25
টিচার্স রুমে ঢুকে বুঝতে পারলাম কিছু একটা হচ্ছে। নাসির স্যার যে টেবিলে বসেন সেখানে অনেক ফাইলপত্র। সুচরিত স্যার এই টেবিলটার নাম দিয়েছেন বাদশাহী টেবিল। তিনি বলেন, “এই টেবিলে দু’জন বাদশাহ বসেন – বাদশাহ নাসিরুদ্দিন আর সোলেমান বাদশাহ।“
ছোলাইমান স্যার যে বাদশাহ তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর চালচলনে বাদশাহী ভাব, পরনে বহুমূল্য পোশাক। তাঁর পায়ের জুতা আসে ইটালি থেকে। হাতে যে সোনালী ঘড়িটা পরেন তার নাম রাডো। এরকম হাতঘড়ি আগে কখনো দেখা তো দূরের কথা, নামও শুনিনি। একদিন ছোলাইমান স্যার যখন ঘড়িটা দেখাচ্ছিলেন – সুচরিত স্যার বলেছিলেন, এই ঘড়ির দাম তো সত্তর আশি হাজার টাকা হবে। ছোলাইমান স্যার মৃদুকন্ঠে বলেছিলেন, এক লাখ দশ হাজার। আমি মনে মনে হিসেব করে দেখেছিলাম - ছোলাইমান স্যারের একটা ঘড়ির দাম দিয়ে আমার হাতে যে ঘড়িটা আছে সেরকম ৪৪০টি ঘড়ি পাওয়া যাবে।
কলেজে প্রভাবশালী হিসেবে নাসির স্যার বাদশাহ ঠিকই, কিন্তু তাঁর মধ্যে বাদশাহী ভাব একটুও নেই। নামের একটা মাহাত্ম্য তো আছেই। বাদশাহ নাসিরুদ্দিনের মতোই নাসির স্যার চাকচিক্যের ধার ধারেন না। এখন নিজের হাতে ফাইলপত্র গোছাচ্ছেন। সুচরিত স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার নাসির ভাই, ফাইলপত্র গোছাচ্ছেন?”
নাসির স্যার হাতের কাজ একটু থামিয়ে হাসিমুখে বললেন, “ও সুচরিত, প্রদীপ, তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল অ্যাডমিন। এখন থেকে এই রুমে আমি আর বসবো না। পাশের রুমে বসবো।“
এত বড় একটা খবর এত ক্যাজুয়েলি দিলেন যে আমি তার গুরুত্বই বুঝতে পারলাম না ঠিকমতো। একটু পর দেখলাম তিনি ফাইলপত্র নিয়ে চলে গেলেন পাশের রুমে। পাশের ছোট্ট অফিস রুমে গাউস সাহেব বসতেন। এখন গাউস সাহেব চলে গেছেন ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে অন্য অফিস স্টাফদের সাথে। কলেজে এখন দু’জন ভাইস প্রিন্সিপাল - উপাধ্যক্ষ (শিক্ষা) ও উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন)।
টিচার্স রুমে এ ব্যাপারে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মত-পার্থক্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডাম পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন। তিনি ভাবনার কথা নিশ্চয় কাউকে বলেছেন – নইলে তা আমাদের কানে কীভাবে আসছে। কলেজে ভেতরে ভেতরে অনেক কিছুই ঘটছে।
গতকাল ছুটির পর বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী বললো, “তোকে একটা কথা বলবো, কাউকে বলবি না কিন্তু।“
“কাউকে জানাতে না চাইলে আমাকেও বলিস না। আমার পেটে কথা থাকে না।“
“শুনে দেখ না এটা থাকে কী না।“
সে ফিসফিস করে বললো কিছু ঘটনার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, “কমপ্লেইন করেছিস?”
“কাকে কমপ্লেইন করবো? শেষে আমারই মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।“
“তো? কী করবি ভাবছিস?”
“রিজাইন করবো।“
“আর কোথাও অফার পেয়েছিস?”
“এখনো পাইনি, এক জায়গায় হবার কথা আছে।“
তার মানে সেও চলে যাচ্ছে শীঘ্রই। কর্মক্ষেত্রে এরকম আসা-যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কোন পদই কারো জন্য খালি পড়ে থাকে না। একজন যাবে, অন্যজন আসবে। তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই।
হাজিরা খাতায় সাইন করতে গিয়ে দেখলাম ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রিপোর্ট কার্ডে সাইন করছেন। আমাকে দেখে বললেন, “প্রদীপ, আপনার ক্লাসের রিপোর্ট কার্ডগুলো নিয়ে যাবেন।“
এই রুমটা এখন অনেক হিজিবিজি হয়ে গেছে। অফিস স্টাফ - গাউস সাহেব, কাদের সাহেব, নূর মোহাম্মদ সাহেব সবাই এই রুমে বসছেন এখন। সাইন করে ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললাম, “ম্যাডাম, আমার রিপোর্ট কার্ডগুলো।“
“ও হ্যাঁ, এই যে, নিয়ে যান। আপনার ‘দুর্বল’ বানানটি ঠিক করতে হবে। আপনি দীর্ঘ-উকার দিয়ে লিখেছেন।“
‘দুর্বল’ যে হ্রস্ব-উকার দিয়ে লিখতে হবে তা তো জানতামই না। তবুও ভালো যে শিক্ষার্থীদের হাতে পড়ার আগেই ঠিক করে দেয়ার সুযোগ পেলাম। ক্লাস সেভেনের ছেলে-মেয়েদের সেকেন্ড টার্মিনালের রিপোর্ট কার্ড দিয়ে দিতে হবে দু-তিন দিনের মধ্যে।
>>>>>>>>>
ক্লাস সেভেন এ সেকশানের রোল কল শেষ হবার সাথে সাথেই সুব্রত বেশ গম্ভীরভাবে বললো, “ত্রিভুজের বহিস্থ কোণ অন্তস্থ দূরবর্তী কোণদ্বয়ের সমষ্টির সমান।”
আমি হাজিরা খাতা বন্ধ করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, “তাতে কী হয়েছে?”
সুব্রত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “এটা প্রমাণ করতে হবে স্যার।“
“কেন প্রমাণ করতে হবে?” – আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
“কারণ স্যার এখন আমাদের গণিতের ক্লাসে আপনি আজ জ্যামিতি করাবেন। জ্যামিতির এই উপপাদ্যটি এখন প্রমাণ করতে হবে।“ – স্পষ্ট উচ্চারণে এক নিশ্বাসে বললো রেহনুমা। মনে হলো সুব্রতকে সাহায্য করছে সে।
আমার ক্লাসে সুযোগ পেলে কমবেশি সবাই কথা বলে। কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রায় সবাই উত্তর দিতে চায়। এতে ক্লাসে তরতাজা একটা ভাব থাকে। চুপচাপ নিষ্প্রাণ ক্লাসে একতরফা বক বক করাটাকে শিক্ষাদানের খুব একটা কার্যকর পদ্ধতি বলে মনে হয় না আমার।
আমি রেহনুমাকে বললাম, “উপপাদ্যটি আবার বলো।“
“কোন ত্রিভুজের বহিস্থ কোণ, ত্রিভুজটির অন্তস্থ দূরবর্তী কোণদ্বয়ের সমষ্টির সমান।“
“এত জটিল শব্দ ব্যবহার করছো কেন? বহিস্থ, অন্তস্থ, দূরবর্তী – এরকম জটিল শব্দ ব্যবহার না করলে হয় না?”
“জটিল শব্দ ব্যবহার না করলে কি উপপাদ্য হবে স্যার?”
“হবে না কেন? মূল বিষয়টাতো শব্দ নয়, বিষয়টা তো জ্যামিতি। উপপাদ্যটিকে সোজা বাংলায় বলো দেখি।“
ক্লাসে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সবাই কিছু না কিছু বলছে। তাদের সবার গলা ছাপিয়ে রেহনুমার গলা শোনা গেল, “কোন তিন-বাহুর বাইরের কোণ, তিন-বাহুটির ভিতরের দূরের কোণ দুইটির যোগফলের সমান।“
“তিন-বাহু কী জিনিস?” – আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম।
“ত্রি মানে তিন, আর ভুজ মানে বাহু – ত্রিভুজকে সোজা বাংলা করলে তিন-বাহু হয় না স্যার?” – রেহনুমার কথায় হেসে উঠে অনেকেই।
এদের এই প্রাণবন্ততা বেশ ভালো লাগে আমার। অনুভূতি লুকিয়ে রাখে না এরা। আনন্দে হেসে ফেলে, আর দুঃখে কেঁদেও ফেলে। এই যে রেহনুমা – এত হাসিখুশি। এখন দেখলে কেউ কি বিশ্বাস করবে যে সে ক্লাস টেস্টে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল! ক্লাস টেস্টে দুটো অংক আর একটি জ্যামিতি করতে দিয়েছিলাম। নির্ধারিত ৩০ মিনিট শেষ হবার পর যেই বললাম সময় শেষ, সাথে সাথেই সে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো।
“কী হয়েছে, কাঁদছো কেন?”
“স্যার, দু’লাইন লিখতে পারি নাই।“
“ঠিক আছে, কেঁদো না। এখন লিখে দাও দুই লাইন।“
“এখন তো স্যার সময় শেষ হয়ে গেছে।“
এত কম বয়সে কোন ধরনের অন্যায় সুযোগ না নেয়ার শিক্ষা সে কোত্থেকে পেয়েছে কে জানে। ক্লাসের সবাই হয়তো তার মতোই। এদেরকে ভালো না বেসে পারা যায়?
“স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে।“
দেখলাম পার্সা লোহানী হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
“কী প্রশ্ন?”
“স্যার, অঙ্কের মাস্টার গল্পটা কি আপনার লেখা?”
আমি এই প্রশ্ন আশা করিনি। বছর খানেক আগে এই নামে একটা গল্প আমি লিখেছিলাম যায় যায় দিন ম্যাগাজিনে। স্টুডেন্ট লাইফে আমার টিউশনির গল্প। এতদিন পর সেই গল্প পার্সা লোহানী কোথায় পেল? ওই ম্যাগাজিনের লেখাগুলি তো এত কম বয়সীদের জন্য উপযুক্তও নয়। তবে কি পার্সা লোহানীর মা-ও পড়েছেন এই গল্প? সপ্তাহ-খানেক আগেও আমি জানতাম না যে পার্সা হুমায়রা ম্যাডামের মেয়ে। গত আট মাস ধরে ক্লাস সেভেনে ক্লাস নিচ্ছি আমি। হুমায়রা ম্যাডাম একবারও বলেননি যে তাঁর মেয়ে আমার ক্লাসে আছে।
চমৎকার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব ইকোনমিক্সের হুমায়রা ম্যাডামের। মাসখানেক আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি মেরিন একাডেমির ক্যাডেটদের কয়েকটা ফিজিক্স ক্লাস নিতে পারবো কি না। কথায় কথায় জানতে পারি ম্যাডামের স্বামী মেরিন একাডেমির পরিচালক। ম্যাডাম মেরিন একাডেমির কোয়ার্টারে থাকেন। প্রতিদিন একাডেমির স্পিড বোটে নদী পার হয়ে কলেজে আসেন। গত সপ্তাহে একদিন পার্সা ক্লাসে দেরি করে এসেছিল। বলেছিল বোট আসতে দেরি করেছে। কোথাকার বোট, কেন দেরি হলো এরকম কিছুই আমি জানতে চাইনি। সেদিনই হুমায়রা ম্যাডাম আমার কাছে এসে বললেন, “সরি আজ বোট আসতে দেরি হওয়ায় আমার মেয়েটার ক্লাসে আসতে দেরি হয়েছে।“
“আপনার মেয়ে?”
“পার্সা লোহানী”
আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আজ আবার অবাক হচ্ছি পার্সা আমাকে গল্পের বিষয়ে প্রশ্ন করছে দেখে। ভয়ও হচ্ছে। হুমায়রা ম্যাডাম যদি গল্পটা পড়েন এবং ভাবেন যে আমি নিয়মিত গল্প-টল্প লিখি তাহলে তো বিপদ। আমি হলফ করেও যদি বলি যে এই গল্পটাই আমার একমাত্র গল্প – তিনি কি বিশ্বাস করবেন? রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে হুমায়রা ম্যাডামের খুব বন্ধুত্ব। রিফাৎ আরা ম্যাডাম যদি জানতে পারেন যে আমি গল্পও লিখেছি তাহলে আরো কী বিপদ হয় কে জানে। লিটারেচারের শিক্ষকরা গল্পের ব্যবচ্ছেদ করেন, অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ফেলে গল্পের কাঠামো ভাব ভাষা এগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। তুমি আমাকে কী বিপদে ফেললে পার্সা লোহানী। কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর তো দিতে হবে।
বললাম, “কোথায় পেলে সেই গল্প?”
“একটা ম্যাগাজিনে স্যার। আপনার নাম লেখা আছে সেখানে।“
“তাহলে?”
“গল্পে যা যা লিখেছেন তা সব সত্যি স্যার? আমাদের নিয়েও একটা গল্প লিখবেন স্যার?”
এরকম প্রশ্ন থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা। তাড়াতাড়ি জ্যামিতির উপপাদ্য প্রমাণ করতে শুরু করলাম – কোন ত্রিভুজের বহিস্থ কোণ, ঐ ত্রিভুজের অন্তস্থ দূরবর্তী কোণদ্বয়ের সমষ্টির সমান।
>>>>>>>>>
“স্যার, আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?”
টিচার্স রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফারজানা। সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে তারা। নতুন ফার্স্ট ইয়ার এখনো আসেনি। ফার্স্ট ইয়ারের ভর্তি ফরম দেয়া হচ্ছে। ফারজানার পেছনে তার সহপাঠী জয়নব, ফাহমিদা, আর মিতা।
“অবশ্যই কথা বলা যাবে। কী বলবে বলো।“
“আমরা স্যার আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাই।“
“প্রাইভেট পড়তে হবে না। তোমাদের কী সমস্যা আছে ক্লাসে বলো, আমি বুঝিয়ে দেবো।“
“না স্যার, আমাদের চারজনকে স্যার আপনাকে পড়াতেই হবে।“
অঞ্জন স্যার আমার পাশে বসে আছেন। তিনি মিতাকে বললেন, “হ্যাঁ তোমরা প্রদীপ স্যারকে রাজি করাও। পড়াবে না কেন? স্টুডেন্টদের হেল্প করা তো টিচারের কর্তব্য।“
“আমি তো হেল্প করবো না বলছি না। আমি প্রাইভেট পড়াবো না বলছি।“
“কেন, কী হয়েছে? তুমি না পড়ালে এরা কার কাছে গিয়ে পড়বে বলো তো?” – অঞ্জন স্যার যুক্তি দেখান।
“তোমাদের কার কী সমস্যা আছে আমাকে ক্লাসে দেখাবে। বা ক্লাসের বাইরেও কলেজে দেখাবে।“ – আমি তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা খুব একটা খুশি হয় না। মিতা অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বলে, “আপনি আমাদের পড়াবেন স্যার।“
একটু বেশি আত্মবিশ্বাসের সুর তার গলায়। এর কারণ কী?
"অঙ্কের মাস্টার" গল্পটা সত্যিই কি আপনার বাস্তব জীবনের
ReplyDeleteঘটনা ?
হ্যাঁ। আমার টিউশনির ঘটনা।
Delete