রামন ইফেক্ট
আবিষ্কার
১৯২৮ সাল
রামনের জন্য অনন্য একটি বছর। ১৯২৭ সালের শেষের দিকে আর্থার কম্পটনকে ‘কম্পটন ইফেক্ট’ আবিষ্কারের
জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলে রামনের মনে হলো এক্স-রে’র ক্ষেত্রে
কম্পটন ইফেক্ট যেরকম সত্য - সেরকম ঘটনা আলোর ক্ষেত্রেও সত্য হবার সম্ভাবনা আছে।
রামন সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা দ্রুত পরীক্ষা করে দেখবেন। তিনি অ্যাসোসিয়েশানের
সব গবেষকদের একেকজনকে একেকটা কাজ ভাগ করে দিলেন - যেন সবগুলো দিক দ্রুত পরীক্ষা
করে ফেলা যায়।
তরলে আলোক বিক্ষেপণের কাজ পুরোদমে
এগিয়ে চলছে অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণাগারে। রামন হিসেব করে দেখেছেন যে দৃশ্যমান আলোক
তরঙ্গের ক্ষেত্রে সত্যিকারের কম্পটন ইফেক্ট দেখা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দৃশ্যমান
আলোর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের (যেমন এক্স-রে)। আণবিক বিক্ষেপণ পরীক্ষার জন্য
কম্পটনের হিসেবে কিছু পরিবর্তন করা দরকার। অনেকদিনধরে দিনরাত পরিশ্রম করে রামন সেই
প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটুকু করে ফেললেন। পরবর্তীতে তা ‘কম্পটন-রামন
ফর্মুলা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯২৮ সালের
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুটো মাস রামনের গবেষণাগারে প্রায় ‘ঘূর্ণিঝড়’ বয়ে গেলো। জানুয়ারি
থেকে শুরু হলো পরীক্ষণের কাজ। রামনের সহকারী ভেঙ্কটেশ্বরণ ঘন জৈবতরলে আলোকের
বিক্ষেপণ নিয়ে কাজ করছিলেন। ভেঙ্কটেশ্বরণ
গ্লিসারিন বিশুদ্ধ করে তার ভেতর দিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করানোর পর বিশুদ্ধ
গ্লিসারিনে সবুজ আলোকরেখা দেখা যাচ্ছে। অথচ নীল আলো দেখতে পাওয়ার কথা। অনেকবার
ফিল্টার বদল করার পরেও দেখা গেলো প্রতিবারই আলোর রঙ বদলে যাচ্ছে।
যেখানে নীল বর্ণালী-রেখা পাওয়ার কথা
সেখানে হালকা সবুজ বর্ণালী-রেখা পাওয়া যাচ্ছে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য নীল বর্ণালীর
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বড়। তার মানে আলো কিছুটা শক্তি হারাচ্ছে। তার মানে আলোর
বিকিরণে নতুন তত্ত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা পরিষ্কার।
কিন্তু ভেঙ্কটেশ্বরণ ছিলেন খন্ডকালীন
ছাত্র। দিনের বেলায় তিনি আলিপুর টেস্ট হাউজে সহকারী কেমিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। অ্যাসোসিয়েশানে
কাজ করতেন অফিস ছুটির পর এবং ছুটির দিনে। তাই পরীক্ষণের জন্য শুধুমাত্র সকাল ও পড়ন্ত বিকেলের আলোতে কাজ করা সম্ভব
হচ্ছিল তাঁর পক্ষে। পুরো পরীক্ষণে দিনের আলোর ব্যবহার এত বেশি দরকারি যে শুধুমাত্র
ভেঙ্কটেশ্বরণের ওপর নির্ভর করা যাচ্ছিলো না। রামন চাইলেন এমন কাউকে কাজটা দিতে
যিনি দিনের আলোর পুরাটাই পরীক্ষণের কাজে লাগাতে পারবেন।
রামন তাঁর সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র কৃষ্ণানকে
বললেন তাঁর পুরো সময়টা এই গবেষণায় দেয়ার জন্য। কৃষ্ণান তখন এ সংক্রান্ত তত্ত্বীয়
গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। ‘প্রফেসর’ রামন তাঁকে
পরীক্ষণের ভার দেয়াতে তিনি বুঝতে পারলেন একটা বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে।
রামনের নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষ্ণান
জৈব-তরল ও বাষ্পের মধ্যে আলোর বিক্ষেপণের ফলে বর্ণালীর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করার
জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সেট করলেন এবং পরীক্ষণ শুরু করলেন। চমৎকার ফল পাওয়া
যেতে শুরু করলো। রামন ভীষণ উৎকন্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে সবকিছু তদারকি করছেন।
ফেব্রুয়ারির সাত তারিখ থেকে ষোল
তারিখের মধ্যে রামন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তাঁদের এতদিনের গবেষণা ‘ক্রেমার্স-হাইজেনবার্গ
পদ্ধতি’র সাথে সংশ্লিষ্ট। ফোটন ও ইলেকট্রনের বিক্ষেপণের পরিমাণ
হিসেব করার একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছেন হেনড্রিক ক্রেমার্স ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ
১৯২৫ সালে। রামন দেখলেন ক্রেমার্স-হাইজেনবার্গের প্রাপ্ত ফলাফল তাঁর প্রাপ্ত
উপাত্তের বেলাতেও প্রয়োগ করা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে তিনি নেচার জার্নালে এ
সংক্রান্ত ছোট্ট একটা পেপার পাঠিয়ে দেন।[1]
ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ রামন ঠিক করলেন
বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের (spectroscope) সাহায্যে
আলোর বিক্ষেপণে পরিবর্তিত বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করবেন। অ্যাসোসিয়েশানের
ল্যাবোরেটরিতে আশুবাবু সারাদিন ধরে যন্ত্রপাতি সেট করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতে
সূর্য ডুবে গেল। সূর্যালোকের অভাবে সেদিন আর কিছু করা গেলো না। পরদিন ২৮
ফেব্রুয়ারি সকালে সূর্য ওঠার পর পরই শুরু হলো পর্যবেক্ষণ। একটু পরেই দেখা গেলো
নির্দিষ্ট বর্ণের আলোর বর্ণালীর পাশে আরেকটি ভিন্ন বর্ণের আলোক রেখা - “রামন রেখা”।
আশুবাবু একটা
মার্কারি আর্ক সেট করলেন যেখান থেকে পাওয়া গেল এক বর্ণের উজ্জ্বল সাদা আলোক রেখা।
এই আলোতে নীল বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে লম্বা অন্যসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রেখা
ঢাকা পড়ে যাবার কথা। ঢাকা পড়ে গেলো ঠিকই - কেবল নীল-সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমানায়
দুটো নতুন রেখা ছাড়া। এই নতুন রেখা সৃষ্টি হয়েছে যে বিক্ষেপণের প্রভাবে তার নাম
দেয়া হলো ‘রামন ইফেক্ট’। রামন-ইফেক্ট
আবিষ্কৃত হলো।
কৃষ্ণান ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে
রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের বিভিন্ন ঘটনা তাঁর ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। কৃষ্ণানের
জীবদ্দশায় এই ডায়েরি অপ্রকাশিত ছিল। ১৯৫৩ সালে প্রফেসর রামসেশানের সাথে কথোপকথনের
সময় কৃষ্ণান তাঁর ডায়েরির কথা উল্লেখ করেছিলেন।[2] ১৯৬১ সালে
কৃষ্ণানের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে শ্রীনিভাসনের কাছ থেকে ডায়েরিটি নিয়ে যান কে আর
রামনাথন। ১৯৭০ সালের পর থেকে রামন-ইফেক্ট আবিষ্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখায় এই
ডায়েরির অংশবিশেষ প্রকাশিত হতে থাকে কৃষ্ণানের পরিবারের অনুমতি ছাড়াই। কৃষ্ণানের
ডায়েরি প্রথম সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে রয়েল সোসাইটির জার্নালে।[3]
ডায়েরিটি খুব একটা বড় নয়; ৫
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ পর্যন্ত মাত্র কয়েকদিনের দিনলিপি পাওয়া
যায় তাতে। রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের দিনগুলোর প্রত্যক্ষ বিবরণ আছে এতে। রামনকে
কৃষ্ণান ‘প্রফেসর’ বলে সম্বোধন
করতেন। ইংরেজিতে লিখিত ডায়েরির বাংলা অনুবাদ:
রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি
১৯২৮
|
মূলত আমাদের সব গবেষণা- বৈদ্যুতিক ও
চৌম্বকীয় দ্বৈত-প্রতিসরণ, ক্রিস্টালের ম্যাগনেটিক এন-আইসোট্রপি, ধাতব পর্দার ওপর
আলোর বিচ্ছুরণ, ল্যাংগেভিন তত্ত্বের পরিবর্ধন সংক্রান্ত তিনটি পেপার, লরেঞ্জ-ডিবাই
তত্ত্ব, আলোক বিক্ষেপণের রামনাথন তত্ত্ব,
তরলের ওপর ম্যাক্সওয়েল তত্ত্বের প্রভাব ইত্যাদি মিলিয়ে ১১টি পেপার ও নেচার
সাময়িকীতে দুটো চিঠি আমরা প্রকাশ করেছি গত বিশ মাসের মধ্যে।
তবুও প্রফেসরের সাথে একমত হতেই হয় যে-
কোন বিজ্ঞান গবেষকেরই উচিত নয় পরীক্ষামূলক গবেষণা থেকে দূরে থাকা। প্রফেসর আমাকে
করতে বলেছেন বলেই শুধু নয়, জৈব বাষ্পে আলোর উৎপত্তি সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলোতে আমার
সম্পৃক্ত হওয়ার আরো একটা প্রধান কারণ হলো আমি চাইছিলাম যথাশীঘ্র পরীক্ষণ শুরু
করতে। আসলে রামচন্দ্র রাওয়ের সাথে এন-আইসোট্রপির যে পেপারটা লেখার প্রস্তাব আমি
করেছিলাম - গতমাসে সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দেয়ার জন্য তিনি যখন এখানে এসেছিলেন -তখন দু’জনে মিলে
পেপারটা কিছুটা লিখেও ছিলাম - সেটা এখনো শেষ হয়নি। সায়েন্স কংগ্রেসের আগে তরলের
প্রতিসরাঙ্ক সম্পর্কিত যে পেপারটা আমি শুরু করেছিলাম তাও শেষ করতে হবে। জিম্যান
ইফেক্টের একটা তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টাও করেছি সপ্তাহ খানেক।
অনেকদিন আগে প্রফেসর কিছু সাবানের
ফেনার ছবি তুলে নিকেলের ফ্রেমে আটকে রেখেছিলেন। সেগুলোও পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা
করলাম যদি দ্বৈত-প্রতিসরণের কোন প্রমাণ মেলে। এগুলোর জন্য অনেক সময়ের দরকার। যাই
হোক, আমি ভাবলাম ডেস্ক ছেড়ে উঠেই পরীক্ষণের কাজে লেগে গেলে মন্দ হয় না। সে অনুসারে
গত তিন-চারদিন ধরে আমার সবটুকু সময় আমি পরীক্ষণের পেছনেই দিয়েছি। মনে হচ্ছে এই
বিষয়টি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। যদিও এখনো পর্যন্ত কোন ধরনের তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠিত হয়নি যা দিয়ে পরীক্ষণের ফলাফলগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া যায়।
এনথ্রাসিনের বাষ্প পরীক্ষা করে
দেখলাম। অনেক আলো তৈরি হয় এতে। কিন্তু প্রিজমের মধ্য দিয়ে দেখলে মনে হচ্ছে কোন
ধরণের মেরুকরণ ঘটছে না। প্রফেসরও সবসময় কাজ করছেন আমার সাথে।
ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন থেকে আমাদের
ম্যাক্সওয়েল ইফেক্ট সম্পর্কিত পেপারটির প্রুফ এসেছে আজ।
প্রফেসর সম্প্রতি মিস্টার
ভেংকটেশ্বরণের সাথে অ্যারোম্যাটিক তরলের
ফ্লুরোসেন্স পরীক্ষা করে দেখেছেন। অতিবেগুনি রশ্মির কাছাকাছি তরঙ্গের সূর্যালোকে
দেখা গেছে কিছু কিছু তরলের ফ্লোরোসেন্সে মেরুকরণ ঘটছে। যাই হোক এনথ্রাসিনের
বাষ্পের ফ্লুরোসেন্সে কোন মেরুকরণ দেখা যায়নি। প্রফেসর আমাকে বলেছেন এগুলো আর একটু
যাচাই করে নিতে।
সোমবার, ৬
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
সপ্তাহ দুয়েক
আগে প্রফেসর যখন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের মিটিং উপলক্ষে ব্যাঙ্গালোর
যাচ্ছিলেন তখন তাঁর সাথে স্টেশনে গিয়েছিলাম আমি। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে ডক্টর এ
এল নারায়ণন আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করে দেখতে
ডক্টরেটের জন্য তিন বছরের সময়সীমাকে কমিয়ে নেয়া যায় কি না। প্রফেসরকে অনুরোধ
করেছিলাম মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট মেম্বারদের কারো সাথে দেখা হলে যেন
ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করেন।
প্রফেসর আজ আমাকে বললেন ভাইস
চ্যান্সেলর স্যার ভেংকটরত্নমের সাথে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়েছে কিন্তু দেখা হয় নি।
যাই হোক, প্রফেসর জানালেন স্যার ভেঙ্কট তাঁকে চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন
মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বক্তৃতা দিতে। স্যার ভেঙ্কটরত্নমকে চিঠি লেখার সময়
প্রফেসর আমার কথাও লিখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি আমার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার
সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিলেন। কথাপ্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ করলেন যে ইউনিভার্সিটিতে
যদি একক লেকচারের পরিবর্তে সিরিজ লেকচারের ব্যবস্থা হয় তাহলে তিনি আমাকেও নিয়ে
যাবেন।
সারাদিন পেপারটার প্রুফ দেখলাম আর
গাণিতিক সমীকরণগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে নিলাম।
মঙ্গলবার ৭
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
অতিবেগুনি আলোর
কাছাকাছি এলে কিছু কিছু অ্যারোম্যাটিক তরলের ফ্লুরোসেন্সের যে
মেরুকরণ ঘটে তা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করলাম সারাদিন। ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করলাম
যে সব বিশুদ্ধ তরলেই জোরালো ফ্লুরোসেন্স ঘটছে। এবং আরো আশ্চর্য বিষয় হলো তাদের
সবগুলোরই তীব্র মেরুকরণ ঘটছে। এমনকি সাধারণ আলোতেও তা দেখা যাচ্ছে। অ্যালিফেটিক
তরলের মেরুকরণ অ্যারোম্যাটিক
তরলের তুলনায় বেশি। ফ্লুরোসেন্ট আলোর মেরুকরণ সাধারণ ভাবে বিক্ষেপিত আলোর
মেরুকরণের সমান্তরালে ঘটছে। অর্থাৎ অণুর অপটিক্যাল অ্যান-আইসোট্রপি যত ছোট, ফ্লুরোসেন্ট
আলোর মেরুকরণ ততই বড়।
আমি যখন প্রফেসরকে আমার পরীক্ষণের
ফলাফল জানালাম তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে সবগুলো তরল দৃশ্যমান আলোতেই
পোলারাইজড ফ্লুরোসেন্স দেখাচ্ছে। তিনি যখন রুমে এলেন - আমি একটা নীল বাল্ব
জ্বালিয়ে আলোর প্রবেশ পথে বেগুনি ফিল্টার বসিয়ে দিলাম। আলোর সবুজ ও হলুদ রেখা দেখে
তিনি মন্তব্য করলেন, “কৃষ্ণান, তুমি
নিশ্চয়ই মনে করছো না যে এদের সবগুলোই ফ্লুরোসেন্স?” যাই হোক, যখন
তিনি সবুজ ও হলুদের সমন্বিত আলোর গতিপথ পরিবর্তন করে আলোর প্রবেশ পথের দিকে নিয়ে
এলেন - তখন আর কোন আলোক রেখা দেখা গেলো না। তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। অনেক বার
পরীক্ষাটা করে দেখলেন কীভাবে আলোর মেরুকরণ ঘটছে। এমন চমৎকার ফলাফলে তিনি খুবই
উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। একটার পর একটা করে সবগুলো তরলই পরীক্ষা করে দেখা হলো। সবগুলো
তরলেই একই রকম ফল পাওয়া যাচ্ছে। প্রফেসর ভাবতে লাগলেন - কীভাবে আমরা কেউই এই
ব্যাপারটা গত পাঁচ বছরে একবারও ধরতে পারিনি।
বিকেলে ফ্লুরোসেন্সের মেরুকরণ
সম্পর্কিত আরো কিছু ডাটা সংগ্রহ করলাম।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে প্রফেসর আমাকে
একটা টাইপ করা চিঠির ড্রাফ্ট দেখালেন। গতকালের তারিখ দেয়া (অর্থাৎ ৬ই) স্যার
ভেঙ্কটরত্নমের কাছে লেখা চিঠি - কালি দিয়ে অনেক জায়গায় পরিবর্তন করা হয়েছে। চিঠিতে
মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য তিনবছরের সময়সীমার বাঁধনটা
শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি আমার ব্যাপারে অতিরিক্ত রকমের প্রশংসা করে
উল্লেখ করেছেন যে তিনি মনে করেন আমি অনেক কম সময়ের ভেতর রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ
পেয়ে যেতে পারি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে চিঠিটি টাইপ করা হয়েছে গতকাল। আজ সকালের
উত্তেজনাপূর্ণ ফলাফলের পরে এ চিঠি লেখা হয়নি। আরো আশ্চর্য হলাম আমাদের প্রস্তাবিত
গবেষণাপত্রটির শিরোনাম আমি যা দিয়েছিলাম - ‘দি পোলারাইজড
ফ্লুরোসেন্স এক্সিবিটেড বাই অর্গানিক ভ্যাপার্স’ - তাই রেখে
দিয়েছেন তিনি। শুধুমাত্র ‘ভ্যাপার্স’ এর জায়গায় ‘লিকুইড’ বসিয়ে
দিয়েছেন।
রাতের খাবারের পর ভেঙ্কটেশ্বরণ আর আমি
আমাদের রুমে বসে গল্প করছিলাম। এমন সময় প্রফেসর এলেন। রাত তখন প্রায় ন’টা বাজে। তিনি
ডাকলেন আমাকে। নিচে নেমে এসে দেখলাম তিনি খুব উত্তেজিত। এত রাতে তিনি ছুটে এসেছেন
আমাকে বলতে যে সকালে আমরা যা দেখেছি তা নিশ্চয়ই ক্রেমার্স-হাইজেনবার্গ ইফেক্ট।
সুতরাং আমরা ঠিক করলাম এই ইফেক্টকে আমরা ফ্লুরোসেন্স বলার চেয়ে ‘মডিফাইড স্ক্যাটারিং
ইফেক্ট’ বলে ডাকবো। আমরা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে কথা বললাম। তিনি বার বার আমাদের আবিষ্কারের অভিনবত্ব
সম্পর্কে বলছিলেন।
বুধবার ৮
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
কিছু প্রচলিত
তরলের মডিফাইড স্ক্যাটারিং সম্পর্কিত প্রাথমিক মেরুকরণের পরিমাপ করলাম।
বৃহস্পতিবার ৯
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
সকালে বড়
টেলিস্কোপটি ফিট করে বাষ্পের প্রভাব দেখার প্রাথমিক প্রস্তুতিটুকু করে রাখলাম। প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই প্রফেসর কলেজে চলে
গেলেন ক্লাস নিতে।
দুপুরের পর ইথারের বাষ্প নিয়ে কাজ করে
একই ফলাফল পাওয়া গেল। ক্রমান্বয়ে আরো কয়েকটি পরীক্ষা করেও একই রকম সাফল্য পাওয়া
গেল।
বিকেল তিনটের দিকে প্রফেসর যখন ফিরলেন
তাঁকে জানালাম আমার পরীক্ষণের ফলাফলের কথা। তখনো দিনের আলো প্রচুর। প্রফেসর নিজের
চোখেই দেখতে পেলেন। তিনি উত্তেজনায় বাচ্চা ছেলের মত চিৎকার চেঁচামেচি করে আনন্দ
প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁর অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে কত বড় মাপের একটা
আবিষ্কার আমরা করে ফেলেছি। প্রফেসর বললেন ক্লাস নেবার সময় তাঁর খুব অস্থির লাগছিলো
যে পরীক্ষণের শুরুতেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। তবে আমার ওপর এই বিশ্বাস তাঁর ছিল যে
আমি আমার আবিষ্কারের শেষ না দেখে থামবো না। তিনি আমাকে বললেন সবাইকে সেখানে ডেকে
নিয়ে আসতে। এসে দেখে যাক আমাদের আবিষ্কার। প্রায় সাথে সাথেই নাটকীয় ভাবে আমাদের
মেকানিককে ডেকে উচ্চ-তাপমাত্রার বাষ্পে আমাদের ইফেক্ট-টা পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা
করা হলো।
সন্ধ্যেবেলা হট বাথ-টাবের ব্যবস্থা
করতে করতে সময় গেলো, ঘর থেকে বেরোইনি একবারও। সান্ধ্যভ্রমণ থেকে ফিরে প্রফেসর
আমাকে বললেন এরকম বড় বড় সমস্যার সমাধান করাই হবে আমার কাজ। আরো বললেন এই কাজটা শেষ
হলে ইলেকট্রনের স্পিন সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলো শুরু করা উচিত আমার। ভেঙ্কটশ্বরণকে
বললেন এই আবিষ্কারের কথা। আমাদের সাথে আলোচনার সময় প্রফেসর বললেন আমাদের
আবিষ্কারটার নাম হওয়া উচিত ‘রামন-কৃষ্ণান
ইফেক্ট’। ভেঙ্কটশ্বরণ বা অন্যরা এ নামে ডাকবে
হয়তো। কথাপ্রসঙ্গে প্রফেসর বললেন এবার আমার রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়াটা আর কেউ
ঠেকাতে পারবে না। বললেন আমি সম্ভবত ডক্টরেট পাওয়ার আগেই রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ
পেয়ে যাবো। রামানুজন মাত্র বিএ পাশ করেই ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।
১০-১৫
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
বেশ কয়েকটি
বাষ্প নিয়ে পরীক্ষা করলাম। যদিও তাদের অনেকগুলোই আমাদের ‘ইফেক্ট’দেখাচ্ছে -
কিন্তু মডিফাইড স্ক্যাটারিং এর পোলারাইজেশান সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পাওয়া
গেলো না।
বৃহস্পতিবার ১৬
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
উচ্চতাপমাত্রায়
পেন্টেইন বাষ্প পরীক্ষা করে দেখলাম আজ। মডিফাইড স্ক্যাটারিং এর পরিষ্কার
পোলারাইজেশান দেখা গেলো।
আজ নেচার সাময়িকীতে একটা নোট পাঠালাম ‘এ নিউ টাইপ অব
সেকেন্ডারি রেডিয়েশান’ শিরোনামে।
শুক্রবার ১৭
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
পেন্টেইন
বাষ্পের ফ্লুরোসেন্সের পোলারাইজেশান কনফার্ম করলেন প্রফেসর। আমার বাম চোখে খুব
সমস্যা হচ্ছে। প্রফেসর বললেন সামনের কয়েকদিন পরীক্ষাগুলো তিনি নিজেই করতে পারবেন।
১৯-২৬
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
আরো কিছু বাষ্পের পরীক্ষা করেছি আজ।
সোমবার ২৭
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
সৎমায়ের
অনুষ্ঠান ছিল। অ্যাসোসিয়েশানে যাইনি।
মঙ্গলবার ২৮
ফেব্রুয়ারি ১৯২৮
বিকেলবেলা
অ্যাসোসিয়েশানে গিয়েছিলাম। প্রফেসর ছিলেন সেখানে। আমরা আমাদের পরীক্ষায় আপতিত আলোর
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোন প্রভাব আছে কি না বের করার চেষ্টা করলাম। ইউরেনিয়াম গ্লাসের
সাথে নীল-বেগুনি ফিল্টার যোগ করে দিলাম। ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমারেখা স্বাভাবিকের
চেয়ে অনেক কমে গেলো। ডাইরেক্ট ভিশান স্পেক্ট্রোস্কোপ দিয়ে বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে
চমকে উঠলাম। আপতিত আলোকরশ্মি থেকে মডিফাইড
স্ক্যাটারিং এর ফলে প্রতিসরিত রশ্মি আলাদা হয়ে গেছে। দুটোর মাঝে একটা কালো রেখা
দেখা যাচ্ছে।
এটা থেকে উৎসাহ পেয়ে আমরা
মনোক্রোম্যাটিক লাইট ব্যবহার করার ... ... ...
ডায়েরিটি
এখানেই হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে। সেদিনই ‘রামন-ইফেক্ট’ আবিষ্কারের
খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রফেসর রামন নিজেই ‘রামন-কৃষ্ণান
ইফেক্ট’ নামকরণ করার পক্ষে থাকলেও পরে কীভাবে যেন কৃষ্ণানের নাম
বাদ পড়ে গেলো। অন্তর্মুখী কৃষ্ণান কখনো এই বিষয়ে কারো কাছে কোন অভিযোগ করেননি।
কৃষ্ণানের হাতে লেখা ডায়েরি
১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্সে আনন্দের
বন্যা বয়ে গেলো। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই আবিষ্কারের জন্য অ্যাসোসিয়েশানের সব
গবেষক-ছাত্র মিলে দিনরাত কাজ করেছেন। সেই সময় রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছিলেন
বত্রিশ জন গবেষক, যাদের মধ্যে একুশজন ছিলেন পূর্ণকালীন গবেষক, আর এগারজন ছিলেন
খন্ডকালীন গবেষক। গবেষকদের মধ্যে ছিলেন এস আপস্বামিয়ার, এস সি সরকার, পি
কৃষ্ণমূর্তি, পি এন ঘোষ, এস ভগবন্তম, বি ব্যানার্জি, এস ডাবলু চিঞ্চলকর,
রাঘবেন্দ্র রাও, জি এল দত্ত, কে শেষাগিরি রাও, কে সুব্রামাইয়া, এন কে শেঠি, ভি এস
রাজগোলাপন, ভি এস ঠাম্মা, পি নীলকন্ঠন, কে আর রামনাথন, জি আর রেন্ডাল, এ এস গনেশন,
কে ব্যানার্জি, এ জে জয়রাম, এ এস কৃষ্ণান, কে এস কৃষ্ণান, ভি কৃষ্ণমূর্তি, এল এ
রামদাস, টি কে শ্রীনিবাসন, এস কে দত্ত, এম আর ভাট, আই রামকৃষ্ণ রাও, কে এস
বিশ্বনাথন, সি এম সোগানি প্রমুখ।
রামনের বড়ভাই
সুব্রাহ্মণ্যের ছেলে চন্দ্রশেখর তখন সবেমাত্র মাদ্রাজ কলেজে ভর্তি হয়েছেন। চন্দ্রশেখরও
কিছুদিন রামনের ল্যাবে কাজ করেছিলেন। এই চন্দ্রশেখর ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পান।
গবেষকদের মধ্যে বেশিরভাগ অবাঙালি হলেও বাঙালি গবেষকের সংখ্যাও খুব একটা কম ছিল না।
রামন প্রতিদিন
অ্যাসোসিয়েশানে আসার পর প্রত্যকে গবেষকের সাথে কয়েক মিনিট করে কথা বলতেন। তাঁদের
গবেষণার অগ্রগতি পরীক্ষা করতেন এবং সামগ্রিক ফলাফলের সমন্বয় করতেন। তিনি বত্রিশ
জনের গবেষণার সমন্বিত ফল কোন্দিকে যাচ্ছে তা দেখতে পেতেন।
১৯২২ সাল থেকে ১৯২৮ সাল
পর্যন্ত আলোর বিক্ষেপণের ধর্ম নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষার ফলাফল দেখতে দেখতে রামন বুঝতে
পেরেছিলেন যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে চলেছে। সেই আবিষ্কারের জন্য খুব
বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না।
১৯২৮ সালের ২৮
ফেব্রুয়ারি রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের পরপরই রামন বিশ্বব্যাপী এই আবিষ্কারের কথা
প্রচার করার দ্রুত ব্যবস্থা করলেন। সেই সময় এখনকার মতো এত দ্রুত প্রচারিত হতো না
কিছুই।
১৬ ফেব্রুয়ারি নেচার
সাময়িকীতে যে পেপারটি পাঠিয়েছিলেন এই আবিষ্কার সম্পর্কে সেটা প্রকাশিত হয়েছে ৩১
মার্চ। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ থেকে পরবর্তী এক বছর ধরে রামন সারাপৃথিবীতে
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করেছেন তাঁর আবিষ্কারের কথা। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি
স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিকদের খবর পাঠালেন। সাংবাদিকদের সামনে ব্যাখ্যা করলেন
কীভাবে এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেলো। পরেরদিন সংবাদপত্রে
শিরোনাম হলো ‘নিউ থিওরি অব
রেডিয়েশান’।
[2] S. Ramaseshan, A
conversation with K. S. Krishnan on the story of the discovery of the Raman
effect. Current Science, 1998. 75(11):
p. 1265-1272.
[3] Mallik, D.C.V., The
Raman Effect and Krishnan's Diary. Notes and Records of the Royal Society
of London, 2000. 54(1): p. 67-83.
No comments:
Post a Comment