Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ৯


 আই. . সি. এস

           
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স বা আই-এ-সি-এস এর কিছুটা পরিচয় এখানে দেয়া যাক। ভারতের মাটিতে আধুনিক বিজ্ঞানের বীজ রোপিত হয় বিদেশিদের দ্বারা- তাঁদের নিজেদের স্বার্থে।[1]  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানের সাবালকত্ব অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভারতে স্বদেশি বিজ্ঞান গবেষণার গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার।
            মহেন্দ্রলাল সরকারের জন্ম ১৮৩৩ সালে হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে অনেক কষ্টে। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান, আট বছর বয়সে মা। তারপর মামাদের আশ্রয়ে মানুষ। লেখাপড়ায় দুর্দান্ত রকমের ভালো ছিলেন। ভালো স্কুলে পড়েছেন স্কলারশিপ নিয়ে। ১৮৪০ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে। সব ধনী লোকের ছেলেরা পড়তো হেয়ার স্কুলে। তারা অবৈতনিক ছাত্রদের খুব হাসিঠাট্টা করতো। ১৮৪৯ সালে স্কুল পাস করে মহেন্দ্রলাল ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। তারপর ১৮৫৪ সালে ভর্তি হন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ১৮৬০ সালে কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারি পাস করেন। মেডিসিন, সার্জারি ও ধাত্রীবিদ্যায় অনার্স লাভ করেন তিনি। ১৮৬৩ সালে তিনি এম-ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের দ্বিতীয় এম-ডি।
            আধুনিক ওয়েস্টার্ন মেডিসিনের ডক্টরেট হয়েও তিনি ভারতীয় দেশাত্ববোধ ও ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং কম পয়সায় গরীবমানুষকে চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় বলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। ১৮৬৭ সাল থেকে তিনি ভারতে ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশান গড়ে তোলার প্রয়োজনের কথা বলতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন খুবই সক্রিয় সংগঠক। ব্রিটিশ সরকারের ওপর তাঁর কোন আস্থা ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যা করার নিজেদের তাগিদেই করতে হবে। ১৮৬৮ সালে তিনি ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞান অনুশীলন সমিতি গড়ে তোলার কথা বলেন।
            তিনি চেয়েছিলেন এমন  একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যার অনুপ্রেরণা হবে লন্ডনের রয়েল ইনস্টিটিউশন এবং ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশান ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স। বিদেশি শাসকদের অর্থানুকুল্যে নয়, শুধু দেশবাসীর দরাজ অনুদানেই তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান  যেখানে গবেষণা করার জন্য লাগবে না কোন ডিগ্রির তকমা, শুধু বিজ্ঞান ভালবাসাই হবে যোগ্যতা।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার


এই লক্ষ্যে তিনি ধনী ভারতীয়দের কাছ থেকে চাঁদা তুলতে শুরু করেন। অনেকে এক হাজার, দুহাজার রুপি পর্যন্ত চাঁদা দেন। সেই সময় এই টাকার মূল্য অনেক বেশি থাকলেও চাঁদা দেয়ার লোক বেশি ছিল না। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক লাঁফো মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগকে খুব সহায়তা করলেন। তাঁর সহায়তায় মহেন্দ্রলাল সরকার বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পলের সাথে দেখা করলেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকটি মিটিং-এর পর সরকারি সাযায্য পাবার আশ্বাস পাওয়া গেলো। তারপর অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর, অনেক মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরার পর অবশেষে প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন হলো।
            ১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বউবাজার স্ট্রিটের ২১০ নম্বর বাড়িটি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হলো অ্যাসোসিয়েশানের কাজকর্মের জন্য। প্রতিষ্ঠিত হলো আই-এ-সি-এস। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখা ছিল - যাঁহারা এক্ষণে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ বিজ্ঞানশাস্ত্র অধ্যয়নে একান্ত অভিলাষী আছেন, কিন্তু উপায়াভাবে সে অভিলাষ পূর্ণ করিতে পারিতেছেন না এইরূপ ব্যক্তিগণকে বিজ্ঞানচর্চা করিতে আহ্বান করা হইবে।[2]
            সরকার শুরুতে এই বাড়ির মালিকানা অ্যাসোসিয়েশানের হাতে দেয়নি, শুধু ব্যবহার করতে দিয়েছিল। তার মানে সরকার ইচ্ছা করলে সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েশান তুলে দিতে পারে। অনেক দেনদরবার করে ১৮৮০ সালে সরকারের কাছ থেকে এই বাড়িসহ জমি কিনে নেয়া হলো অ্যাসোসিয়েশানের নামে। ১৮৮৪ সালে অ্যাসোসিয়েশানের লেকচার হল তৈরির কাজ শেষ হলো। নিয়মিত বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার জন্য এই হলের খুব দরকার ছিল। ১৮৮৪ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপন এই হলের উদ্বোধন করেন। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙালি বিজ্ঞানী এই হলে বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক বক্তৃতায় বিজ্ঞানের সত্যিকারের প্রসার হয় না। তার জন্য দরকার নিয়মিত গবেষণা। গবেষণার জন্য দরকার গবেষণাগার।             অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণাগার তৈরি করে দেবার জন্য বিজয়নগরের মহারাজার সাহায্য চাইলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ১৮৯১ সালে তৈরি হলো বিজয়নগর ল্যাবোরেটরি। বেশ বড় বড় রুম এবং অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হলেও তখনকার বাঙালি গবেষকদের কেউই এই গবেষণাগারে গবেষণা করতে এগিয়ে এলেন না। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু অনেক কষ্ট করে প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণাগার তৈরি করে সেখানে বসে কাজ করেছেন। তিনিও অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণাগারে বসে কাজ করতে আগ্রহী হননি। ধরতে গেলে ১৯০৭ সালে রামন আসার আগপর্যন্ত এই বিজয়নগর গবেষণাগার এক প্রকার অব্যবহৃতই ছিল।
            অ্যাসোসিয়েশানের কাজকর্ম চালানোর জন্য প্রচুর ফান্ডের দরকার। আশা করা হয়েছিল স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিত্তবান ভারতীয়রা নিশ্চয়ই এ শুভ কাজে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু সে আশা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও এ প্রতিষ্ঠানের জন্য আশানুরূপ অর্থ সংগ্রহ করতে পারেননি।
            বিজ্ঞান গবেষণায় বাঙালির কৃপণতা লক্ষ্য করে ১৯০০ সালে লর্ড কার্জনও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে তো ধনী পৃষ্ঠপোষকের অভাব নেই। তবে তাঁরা কেন এরকম মহৎ প্রয়াসে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন না?[3]
            জীবনের শেষবেলায় মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন আশাভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত। অ্যাসোসিয়েশানে একটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট অর্থসাহায্য জোগাড় করা গেলো না। বড়ই দুঃখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে বিজ্ঞান-সভা স্থাপনা করার চিন্তাই ছিল ভুল। সমস্ত জীবনে এক মরীচিকার পিছনে ছুটে বেড়ালেন। তার চেয়ে ডাক্তারিতে মন দিলে হয়তো গত তিরিশ বছরে যে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তিনি নিজেই উপার্জন করতে পারতেন। ১৯০৪ সালে মহেন্দ্রলাল সরকার মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর আই-এ-সি-এস এর পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাঁর ছেলে অমৃতলাল সরকার।
            খুব হতাশা নিয়ে মারা গেলেও মৃত্যুর আগে মহেন্দ্রলাল সরকারের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, একদিন তরুণ বিজ্ঞানীরা নিজের ভেতরের বৈজ্ঞানিক তাড়নায় আরো অনেক বেশি শক্তি নিয়ে কাজ করতে এসে দাঁড়াবে এই প্রতিষ্ঠানের দরজায়। রামনকে দেখে অমৃতলাল বুঝতে পারলেন সেই দিন এসে গেছে।



[1] এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়. ভারতীয় বিজ্ঞান: উত্তরণের কাল. কলকাতা: কেমব্রিজ ইন্ডিয়া, ২০০৫.
[2] শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ ১৯৯৯.
[3] এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়. ভারতীয় বিজ্ঞান: উত্তরণের কাল. কলকাতা: কেমব্রিজ ইন্ডিয়া, ২০০৫.

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts