Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ১০



সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানে রামন

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্স বা আই-এ-সি-এসকে সংক্ষেপে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশান বলে সবাই। সেই সময় এককালীন পাঁচশ রুপি চাঁদা দিলে অ্যাসোসিয়েশানের আজীবন-সদস্য (Life Member) হওয়া যেতো। অ্যাসোসিয়েশানের সেক্রেটারি অমৃতলাল সরকার ১৯০৭ সালের বার্ষিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, "আগস্ট মাসে মি. সি. ভি. রামন, এম.., এবং বাবু অমূল্য রতন দত্ত পাঁচশ রুপি চাঁদা দিয়েছেন অবজারভেটোরি ফান্ডে এবং অ্যাসোসিয়েশানের আজীবন-সদস্যপদ লাভ করেছেন।"[1]
            কলকাতায় আসার পর এই প্রথম রামনের মনে হলো তিনি প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। গবেষণাকাজ শুরু করলেন তিনি। ঝড়ের মতো কাজের গতি তাঁর। তাঁর দৈনন্দিন রুটিন মোটামুটি এরকম: ভোর সাড়ে পাঁচটায় অ্যাসোসিয়েশানে এসে গবেষণা শুরু করেন, পৌনে দশটায় বাসায় এসে দ্রুত স্নান সেরে গপাগপ কিছু খেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে অফিসে চলে যান। ট্রামে যেতে অনেক সময় লাগে বলেই সময় বাঁচানোর জন্য এই ব্যবস্থা। পাঁচটায় অফিস ছুটির পর বাসায় না এসে সোজা চলে যান অ্যাসোসিয়েশানের ল্যাবে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে নটা থেকে দশটা বেজে যায়। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনের পুরোটাই কাটে অ্যাসোসিয়েশানের ল্যাবে। মাদ্রাজে থাকতে যে দুটো পেপারের কাজ এগিয়ে রেখেছিলেন রামন, সেদুটো দ্রুত শেষ করে পাঠিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডে। একটি পাঠিয়েছেন বিখ্যাত নেচার জার্নালে, অন্যটি ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। ১৯০৭ সালের মধ্যে দুটো পেপারই প্রকাশিত হলো।[2] এই প্রথম বিশ্বের বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন আই-এ-সি-এস এর কথা। এই প্রথম অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণার কোন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো, তাও বিশ্বের সবচেয়ে নামী বিজ্ঞান-সাময়িকীতে।
            রামন যে তাঁর সবচেয়ে ভালোবাসার বিষয় বিজ্ঞান গবেষণা করার উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেয়েছেন তাতে খুব খুশি সুব্রাহ্মণ্য। কিন্তু শুরুতেই একেবারে পাঁচশ রুপি চাঁদা দিয়ে দেয়াটা কতটা বিবেচনার কাজ হয়েছে তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। কথা ছিল দুই ভাই মিলে বাবার ঋণের টাকা শোধ করবেন। এখন রামন যদি এরকম করে তাহলে তো পুরো ঋণটাই নিজের ঘাড়ে এসে পড়বে। সুব্রাহ্মণ্য এব্যাপারে বেশ হিসেবি। তিনি রামনের সাথে কথা বললেন। রামন তাঁকে আস্বস্ত করলেন যে যেভাবেই হোক তিনি বাবার ঋণের অর্ধেক শোধ করবেন।
            রামনের বাবা প্রতি মাসে একবার বিশাখাপট্টম থেকে কলকাতায় এসে ছেলেদের দেখে যান। সম্প্রতি এসে তিনি সুখবর শুনলেন। রামন গবেষণা করছে দেখে খুশি হয়েছেন। তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছেন তিনি দাদা হতে চলেছেন জেনে। সুব্রাহ্মণ্যের স্ত্রী সীতা সন্তানসম্ভবা। ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে সুব্রাহ্মণ্য ও সীতার প্রথম কন্যা রাজলক্ষ্মীর জন্ম হয়। দুবছর পর ১৯১০ সালের অক্টোবরে জন্ম নেয় তাদের প্রথম পুত্র চন্দ্রশেখর। এই চন্দ্রশেখরই পৃথিবীবিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে।
            সুব্রাহ্মণ্য ও সীতার সংসার বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে হচ্ছে। এসব দেখে রামনের কোন প্রতিক্রিয়াই হয় না। কেবল লোকমের মন খারাপ হয়ে যায়। তার স্বামী এখনো ব্রহ্মচর্য পালন করছে। এই ব্রহ্মচর্য কখনো শেষ হবে কিনা তিনি জানেন না। বিয়ের পর থেকেই দেখছেন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টা রামন ঘরের বাইরে থাকেন। লোকম শুরুতে মান-অভিমান করলেও বুঝতে পারলেন রামনের কিছুই যায় আসে না তাতে। রামনের কাছে বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার তুলনায় লোকসুন্দরী বা ঘর-সংসার নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। পরবর্তী তেষট্টি বছরের বিবাহিত জীবনে লোকসুন্দরী প্রতিদিনই তাঁর স্বামীকে তুলনা করেছেন সাইক্লোনের সাথে - যাকে বেঁধে রাখা যায় না।
            রামনের বাবা একবার বিশাখাপট্টম থেকে সুব্রাহ্মণ্যর জন্য একটি বেহালা নিয়ে এসেছিলেন। সুব্রাহ্মণ্য যখন বেহালাটি বাজাচ্ছিলেন রামন খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করলেন কীভাবে তারের সাথে ছড়ের ঘর্ষণে সুর সৃষ্টি হচ্ছে। কখন উচ্চ কম্পাঙ্কের তীক্ষ্ম সুর, আর কখন নিম্ন কম্পাঙ্কের চড়া সুর তৈরি হচ্ছে। হাতের আঙুল কীভাবে তারের ওপর সুরের নিয়ন্ত্রণ করছে - সব দেখতে দেখতে অনেক রকমের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারণা পেলেন রামন। অ্যাসোসিয়েশানের ল্যাবে বসে একে একে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন সব।


আশুবাবু

      
অ্যাসোসিয়েশানের প্রধান সহকারী আশুতোষ দে ওরফে আশুবাবু অ্যাসোসিয়েশানেই বাস করতেন। রামন যখনই অ্যাসোসিয়েশানে যেতেন আশুবাবু দরজা খুলে দিতেন, রামনের গবেষণায় সহায়তা করতেন। ১৯০৭ সাল থেকে পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে রামন যতদিন অ্যাসোসিয়েশানের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি রামনের সাথেই ছিলেন। রামন বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে আশুবাবুর নাম দিয়েছেন সহ-লেখক হিসেবে। শুধু তাই নয়, রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ একটা গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছে যার একমাত্র লেখক আশুতোষ দে অর্থাৎ আশুবাবু।[3] আশুবাবুর পেপার পড়ে কেউ ধারণাও করতে পারবেন না যে তিনি কোনদিন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। রামন প্রমাণ করেছেন বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির চেয়ে মনের ভেতরের ইচ্ছা ও উৎসাহের গুরুত্ব অনেক বেশি।
            বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের সাথে যন্ত্রপাতি তৈরি ও মেরামত করার জন্য ওয়ার্কশপ থাকার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন রামন একেবারে প্রথম থেকেই। তিনি অ্যাসোসিয়েশানে যন্ত্রপাতির ওয়ার্কশপ গড়ে তুললেন। নিজের পরীক্ষণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার হয় তার বেশিরভাগই সেখান থেকে খুব কম খরচে তৈরি করার ব্যবস্থা করা হলো। এর জন্য অভিজ্ঞ দেশীয় কারিগর নিয়োগ দিলেন তিনি।
            অ্যাসোসিয়েশানের সেক্রেটারি অমৃতলালের কাছ থেকে পূর্ণ-স্বাধীনতা পেয়েছেন রামন। একজন গবেষকের জন্য এই স্বাধীনতার খুবই দরকার আছে বলে মনে করেন রামন। একজন গবেষক কী নিয়ে গবেষণা করবেন, কেন করবেন, কীভাবে করবেন তা ঠিক করবেন গবেষক নিজেই। তার জন্য যা যা দরকার হবে তা সাধ্যমতো সরবরাহ করা উচিত বলে বিশ্বাস করেন রামন। অ্যাসোসিয়েশানে রামন মনের মতো পরিবেশ পেয়ে অতি দ্রুত গবেষণার ফল পেতে শুরু করেছেন। পরের দু'বছরের মধ্যে আরো সাতটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হলো নেচার ও ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।
            তখনকার দিনে বিদেশে প্রবন্ধ পাঠানোর প্রধান উপায় ছিলো ডাকযোগে পাঠানো। কলকাতা থেকে লন্ডনে জাহাজে করে সেটা পৌঁছাতে কয়েক মাস লেগে যেতো অনেক সময়। রামন ছোট ছোট প্রবন্ধগুলো টেলিগ্রাম করে পাঠিয়ে দিতেন। সেই সময় তিনি চাকরি থেকে যে বেতন পেতেন তাতে টেলিগ্রামের খরচের জন্য কোন চিন্তাই করতে হতো না তাঁকে।
            রামন ভেবে দেখলেন একটা পূর্ণাঙ্গ গবেষণাকেন্দ্রের নিজস্ব জার্নাল থাকা দরকার। উপমহাদেশে তখনো কোন গবেষণা-সাময়িকী প্রকাশিত হতো না। দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-পত্র প্রকাশের জন্য কোন জার্নাল নেই। দেশের বাইরে পাঠালে প্রকাশিত হতে অনেক সময় লেগে যায়। রামন উদ্যোগ নিয়ে অ্যাসোসিয়েশানের বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। এই বুলেটিনে তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন নিয়মিতভাবে। ১৯১৭ সালে এই বুলেটিন প্রসিডিংস-এ পরিণত হয় এবং আরো পরে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স-এ রূপান্তরিত হয়।



[1] IACS Annual Report 1907
[2] Raman, C.V., Newton's rings in polarized light, Nature, 1907, Vol.76, p637
    Raman, C.V., The curvature method of determining the surface tension of liquids, Philosophical Magazine, 1907, Vol.14, p591-596
[3] Ashutosh Dey, A New Method for the Absolute Determination of Frequencies, Proceedings of the Royal Society, V95, 1919, p533

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts