27
শুনেছি স্নেহ জিনিসটা খুব একটা ভালো জিনিস নয়। এই জিনিসটি বেশি হয়ে গেলে হাজারো ঝামেলা তৈরি করে। শরীরে স্নেহ-পদার্থ বেশি হলে সমস্যার শেষ থাকে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মধ্যপ্রদেশে। সেটা তখন স্ফীত হতে থাকে। বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি ছোলাইমান স্যারের মধ্যপ্রদেশ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। মহাবিশ্বের স্ফীতির সাথে এর তুলনা যদিও চলে না, কিন্তু স্থান-কালের বক্রতা টের পাওয়া যায় এই স্ফীতির ফলে সৃষ্ট আনুষঙ্গিক পরিবর্তন দেখে। যেমন এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি সেই অঞ্চলে তাঁর শার্টের দুই বোতামের মাঝখানে হা হয়ে আছে জানালার মতো। ভেতরের সাদা গেঞ্জির অংশ-বিশেষ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে সামনের দিকে। এই তো স্থান-কালের বক্রতা। কিন্তু কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি! আইনস্টাইনের স্পেস-টাইম কার্ভেচারের তুলনা করছি … – ছোলাইমান স্যার জানতে পারলে আস্ত রাখবেন না আমাকে। একটু আগেই তিনি আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছেন কীভাবে কড়া শিক্ষক হতে হয় সে প্রসঙ্গে। তাঁর মতে শিক্ষকদের মনের ভেতর স্নেহ জাতীয় জিনিস বেশি থাকা উচিত নয়। আমার ভেতর নাকি স্নেহের পরিমাণ খুব বেশি – তাই আমার পক্ষে খুব একটা ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ভালো শিক্ষক হতে গেলে কড়া শিক্ষক হতে হয়। যদিও আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে আমার শরীরে কিংবা মনের কোথাও স্নেহ জাতীয় কোন পদার্থ নেই, আমি ছোলাইমান স্যারের কথা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না। কারণ তিনি আমাকে যেসব ব্যাপারে অভিযুক্ত করছেন তার সবগুলোই আমি করেছি।
“আপনি সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে-মেয়েদের বলেছেন কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে?”
“জ্বি, বলেছি। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?”
ছোলাইমান স্যার আমার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরমুখে তাঁর গলায় ঝোলানো সংক্ষিপ্ত টাইটি কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন। বুঝতে পারলাম এই গরমেও আজকে তাঁর টাই পরে আসার কারণ। তিনি আজ ডিউটি অফিসার ছিলেন। ছিলেন বলছি – কারণ ছুটি হয়ে যাবার পর ডিউটি অফিসারের ডিউটিও নিশ্চয় শেষ হয়ে যায়। তবে কি আজ কলেজের কোন ছেলে পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়ে আমার নাম বলে দিয়েছে? কে কে ধরা পড়েছে জানতে ইচ্ছে করছে। কারণ এই বেকুবদের চিনে রাখা দরকার। কিন্তু ছোলাইমান স্যার খোলাসা করে বলছেন না ব্যাপারটা।
“কীভাবে ধরলেন স্যার? ক’জন পালাচ্ছিল?” – অনেকটা মোলায়েমভাবে জিজ্ঞেস করলাম ছোলাইমান স্যারকে।
“এক জন দু’জন হলে তো ধরতে পারতাম না, এক সাথে দশ বারোজন পালাচ্ছিল। ছেলেরা তো আছেই। আপনি মেয়েদেরকেও কলেজ পালাতে উৎসাহ দিচ্ছেন?”
“মেয়েরাও ছিল না কি?”
“চারজন ছিল। সবগুলা সায়েন্সের। ভালো ভালো স্টুডেন্টগুলাকে আপনি এসব কী শেখাচ্ছেন?”
মনে মনে বললাম – শেখাতে আর পারলাম কই? ঠিকমতো শিখলে কি আর আপনার হাতে ধরা পড়ে?
আজ ক্লাসে কী যেন প্রসঙ্গে সালমান শাহ’র কথা উঠলো। বাংলা সিনেমায় ফিজিক্সের কোন সূত্র যে খাটে না এরকম কিছু কথা থেকেই সম্ভবত সিনেমার প্রসঙ্গ চলে এসেছিল। বিশেষ করে মারপিটের সময় হিরো কিংবা ভিলেন যেভাবে মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে উড়ে যায় তা দেখলে ফিজিক্সের সব সূত্র পালিয়ে যাবে।
“স্যার আপনি কি সিনেমা দেখেন?”
“দেখি না মানে? সিনেমা না দেখলে আমার ভাত হজম হয় না। চট্টগ্রাম শহরে এমন কোন সিনেমা হল নেই যেখানে আমি সিনেমা দেখিনি।“
“সালমান শাহ্র সিনেমা দেখেন স্যার?” – ইকবাল প্রশ্ন করে।
“ইকবাল সালমান শাহ্ কাট দিছে।“ – কে যেন বললো পেছন থেকে।
দেখলাম ইকবালের সাম্প্রতিক চুলের স্টাইল অনেকটা নায়ক সালমান শাহ্র মত হয়ে যাচ্ছে। বললাম, “দেখো, সামলে রাখতে পারো কি না। শেষে না নাসির-স্যার কাট দিতে হয়।“
সবাই হেসে উঠতেই বললাম, “সালমান শাহ্র স্নেহ চলছে। দেখেছো নাকি? তোমাদের গেটের কাছেই কলেজের নামে সিনেমা হল – আর সেখানে এখন সালমান শাহর সিনেমা চলছে। সেই সিনেমা তো অবশ্যই দেখা উচিত। তোমাদের এই হলে আমি অনেকবার সিনেমা দেখেছি।“
“এখন দেখেন না স্যার?”
“এই হলে আর দেখি না। ভয়ে দেখি না – যদি তোমাদের কারো সাথে দেখা হয়ে যায়।“
আবারো হাসির রোল উঠল ক্লাসে। সিনেমা দেখা কোন দোষের কিছু নয়। ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখাটাও মারাত্মক কোন দোষের মধ্যে পড়ে বলে আমি মনে করি না। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে এধরনের কাজে যে থ্রিল থাকে – অনার্সের ক্লাসে সে ধরনের থ্রিল থাকে না। ফ্রিডম না থাকলে ফ্রিডম পাবার আনন্দ পাওয়া যায়। তাই এখন যা করলে আনন্দ পাওয়া যাবে – তিন চার বছর পর সেই কাজে আর সেরকম আনন্দ পাওয়া যাবে না। আমি সরাসরি কাউকে বলিনি যে ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখে এসো। তবে আমি যে অনেকবার ক্লাস না করে সিনেমা দেখেছি তা বলেছি। এখন দেখছি তারা দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বি সেকশানে তো আমার কোন ক্লাস ছিল না। তাই মেয়েরা যদি এই দলে জুটে গিয়ে থাকে তার দায় আমার নয়। সম্ভবত দুপুর সাড়ে বারোটার শো দেখতে চেয়েছিল তারা। তাই টিফিন আওয়ারে চলে যাচ্ছিল। ছোলাইমান স্যার দায়িত্ববান ডিউটি অফিসার হিসেবে তাদের ধরেছেন। সম্ভবত পুলিশী কায়দায় জেরা করেছেন – এবং মন্ত্রণাদাতা হিসেবে আমার নাম পেয়েছেন। তাই ছোলাইমান স্যার আমাকে জেরা করছেন।
“আপনি ক্লাসে গান গেয়েছেন কেন?” – ছোলাইমান স্যার আবার প্রশ্ন করলেন। আমার কিছুটা বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে। বাস আসতে আজ এত দেরি করছে কেন? বাসের জন্য কলেজের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। আজ টুনিও নেই যে বাস আসার খবর দেবে। স্যাররা সবাই চলে গেছেন যে যার মতো। অঞ্জন স্যার চলে গেছেন স্টুডেন্টদের গাড়িতে, বিমল স্যার ও সুপাল স্যারও গেছেন তাঁর সাথে। সুচরিত স্যার এদিকে কোথাও প্রাইভেট পড়াতে শুরু করেছেন। তিনি সেখানে গেছেন। ডিউটি অফিসার না হলে ছোলাইমান স্যারও এতক্ষণে চলে যেতেন। কিন্তু আজ যেতে পারছেন না বলে আমার উপর রাগ ঝাড়ছেন। সিনেমার প্রসঙ্গ থেকে এবার আবার গানের প্রসঙ্গ চলে এসেছে। গান তো আজ দুই ক্লাসে গেয়েছি – কোন্ ক্লাসের কথা বলছেন তিনি?
বিরক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন্ ক্লাসে?”
“ক্লাস সেভেন বি, হ্যাঙ্গারে।“
“আপনি শুনেছেন?”
“পাশের রুমেই আমার ক্লাস ছিল।“
“ওরা এত করে ধরলো, তাই গাইতে হলো।“
“ধরার সুযোগ দিলে তো ওরা ধরবেই। আপনার ভালোর জন্য বলছি। স্টুডেন্টদের এত লাই দেবেন না। তাছাড়া আপনি তো গান গাইতে জানেন না। ওরা যে আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তাও কি আপনি বোঝেন না?”
আহা, ছোলাইমান স্যার আমাকে নিয়ে কত্তো চিন্তা করছেন। স্টুডেন্টরা আমাকে নিয়ে যদি হাসাহাসি করে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, কিন্তু তিনি রেগে যাচ্ছেন।
ক্লাসে গান গাওয়ার ব্যাপারটা আজকেই প্রথম ঘটলো। এত আগে বইয়ের সবকিছু শেষ করে ফেলা উচিত হয়নি। এখন তারা আর অংক করতে চাইছে না।
“আজ আমরা কী করবো” – জিজ্ঞেস করার আগেই সুব্রত বললো, “আপনি আমাদের কবিতা শোনাবেন।“
“আমি কবিতা শোনাতে জানি না।“
“আপনি ক্লাস টেনে কবিতা শুনিয়েছেন।“
“তুমি কীভাবে জানো?”
“মৌসুমী বলেছে।“
“কোন্ মৌসুমী?”
“ক্লাস টেনের”
“তাকে তুমি চেন?”
“চিনি কি না জানি না। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে সে আমার বোন।“
এই পুঁচকে সুব্রত গম্ভীরভাবে এত দার্শনিক কথাবার্তা বলে যে চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হবে স্বয়ং সক্রেটিস বাংলা ভাষায় কথা বলছে।
“সে যাই হোক, আমি তোমাদের কবিতা শোনাবো না।“
“ঠিক আছে। কবিতা না, গান শোনাবেন স্যার।“ – রেহনুমা বললো। এই মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের সহজাত লিডারশিপ আছে। সে ক্লাসের মনিটর নয়, অথচ তার কথা মনে হয় সবাই শোনে। সে বলেছে গানের কথা, এখন সবাই বলছে – গান শোনাতে হবে।
এ কী বিপদ রে বাবা। কবিতায় রাজি হয়ে যাওয়াই তো ভালো ছিল। কবিতা তো বই দেখে পড়ে দেয়া যায়। কিন্তু গান? গাইবো কীভাবে? আমার গলায় যে অসুরের বসবাস। ভাবলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পদ্ধতি প্রয়োগ করা যাক। সুনীল নাকি কোন শিল্পীর কাছ থেকে গান শুনতে ইচ্ছে করলে বেসুরো গলায় নিজেই গান ধরেন। তখন শিল্পী বিরক্ত হয়ে তাঁকে থামিয়ে নিজের গান শুরু করেন। এখন আমাকেও তাই করতে হবে। আমার গলা যে কতটা বেসুরে বাঁধা তা যদি এরা একবার জানে তাহলে আর জীবনে গান গাইতে বলবে না আমাকে। আমাকে গাহিয়া প্রমাণ করিতে হইবে যে আমি গাহিতে জানি না।
“গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে।…”
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের কানেই আবদুল আলীমের ভাওয়াইয়া গানের মত লাগছিল। ভেবেছিলাম আমাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই থামিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আমার গান শুনে এরা এতটাই নিশ্চুপ হয়ে গেল যে আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই কি একসাথে জ্ঞান হারালো? গানটির কথা দুই লাইনের বেশি আমি জানি না। দুই লাইনই গাইলাম তিন চার বার করে। কেউ কোন শব্দ করলো না। চুপচাপ সহ্য করলো। ধন্য তাদের সহ্যশক্তি। অবশ্য তাদের ভদ্রতাবোধও প্রবল। গান থামানোর পর গান সম্পর্কে একটা শব্দও বললো না। তারপর যে বর্গমূল ঘনমূলের অংক করার সময় তারা ‘অসহ্য’ বলে চিৎকার চেঁচামেচি করতো – সেই অংকও নিঃশব্দে করে ফেললো। এখন মনে হচ্ছে আমার গানকে মিউজিক থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কোন ক্লাসকে যদি মুহুর্তে চুপ করাতে হয় – এই মিউজিক থেরাপি হবে অব্যর্থ দাওয়াই।
ক্লাস সেভেন বি সেকশানের সাথে এ সেকশানের দূরত্ব অনেক। বি সেকশান হ্যাঙ্গারের দোতলায়। মেইন বিল্ডিং থেকে হেঁটে যেতে প্রায় পাঁচ মিনিট লেগে যায়। কিন্তু এ সেকশানে আমার ক্লাসে কী কী ঘটে তা তারা কীভাবে যেন জেনে যায়। সম্ভবত টিফিন আওয়ারে তারা জেনে নেয়। বি সেকশানের সাথে আমার ক্লাস থাকে টিফিনের পর। আজ তাদের ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই ফেরদৌসী বললো “আজ আমরা আপনার গান শুনবো স্যার।“ গম্ভীরভাবে বলার চেষ্টা করেও গম্ভীর থাকতে পারলো না – হেসে ফেললো। ফেরদৌসীকে আমি কখনো গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখিনি। সারাক্ষণই সে হাসছে। ক্লাসের মনিটর এরকম হাসিখুশি থাকলে সেই ক্লাসে সবাই অনবরত কথা বলবে, গল্পগুজব করবে, গন্ডগোল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্লাসে সেটা হবার জো নেই। কারণ আরেক মনিটর আবদুল আলীম ভীষণ কড়া। তার চালচলন মেজাজ সবই মিলিটারিদের মত।
আমি বললাম, “গান শুনতে হবে কেন? অন্য কিছু কেন নয়? গল্প কিংবা কবিতা?”
“না স্যার, আমরা গান শুনবো।“
“কেন?”
“এ সেকশানে আপনি গান শুনিয়েছেন।“
“তোমরা কীভাবে জানলে?”
“ওরা বলেছে স্যার।“
“গান শুনে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা বলেনি?”
“বলেছে স্যার। আমরা মিস করেছি বলেছে স্যার।“
বুঝতে পারছি এ সেকশানের ছেলেমেয়েরা কী ধরনের শক্ড হয়েছে তা বি সেকশানকে বলেনি। বি সেকশানের জন্য মায়া হচ্ছে। না জেনে মিউজিক থেরাপি নিতে চাচ্ছে।
“দেখো, আমার গান তোমাদের সহ্য নাও হতে পারে।“
“না, স্যার, আমরা শুনবো স্যার।“
“কোন্ গান গাইবো?”
“গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ”
“ওই গানটাই গাইতে হবে? অন্য কোন গান হবে না?”
“না স্যার। আগে গ্রাম ছাড়া - তারপর অন্য কিছু।“
মনে মনে বললাম একবার আমার গ্রামছাড়া শুনলে একেবারে গান-ছাড়া হয়ে যাবে। মনোবিজ্ঞানীরা যেমন জানেন যে রোগীকে সম্মোহন করলেই রোগী ঘুমিয়ে পড়বে, আমিও সেরকম জানি যে গান ধরলেই সবাই শক্ড হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যাবে। খুবই আত্মবিশ্বাস নিয়ে গান শুরু করলাম, “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ”
সারা ক্লাস দাঁত বের করে হাসতে শুরু করলো। নির্বাক নিশ্চুপ হওয়াতো দূরের কথা, মনে হচ্ছে অনেকেই গলা মেলাচ্ছে আমার সাথে। কী প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম, আর কী প্রতিক্রিয়া হলো। দেখা গেলো এই ক্লাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রতিক্রিয়া হলো। একটু পরে আমার গলা থেকে গান কেড়ে নিয়ে ছেলে-মেয়েরাই গাইতে শুরু করলো। আমার মিউজিক থেরাপি এই ক্লাসে ফেল করলো। ছোলাইমান স্যার পাশের ক্লাসে থেকে এই গান শুনেছেন।
বাস এলো অনেক দেরি করে – অনেক বেশি মানুষ নিয়ে। টিচারদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। ম্যাডামরা কোনরকমে বসতে পেরেছেন। আমি আর ছোলাইমান স্যার জায়গা পেলাম অনেকটা পেছনের দিকে। ছোলাইমান স্যারের মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। এখন আরো খারাপ হয়ে গেল। শাহীন সিনেমা হলের সামনে দিয়ে আসার সময় ভাবলাম ছোলাইমান স্যারকে “স্নেহ” সিনেমার ব্যানার দেখাই। কিন্তু তিনি যেভাবে আমাকে বেশি-স্নেহ-দেখাতে-নেই বলে উপদেশ দিয়েছেন – আমার আর সাহস হলো না।
গুলজার সিনেমার সামনে বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ছোলাইমান স্যার দ্রুত মিশে গেছেন মানুষের ভীড়ে। কোন্দিকে গেলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। লাইলুন্নাহার ম্যাডাম রিকশায় উঠতেই আমি হাঁটতে শুরু করলাম গুলজারের দিকে। এই হলের নাড়ি-নক্ষত্র আমি চিনি। সালমান শাহ্র “স্নেহ” চলছে গত চার সপ্তাহ ধরে। বিশাল পোস্টারে সালমান শাহ, মৌসুমী, আলমগীর আর শাবানাকে দেখা যাচ্ছে। আজ সিনেমাটি দেখে নেয়া যাক। এই সাড়ে তিনটার শোতে আশা করি শাহীন কলেজের কোন স্টুডেন্ট থাকবে না। আচ্ছা টিচার হয়ে গেলেই স্টুডেন্টরা দেখে ফেলবে এরকম মনে হয় কেন সিনেমা দেখতে এলে? আমি মনে করি এটাও এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় সংস্কার। শিক্ষাঙ্গনের বাইরে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ হতে না পারার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
সিনেমা হলে ঢুকে বুঝতে পারলাম প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। এক প্যাকেট চানাচুর আর এক বোতল কোকাকোলা হলো দুপুরের খাবার। সিনেমা শেষে দিদির বাসায় যাবার প্ল্যান আছে। কিন্তু হল থেকে বের হয়ে মনে পড়লো আজ দিদিরা থাকবে না বাসায়। সুতরাং নিজের বাসার দিকে যাওয়া যাক। রিকশা নেবো, নাকি হেঁটে যাবো ভাবছি – এমন সময় – “অ্যাই প্রদীপদা” শুনে ফিরে তাকালাম।
দেখলাম রঞ্জন চক্রবর্তী। আমাকে দেখে দৌড়ে এলো। তার পাশে আরো দুজন – পাভেল আর বাবর। বাবরকে ইদানীং কলেজের ক্লাসে খুব একটা দেখি না। সেকেন্ড ইয়ার সিন্ড্রোমে ধরেছে হয়তো। কলেজের অনেকেই সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আর নিয়মিত ক্লাস করে না। প্রাইভেট পড়ে। শুনেছি চিটাগং কলেজ বা মহসিন কলেজে অনেকে একটা ক্লাসও করে না। শুধু প্রাইভেট পড়ে। কেরানিদের টাকা দিয়ে ক্লাসের উপস্থিতির হার ঠিক করে নেয়। শাহীন কলেজে তবুও এখনো অনেকেই ক্লাস করে।
“এখানে কী করছেন?” – রঞ্জন জিজ্ঞেস করলো।
“সিনেমা দেখে বের হলাম।“
“কী পাভেল, তোমাকে বলেছিলাম না এই মানুষটা একটা পাগল? হাহাহা। দেখলে তো? একটা কলেজের টিচার – সিনেমা হল থেকে বের হচ্ছে সিনেমা দেখে। পাগল না হলে কেউ এই রকম সিনেমা দেখে? সালমান শাহ্ - যত্তসব। সিনেমার নাম কী? স্নেহ – ফ্যাট ফ্যাট। হাহাহাহা।“ রঞ্জন হাহাহা করে হাসছে। বাবর ও পাভেল কী করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
No comments:
Post a Comment