশচন্দ্র একমত হলেন না। ফলে তাঁর পাঁচটি পেপারই রয়েল
সোসাইটি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়।
জগদীশচন্দ্র খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে লিখলেন:
"আমার
ধারণা ছিল এই কুৎসিত মতদ্বন্দ্ব বুঝি অনেকদিন শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি,
শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক মূল্যের ভিত্তিতে বিচার না করে ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের
উদ্দেশ্যে আমার নতুন নিবন্ধগুলিকে অবরোধ করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষের নিশ্চিত ধারণা,
আমি এই দূরান্তে নিরুত্তর বসে থাকবো। হয়তো তাই থাকতাম, কিন্তু এই অবস্থায় অত্যন্ত
দুঃখের সঙ্গে আমি আনুপূর্বিক ঘটনা সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছি।
বৈজ্ঞানিক আলোচনার পরিধির মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব কতখানি লজ্জাকর, তা
আমি গভীরভাবে অনুভব করছি।"
২৯/৬/১৯০৪ তারিখে
তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন:
"আমার মনটা একটু বিষণ্ণ আছে। ১৯টি
প্রবন্ধ লিখিয়াছি, তাহার একটিও প্রকাশিত হইতে পারিতেছে না। বই লিখিব মনে করি,
কিন্তু সেই পুরাতন লেখা এখন দেখিতে ইচ্ছা করে না। আমার যে প্রতিদ্বন্দ্বী, আমার
আবিষ্ক্রিয়া চুরি করিয়াছিল, সে একখানা পুস্তক লিখিয়াছে। তাহাতে লেখা আছে যে,
পূর্বে লোকে মনে করিত যে, কেবল sensitive plant সাড়া দেয়; "But these notions
are to be extended and we are to recognise that any vegetable protoplasm gives
electric response."
এখানে ভেজিটেবল
ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে বলা যায় যে জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছিলেন যে উদ্ভিদের
শরীরে নিজস্ব একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ আছে। কিন্তু ওয়েলারও একই আবিষ্কার করেছিলেন। কে
আগে করেছিলেন সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েস্টার্ন লুইজিয়ানার
অধ্যাপক সুব্রত দাসগুপ্ত এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন রয়েল সোসাইটিতে ১৯৯৮
সালে।[4]
নিবেদিতার বেশির ভাগ সময় অবলা ও
জগদীশচন্দ্রের সাথে কাটলেও হিন্দুধর্মের প্রসারের কাজে তিনি তখনো তৎপর। বুদ্ধগয়ায় মন্দির নিয়ে কিছুটা
রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছিল তখন। অনেককাল
থেকে হিন্দু মোহন্ত এই মন্দির
পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। লর্ড
কার্জন বৌদ্ধদের সমর্থন করেছেন। নিবেদিতা চাচ্ছিলেন সেখানে হিন্দুদের অধিকারই বজায় থাকুক। তাই তিনি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে হিন্দু মোহন্তের পক্ষে জনমত সৃষ্টি
করার
উদ্দেশ্যে ১৯০৪ সালের ৮ অক্টোবর
কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বুদ্ধগয়া
ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। ব্রাহ্ম হলেও
জগদীশচন্দ্র ও অবলাকে কিছুতেই আলাদা করে দেখতে পারেন না নিবেদিতা। তাই তিনি জগদীশচন্দ্র ও অবলাকেও
সাথে যাবার নিমন্ত্রণ করেছেন।
বুদ্ধগয়ায় যাবার কথা শুনে জগদীশচন্দ্রের
মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের কথা। চার বছর আগে (১৭/৯/১৯০০) রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন:
"বোধ করি মনে আছে,
আপনি আমাকে একটি ভ্রমণ সঙ্গ দানে প্রতিশ্রুত আছেন। কাশ্মীরে হোক, উড়িষ্যায় হোক,
ত্রিবাঙ্কুরে হোক, আপনার সঙ্গে ভ্রমণ করে আপনার জীবনচরিতের একটা অধ্যায়ের মধ্যে
ফাঁকি দিয়ে স্থান পেতে ইচ্ছে করি। আশা করি, বঞ্চিত করবেন না- সেই ভবিষ্যৎ কোন একটা
ছুটির জন্য পাথেয় সঞ্চয় করে রাখছি।"
জগদীশচন্দ্র নিবেদিতার সাথে কোন পরামর্শ
না করেই রবীন্দ্রনাথকে নিমন্ত্রণ করে বসলেন বুদ্ধগয়ায় যাবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ
দ্রুত আরো কিছু সঙ্গীসাথী জুটিয়ে নিলেন। রবীন্দ্রানাথের ডায়েরি
থেকে জানা যায়,
“১৯০৪ সালের ৮ অক্টোবর মিস নোবল (নিবেদিতা) বুদ্ধগয়ায় যাওয়ার জন্য একটা পার্টি করেছেন। আমরা সন্ধ্যায় গিরিডি থেকে ছাড়লুম।”
বুদ্ধগয়াগামী এই দলে জগদীশচন্দ্র, নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ
ছাড়া ছিলেন অবলা বসু,
স্বামী সদানন্দ, ব্রহ্মচারী অমূল্য (স্বামী
শঙ্করানন্দ), যদুনাথ সরকার, আনন্দমোহন বসুর দুই
মেয়ে, ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মা, মাহিন ঠাকুর ও সিস্টার
ক্রিস্টিন।
অনেক রাত পর্যন্ত নিবেদিতা, জগদীশ, রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধধর্ম ও তার
ইতিহাস নিয়ে আলোচনা
করেছেন। কিন্তু নিবেদিতার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হলো। রবীন্দ্রনাথ এবং
তাঁর সাথীরা সেখানে গিয়ে বৌদ্ধদের পক্ষে বললেন। হিন্দু ও ব্রাহ্মদের
মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হলো। নিবেদিতার পুরো
পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেলো
মূলত জগদীশচন্দ্রের কারণে।
এর কয়েকমাস পর খুব অসুস্থ
হয়ে যান নিবেদিতা। একমাস ধরে জ্বর। আর্থিক অনটন। ঘুপসি
বাসায় প্রচন্ড গরম। খুবই
সঙ্গীন অবস্থা তখন নিবেদিতার। সিস্টার ক্রিস্টিন একা পারছিলেন
না নিবেদিতাকে সেবাযত্ন করতে। খবর
পেয়ে ছুটে এলেন
অবলা ও জগদীশ। বোসপাড়া লেনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে নিবেদিতা
ও ক্রিস্টিনকে নিয়ে এলেন
তাঁদের বাড়ির পাশের একটা বাড়িতে।
এদিকে ইংল্যান্ডে জগদীশের গবেষণাপত্র
প্রকাশ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজ কতৃপক্ষ
ধরে নিয়েছেন জগদীশচন্দ্রের গ্রহণযোগ্যতা শেষ হয়ে গেছে। তাঁর সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দেয়ার
সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। জগদীশচন্দ্র ভাবলেন অপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলোকে বই আকারে
প্রকাশ করবেন। হাতের কাছেই আছেন নিবেদিতা। লেখার দায়িত্ব আগ্রহভরে কাঁধে তুলে
নিলেন তিনি। নিবেদিতা লিখতে শুরু করেছেন
জগদীশের দ্বিতীয় বই ‘Plant Response as a Means of Physiological Investigation’।
অবলার সেবায় আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে
শুরু করেছেন নিবেদিতা। কিন্তু
বেশিক্ষণ লিখতে পারেন না। নিবেদিতাকে খুশি করার জন্য একদিন একটা শেয়ালের
বাচ্চা নিয়ে এলেন
জগদীশ। ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখে এত মায়া লাগলো নিবেদিতার। দিনরাত শেয়ালের বাচ্চার সাথে খেলা
করেন। জগদীশ দেখলেন নিবেদিতা এখন কিছুটা
সুস্থ হয়েছেন। তিনি অস্থির
হয়ে উঠলেন কখন নিবেদিতা
আবার লেখার কাজ শুরু
করবে। সারাদিন যদি শিয়ালের
বাচ্চার পেছনেই কাটে তাহলে
লিখবে কখন?
জগদীশের অস্থিরতা
দেখে নিবেদিতা একদিন বললেন, “কাজ করতে পারবো এবার। শেয়ালছানাটাকে আজ বিকেলেই জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসবো।"[5]
নিবেদিতা দুর্বল
শরীরেই আবার কাজ
শুরু করলেন। জগদীশ খুব খুঁতখুঁতে
শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারে। নিবেদিতার কোন লেখা
পছন্দ না হলেই
তিনি রেগে বলেন,
“যে অধ্যায়টা লিখেছো তা আমি
ছিঁড়ে ফেলবো। যেটা লিখেছো
সেটা আমার ভাবনা
নয়।”
নিবেদিতাও ছেড়ে
কথা বলেন না,
“তা করলে আমি
এখনই চলে যাবো। আমি তো তোমার
চিন্তাগুলোকেই সহজভাবে লেখার চেষ্টা করছি।”
“আমার
চিন্তা ওরকম নয়।”
“তোমার
তো একেবারে ঠিক ঠিক
শব্দ হওয়া চাই-
আর কিছু নয়।”
ঝগড়া লেগে যায় নিবেদিতা ও জগদীশের। অবলা দু’জনকে শান্ত
করার চেষ্টা করেন। এভাবে
চলতে থাকে জগদীশের
দ্বিতীয় বই লেখার
কাজ।
১৯০৪ সালের শেষের দিকে জগদীশ
ও অবলা রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণে শিলাইদহের পদ্মার বোটে ছুটি
কাটাচ্ছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর
নিবেদিতা যান সেখানে
এবং ২ জানুয়ারি
১৯০৫ সবাই একসাথে
কলকাতায় ফিরে আসেন।[6]
সেসময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রাথমিক পরিকল্পনা গল্প আকারে
শোনালেন জগদীশকে। হিন্দুধর্মের কিছু বাড়াবাড়ি
বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতের সাথে
প্রচন্ড বিরোধ হয় নিবেদিতার।
অনেকদিন থেকেই রবীন্দ্রনাথের মতের সাথে
মিলছিল না নিবেদিতার। আর নিবেদিতাকেও খুব একটা পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ। আয়ারল্যান্ডের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার নাতনি নিবেদিতার ভেতর সুপ্ত আছে স্বাধীনচেতা বিপ্লবী মন। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন চলছে। নিবেদিতা
এসব ব্যাপারে উদ্বেলিত। চরমপন্থা মনোভাবকে তিনি সমর্থন
করেন। তাঁর গুরু
বিবেকানন্দও মনে করতেন
“প্রচন্ড ধাক্কা দরকার। মিনমিন করে গান
গেয়ে স্বাধীনতা আনা যাবে
না।” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন সত্য
তবে চরমপন্থার ঘোর বিরোধী
তিনি। তাই নিবেদিতার
সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুব একটা
মধুর ছিল না। এখানে নিবেদিতার স্ববিরোধিতা লক্ষ্যণীয়। রবীন্দ্রনাথ
স্বদেশী চেতনা যথেষ্ট উগ্র নয় বলে তাঁকে পছন্দ করেন না নিবেদিতা, অথচ
জগদীশচন্দ্রের যে স্বদেশী আন্দোলনের কোথাও কোন অংশগ্রহণ নেই তা যেন দেখেও দেখেন না
তিনি।
শিলাইদহে এসে পর্যন্ত নিবেদিতা দেখছেন অবলা ও রবীন্দ্রনাথ
খুব
প্রাণ খুলে কথা
বলছেন। তাঁদের দু’জনকে এতটা
খুশি দেখে নিবেদিতার
সহ্য হলো না। কেন সহ্য
হচ্ছে না তার যুক্তি খুঁজে না পেয়ে আরো ক্ষেপে গেলেন। তাঁর মনে
হতে
লাগলো রবীন্দ্রনাথের সাথে অবলার এত মাখামাখিতে হয়তো জগদীশও কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন। মিসেস সারা বুলকে ৫/১/১৯০৫
তারিখের একটা চিঠিতে
নিবেদিতা এসব লিখে
জানান।[7]
১৯০৫ সালের পুরোটাই লাগলো জগদীশের বইটা শেষ হতে। নিবেদিতা যে জগদীশের বই
লিখে দিচ্ছেন তার কোন
রেকর্ড থাকছে না দেখে
সারা বুল নিবেদিতাকে
পরামর্শ দিলেন জগদীশের সাথে এ ব্যাপারে লিখিত চুক্তি করতে।[8] কিন্তু নিবেদিতা জগদীশের ব্যাপারে অন্ধ। ২২ নভেম্বর ১৯০৫ তিনি
মিস ম্যাকলাউডকে লিখলেন, “We are gradually finishing the gigantic labour of the
Birn’s book of Botany.”[9]
১৯০৬ সালে তাঁর
দ্বিতীয় বই “Plan response: as a
means of physiological investigations” প্রকাশিত হলো
লংম্যান গ্রিন কোম্পানি থেকে। প্রথম বইয়ের মতো এবারও
বইয়ের কোথাও নিবেদিতার উল্লেখমাত্র নেই। জগদীশ
কেন নিবেদিতার এত পরিশ্রমের
কোন মর্যাদাই দিলেন না? তাঁর প্রতি
নিবেদিতার দুর্বলতাকে তিনি কাজে
লাগিয়েছেন, কিন্তু কোন কৃতজ্ঞতা
স্বীকার পর্যন্ত করেননি। এই ব্যবহার
কিছুতেই বিজ্ঞানীসুলভ ব্যবহার নয়।
কিন্তু তাতেও কিছু যায় আসে না
নিবেদিতার। জগদীশচন্দ্রের জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করাতেই তাঁর আনন্দ। তিনি আবার
লেগে গেলেন কাজে। ১৯০৬ এর পুরোটাই গেলো জগদীশের তৃতীয় বই লেখায়। শুধু লেখা নয়, বইয়ের জন্য গ্রাফ তৈরি, ছবি আঁকা সবই
করেছেন নিবেদিতা। বই লেখার মধ্যে অন্যান্য গবেষণাপত্রও লিখে দিয়েছেন জগদীশকে।
বিজ্ঞানীর কথা শুনে নিজের ভাষায় সেই বিজ্ঞান যুৎসই ভাষায় লেখা সহজ কথা নয়। এই কঠিন
কাজটি করেছেন নিবেদিতা দিনের পর দিন।
১৯০৭ সালে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের
তৃতীয় বই “Comparative
Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study”।
দুটো বইই ব্যাপক সাড়া
জাগায়। পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবোরেটরিতে জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষাগুলো অনুসরণ করেন
বিজ্ঞানীরা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষায়
জগদীশচন্দ্রের পরিকল্পিত 'অপ্টিক্যাল লিভার' যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। রাশিয়ার
তাস্খন্দ বিশ্ববিদ্যালয় জগদীশচন্দ্রে বইগুলো রুশ ভাষায় অনুবাদের জন্য অনুমতি
প্রার্থনা করে।
বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর থেকে নিবেদিতা অনেকটাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত
নিচ্ছেন নিজের কাজের ব্যাপারে। রাজনৈতিক
কাজে নিবেদিতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের খবর ব্রিটিশ
সরকারের হাতে আছে। নিবেদিতাকে যেকোন সময় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হতে
পারে। এই গ্রেফতার
এড়াতে
১৯০৭ সালের ১২ আগস্ট
নিবেদিতা কলকাতা ছেড়ে ইওরোপে
চলে গেলেন। ৬ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড পৌঁছলেন তিনি।
এদিকে জগদীশচন্দ্রের বই প্রকাশের পর
বিশ্বব্যাপী তাঁর যে সুনাম হচ্ছে তাতে ভারতের শিক্ষা-বিভাগে জগদীশচন্দ্রের গৌরব
আবার বেড়ে গেলো অনেক। বাংলার তৎকালীন লাট স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের আগ্রহে
জগদীশচন্দ্রের পদোন্নতি এবং বেতনবৃদ্ধি হয় এসময়।
জগদীশচন্দ্র আবার ইওরোপে যাবার
প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছুটির দরখাস্ত করলে কর্তৃপক্ষ বললেন তাঁকে ডেপুটেশানে পাঠানো
হবে ইওরোপে। কারণ তাতে সরকারের মুখ উজ্জ্বল হবে। কিন্তু ডেপুটেশানের অর্ডার আসতে
দেরি হচ্ছে দেখে জগদীশচন্দ্র ছুটি নিয়েই যাবেন ঠিক করলেন।
[2] Letters of sister Nivedita, Vol. II., editor Sankari Prasad Basu, Nobabharot publishers, Calcutta, 1982. Page
550
[4] Subrata
Dasgupta, Jagadis Bose, Augustus Waller and the discovery of 'vegetable
electricity', Notes Rec. R. Soc. Lond. 52 (2), 307-322 (1998).
[7] Letters of sister Nivedita,
Vol. II., editor Sankari Prasad Basu,
Nobabharot publishers, Calcutta, 1982. page 711
No comments:
Post a Comment