রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ
বিশ্বজুড়ে
বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক-অর্জনের একটি প্রধান সম্মানজনক ধাপ হলো রয়েল সোসাইটির
ফেলোশিপ পাওয়া। রয়েল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৬০ সালে। পৃথিবীর সমসাময়িক
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের নিয়মিত আলোচনা সভা বসে এই
সোসাইটিতে। বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য থাকে এফ-আর-এস বা 'ফেলো অব রয়েল সোসাইটি' টাইটেল
অর্জন করার। ভারতীয়দের মধ্যে রামনের আগে গণিতবিদ রামানুজন ও পদার্থবিজ্ঞানী
জগদীশচন্দ্র বসু রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন।
রামনের ১৯০৭ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত
গবেষণার ভিত্তিতে ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে সি ভি রামনের নাম প্রস্তাব করা হয় রয়েল
সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য। রয়েল সোসাইটিতে রামনের নোমিনেশান সার্টিফিকেট (মনোনয়ন
সনদ) থেকে দেখা যায় রামনকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন রয়েল সোসাইটির ফেলো: সিডনি বুরার্ড (Sidney G Burrard), জন এভারশেড (John Evershed), গিলবার্ট ওয়াকার (Gilbert T Walker), জর্জ সিম্পসন (George C Simpson), চার্লস মিডলমিস (Charles S
Middlemiss), আলফ্রেড পোর্টার (Alfred W Porter), এবং এডউইন বার্টন (Edwin H Barton)। গবেষণা ও
প্রকাশিত গবেষণা-পত্রের ভিত্তিতে তাঁকে ফেলোশিপ দেয়া হয় ১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর।[1]
রামন তাঁর গবেষণার
স্বীকৃতি পেলে শিশুর মতো খুশিতে হৈ চৈ করেন। আবার একই ভাবে তাঁর গবেষণার কেউ
সমালোচনা করলে তিনি শিশুদের মতোই রেগে আগুন হয়ে যান। এফ-আর-এস হয়ে রামন খুবই খুশি।
কিন্তু তাঁর লক্ষ্য হলো নোবেল পুরষ্কার। রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়া উপলক্ষে
রামনকে অভিনন্দন জানিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয় তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য কী, তিনি এক
সেকেন্ডও চিন্তা না করে বলেন, "অবশ্যই নোবেল পুরষ্কার।"
১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশান ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের আমন্ত্রণে কানাডার টরন্টোতে
যান রামন। সেখানে তিনি আলোর বিক্ষেপণের ওপর বক্তৃতা দেন। সেখান থেকে তিনি যান
ফিলাডেলফিয়ায় ফ্রাঙ্কলিন ইন্সটিটিউটে। সেখানে আগের বছরের (১৯২৩) নোবেল বিজয়ী
পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান রামনকে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে
(ক্যালটেক) কিছুদিন কাটানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান।
রবার্ট মিলিক্যান ও রামন |
রামন সেপ্টেম্বরের
মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্যালটেকে ছিলেন। সেখানে অনেক বিজ্ঞানী
ও তাঁদের গবেষণার সাথে পরিচিত হন প্রফেসর রামন। আমেরিকার আরো অনেক ইউনিভার্সিটি
ভ্রমণ করে তিনি ইওরোপে আসেন। সেখানে নরওয়ে, জার্মানি ও ডেনমার্ক ভ্রমণ করে ১৯২৫
সালের মার্চ মাসে তিনি কলকাতায় ফেরেন।
এপ্রিল থেকে জুলাই
পর্যন্ত অনেক কাজ করে ফেললেন রামন। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ এই তিন বছরে তাঁর পঞ্চাশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এগুলো
ছাড়া তাঁর ছাত্রদের পেপারতো আছেই। ১৯২৪-২৫ সালে বিদেশ ভ্রমণের মধ্যেও তাঁর চৌদ্দটি
গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
১৯২৫ এর আগস্ট মাসে রামন
আবার গেলেন ইওরোপে। প্রথমে গেলেন রাশিয়ায়, ম্যান্ডেলিফ কংগ্রেসে যোগ দেয়ার জন্য
মস্কোতে। সেখান থেকে জর্জিয়া, লেনিনগ্রাদ, বার্লিন ও প্যারিস। সেখান থেকে
সুইজারল্যান্ড ও ইতালি। ইতালিতে আল্পস পর্বতের তুষারের উপর আলোর বিক্ষেপণ
পর্যবেক্ষণ করেন। চার মাস ইওরোপে কাটিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরেন নভেম্বর মাসে।
প্রফেসর রামন ক্রমশ
ভারতের বিজ্ঞানচর্চার আইকনে পরিণত হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন
উৎসবে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ডাক পাচ্ছেন তিনি। তরুণ প্রজন্মের সাথে কথা বলা, তাদেরকে
উদ্বুদ্ধ করাটাকে তিনি প্রত্যেক শিক্ষকের কর্তব্য বলে মনে করতেন।
১৯২৬-২৭ সালে রামন
ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে অনেকগুলো বক্তৃতা দেন।
সেগুলোতে তাঁর জীবনদর্শনের অনেক প্রতিফলন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, শুধুমাত্র বইপড়া
বিদ্যা তেমন কোন কাজে আসে না। বইপোকা তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হতে পারে
না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
দিয়ে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরি করা। তারা ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে, বিজ্ঞান-গবেষণায়
নেতৃত্ব দেবে, শিল্প-উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবে, আরো যেসব ক্ষেত্র আছে সবগুলোতে নেতৃত্ব
দেয়ার জ্ঞান ও দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা থেকে আসতে হবে। বইপোকা কী করে? বইপোকা
মুখ দিয়ে বই খায় আর পেট থেকে বের করে শুধু ধুলো যেগুলো কোন কাজে আসে না। জ্ঞান
শুধু অর্জন করলে হবে না, জ্ঞান সঞ্চালন করার ক্ষমতাও থাকতে হবে।
আধুনিক জ্ঞান ও
বিজ্ঞানের ব্যাপারে রামনের দর্শন খুবই পরিষ্কার। তিনি বলেন, আমরা পাঁচ হাজার বছর
আগের বেদ বা উপনিষদের যুগে বাস করি না। সেই বইগুলোতে জ্ঞান আছে সেকথা ঠিক, কিন্তু
গোয়ার্তুমি করে বা ধর্মপারায়ণ হয়ে শুধুমাত্র সেটুকু আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না।
সত্যিকার জ্ঞান হলো সেটাই যেটা সবসময়েই আমাদেরকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। বৈজ্ঞানিক
গবেষণা হচ্ছে আধুনিক পৃথিবীতে সামনে যাবার আধুনিক পথ।
অ্যাসোসিয়েশানে রামন
১৯২৬ সালে
স্যার সিভি রামনের সাথে আরো তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় কৃষ্ণানের। সেগুলো ছাড়াও
রামনের আরো চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় সেবছর। ১৯২৭ সালে কৃষ্ণান নয়টি
গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেন যাদের মধ্যে আটটির সহ-লেখক হিসেবে রামনের নাম আছে। সবগুলো
পেপারই তরলের ভৌত-ধর্ম সংক্রান্ত। এই পেপারগুলো রামনের নোবেলবিজয়ী গবেষণার
দিক-নির্দেশক। কৃষ্ণান রামনের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষালব্ধ ফলাফলগুলোর
তাত্ত্বিকদিকটা প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯২৭ সালে রামনের আরো বারোটি
গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় আলোর বিক্ষেপণের অনেকগুলো দিক
নিয়ে।
কৃষ্ণানের
প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তখনো শুধুমাত্র বিএ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এসসিতে ভর্তি
হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু পরীক্ষা দেয়া হয়নি। রামন তাকে পরামর্শ দিলেন যেসব
গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে এম-এসসি ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে। ১৯২৭ এর
এপ্রিলে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম-এসসি ডিগ্রির জন্য দরখাস্ত করলেন কৃষ্ণান। ১৯২৩
সাল থেকে যেসব গবেষণা-কাজ করেছেন সেগুলোর ভিত্তিতে রিসার্চ-মাস্টার্স ডিগ্রি দেয়ার
জন্য আবেদনপত্রে সুপারিশ করেন স্যার সি ভি রামন। রামনের সুপারিশ ও কৃষ্ণানের
গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে ১৯২৭ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন
কৃষ্ণান।
[1] Rajinder Singh. The story of C. V. Raman’s
resignation from the Fellowship of the Royal Society of London. CURRENT SCIENCE 2002;83 (9).
No comments:
Post a Comment