02
"অঞ্জনদা, ও হলো প্রদীপ। আজকে জয়েন করলো। সবার সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দেবেন।" বলেই চলে গেলেন সংযুক্তা ম্যাডাম।
আমি মুখটা হাসি হাসি করে তাকালাম সামনের দিকে। ছোট্ট একটা রুম। তিনটা টেবিল, টেবিলের দু'পাশে কিছু চেয়ার। টেবিলের উপর বেশ কিছু খাতাপত্র। দরজার কাছের টেবিলের এক কোণায় বসে আছেন স্যুট-টাই পরা গোলগাল ভদ্রলোক। দেখেই মনে হলো খুব পাওয়ারফুল মানুষ। তাঁর সামনের চেয়ারে বসে একজন বৃদ্ধ দাড়িওয়ালা সোয়েটারপরা ভদ্রলোক খুব যত্ন করে পানে চুন লাগাচ্ছেন। ইনি নিশ্চয় অঞ্জনদা নন। তাহলে স্যুট-টাই হলেন অঞ্জনদা।
"আরে প্রদীপ, এসো এসো এসো।" - মনে হলো খুবই আন্তরিক হাসিখুশি মানুষ অঞ্জনদা।
"তুমি কেমিস্ট্রির না?"
"না স্যার, আমি ফিজিক্সের।"
"ওহ্ ফিজিক্স ফিজিক্স। আমি স্ট্যাটিস্টিক্সের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট। ভাইজান, ফিজিক্সের নতুন লেকচারার প্রদীপ। আর ইনি আমাদের সবার ভাইজান - কাশেম ভাই।"
আমি হাত তুলে সালাম দিলাম। কাশেম ভাইয়ের মুখভর্তি পান। মুখের পান কোন রকমে সামলে হাত তুলে কিছু একটা বললেন। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কী বললেন। শুধু দেখলাম তাঁর মুখ থেকে রক্তের মত টকটকে লাল পানের কিছু টুকরো ছিটকে পড়লো টেবিলের খোলা খাতাপত্রের উপর। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে গলায় জড়ানো মাফলারের একটা অংশ দিয়ে লালাভেজা ঠোঁটটা মুছে নিলেন কাশেম ভাই।
"তুমি এখানে এই টেবিলে আমার পাশের চেয়ারে বসবে।" - অঞ্জনদা একটি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। স্ট্যাটিস্টিক্সের হেড অব দি ডিপার্টমেন্টের পাশের চেয়ারে বসতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। রুমের চারপাশটা একটু দেখে নিলাম। দরজা দিয়ে ঢুকলেই বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষে একটি কাঠের টুলের উপর পানির একটা বড় জার। সম্ভবত খাবার পানি। তার পাশে একটি স্টিলের আলমারির মত জিনিস, যাতে অনেকগুলো ছোট ছোট দরজা। মনে হচ্ছে পায়রার খোপ। কোন কোন খোপে বড় বড় চাবি লাগানো। ডানদিকে প্রথম টেবিলের প্রথম চেয়ারটাতে আমাকে বসতে বলছেন অঞ্জনদা। বিনাবাক্যব্যয়ে বসে পড়লাম। আমার প্রথম চাকরির প্রথম চেয়ার। চেয়ারটার হাত-পা কাঠের। কিন্তু বসার জায়গাটা প্লাস্টিকের; সারি সারি ছিদ্র সেখানে। অবাধ বায়ুপ্রবাহের উদ্দেশ্যেই হয়তো এধরনের চেয়ার নির্বাচন করা হয়েছে শিক্ষকদের জন্য।
"অঞ্জনদা, নাসিরভাইকে দেখেছেন?" -
বলতে বলতে রুমে ঢুকলেন একজন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। স্যুট-টাই পরা স্বাস্থ্যবান মানুষটির গায়ে সাদা অ্যাপ্রন দেখে হঠাৎ মনে হলো - কলেজে কি ডাক্তারও আছে?
"সকালে দেখেছিলাম। নাসিরভাই হয়তো প্রিন্সিপালের রুমে আছেন। কাইয়ুম, ও হলো প্রদীপ, ফিজিক্সে জয়েন করেছে আজ। "
"হ্যালো প্রদীপ"
আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর বাড়ানো হাতটা ধরতেই তিনি দু'হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, "ওয়েলকাম টু দি কলেজ। ইওর ফার্স্ট ডে ইজ মাই লাস্ট ডে ইন দি কলেজ। আই হোপ ইওর ডে-জ উইল বি এনজয়েবল হিয়ার। শেক্সপিয়ার সেড ..." শেক্সপিয়ারের রচনা থেকে কঠিন উদ্ধৃতি দিতে শুরু করলেন কাইয়ুম সাহেব। ইংরেজি আমি এমনিতেই কম বুঝি।
তার উপর অরিজিন্যাল শেক্সপিয়ারের বাক্য বাণের মত ঠেকছে আমার মাথায়। এদিকে আমার হাতটাও আটকে পড়েছে তাঁর দু'হাতের মধ্যে। এত দীর্ঘ হ্যান্ডশেকের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কথার মাঝখানে কথা বলা অভদ্রতা, হ্যান্ডশেক শেষ হবার আগে হাত ছাড়িয়ে নেয়াটাও অভদ্রতা। আমাকে অস্বস্তি থেকে বাঁচালেন অঞ্জনদা। তিনি হঠাৎ জানালার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ডাকলেন, "অ্যাই নাসরিন শোন এদিকে।"
প্রায় সাথে সাথে কাইয়ুম সাহেবের হস্তবন্ধন থেকে আমার হাত মুক্তি পেলো। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দুজন ছাত্রী। অঞ্জনদা ও কাইয়ুম সাহেব তাদের সাথে পরীক্ষার রেজাল্ট সংক্রান্ত কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি চেয়ারে বসে উশখুস করছিলাম। বাথরুমটা কোথায় জানা দরকার। ছাত্রীদের সামনে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে। আস্তে করে উঠে রুম থেকে বের হয়ে
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
বর্গাকার একতলা বিল্ডিং। চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা। মাঝখানে সুন্দর সবুজ ঘাসেঢাকা লন। পুরো পরিবেশটা খুব চুপচাপ। মনে হচ্ছে পরীক্ষা চলছে। বারান্দায় হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখলাম লনে হাঁটাহাঁটি করছে। ছেলেদের আকাশী রঙের শার্ট আর খাকি রঙের প্যান্ট। মেয়েদের সাদা সালোয়ার, আর আকাশী জামা।
ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজলো। কয়েকজন শিক্ষককে দেখলাম টিচার্সরুমের দিকে যাচ্ছেন। সবাই খুব ব্যস্ত। দেখলাম সবাই জামাকাপড়ের উপরে সাদা লম্বা অ্যাপ্রন পরেছেন। অর্থাৎ এটাই শিক্ষকদের ড্রেস। অঞ্জনদা'র এত জমকালো স্যুট এই সাদা অ্যাপ্রন দিয়ে ঢেকে ক্লাসে যাবেন? তবে আমার খুব পছন্দ হলো এই অ্যাপ্রনের ব্যাপারটা। শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে বা শার্ট ইস্ত্রী করা না থাকলেও কোন সমস্যা নেই। প্যান্টও পুরোটা ইস্ত্রী করার দরকার নেই, শুধু নিচের দিকটা করলেই চলবে। কিন্তু জানা দরকার এই অ্যাপ্রন কি নিজেকে জোগাড় করতে হবে, নাকি কর্তৃপক্ষ দেবে? এই মুহূর্তে একটা অ্যাপ্রন পেলে কতো সুবিধা হতো আমার, গলার বোতামটা গলা টিপে ধরে আছে।
খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করা ঠিক হবে না - কারণ প্রকৃতি যেভাবে ডাকছে তাতে যে কোন মুহূর্তেই একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। প্রথম দিনেই ওরকম কিছু ঘটলে কাইয়ুম সাহেবের কথাকে কিছুটা ঘুরিয়ে আমাকে বলতে হতে পারে, "মাই ফার্স্ট ডে ওয়াজ মাই লাস্ট ডে"। চাকরির পরীক্ষা দিতে যখন এসেছিলাম তখন ছাত্রদের টয়লেট ব্যবহার করেছিলাম। আজও কি সেখানে যাব? শিক্ষকদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু সেটা কোথায় দেখতে পাচ্ছি না। বারান্দায় হেঁটে হেঁটে রুমের দরজায় লাগানো সাইনগুলো দেখলাম। সবগুলোই ক্লাসরুম। প্রকৃতির ডাক বিপদসীমানায় পৌঁছাবার আগেই আমি পৌঁছে গেলাম ছাত্রদের টয়লেটে।
ভীড়ের আশংকা ছিল। কিন্তু কেউ নেই এখন। খুব স্বস্তি লাগলো। কিন্তু মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে হঠাৎ চমকে উঠলাম। আমার ঠিক পাশের ইউরিনালে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বললো, "কি রে, তুমি এতদিন পরে এলে?"
ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি একজন ছাত্র। এত কাছে এই অবস্থায় আমার চেয়ে লম্বা একজন ছাত্র আমাকে বন্ধুর মত জিজ্ঞেস করছে এতদিন পরে কেন এলাম? যতটা অবাক হচ্ছি - তার চেয়েও বেশি হচ্ছে অস্বস্তি। চেহারাটা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না। সে অবলীলায় নিজের কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করছে, "ওয়েটিং লিস্টে ছিলে বুঝি?"
No comments:
Post a Comment