28
“সিনেমা দেখেছি – তাতে এত জোরে হাসার কী হলো?” – রঞ্জনের হাসি থামানোর জন্য প্রশ্ন করি। তাতে কাজ হয়। মুহূর্তেই তার হাসি থেমে যায়।
বেশ গম্ভীরভাবে তর্ক করে, “হাসবো না? আপনি ফিজিক্সের টিচার হয়ে সিনেমা কেন দেখবেন? জামাল স্যার কি সিনেমা দেখেন? প্রামাণিক স্যার কি সিনেমা দেখেন? অরুন স্যার কি সিনেমা দেখেন?”
“আমি প্রামাণিক স্যারও নই, অরুন স্যারও নই। জামাল নজরুল ইসলামও নই। আমি সিনেমা দেখি। তাতে তোমার কোন সমস্যা আছে?”
“আমার সমস্যা আছে। অবশ্যই সমস্যা আছে। আজ বিকেলে আপনার বাসায় গিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে। আপনি সিনেমা না দেখলে আমাকে ফিরে আসতে হতো না।“
“আমি সিনেমা না দেখলেও এই সময় বাসায় থাকতাম না। তোমাকে ফিরে আসতে হতো।“
“এখন কি বাসায় যাবেন, না অন্য কোথাও যাবেন?”
“বাসায় যাবো।“
“চলেন তাহলে আমিও যাই। অ্যাই তোমরা চলে যাও। সোজা বাসায় চলে যাবা। সিনেমা টিনেমা দেখবা না। অ্যাই রিক্সা – চলো। মিয়ার বাপের মসজিদ“ – বলেই সামনের একটা খালি রিকশায় উঠে বসলো রঞ্জন। তার মধ্যে একটা ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব আছে। এই ভাবটা অনেক সময় আরোপিত বলে মনে হয়। কিন্তু তা নিয়ে আমি তাকে কিছু বলিনি কখনো।
রিকশা দ্রুত লালচাঁদ রোডে ঢুকে গেল। বেশ ভীড় এখন এই ছোট্ট রাস্তায়। মিষ্টিমুখ রেস্টুরেন্টের সামনে আসতেই “থামো থামো” বলে চেঁচিয়ে উঠল রঞ্জন। রিকশা থামতেই দ্রুত নেমে গেল সে। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ভ্যান-গাড়ির উপর পিঁয়াজু বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট সাইজের পিঁয়াজু – অনেক তেল, অনেক ঝাল, অনেক মজা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই হাতে দুই ঠোঙা নিয়ে রিকশায় উঠে এলো সে।
“এই নেন্, আপনার মজার খাবার।“ – একটি ঠোঙা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো রঞ্জন।
সন্ধ্যার এই সময়টাতে চকবাজারের সামনে প্রচন্ড জ্যাম লেগে যায়। বেশিরভাগই রিকশা। লালচাঁদ রোড থেকে সিরাজদৌল্লা রোড ক্রস করে চকবাজারের সামনে আসতেই জ্যামে পড়ে গেলাম। ধুনি-পুল পার হয়ে রিকশা সোজা বিএড কলেজের দিকে চলে যাচ্ছিলো। রিকশাওয়ালারা এই ভুল প্রায়ই করে। মিয়ার বাপের মসজিদ বললে বড় মিয়ার মসজিদের দিকে চলে যায়। আমি কিছু বলার আগেই রঞ্জন “অ্যাই ডানে যাও” বলে প্রায় ধমক দিলো রিকশাওয়ালাকে।
রঞ্জনের এই ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। সে বিজ্ঞান পছন্দ করে, বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসে – এসব খুব ভালো গুণ তার। কিন্তু তার ভেতর মানুষের পেশাগত শ্রেণিবিভাজন প্রকটভাবে আছে।
“এত জোরে না বললেও পারতে।“
“জোরে না বললে সে তো শুনবে না। চারদিকে এত শব্দে কিছু শোনা যায়?” – রঞ্জন নিজের যুক্তি দেখায়।
“অনামিকা কি আপনার গোল্ডস্টেইনের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স ফেরত দিয়েছে?” – কাজের কথা শুরু করলো সে।
“দিয়েছে তো।“
“ওটা আমার একটু লাগবে। আর রেজনিক হ্যালিডে সেকেন্ড পার্ট।“
রঞ্জন আমার চার ব্যাচ জুনিয়র। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হবে। সে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতো ফতেয়াবাদের রামকৃষ্ণ মিশনে। সেই সময় মাঝে মাঝে আসতো আমার মেসে। ফিজিক্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতো। আমি কিছু শুনতাম, কিছু শুনতাম না। সে নিজের মনেই বকবক করতো। বেশিরভাগই খুব উচ্চস্তরের দার্শনিক কথাবার্তা। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য করতো সে। তার মতে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যে হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া কেউ কিচ্ছু জানেন না। বই দেখে দেখে বোর্ডে লেখেন, আর গৎবাঁধা বুলি আওড়ান। আমি তার সাথে খুব একটা তর্ক করতাম না শুধুমাত্র এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কারো কথায় সরাসরি দ্বিমত পোষণ না করার অর্থ এই নয় যে আমি তার কথা মেনে নিচ্ছি। আমি তার সাথে তর্ক করছি না – কারণ আমি তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই সে শহরে চলে আসে। আমি ফতেয়াবাদের পাট চুকিয়ে এখানে বাসা নেয়ার কিছুদিনের ভেতরই সে কীভাবে যেন আমার বাসা খুঁজে বের করে বাসায় এসে হাজির। তারপর থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাসায় আসে। দেখা হলেই অভিযোগ করে যে আমার বাসায় অনেকবার গিয়েও আমার দেখা পায়নি সে।
মিয়ার বাপের মসজিদের সামনে আসতে না আসতেই কারেন্ট চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রিকশার পেছনে লাগানো হারিকেনের আলোকেও অনেক উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। গলির মুখে রিকশা ছেড়ে দিলাম। নতুন একটি মুদি-দোকান হয়েছে এখানে। দোকানের মালিক আবেদিন – আমার সমবয়সী বা বছর খানেক বড় হতে পারে। টুকটাক জিনিসপত্র তার দোকান থেকেই কিনি। বাসায় রান্না করার কিছু আছে কি না মনে পড়ছে না। মোমবাতি-ম্যাচ আছে। ডিম আর ডাল কিনতে আবেদিনের দোকানে ঢুকলাম।
আমাকে দেখেই আবেদিন বললো, “একটা ছেলে আপনাকে খোঁজ করছিলো, চারটা - সাড়ে চারটার দিকে।“
“কোন্ ছেলে? নাম বলেছে?”
“না, মনে হয় আপনার কোন ছাত্র হবে। সাইকেল নিয়ে এসেছিলো। আপনার বাসা খুঁজছিল।“
কে হতে পারে? যেই হোক – বাসা যখন চিনে গেছে আরেকদিন আসবে নিশ্চয়। দোকান থেকে বের হয়ে দেখলাম রঞ্জন গলির মুখে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকাচ্ছে।
“কী দেখছো?”
“দেখছিলাম – এখানে আপনার একটা সাইনবোর্ড কোথায় লাগানো যায়।“
“সাইনবোর্ড কেন লাগাতে হবে?”
“আপনার বাসা খুঁজতে অনেকে আসে। একটা সাইনবোর্ড থাকলে সুবিধা না?”
“তোমার গলির মুখে যেরকম ঝুলিয়েছ?”
“কেন লজ্জা দিচ্ছেন দাদা? ওটা তো লাগিয়েছি ছাত্র ধরবার জন্য।“
“আমাকে কেন লাগাতে বলছো? আমি তো ছাত্র ধরতে চাই না।“
বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। গলিপথের সমস্ত বাঁক আমার মুখস্থ। অন্ধকারে সমস্যা নেই। কিন্তু রঞ্জন হোঁচট খাচ্ছে একটু পর পর। আর উচ্চস্বরে বলছে, “চট্টগ্রাম শহরে এত জায়গা থাকতে আপনি এরকম অদ্ভুত একটা জায়গায় কেন বাসা নিলেন আমি বুঝতে পারছি না।“
“কেন নিয়েছি বুঝতে পারছো না? ভেবেছিলাম এখানে কেউ আসবে না। সেটা আর হতে দিচ্ছ কোথায়?”
রঞ্জন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোন রকমে সামলে নিলো।
দুপাশের ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর থেকে রান্না-বান্নার শব্দ আসছে। বাম পাশে আমার বাড়িওয়ালা সালাম সাহেবের বড় ভাইয়ের গোয়াল। গোবরের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। রঞ্জন উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “ইস্ - আপনার নাকে কি গন্ধ-টন্ধ কিচ্ছু লাগে না?”
আমি কোন জবাব দিলাম না। সালাম সাহেবের বাড়িতে হারিকেন জ্বলছে। তাঁর উঠোন পেরোলেই আমার বাসা। আমার ডানদিকের প্রতিবেশীর বালকপুত্র স্বপন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বললো, “আংকেল, একটা ছেলে আপনাকে খোঁজ করছিল।“
“কিছু বলেছে?”
“একটা চিঠি দিয়ে গেছে।“
“কোথায় চিঠি?”
“আমার মায়ের কাছে।“
আমি আশা করেছিলাম স্বপন দ্রুত গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কিছুই করলো না। যেন খবরটা দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ।
“চিঠিটা এনে দাও তোমার মায়ের কাছ থেকে।“
“মা তো বাসায় নেই। কোথায় গেছে জানি না।“
“দেখো চিঠিটা কোথায় রেখেছে।“
“আমি তো বাসায় ঢুকতে পারছি না, দরজায় তালা।“
চিঠি কখন পাওয়া যাবে জানি না। নিজের বাসায় ঢুকলাম। সকালে বের হবার সময়ও কারেন্ট ছিল না। দরজার কাছে টেবিলের উপরেই মোমবাতি আর ম্যাচ রেখেছিলাম। মোম জ্বালাতেই এতক্ষণের জমাট অন্ধকারটা কেটে গেল। দেখলাম রঞ্জনের পায়ের স্যান্ডেলে কাচা গোবর লেগে আছে।
“তুমি কি ঘরে ঢুকবে, না দরজা থেকেই বিদায় নেবে? ঢুকলে গোবর-মাখা স্যান্ডেল বাইরে রেখে আসো।“
রঞ্জন স্যান্ডেল খুলে ঘরে ঢুকেই বললো, “আপনার কি ঝাড়ু-টাড়ু নেই? ফ্লোরে এত ধুলোবালি কোত্থেকে আসলো?”
“ধুলোবালি না, ঘুণ পড়ছে চেয়ার থেকে।“
“দেখি, তাই তো। লালদিঘীর পাড়ের চেয়ার, ঘুণ তো পড়বেই। হাহাহা“ – রঞ্জনের হাসির শব্দে আমার বাম পাশের প্রতিবেশীর পোষা মুরগিরা কোঁ কোঁ করে উঠলো।
এই বাসায় যখন উঠেছিলাম তখন আমার আসবাবপত্র ছিল একটি পাঁচ পায়ের চৌকি, একটি টেবিল, একটি চেয়ার আর দুটো বাঁশের বুকশেল্ফ। ফতেয়াবাদ থেকে এগুলো এনে দিয়েছিল সাহেব মিয়া আর কুদ্দুস। এর চেয়ে বেশি আসবাবপত্রের দরকার হয় নাকি? কিন্তু দেখা গেল বাসায় একজনের বেশি মানুষের বসার জায়গা নেই। খাটটা বসিয়েছি ভেতরের ঘরে। বাইরের ঘরে চেয়ার-টেবিল। এখন কেউ এলে তাকে তো আর খাটে বসতে বলা যায় না। তাছাড়া ভেতরের ঘরে কোন জানালা নেই, তাই দিনের বেলায়ও লাইট জ্বালাতে হয়। বাইরের ঘরে বসার কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। সোফা কেনার টাকা নেই আমার। সবচেয়ে সস্তা দামের আসবাবপত্র পাওয়া যায় লালদিঘীর পাড়ে। স-মিলের ফেলে দেয়া কাঠ থেকে বানানো চেয়ার-টেবিল আলনা সব পাওয়া যায় ওখানে। একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে চারশ টাকা দিয়ে একেবারে ফুল-সেট ফার্নিচার কিনে নিয়ে এসেছি। ঠিক ফুল-সেট বলা যাবে না। তবে অনেক ফার্নিচার – চারটি চেয়ার, একটি আলনা আর একটি রান্নাঘরে রাখার তাক। আর লাগে কী? তবে সস্তার যেসব সাইড ইফেক্ট আছে সেগুলো এখানেও দেখা গেল। কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু কেমন যেন বেঁকে যেতে শুরু করলো। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাদা মিহি ঘুণ পড়তে লাগলো। পড়ুক, তাতে কোন সমস্যা নেই। কাজ তো চলছে।
রঞ্জনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করে দেয়া দরকার। রেজনিক হ্যালিডে আর গোল্ডস্টেইন তার হাতে ধরিয়ে দিতেই সে বললো, “আমার ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের কিছু সমস্যা ছিল। আপনি কি কালকে থাকবেন?”
“কালকে তোমাকে সময় দিতে পারবো না।“
“আপনার চেয়ারের ঘুণপোকা মারার একটা ওষুধ আমার আছে। ঘুণপোকা নির্বংশ হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।“
“কারেন্ট আসুক। অন্ধকারে কীভাবে যাবো? আসার সময় তো পড়ে যাচ্ছিলাম। স্যান্ডেলে গোবর লেগে গেছে।“
“কারেন্ট আসতে অনেক দেরি আছে। আজ বৃহস্পতিবার, কারেন্ট আসবে অনেক রাতে। তুমি একটা মোমবাতি নিয়ে যাও।“
ছোট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে চলে গেল। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম টেবিলের উপর তার পিঁয়াজুর ঠোঙাটা ফেলে গেছে। তাকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকলাম না।
রান্নাঘরের অবস্থা খারাপ। কালকের কিছু ভাত আর সবজি আছে। ভাতের ডেকসির ঢাকনা তুলতেই দেখা গেলো কালো কালো পিঁপড়ায় ভর্তি হয়ে আছে সেটা। তরকারি থেকে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছে। ফ্রিজ থাকলে এই সমস্যা হতো না। আমার ফ্রিজ কেনার টাকা নেই, তাই ফ্রিজের অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বেশ কিছু জোরালো যুক্তি আছে – যার মধ্যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বন্ধ করা টাইপের উচ্চস্তরের ব্যাপারও আছে।
এই বাসায় এখনো গ্যাসের লাইন আসেনি। সালাম সাহেব প্রতি মাসেই ভাড়া নেবার সময় বলেন, “এই মাসেই গ্যাস চলে আসবে। আপনাকে আর হিটারে রান্না করতে হবে না। তবে গ্যাস পাবেন এক চুলার।“ সালাম সাহেব আগামী মাসেও একই কথা শোনাবেন। এখন কী করা যায়? আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি। এখন কারেন্ট নেই – রান্না করারও উপায় নেই। একটা একটা করে খেতে খেতে রঞ্জনের ঠোঙাটার শেষ পিয়াজুও ঢুকে গেছে পেটে। কিন্তু ক্ষুধা যায়নি। ঘন্টাখানেকের ভেতর কারেন্ট না এলে হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।
টাইপরাইটারটা টেনে নিলাম। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত পাঠাচ্ছি। কিছু কিছু প্রস্পেকটাস আসতে শুরু করেছে। টোফেল জি-আর-ই দিতে হবে। এদিকে ১৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে গেছে গত মাসে। শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। প্রিলিমিনারিতে টিকলে ভাইবা হবে। অনার্স মাস্টার্সের আনুপাতিক নম্বর যোগ হবার পর ভাইবাতে শুধুমাত্র পাস নম্বর পেলেও আমার টিকে যাওয়া উচিত। কিন্তু জানি না কী হয়।
দরজায় কে যেন জোরে জোরে কিল ঘুষি মারছে। এভাবে দরজা নক করতে পারে কে?
“কে?”
“আমি”
মেয়ে কন্ঠের এই আমিকে তো আমি চিনি না। কে হতে পারে? দরজা খুললাম।
পাশের বাসার স্বপনের মা। একটা কাঁসার থালা ডানহাতে ধরে আছেন। তার উপর ভাঁজ করা একটি কাগজ।
“আপনার চিঠি। একটা ছেলে দিয়ে গেছে বিকালে।“
হাতচিঠি দেয়ার এই পদ্ধতিটি আমার কাছে অভিনব মনে হচ্ছে। থালার উপর থেকে চিঠিটি নিয়ে বললাম, “স্বপন বলছিলো সন্ধ্যাবেলা।“
“আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। এই মাত্র ফিরেছি।“
“আচ্ছা ঠিক আছে।“
দরজা বন্ধ করে কাগজটা খুললাম।
“আমি এসেছিলাম। না পেয়ে ফিরে গেলাম। আবার আসবো। বিকেল ৪টা ২৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড।“
কোন মানে হয়? নিজের নামটা লিখতে কী সমস্যা হয়? ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দিয়ে আমি করবোটা কী যদি কে এসেছিল জানতে না পারি। হাতের লেখা বেশ আর্টিস্টিক। কাগজটা কোন খাতা থেকে ছিঁড়েছে। ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দেখে মনে হচ্ছে ডিজিটাল ঘড়ি দেখে সময় লিখেছে। আর ওরা তো বললোই একটা ছেলে। আবেদিন বলেছে আমার ছাত্র – সাইকেল নিয়ে এসেছিল। কিন্তু কে এসেছিল? শাহীন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে আমার জানামতে বাসা চেনে বাবর। তার সাথে তো দেখা হয়েছে আজ। সে এলে তো বলতো। রঞ্জন বলেছে সে একবার এসেছিল বিকেলে। এটা রঞ্জনের লেখা নয়। অন্য কেউ হবে। আবার আসবে বলেছে – দেখা যাক কখন আসে।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো হৈচৈ-এর শব্দে। দরজার বাইরে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। ঘর অন্ধকার। সুইচ টিপতেই বাতি জ্বললো। কারেন্ট এসেছে। রাত সাড়ে বারোটা। এত রাতে কিসের হৈ চৈ? বাইরের ঘরে আসতেই পরিষ্কার শোনা গেল সালাম সাহেবের স্ত্রীর চড়া গলা – কালিয়া দিনর ভিতর আঁর ঘর খালি গরি দিবি।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছে, “কালকে দিনের মধ্যে আমার ঘর খালি করে দিবি।“
আমার বাম পাশের প্রতিবেশী সম্পর্কে সালাম সাহেবের স্ত্রীর বড় বোন। অনেকদিন থেকে এখানে আছে। তার স্বামী কিছুই করেন না। কোন ছেলেমেয়েও নেই। ঘরের ভেতর একটা রুমে মুরগির খামার করেছেন, অন্যরুমে নিজেরা থাকেন। অনেকদিন থেকে নাকি ঘরভাড়াও দেন না, ঘরও ছেড়ে দেন না। এই নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ঝগড়া। কাল সকালে কী হবে জানি না। কিন্তু এই মধ্যরাতে এরকম চিৎকার চেঁচামেচি হলে মানুষ ঘুমাবে কীভাবে? এই প্রশ্ন এখানে কেউ করে না। চিৎকার চেঁচামেচি ঝগড়া মারামারি এখানকার জীবন-যাপনের অংশ।
ক্ষুধা লেগেছে প্রচন্ড। কিন্তু এত রাতে আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। এত রাতে কোন হোটেলও খোলা পাবো না। সুতরাং ঘুম।
শুক্রবার সকালে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠার মধ্যে এক ধরনের রাজকীয় আনন্দ আছে। কিন্তু আজ রাজকীয় আনন্দে ছেদ পড়লো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। মাত্র পৌনে আটটা বাজে। এত ভোরে কে এলো? অনেক বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম।
“গুড মর্নিং স্যার।“
“আলী আশরাফ, তুমি? এত সকালে?”
“সরি স্যার, আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব আর্লি রাইজার। আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত স্যার। আমি কি পরে আসবো?”
আমার খালি গা, পরনে লুঙ্গি – কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। এই পোশাকে ছাত্রের সামনে অস্বস্তি তো লাগবেই। বললাম, “তুমি ভেতরে এসে বসো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।“
মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় পালটে যখন বাইরের ঘরে এসে দেখি আলী আশরাফ বুকশেল্ফের বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখছে।
“তুমি কালকে এসেছিলে সাইকেল নিয়ে?”
“জি স্যার।“
“চিঠি লিখে পাশের বাসায় দিয়ে গেছো?”
“জি স্যার।“
“নিজের নাম লেখোনি কেন?”
“নাম লিখিনি? ভুল হয়ে গেছে স্যার।“
“এত সকালে? বাসা চিনলে কীভাবে?”
“গতকাল খবর নিয়ে গেছি।“
“এই এলাকায় আমার বাসা কে বললো তোমাকে? আমার বাসা কোথায় তা তো কলেজের কারো জানার কথা নয়।“
“কী যে বলেন স্যার? কলেজের অনেক স্টুডেন্টই জানে আপনি এই এলাকায় থাকেন।“
“কোথায় থাকো তুমি?”
“আগ্রাবাদ”
“আগ্রাবাদ থেকে এত সকালে চলে এসেছো?”
“সাইকেল নিয়ে চলে এসেছি স্যার। বেশিক্ষণ লাগেনি। শুক্রবার – রাস্তা ফাঁকা।“
“কেন এসেছ বল।“
“এলাম স্যার একটু কথাবার্তা বলতে। ক্লাসের বাইরে আপনার সাথে কথা বলার তো সুযোগই পাই না স্যার। পড়ার বাইরে ইনফরমাল কথাবার্তা বলার জন্য এসেছি স্যার। আপনার বাসাটাকে স্যার আমার লাইসিয়াম বলে মনে হচ্ছে।“
“কোন্ লাইসিয়ামের কথা বলছ তুমি? মিমি সুপারমার্কেটের বইয়ের দোকান লাইসিয়ামের কথা? নাকি অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের কথা?”
“অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের কথা স্যার। আমরা তো স্যার এখন শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য পড়ি। জ্ঞান অর্জনের জন্য তো পড়ি না।“
মনে হচ্ছে আলী আশরাফ ভবিষ্যতে দার্শনিক টাইপের কিছু হবে। অনেক ভালো ভালো কথা বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। কিন্তু আমার যে ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড়। শিক্ষকের বাড়িতে আসার সময় কিছু খানাপিনা নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত ছিল। কী করি। তাকে বসিয়ে রেখে দোকানে যাওয়া সম্ভব নয়, আবার তার সামনে রান্না করাও সম্ভব নয়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দর্শন চর্চাও তো বেশি ভালো লাগার কথা নয়।
ঘন্টা দুয়েক পর আলী আশরাফ বিদায় নিলো। যাবার আগে জানিয়ে গেল, “মাঝে মাঝে আসবো স্যার। বিরক্ত হতে পারবেন না।“
আজ প্ল্যান করে রেখেছিলাম একটুও বের হবো না কোথাও। পাশের বাসা আজ খালি করে দেবার কথা। কিন্তু রাতের গন্ডগোল সম্ভবত রাতেই মিটে গেছে। পাশের বাসার এক ঝাঁক মুরগি এখন এই দুপুরে ঘরের বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে। ফার্মের এই মুরগিগুলো খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারে না। তাদেরকে বাইরে কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছে জানি না। আমার দরজার সামনে এখন তারা স্বাধীনভাবে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে রেখেছে। বাতাসের সাথে বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। বাইরে বের হতে গেলেই সেগুলো মাড়াতে হবে। দরজা-জানালা খুলে রাখা সম্ভব নয় আর।
আলী আশরাফ যাওয়ার পর দ্রুত রান্না করে এত বেশি পরিমাণে খেয়েছি যে মনে হচ্ছে খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি দেখলাম দুপুর আড়াইটা। দরজায় খুব মৃদু শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আলতো করে টোকা দিচ্ছে। দরজার সামনে মুরগিগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে নাকি? কিন্তু দরজারা হুক নাড়ছে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ এসেছে। কিন্তু এত মৃদুভাবে কড়া নাড়ছে যে ঠিকমতো শোনাও যাচ্ছে না।
উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। দরজার সামনে শ’খানেক মুরগি পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মেয়ে। আর একটু দূরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের প্রায় সবগুলো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। এই মেয়ে চারজনকে আমি চিনি। কলেজের ইউনিফর্ম পরেনি বলে একটু অন্যরকম লাগছে তাদের।
No comments:
Post a Comment