03
ওয়েটিং লিস্ট! বলে কী ছেলেটা! ফাজলামি করছে না তো?
দেখলাম ছেলেটির নীল সোয়েটারে আকাশী নেমট্যাগ - মাহফুজ। মুখে একটা হাসির ভাব এনে বললাম, "আরে মাহফুজ, কেমন আছো তুমি? কতদিন পর দেখা।"
মাহফুজ কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, "সেই যে ফরম জমা দিতে আসার সময় দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। মনে আছে?"
মনে পড়লো। আমি যেদিন চাকরির দরখাস্ত জমা দিতে এসেছিলাম, তার সাথে দেখা হয়েছিল মেইন গেইটের গার্ডরুম থেকে কলেজে আসার পথে। সেও ভর্তির দরখাস্ত জমা দিতে আসছিলো। দরখাস্ত শুনেই সে ভেবে নিয়েছিল আমিও ভর্তির দরখাস্ত জমা দিতে এসেছি। আমি তার ভুলটা ভাঙাইনি।
"তুমি সায়েন্সে?" - বেসিনে হাত ধুতে ধুতে মাহফুজের প্রশ্ন।
"হ্যাঁ। তুমি?"
"আমিও"
"কোন্ সেকশানে?" - উচ্ছ্বসিত মাহফুজ প্রশ্ন করলো।
"এখনো সেকশান দেয়নি।"
"এ সেকশান দিতে বলো। আমি এ সেকশানে।"
"ঠিক আছে বলবো।"
টয়লেট থেকে দু'জন একসাথে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। সেদিকের একটা বড় ক্লাসরুমে অনেক ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে। টেবিলে একটা হারমোনিয়াম ও তবলা দেখা যাচ্ছে। কোন অনুষ্ঠান হবে মনে হচ্ছে।
"তুমি তো ইউনিফর্ম সেলাই করো নাই এখনো। নাসির স্যার দেখলে ক্লাস থেকে বের করে দেবে।" আমার জন্য
মাহফুজের উদ্বেগ দেখে ভালো লাগলো।
"ঠিক আছে মাহফুজ। ক্লাসে দেখা হবে।"
"ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?"
"একটু অফিসের দিকে যাই। দেখি।"
"এখনো ভর্তি কমপ্লিট হয় নাই? এ সেকশানের কথা মনে রাখবে।"
"ঠিক আছে, মনে রাখবো।"
মাহফুজকে আস্বস্ত করে অফিসের দিকে পা বাড়ালাম।
কলেজের চারপাশ এত গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন যে খুব সংকোচ লাগছে। এটা একটা কলেজ - অথচ দেয়ালের কোথাও কোন পোস্টার লাগানো নেই, রাজনৈতিক স্লোগান লেখা নেই! বারান্দার ফ্লোরটাও এত পরিষ্কার যে নিজের জুতাজোড়াকে হঠাৎ খুব ময়লা বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য আজ বাসের ভীড়ে আমার জুতার উপর অন্তত কয়েকজনের পা পড়েছে। ভীড়বাসে কেউ পায়ের উপর পা দিলেই যে ঝগড়ার উদ্দেশ্যে দিয়েছে - এখন আর তা মনে করি না। গত সাত বছর ধরে চট্টগ্রামের বাসে চড়াটা যেমন গা-সহা হয়ে গেছে, তেমনি পা-মাড়ানোটাও পা-সহা হয়ে গেছে। কিন্তু আগে তো ময়লা জুতা কোন সমস্যা ছিল না। এখন তো মনে হচ্ছে কলেজে আসার সময় ব্যাগের ভেতর জুতার কালি ও ব্রাশ নিয়ে আসতে হবে। কলেজের ছেলেমেয়েদের পায়ে ঝকঝকে সাদা জুতো। এদের কেউ কি বাসে আসে? যদি আসে, তারা জুতার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে কীভাবে?
"প্রদীপ, আসো আসো। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।" - অঞ্জন স্যার বললেন।
শিক্ষক রুমে এখন অনেকেই আছেন। গণিতের ফারুকী স্যার ও বিমল স্যার, অর্থনীতির সোলায়মান স্যার, কেমিস্ট্রির সুপাল স্যার, আরবির মহিউদ্দিন স্যার, ইতিহাসের সাঈদ স্যার, শরীরচর্চার কামরুজ্জামান স্যার আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নাসির স্যারের সাথে পরিচয় হলো। কাইয়ুম স্যার, অঞ্জন স্যার, আর কাশেম স্যারের সাথে তো আগেই পরিচয় হয়েছে। সবাই খুব হাসিখুশি, আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা করলেন আমাকে। সুপাল স্যার হাসতে হাসতে বললেন, "আপনাকে দেখে তো আমরা ফিল্ড ইউনিটের লোক মনে করেছিলাম।"
সোলায়মান স্যার বললেন, "আমরা তাই বলাবলি করছিলাম। দূর থেকে দেখে ফিল্ড ইউনিটের সাহাবুদ্দিনের মত লাগছিল।"
"ফিল্ড ইউনিট কী?" -
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে সবাই হা হা করে হেসে উঠলেন।
"টিকটিকি, টিকটিকি। আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে।" - মহিউদ্দিন স্যার আশ্বস্ত করলেন। মহিউদ্দিন স্যারকে বয়সে সবার সিনিয়র বলে মনে হলো। তাঁর চেহারায় স্নিগ্ধতা, দৃষ্টিতে স্নেহ। জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার বাড়ি কোথায় প্রদীপ?"
"বাঁশখালি"
মুহূর্তেই টিচার্স রুমের পরিবেশটা কিছুটা বদলে গেলো। মনে হলো হঠাৎ যেন একসাথে অনেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে উঠলেন।
"ওয়া সোলেমান সাআব, তোঁয়ারার বাঁশখাইল্যা।" - বললেন মহিউদ্দিন স্যার।
"বাঁশখালির কইনৎ?" - সোলায়মান স্যার জানতে চাইলেন।
"নাপোড়া।"
"নাপোড়া নে? আঁর বারি পুকুরিয়া।"
দেখা গেলো মহিউদ্দিন স্যার, অঞ্জন স্যার, সোলায়মান স্যার, নাসির স্যার, সুপাল স্যার - সবার বাড়ি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের মানুষ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার কোন সুযোগ কখনও ছাড়ে না। আমরাও কিছুক্ষণ সেই সুযোগটা নিলাম।
একটু পরেই প্রায় সবাই চলে গেলেন পরীক্ষার ডিউটি করতে। আমি একা বসে রইলাম আমার সদ্যপ্রাপ্ত চেয়ারে। রুমের ভেতরেই একটা বাথরুম আছে - যেটা আগে খেয়াল করিনি। একটু পরেই সেখান থেকে বের হয়ে কামরুজ্জামান স্যার আমার সামনের চেয়ারে এসে বসলেন।
"প্রদীপ ভাই, একটা প্রশ্ন করি?"
শরীরচর্চা শিক্ষকরা খুব সিরিয়াস টাইপের হয়ে থাকেন। তাঁদের ভেতর একটা মিলিটারি মিলিটারি ভাব থাকে। কামরুজ্জামান স্যারকেও খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে। সিরিয়াস মানুষদের আমি খুব ভয় পাই। আমার স্কুল কলেজে যতজন শরীরচর্চা শিক্ষক আমি পেয়েছিলাম, সবার হাতেই আমি মার খেয়েছিলাম। এখানে কামরুজ্জামান সাহেব যতই সিরিয়াস হোন, মারধর নিশ্চয় করবেন না। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, "কী প্রশ্ন?"
"আপনাদের বাঁশখালির মানুষ নাকি একটু ডাকাত টাইপের হয়?"
"আমাকে দেখে কি ডাকাত টাইপের মনে হয়?"
"জ্বি, মনে হয়। তবে বেশি না, সামান্য।"
আমার মুখ হা হয়ে গেল।
কামরুজ্জামান সাহেব সিরিয়াস ভঙ্গিতে মেরুদন্ড সোজা রেখেই চেয়ার থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন। আমি বুঝতে পারছি না আমার ভেতর 'সামান্য' ডাকাতভাব কোত্থেকে এলো। আর সেটা কামরুজ্জামান স্যারের চোখে কীভাবে ধরা পড়লো।
রুমে কেউ নেই এখন। সবকিছু কেমন যেন চুপচাপ। কলেজ বলতে যেরকম একটা হৈ চৈ ব্যাপার বুঝি, এখানে সেরকম কিছু নেই। চেয়ার থেকে উঠে দরজায় দাঁড়ালাম। বাইরের খোলা সবুজ লনে শীতের রোদ ঝলমল করছে। এরকম ঘন সবুজ ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটতে কী যে আরাম - সেটা সম্ভবত এখানে কেউ জানে না। জানলে একজনও কি ঘাসে হাঁটতো না? বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের গায়ে লেগে আছে টুকরো টুকরো নীল আকাশ। স্কুল সেকশানের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। এরা নিশ্চয় কলেজের শিক্ষার্থী। দেখে মনে হচ্ছে শাসনের বাঁধনে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে এদের।
বারান্দার বাম দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন বেঁটে মোটাসোটা মানুষ ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুম থেকে বের হয়ে এদিকে আসছেন। মাঝখানের মাত্র দুটো রুম পার হয়ে আসতে যেন অনন্তকাল সময় নিচ্ছেন তিনি।
আগের পর্ব
No comments:
Post a Comment