স্কুলজীবন
ছোটবেলা থেকেই রামনের
স্বাস্থ্য খুব খারাপ। তবে শরীর যতই খারাপ হোক, লেখাপড়ায় রামনের জুড়ি নেই। এ ভি এন
স্কুলে ভর্তি হয়েছে রামন। স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে তার বাবার
পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনের মোটা মোটা বই পড়তে শুরু করে দিয়েছে সে। স্কুলের
পরীক্ষায় বিস্ময়কর ভালো ফলাফল করছে রোগা রামন। স্কুলের বইগুলো মাত্র কয়েকদিনেই পড়া
হয়ে যায় তার। তারপর সে পড়তে শুরু করে হাতের কাছে যে বিজ্ঞানের বই পায় সেই
বিজ্ঞানের বই। বিজ্ঞান ছাড়াও বাড়িতে অন্য যেসব বই আছে সবগুলো শেষ করে ফেলে সে
দ্রুত।
কলেজে ফিজিক্স ও গণিতের শিক্ষক হিসেবে
বাড়িতে প্রচুর বই ছিল চন্দ্রশেখরনের। রামন কলেজের মোটা মোটা ফিজিক্সের বই পড়ে
ফেলেছে আট-নয় বছর বয়সে। মাতৃভাষা হিসেবে রামন তামিল পড়তে, বলতে এবং লিখতে পারলেও
ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার কারণে ইংরেজি পড়তে এবং লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে
সে।
১৮৯৭ সালে রামনের বয়স যখন নয়, এবং তার
বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্যের বারো তখন তাদের উপনয়ন বা পৈতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
চন্দ্রশেখরন খুব বেশি ধার্মিক না হলেও সামাজিক এসব নিয়ম-কানুন না মানার মতো মনের
জোর তাঁর ছিল না। পরবর্তীতে রামনও বাহ্যিক ধর্ম-পালনে মোটেও উৎসাহী ছিলেন না।
কিন্তু সেই নয় বছর বয়সে যে পৈতা কাঁধে তুলে দেয়া হয়েছে সেই পৈতা কখনো ফেলে দেননি। ধর্মীয়
নিয়ম অনুসারে তাঁর মাথায় একটা লম্বা টিকিও ছিল ছোটবেলা থেকে। জনসমক্ষে সেই টিকি
তাঁর পাগড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকতো।
বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাস দেখানোর জন্য
রামনকে কলেজের ল্যাবোরেটরিতে নিয়ে যেতেন তার বাবা। চোখের সামনে টেস্ট টিউবের মধ্যে
রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠতো রামন। তার সবচেয়ে প্রিয় পরীক্ষণ
ছিল লিডেন জারের পরীক্ষা। সেই ১৭৪৫ সালে একেবারে প্রথম যুগের ক্যাপাসিটার ছিল এই
লিডেন জার। দুটো টিনের পাতের মধ্যে একটা অপরিবাহী বস্তু রেখে সেখানে ইলেকট্রিক
চার্জ জমা করে রাখা যায়। কাচের বোতলের ভেতরে এবং বাইরে টিনের পাত মুড়ে দিয়ে এই লিডেন
জার বানানো যায়। রামন বিদ্যুতের খেলা দেখে ভীষণ আনন্দ পেতো। চোখের সামনে সে দেখতে
পেতো কীভাবে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চার্জ একসাথে মিলে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে।
রোগা শরীরের কারণে যখন তখন অসুস্থ হয়ে পড়তো রামন। তখন সে বার বার লিডেন জারের
পরীক্ষা দেখতে চাইতো।
১৯০০ সালের শেষের দিকে মাত্র বারো বছর
বয়সে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করলো রামন। পুরো জেলার মধ্যে ফার্স্ট হলো সে।
তারপর বাবার কলেজেই এফ-এ বা
উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হলো রামন। ক্লাস শুরু হবার আগেই রামন তার সব বই পড়ে শেষ
করে ফেললো। টেক্সট বইয়ের মধ্যে রাধাকৃষ্ণানের অ্যালজেব্রা, স্মিথ অ্যান্ড
ব্রায়ান্টের জিওমেট্রি, হল অ্যান্ড স্টিভেন্স এর ট্রিগোনোমেট্রি শেষ করে গ্রিক
সাহিত্যও পড়ে ফেললো। তার আরো বইয়ের দরকার। বাড়িতে বাবার বইয়ের আলমারিতে খুঁজতে
খুঁজতে পেয়ে গেলো অনেকগুলো পদার্থবিজ্ঞানের বই। এই বইগুলো চন্দ্রশেখরন এনেছিলেন
নিজে পদার্থবিজ্ঞানে এম-এ পরীক্ষা দেবেন বলে। কিন্তু বইগুলো ধরে দেখারও সময় পাননি।
আর এখন তার বারো বছর বয়সী ছেলে এগুলো নিয়ে গোগ্রাসে পড়তে শুরু করেছে।
ম্যাক্সওয়েলের বই "A Dynamical Theory of the Electromagnetic Field" তন্ময় হয়ে পড়ছে
রামন। চন্দ্রশেখরন ভাবলেন রামন হয়তো বুঝতে পারবে না সবটুকু। কিন্তু রামনের কোন
সমস্যাই হচ্ছে না বুঝতে। রামন নিজেই বুঝিয়ে দিচ্ছে তার বাবাকে তড়িৎচৌম্বকীয়
ক্ষেত্রের গতিতত্ত্ব আসলে কী। কয়েক মাসের মধ্যেই রামন সবটুকু পড়ে বুঝে ফেললো: এডোয়ার্ড রুথের A Treatise on Dynamics of Rigid Bodies, A Treatise on Analytic
Statistics, এবং A Treatise on Dynamics of a Paricle।
১৯০২ সালের ডিসেম্বরে তার
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে গেলো। এবারও পরীক্ষায় প্রথম হয়ে স্কলারশিপ
পেলো রামন। এবার মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ।
No comments:
Post a Comment