Saturday, 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ২০

20
স্টেশন রোডে হানিফের কাউন্টারে যখন পৌঁছলাম তখন সাতটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। আরো একটু আগে আসতে পারতাম। ছ’টায় বের হয়েছিলাম বাসা থেকে। কিন্তু গলির মুখে আসতেই দেখলাম একপাল ক্ষুদে দেশপ্রেমিক - হাতে আলপিন আর মাইক্রো-সাইজের কাগজের পতাকা হাতে নিয়ে সামনের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই হই হই করে এগিয়ে এল আলপিন উঁচিয়ে। কিছু বলার আগেই একজন দক্ষ ভলিবল প্লেয়ারের মত লাফ দিয়ে খামচে ধরলো আমার শার্ট, এলোমেলোভাবে গেঁথে ফেললো একটি পতাকা আমার বুকপকেটের একটু নিচে – কলজে বরাবর। দেখলাম ছেলেটার গায়ে একটি ঢলঢলে সাদা টি-শার্ট – সেখানে কালো চশমায় চোখ ঢাকা জিয়াউর রহমানের মুখ। কাছেই মাইকে বাজছে – “আমার আঙিনায় ছড়ানো বিছানো, সোনা সোনা ধূলিকণা। মাটির মমতায় ঘাস ফসলে, সবুজের আলপনা…” । চব্বিশতম স্বাধীনতা দিবসের আবাহন। দশ টাকার একটি নোটে সন্তুষ্ট হলো না তারা, আরো বিশ দিতে হলো তাদের দেশপ্রেমের ব্যারিকেড শিথিল করার জন্য। ছুটির সকাল বলেই হয়তো – একটা রিক্সাও নেই আশেপাশে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে একটু জোরেই হাঁটতে হলো। মিয়ার বাপের মসজিদের সামনে আরেক দল দাঁড়িয়ে আছে। শার্টে লাগানো ক্ষুদ্র পতাকা দেখিয়ে মোটামোটি সহজেই পার পেয়ে গেলাম। রিক্সা পেলাম সিরাজদৌল্লা রোডে গুলজার বেগম স্কুলের সামনে এসে।
সাতটার বাস ছাড়লো সাতটা বিশে। স্বাধীনতা দিবসে এটুকু দেরি করার স্বাধীনতা নিশ্চয় তাদের আছে। ছুটির দিনের সকালেও ঢাকা যাবার যাত্রীর সংখ্যা অনেক। মাত্র আড়াইশ কিলোমিটার পথ, লাগলো প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা। ফকিরাপুলে যখন নামলাম তখন তিনটা বেজে গেছে। ভ্যাবসা গরম, ঘাম আর ধুলোয় ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। এখানে সস্তা দামের হোটেলের অভাব নেই। যে কোন একটাতে উঠলেই হলো। হানিফের কাউন্টারের পাশেই যে হোটেলটা আছে সেটার দিকে পা বাড়াতেই ব্যাগে টান পড়লো। ঝাপটাবাজের পাল্লায় পড়লাম নাকি? আঁৎকে উঠে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি আশরাফ।
“কি রে আশরাফ, এই গরমের মধ্যে এরকম টাই পরে এখানে কী করিস তুই?”
আশরাফ আমার ক্লাসমেট। মাস্টার্স পরীক্ষার পর এই প্রথম দেখা।
“আমি দোস্ত এখানে কাজ করি। হানিফের কাউন্টারে। তুই কী করিস? ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছিস?”
“আমি শাহীন কলেজে জয়েন করেছি।“
“ঢাকা শাহীনে?” – বেশ উৎফুল্ল হয়ে জানতে চায় আশরাফ।
“চট্টগ্রাম শাহীনে।“
“ওহ্‌ চট্টগ্রামে!” কেমন যেন আশাহত হয় আশরাফ। আবার জিজ্ঞেস করে, “ইউনিভার্সিটিতে নেয়নি তোকে, না?”
আমি কোন জবার দিলাম না। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললাম, “তুই এখানে কতদিন ধরে আছিস?”
“এই তো কয়েক মাস হলো। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব হবার কথা আছে। যতদিন না হয়, এখানেই আছি। তুই কি আজকেই এলি?”
“হ্যাঁ, তোদের এই বাস থেকেই তো নামলাম।“
“উঠবি কোথায়?”
“হোটেলে।“
“ঠিক আছে দোস্ত। দেখা করিস। আমি অফিসে আছি সন্ধ্যা পর্যন্ত।“
আশরাফ বাসের কন্ডাক্টরের সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যায়। আমি উঠে আসি হোটেলের বারান্দায়।
রুমে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে গেলাম। হোটেলের নিচের তলায় রেস্টুরেন্টে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের দিকে। রাস্তায় মানুষের ঢল সেখানে। স্বাধীনতা দিবসের চেয়েও বড় হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণ-আদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকী। আমি যখন কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন ভাষণ দিচ্ছেন আসাদুজ্জামান নূর। মঞ্চে বসে আছেন জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল, শেখ হাসিনা, শওকত ওসমান। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে যে গণ-আদালত গঠিত হয়েছে – জাতীয় গণ তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে – তার রিপোর্ট হস্তান্তর করা হলো আজ। গণ তদন্ত কমিশনের সদস্যদের নাম বলা হলো – শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সরওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, শফিক আহমেদ, আবদুল খালেক, সদরুদ্দিন। এখানে এসে কেমন এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছি। অনুষ্ঠান শেষে দেশের জন্য ভালোবাসা, রাজাকাররা মন্ত্রী হয়েছে এজন্য ক্ষোভ, নিজে কিছু করতে পারছি না এজন্য হতাশা – সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা ঝিমধরা অনুভূতি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
লবিতে ঢুকে প্রায় কোনদিন না তাকিয়েই চলে যাচ্ছিলাম সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত গলার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“স্যার, আপনি কখন এসেছেন?”
“কী রে মতিন, তুমি এখানে?”
শাহীন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের মতিন। মনে হলো সে প্রতিদিন কয়েক বর্গ ইঞ্চি করে মোটা হচ্ছে। এখনই তাকে বাংলা সিনেমার ভিলেন-থেকে-নায়ক জসিমের মত লাগছে।
“আমরা বিএনসিসির ক্যাম্পিং-এ এসেছি স্যার। শংকর স্যারও এসেছেন।“
দেখলাম শাহীন কলেজের অনেক ছাত্র লবিতে। শংকর স্যার কোত্থেকে ছুটে এসে হ্যান্ডশেক করলেন। তাঁর হ্যান্ডশেক করার পদ্ধতিটা অভিনব। তিনি হাত দিয়ে আমার বুড়ো আঙুল চেপে ধরেন।
“আপনারা কি এই হোটেলে উঠেছেন সবাই?”
“না, আমরা ক্যাম্পিং সেরে আজ সকালে স্বাধীনতা দিবসের প্যারেড করে এখন ফিরে যাচ্ছি চিটাগং-এ। একটু পরেই বাসে উঠে যাবো। আপনি কখন এসেছেন? ফিরবেন কখন?”
“আমি এসেছি আজ বিকেলে। পরশু চলে যাবো।“
শংকর স্যার আর মতিন গং-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে এলাম। কাল সকালে যেতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। ওটা নাকি সচিবালয়ের ভেতরে।
>>>>>>>
“আপনার পাসটা দেখান।“
সকালবেলা সচিবালয়ের গেট দিয়ে ঢুকে হন হন করে চলে যাচ্ছিলাম ভেতরে। আরো অনেকেই যাচ্ছেন। তাঁদের কাউকে থামায়নি পুলিস। কিন্তু আমাকেই হাত দেখিয়ে থামিয়ে পাস দেখতে চাইলেন একজন মধ্যবয়সী পুলিস। হাতে বন্দুক কিংবা লাঠি কিছুই নেই। মনে হচ্ছে নিরীহ টাইপের পুলিস।
“পাস? পাস তো নেই। আমাকে আসার জন্য টেলিগ্রাম করা হয়েছে। এই যে দেখেন।“ – হাতের ব্যাগ থেকে খামটা বের করার আগেই পুলিস বললেন, “ওটা নিয়ে ওই গার্ড রুমে যান। সেখান থেকে পাস নিয়ে আসেন।“
গেটের পাসেই হাতের বামদিকে বড় গার্ডরুম। আমি সেদিকে খেয়াল না করে চলে গিয়েছিলাম। বেশ ভীড় এখানে। এখনো মাত্র ন’টা বাজে। এর মধ্যেই মনে হচ্ছে কয়েক শ মানুষ এসে ভীড় করেছে এই রুমের ভেতরে, আশেপাশে। কয়েকটি কাউন্টারে পাস ইস্যু করা হচ্ছে। লাইন ধরার নিয়ম আছে কি না জানি না। তবে কেউ লাইনে নেই। সবাই কাউন্টারের সামনে মৌমাছির মত ভীড় করে আছে। এই ভীড় ঠেলে কাউন্টারের কাছে যেতে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট লেগে গেল। আমি আশংকা করেছিলাম যে টেলিগ্রামে যে তারিখের মধ্যে আসতে বলা হয়েছে, সেই তারিখের পরে এসেছি বলে আমাকে ঢুকতেই দেবে না। আমি যে টেলিগ্রাম অনেক পরে পেয়েছি তা প্রমাণ করার জন্য পোস্ট-মাস্টারের কাছ থেকে লেখা নিয়ে এসেছি। দিদির অফিসের ঠিকানায় টেলিগ্রামটা এসেছে। সেই ঠিকানা আমিন জুট মিল পোস্ট অফিসের আওতাভুক্ত। বৃহস্পতিবার কলেজ থেকে ফিরে সেই পোস্ট-অফিসে গিয়েছিলাম। বৃদ্ধ পোস্টমাস্টার খুব ভালোমানুষ। তিনি নিজের হাতে টেলিগ্রামটির নিচে লিখে দিয়েছেন ওটা কখন সেই পোস্ট-অফিসে পৌঁছেছে এবং ডেলিভারি দেয়া হয়েছে। তারপর দস্তখত ও সিলমোহর দিয়েছেন। তাঁর ধারণা শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকেই এটা দেরি করে পাঠানো হয়েছে। যাই হোক, সচিবালয়ের পাস-কাউন্টার এ নিয়ে কোন প্রশ্ন আমাকে করলেন না। টেলিগ্রামটিতে একটি সিল মেরে দিলেন। আর একটি প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া পুরনো সরকারি ফর্মে আমার নাম ঠিকানা উদ্দেশ্য সব লিখে ২৭ মার্চ ১৯৯৪ রবিবার – একদিনের জন্য সচিবালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলো।

সচিবালয়ের ভেতরের জগত সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। দেখলাম শত শত মানুষ এখানের বিভিন্ন বিল্ডিং-এর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছেন। কেউ অনেক ব্যস্ত, কেউ আবার খুব ধীরস্থির। এই মানুষগুলির প্রত্যেকে এসেছেন বিভিন্ন কাজে, কিংবা তদ্বির করতে। বিশালাকৃতির অসংখ্য বিল্ডিং আকাশের দিকে উঠে গেছে বিশ পঁচিশ তলা। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপন পদ্ধতি কেমন হবে – এই সচিবালয়ে বসে তার রূপরেখা তৈরি করেন কতিপয় আমলা।  কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানা গেল। লিফ্‌ট ধরে আঠারো তলায় উঠে এলাম। এখানেই স্কলারশিপ সংক্রান্ত অফিস। অফিসের বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন দেশের সরকারি বৃত্তির নোটিশ সাঁটানো আছে। এই নোটিশগুলো কি কোথাও প্রকাশিত হয়? আমি তো শুধুমাত্র ভারত সরকারের বৃত্তির নোটিশটা দেখে দরখাস্ত করেছিলাম। এখানে তো দেখছি প্রায় চল্লিশটি দেশের সরকারি বৃত্তির নোটিশ লাগানো আছে। এগুলোর খবর কি আমার মত কারো পক্ষে এখানে এসে জেনে যাওয়া সম্ভব? ভারত সরকারের পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনোনীত প্রার্থীদের নামের তালিকাও দেয়ালে সাঁটানো আছে। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে আমার নাম আছে দেখলাম। সেই নোটিশেও লেখা আছে মনোনীত প্রার্থীকে ১৮ মার্চের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হবে। কোথায় সেই ফর্ম?
অফিসের করিডোরে ঝাপসা অন্ধকার। মেঝেতে দেয়ালে পানের পিক শুকিয়ে আছে। মোজাইক করা মেঝে সম্ভবত তৈরি হবার পর আর একবারও মোছা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থা দেখেই সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা করাটা মনে হয় উচিত হবে না। মন্ত্রণালয়ের মেঝে ঝকঝকে হয়ে উঠলেই কি শিক্ষাব্যবস্থা রাতারাতি বদলে যাবে?
অফিসের ভেতর উঁকি মারলাম। রুমের ভেতর টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ছাদ থেকে ঝুলন্ত হোল্ডারে বাল্ব লাগাচ্ছেন। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আরেকজন নাতিদীর্ঘ ভদ্রলোক উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছেন বাল্ব ঠিকমত লাগানো হচ্ছে কি না। আমি রুমে ঢুকার পরও আমার দিকে এই দু’জনের কেউ ফিরেও তাকালেন না। একটু পরে বাল্ব লাগানো লোক টেবিল থেকে নেমে ভেতরের আরেকটা রুমে চলে গেলেন। এবার নাতিদীর্ঘ ভদ্রলোক উপরের দিকে তাকানোর মত কিছু না পেয়ে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কী চান?”
আমি বেশ গুছিয়ে পুরো কাহিনি বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। বলতে শুরু করলাম, “উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে ভারত সরকারের একটা স্কলারশিপ…” ভদ্রলোক আমার কথার বাকিটা শোনার কোন আগ্রহ না দেখিয়ে দরজার কাছে এসে হাঁক দিলেন, “হিরন মিয়া, হিরন মিয়া, হি-র-ন্মি-ইয়া—”
“স্যার স্যার জ্বি স্যার, আমি এখানে স্যার’ – বলতে বলতে একজন লোক হরিণের মত ছুটে এলেন। বুঝতে পারলাম ইনিই হিরন মিয়া। নাতিদীর্ঘ ভদ্রলোক কথাবার্তাও খুব পছন্দ করেন বলে মনে হলো না। তিনি আমার দিকে আঙুল তুলে হিরণ মিয়াকে ইশারা করে ভেতরের রুমে ঢুকে গেলেন। সামনের রুমের টেবিলের উপরে চেয়ারটি তখনো রয়ে গেছে।
আমি তাকালাম হিরণ মিয়ার দিকে। মাঝারি উচ্চতার কালো পাতলা মধ্যচল্লিশের বুদ্ধিমান মানুষ। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তিনি আমার দিকে খুবই তাচ্ছিল্যের একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলেন, “কী চাই?”
“স্কলারশিপের ফর্ম”
“কোন্‌ দেশের?”
“ভারতের”
“টেলিগ্রাম পেয়েছেন?”
“জ্বি”
“নাম কী?”
“আমার নাম?”
“জ্বি”
“প্রদীপ দেব।“
“প্রদীপ দেব। বাবু। উঁ। ডেট তো চলে গেছে।“
“আমাকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে ডেট চলে যাবার পরে।“
“সেটা তো আমি জানি না।“
“তাহলে কে জানে?”
“কেউ জানে না।“
“তাহলে?”
“তিন শ টাকা লাগবে।“
“ফরমের দাম?”
“না, ফরম ফ্রি। দেরি করে এসেছেন। আমি ফর্ম দিচ্ছি। তার জন্য খরচ করবেন না? আমি ফর্ম না দিলে তো আপনি ফর্ম ফিল আপ করতে পারবেন না। স্কলারশিপ পাবেন না। স্কলারশিপের চেয়ে তিন শ টাকা বেশি হলে দেয়ার দরকার নেই।“
মাথার ভেতর কেমন যেন যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। টাকার অংক শুনে নয়, টাকা দিতে হবে শুনে। ফরমের দাম নয়, হিরণ মিয়া আমাকে দয়া করে ফরম দেবেন সেজন্য তাঁকে সম্মানী দিতে হবে – যার আসল নাম হলো ঘুষ। ডেট চলে গেছে বলেই টাকা দিতে হচ্ছে? ডেট থাকতে এলে দিতে হতো না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?”

শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিবের অফিসে দাঁড়িয়ে কোন রকম রাখঢাক ছাড়াই টাকা গুণে নিলেন হিরণ মিয়া। তারপর টেবিলের পাশে রাখা এলোমেলো কাগজপত্রের স্তূপ থেকে একটি নীল রঙের বুকলেট বের করে আমার হাতে দিলেন। এটাই ফরম।
“আজ বিকেলের মধ্যে এই ফর্ম পূরণ করে পাঁচ কপি জমা দেবেন।“
ফর্ম পূরণ করা, ফটোকপি করা ইত্যাদি করতে হলে হোটেলের রুমে গিয়ে করা উচিত। দ্রুত চলে এলাম হোটেলে। ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে দেখলাম বিকেলের মধ্যে পূরণ করে জমা দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ডাক্তারি সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির সিলেবাসের কপি পর্যন্ত অনেক কিছুই লাগে সেখানে। হিন্দি আর ইংরেজিতে লেখা ফর্মটি মনে হচ্ছে একশ বছর আগে ডিজাইন করা। সব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে করতে রাত হয়ে যাবে। সিলেবাসের কপি পাবার একটাই রাস্তা আছে – অজিতের মেসে গিয়ে খোঁজ নেয়া। যদি তার সিলেবাসটা ফেলে না দিয়ে থাকে।
আবার ছুটলাম সচিবালয়ে। সারাদিনের জন্য পাস আছে। তাই কোনদিকে না তাকিয়েই সোজা চলে গেলাম শিক্ষার আঠারো তলায়। হিরণ মিয়া তার অফিসের পাশে একটা রুমে বসে চা খাচ্ছেন। সেই রুমটাকে চায়ের দোকান বানিয়ে ফেলেছে কর্মচারীরা।
“ভাইসাব, ফর্ম তো বিকেলের মধ্যে ফিল আপ করা সম্ভব না। এটা জমা দেয়ার শেষ তারিখ কখন?”
“দেখেন, যত তাড়াতাড়ি দেবেন, ততই ভালো না?”
“জমা কি এখানে দিতে হবে?”
“না, না  - জমা দেবেন ধানমন্ডিতে – নায়েম অফিসে।“
আবার হোটেলে চলে এলাম। কাগজপত্রের লিস্ট তৈরি করে চলে গেলাম কাকরাইলে আমার বন্ধু অজিতের অফিসে। সেখান থেকে তার মেসে গিয়ে সিলেবাসের কপি নিলাম। আরো সব কাগজপত্র জোগাড় করে সারা রাত জেগে ফর্ম রেডি করলাম। সকালে সব ফটোকপি করে পাঁচ সেট দরখাস্ত জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে জমা দিতে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম জমা দিতে গিয়ে শুনতে হবে যে ডেট চলে গেছে। কিন্তু শিক্ষাকর্মকর্তা বেশ হাসিখুশি। তিনি কিছু বললেন না দেখে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কি দেরি করে ফেলেছি?”
“না, আরো তিন দিন সময় আছে ফর্ম জমা দেয়ার।“
“আপনি কি দয়া করে একটু দেখে নেবেন, সব ঠিক আছে কি না।“
“আরে ওসব দেখতে হবে না। সব ঠিক আছে। আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আপনার নাম পাঠিয়ে দিয়েছে সেখানে। আমরা এখান থেকে আপনার দরখাস্ত পাঠিয়ে দেবো। তারা আপনাকে চিঠি দিয়ে জানাবে যে আপনি বৃত্তি পেয়ে গেছেন। হাহাহা। এবার ইন্ডিয়া যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।“
বাহ্‌ মনে হলো – তাই তো, এবার তাহলে চলে যাবো উচ্চশিক্ষা নিতে। মনে মনে ভাবলাম – হিন্দিটা কি শিখে ফেলবো নাকি?
>>>>>
কলেজে ফিরে কাউকে কিছু বললাম না। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি – সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে তবেই বলবো। সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দিদি এলো। খুবই রেগে আছে সে আমার ওপর। কারণ কী? সে প্রায় গর্জন করে বললো, “তুই ঢাকায় গিয়ে ফর্ম জমা না দিয়ে চলে এসেছিস? আমাকে বলিসও নি?”
“আমি তো ফর্ম জমা দিয়ে এসেছি।“
সে চিঠি দেখালো। ইন্ডিয়ান হাই কমিশন থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাদের শিক্ষা অফিসার জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের কাছে আমার নাম পাঠিয়েছে, কিন্তু আমার কোন দরখাস্ত তারা পায়নি। এসবের অর্থ কী? আমি নিজের হাতে পাঁচ কপি দরখাস্ত নায়েম অফিসে জমা দিয়ে এসেছি। ভারতীয় হাই কমিশনে জমা দিতে বললে তো সেখানে গিয়েও জমা দিয়ে আসতে পারতাম। এখন কী করা? ইন্ডিয়ান হাই কমিশন বলছে তাদের কাছে দরখাস্ত পাঠাতে।
সেদিন রাতেই ঢাকায় রওনা হয়ে গেলাম। কলেজ থেকে ছুটি নেয়াও হলো না। এবার নির্ঘাত বেতন কাটা যাবে।
>>>>>>>>>
ভারতীয় হাই কমিশনের শিক্ষাবিভাগে খুব একটা ভীড় নেই এই সকালবেলা। সামনের ঘরে বসে আছেন দাসবাবু। তিনি চিঠিটি দেখে বললেন, “ভেতরের ঘরে মুখার্জি বাবুর কাছে যান।“
দাসবাবুর ঘর পার হয়ে মুখার্জি বাবুর ঘরে ঢুকলাম। দেয়ালজুড়ে কাগজপত্রের স্তুপ, পুরনো তহসিল অফিসের মতোই এলোমেলো। মুখার্জিবাবু আমার ফরমটি উল্টেপাল্টে দেখলেন। বললেন, “সব ঠিক আছে।“
নায়েমের অফিসারও বলেছিলেন ‘সব ঠিক আছে’। কিন্তু পরে দেখা গেছে কিছুই ঠিক নেই।
মুখার্জিবাবু বললেন, “এখন আর চিন্তা নেই। আপনার নাম আমরা পেয়েছি, এবার ফর্ম পেলাম। এখন আমরা এই ফর্ম পাঠিয়ে দেবো দিল্লি। তারা আপনার স্কলারশিপ অ্যাপ্রুভ করে দেবে। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এই জুলাই থেকেই আপনি সেখানে পড়াশোনা শুরু করতে পারবেন।“
ভালো কথা, আশার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। মুখার্জিবাবুর কথা প্রায় বিশ্বাস করে ফেললাম। তাঁর রুম থেকে বের হয়ে দাসবাবুর পাশ দিয়ে আসার সময় দাসবাবু বললেন, “বসুন, বসুন, একটু কথা বলি।“
দাসবাবু নিজের থেকে আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন – আমি তো মহাখুশি। ছোটখাট শরীরের পেটমোটা টাকপড়া প্রায় চল্লিশের দাসবাবু। টাকে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “বুঝলেন প্রদীপবাবু, আপনার নাম আমরা পেলাম, অথচ আপনার ফর্ম পেলাম না। ভাবলাম নিশ্চয় কোথাও কোন গন্ডগোল হয়েছে। সাধারণত এরকম ব্যাপার হলে আমরা জাস্ট ইগনোর করি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমরা তা করলাম না। ভাবলাম ইচ্ছে করেই হয়তো তারা আপনার ফর্ম পাঠায়নি। তাই সরাসরি আপনাকে চিঠি দিলুম।“ – দাসবাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি অবতার হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এই অফিসে শুধুমাত্র আমার মত মানুষদের সাহায্য করার জন্য। তাহলে স্বয়ং দাসবাবু যেখানে আমার সহায়, সেক্ষেত্রে দিল্লি তো মোটেই দূরে নয় আমার জন্য!
“আপনার ঠিকানায় দেখছি আছে কেয়ার অফ প্রভাতী দেব। আপনার মা?”
দাসবাবুর জানার আগ্রহে আমি বিগলিত হয়ে যাচ্ছি। বললাম, “আমার দিদি”।
“ও হ্যাঁ, দিদি। ফিশারিজ কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসে আছেন। তাই না? আচ্ছা শুনেছি চট্টগ্রামে বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। মাছ ধরার খুব শখ আমার। কোন ব্যবস্থা করতে পারবেন?”
“আমাদের তো বড় কোন পুকুর নেই।“
“আমার ইচ্ছে কী জানেন? কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে যাবো। মাছ ধরবো। আর বড় বড় মাছ নিয়ে বাড়িতে ফিরবো। আপনার দিদিকে বলে দেখুন না, কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না।“
দাসবাবু চোখের সামনে এতক্ষণ অবতার হয়ে বসেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি মাছের মত হা করে আছেন বৃত্তির টোপ দেখিয়ে মাছ খাবার জন্য। মনটা বিস্বাদে ভরে গেলো। দাসবাবু পরোক্ষভাবে ঘুষ চাচ্ছেন। দাসবাবুর মাছ শিকারে উৎসাহ দেখানোর কোন প্রবৃত্তি আমার হয়নি।
দিল্লি থেকে কোন চিঠি আসেনি কোনদিন।
কলেজে প্রিন্সিপাল স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার স্কলারশিপের কী হলো?”
“হয়নি স্যার।“
“কোন সমস্যা নেই। স্কুল বিতর্কের চিঠি চলে এসেছে। কাজে লেগে পড়ুন। আপনাকে বিতর্ক কমিটিতে রাখা হয়েছে।“
দেখলাম রিফাৎ আরা ম্যাডামের ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসির রেখা। যেন তিনি মনে মনে বলছেন, “এবার তুই পালাবি কোথায়?”

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts