9
সাদা দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা "Ask not what your country can do for you - ask what you can do for your country." - কী চমৎকার কথা! আমার দেশ আমার জন্য কী করতে পারে - সে প্রশ্নের চেয়েও জরুরি হলো আমি আমার দেশের জন্য কী করতে পারি। সেই ১৯৬১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবার দিন এই কথাগুলো বলেছিলেন জন এফ কেনেডি। তারপর থেকে এটা সারা পৃথিবীর সব দেশপ্রেমিকেরই মনের কথা হয়ে আছে। ছোলায়মান স্যারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সার্জেন্ট মেসে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করার কথা না বললে এদিকে আসাও হতো না - আর জানাও হতো না যে এমন চমৎকার সব কথা লেখা আছে ঘাঁটির বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়টাকে ঠিক শীতকাল বলা যায় না। তবুও সকালের দিকে বাতাস ঠান্ডা। সোয়েটার পরতে হয়েছে। সুপাল স্যার আর ছোলায়মান স্যার মাফলার জড়িয়েছেন। বাসে বসেই ছোলায়মান স্যার সুপাল স্যারকে বলছিলেন সার্জেন্ট-মেসে গিয়ে নাস্তা করার কথা। সার্জেন্ট-মেস কী জিনিস আমার কোন ধারণা নেই। ছোলায়মান স্যার বললেন, "মাত্র ছয় টাকায় ফুল কোর্স ব্রেকফাস্ট।"
'ফুল কোর্স ব্রেকফাস্ট' কী জিনিস তাও আমি জানি না। তাই আর কোন প্রশ্ন করলাম না। বাস কলেজের দিকের স্টপে আসার আগের স্টপে বেশিরভাগ বিমানসেনা নেমে যান। সোলায়মান স্যার ও সুপাল স্যারকে অনুসরণ করে সেখানেই নেমে গেলাম। দেখলাম সুচরিত স্যারও নামলেন।
ইউনিফর্ম পরা দলে দলে বিমানসেনা সার্জেন্ট-মেসের দিকে যাচ্ছেন। এঁরা নিশ্চয় সবাই সার্জেন্ট। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নিয়মের বড় কড়াকড়ি বলে শুনেছি। সেখানে সার্জেন্ট-মেসে আমাদের কি ঢুকতে দেবে? আমরা তো সিভিলিয়ান। ছোলায়মান স্যার বললেন, "আমরা তো অফিসার্স-মেসে যাবার জন্য এনটাইটেল্ড। এটা তো নন-কমিশনদের মেস।"
এখানে আসার পর গত কয়েকদিনে অনেক কিছু শিখে ফেলেছি। মানুষে মানুষে কাজ ও পদবি নিয়ে কত ধরনের যে শ্রেণিবিভাজন হতে পারে! ছোলায়মান স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমরা অনেক উচ্চশ্রেণির অফিসার-গোত্রের মানুষ। আমরা চাইলেই যেখানে অফিসার্স-মেসে গিয়ে খানা খেয়ে আসতে পারি, সেখানে এই সার্জেন্ট-মেসে তো আমাদের স্যালুট দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে।
স্যালুট নেবার জন্য মেরুদন্ড সোজা করে ডান হাত রেডি রেখে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। দেখলাম স্যালুট দেয়ার বদলে সবাই কেমন যেন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। বিশাল হলঘর। এত বড় ডাইনিং-হল এর আগে আমি দেখিনি। প্রশস্ত টেবিল গায়ে গায়ে লেগে প্রায় শ'খানেক ফুট লম্বা হয়ে গেছে। তার দু'পাশে সারি সারি চেয়ারে বসে আকাশী রঙের ইউনিফর্ম পরা শত শত বিমানসেনা নাস্তা করছেন। প্লেটের সাথে ছুরি-চামচের টুং-টাং শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এত বড় ডাইনিং হল, এতগুলি মানুষ, নাস্তা করছেন - অথচ কেউ কোন কথা বলছেন না। খাবার সময় কথা বলা যাবে না - এরকম নিয়ম আছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি সোলায়মান স্যারকে অনুসরণ করছি। তিনি নিশ্চয় এখানকার নিয়মকানুন ভালোভাবে জানেন। টেবিলের একদম অন্যপ্রান্তে অনেকগুলি চেয়ার এখনো খালি আছে। আমার ইচ্ছে বিমানসেনাদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে গিয়ে বসা। কিন্তু সোলায়মান স্যাররা এদিকেই বিমানসেনাদের সামনে বসে পড়লেন। সোলায়মান স্যারের পাশে সুপাল স্যার, তাঁর পাশে সুচরিত স্যার বসে পড়েছেন। আমি সুচরিত স্যারের পাশের চেয়ারে বসার জন্য চেয়ারটা টান দিতেই ক্যাঁয়াঅ্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো। আমার মনে হলো সবাই যেন খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভয়ে ভয়ে আঁড়চোখে সোলায়মান স্যারের দিকে তাকালাম। তিনি অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর। এখানে হয়তো মুখ গোমড়া করে রাখার নিয়ম আছে। এই কাজটি আমার জন্য খুব কঠিন।
বসার প্রায় সাথে সাথে পরাটা, সব্জি আর ডিমের মামলেট নিয়ে এলেন উর্দিপরা পরিবেশনকারী। টেবিলে একটার পর একটা প্লেট বাটি নামিয়ে রেখে দ্রুত চলে গেলেন তিনি। আরেকজন নিয়ে এলেন এক বাটি ফিরনি। একেই বলে ফুল কোর্স ব্রেকফাস্ট। নাস্তার দেখা পাওয়ার সাথে সাথে হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে পরাটা ছিঁড়ে সব্জির বাটিতে ডুবিয়ে মুখে পুরে সশব্দে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হলো আমার নিয়ম। কিন্তু আমার নিয়ম এখানে চলবে না। এখানে খেতে হবে ছুরি-কাঁটাচামচ দিয়ে। চিবুতে হবে মুখ বন্ধ করে - যেন কোন শব্দ বের না হয়। এ কী বিপদে পড়লাম।
ঘাড় ফিরিয়ে সুচরিত স্যারের দিকে তাকালাম। এসব ব্যাপারে তিনি যে কী পরিমাণ এক্সপার্ট তা বোঝা যাচ্ছে তাঁর হাতের কাজ দেখে। মনে হচ্ছে ছুরি-কাঁটাচামচের সঙ্গে তাঁর আজন্ম বন্ধুত্ব। কিন্তু আমার চোখ আটকে গেলো তাঁর হাতের বড় বড় পাথরের আংটির দিকে। ডান হাতে তিনটি আর বাঁহাতে দুটো আংটির লাল-নীল পাথরগুলো নাস্তার প্লেটের সাথে টক্কর খেতে খেতে অদ্ভুত একটা বাজনার মত শব্দ হচ্ছে। তাতেই আমার কেমন যেন হাসি পেয়ে গেল। যেখানে হাসা নিষেধ আমার সেখানেই হাসি পায়। ইউনিভার্সিটিতে সবচেয়ে কড়া টিচারের ক্লাসেও আমার মাঝে মাঝে হাসি পেয়ে যেতো। সেজন্য বন্ধুরা বলতো আমার 'লাফিং ডিজিজ' আছে। বুঝতে পারছি সার্জেন্ট মেসের এই গম্ভীর পরিবেশে আমি লাফিং ডিজিজে আক্রান্ত হচ্ছি। জোর করে হাসি চাপতে গিয়ে গলা থেকে কেমন যেন ব্যাঙের মত শব্দ বের হচ্ছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে ভয়ে ভয়ে সামনে বসা সার্জেন্টদের দিকে তাকালাম। তাঁদের মুখভর্তি খাবার, চোখভর্তি বিরক্তি। সুচরিত স্যারের দিকে তাকালাম। তাঁর আংটি-বাদ্য চলছে তো চলছেই।
ফুল কোর্স ব্রেকফাস্টের কোয়ার্টার কোর্সও শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই আমার সঙ্গের তিন স্যার উঠে গেলেন। আমিও তাঁদের পিছু নিলাম। বেসিনে হাত ধুয়ে সোলায়মান স্যারের সাথে কাউন্টারে গেলাম টাকা দিতে। সার্জেন্টদের জন্য মনে হয় অন্য ব্যবস্থা। তাঁরা খাবার পর সোজা বাইরে চলে যাচ্ছেন। একজন সার্জেন্ট এসে কাউন্টারে যিনি টাকা নিচ্ছেন তাঁকে বললেন, "লোকমান, মেস তো মেসি করে ফেলতেছ। তোমার গেস্টরুম কি বন্ধ নাকি?"
"না স্যার, খোলা আছে।" - ক্যাশ কাউন্টারের লোকমান উত্তর দিলেন।
"গেস্টদের গেস্টরুমে বসতে বলবে।"
কথাগুলো তিনি আমাদের উদ্দেশ্যেই বলছেন বলে মনে হলো। নিশ্চিন্ত হবার জন্য তাঁর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছিলেন। আমি ভাবলাম সোলায়মান স্যার এখনই তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বলবেন, 'আমরা অফিসার্স মেসে গিয়েও খানা খেয়ে আসতে পারি।' কিন্তু তিনি সেরকম কিছু না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন।
রাস্তায় এসে সোলায়মান স্যারকে বললাম, "আমরা কি ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছিলাম? আমাদের মনে হয় অফিসার্স মেসে যাওয়া উচিত ছিল স্যার।"
"আপনি ওভাবে খ্যাক্ খ্যাক্ করে হাসতেছিলেন কেন?" - সোলায়মান স্যারের ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব দোষ আমার হাসির।
"আমি তো খ্যাক্ খ্যাক্ করে হাসিনি স্যার।" - মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কাজ হলো না। সোলায়মান স্যার আরো রেগে গেলেন।
"সারাক্ষণ শিয়ালের মত খ্যাক খ্যাক করলে কেউ আপনাকে টিচার বলে মনে করবে?"
আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পশুর সাথে তুলনা করেছেন অনেকেই। শিয়ালের সাথে তুলনা এই প্রথম। বুঝলাম সব দোষ আমার। আমার মধ্যে শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্য নেই বলেই সার্জেন্ট মেসে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু গাম্ভীর্য অর্জন করবো কীভাবে? চারপাশে এত্তো সব মজার উপকরণ ছড়িয়ে আছে যেগুলো দেখলেই হাসি পায় - সেগুলো উপেক্ষা করবো? শিক্ষকতা করতে এসেছি বলে কি জীবন থেকে সব আনন্দ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ গোমড়া মুখে থাকতে হবে ফুল কোর্স ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য? কিন্তু সোলায়মান স্যারকে এসব বলে লাভ নেই। তিনি এতটাই রেগে গেছেন যে তাঁর পরনের প্যান্টটা উপরের দিকে টানতে টানতে প্রায় গলার কাছে তুলে ফেলেছেন। সেটা দেখে আমার লাফিং ডিজিজ কন্ট্রোলে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। টিচার্স রুমে এসে বাথরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ হেসে নিলাম।
হাসতে হাসতে মনে হলো কে যেন গুণ গুণ করে গান করছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছে প্রিন্সিপালের গলা। টিচার্স রুমের বাথরুমের সাথে প্রিন্সিপালের বাথরুম লাগানো। মাঝখানের দেয়ালের উপরের দিকে খোলা ভেন্টিলেটার দিয়েই গানের শব্দ আসছে - ও তোতা পাখিরে ...। আমি প্রিন্সিপালের গলা শুনতে পাচ্ছি - তার মানে তিনিও নিশ্চয় আমার হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি যদি ভেবে বসেন যে আমি তাঁর গান শুনে হেসেছি - তাহলে তো বিপদ। শুনেছি তিনি আগে ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। শতকরা ৯০ ভাগ কথা বলেন ইংরেজিতে। বাঘের মত গরম মানুষ। অথচ বাথরুমে ঢুকে তোতা পাখির গান করছেন। কিন্তু আমি যে তাঁর গান শুনে হাসিনি তা কীভাবে প্রমাণ করবো? আগ বাড়িয়ে গিয়ে যদি বলি, স্যার আপনি খুব চমৎকার গান করেন। আপনার গান শুনে আমি হাসিনি - তাহলে ব্যাপারটা আরো গোলমেলে হয়ে যাবে। এমনও তো হতে পারে যে তিনি কিছু শুনতেই পাননি।
সিটে এসে দেখি পরীক্ষার ডিউটি রোস্টার এসে গেছে। আমার ডিউটি আছে ফারুকী স্যারের সাথে। ফারুকী স্যার শুরুতে যাবেন। আমি যাবো এক ঘন্টা পর আমার ক্লাস শেষ করে। সোয়া আটটায় আমার ক্লাস। এখনো প্রায় বিশ মিনিট বাকি। ডেস্কে বসে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে দেয়ার জন্য একটি প্রোব্লেম ভাবছি - এমন সময় পিয়ন কাশেম এসে বললেন, "স্যার, প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছে।"
আমি চমকে উঠলাম। মনে হলো প্রিন্সিপাল আজ আমাকে আস্ত রাখবেন না। তাঁর গান শুনে হাসার অপরাধে আমাকে কি কারণ-দর্শাও নোটিস পাঠাবেন? শুনেছি এখানে নাকি পান থেকে চুন খসলেই শো-কজ নোটিস পাঠানো হয়। কাশেমকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমাকে ডাকছেন?"
"সবাইকে যেতে বলছেন স্যার। এখনি যেতে বলছেন।"
আমার একার অপরাধে কি সবাইকে শাস্তি পেতে হবে? অন্য স্যারদের দিকে তাকালাম। সাঈদ স্যার আর নাসির স্যার হাসিমুখেই প্রিন্সিপালের রুমে চলে গেছেন। অন্যান্য স্যারদের মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ থাকলেও - ভয়ের চিহ্ন নেই। তাহলে আমার এত ভয় লাগছে কেন?
ভয়ে ভয়ে প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকলাম। দেখলাম শুধু স্যাররা নন, ম্যাডামদেরও ডাকা হয়েছে। সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন প্রিন্সিপাল কী বলেন শোনার জন্য। আমার ভয় কেটে গেছে। সব টিচারকে ডেকে প্রিন্সিপাল নিশ্চয় বলবেন না যে তিনি বাথরুমে ঢুকে 'ও তোতা পাখিরে' গাচ্ছিলেন আর আমি সেই গান শুনে হেসে ফেলেছি।
"গুড মর্নিং লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, একটা গুড নিউজ দেয়ার জন্য আপনাদের ডেকেছি। আমাদের কলেজ সেকশান থেকে একটা ডিবেট টিম আমরা ন্যাশনাল টেলিভিশন ডিবেট কম্পিটিশানে পাঠাচ্ছি। আমাদের ফার্স্ট ডিবেটের টপিক হচ্ছে - কিশোর অপরাধ দমনে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান। আমরা পক্ষে বলবো। আমি চাই আপনারা সবাই এই টপিকটা সম্পর্কে যে যতটুকু পারেন রিফাৎ আরা ম্যাডামের কাছে জমা দেবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে।"
"স্যার, পক্ষের যুক্তির সাথে বিপক্ষের যুক্তিও যদি আমরা পাই তাহলে ভালো হয়।" - রিফাৎ আরা ম্যাডাম প্রিন্সিপালের ডেস্কের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কথা শুনে প্রিন্সিপাল বললেন, "ওহ্ ইয়েস, পক্ষে-বিপক্ষে যত যুক্তি খুঁজে বের করতে পারেন। প্লিজ ডু ইট বাই ওয়ান উইক। থ্যাংক ইউ।"
"আরেকটা কাজ বাড়লো এখন।" - টিচার্স রুমে ঢুকেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন বিমল স্যার। টেলিভিশন বিতর্কের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় সন্ধ্যাবেলা। নিয়মিত টেলিভিশন দেখার সুযোগ নেই আমার। দিদির বাসায় গেলে সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে দেখি এই অনুষ্ঠান। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা কী চমৎকার যুক্তি দেখায় দেখে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু কোনদিনই ভাবিনি যে সেই যুক্তিগুলো তাদের শিক্ষকরা তৈরি করে দেন। প্রিন্সিপালের আদেশ পালন করতে হবে। এক সপ্তাহ সময় হাতে আছে, কিছু একটা লিখে দিয়ে দেবো।
ক্লাস শেষ করে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। ফারুকী স্যার চলে গেলেন ক্লাসে। স্কুল সেকশানের ক্লাসরুমে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে। এই রুমে ক্লাস সেভেন আর ক্লাস নাইনের ছাত্ররা বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রতি বেঞ্চে দু'জন করে বসেছে - একজন সেভেনের, অন্যজন নাইনের। কিন্তু ফার্স্ট বেঞ্চে শুধু একজন। যে যার মতো লিখছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপানো। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। বেশ ভালো লাগছে এদের শৃঙ্খলা দেখে। এদের শার্টের পকেটে লাগানো আছে কলেজের মনোগ্রাম। মনোগ্রামের মাঝখানে সমবাহু ত্রিভুজের ভূমিতে লেখা আছে শৃঙ্খলা, অন্য দুই বাহু হলো শিক্ষা ও সংযম। আসলেই মনে হচ্ছে এদের সবার শিক্ষা ও সংযমকে ধরে রেখেছে কঠিন শৃঙ্খলার ভিত্তি।
হঠাৎ রুমে ঢুকলেন স্যুট-টাই পরা অঞ্জন স্যার। তাঁর তো এখানে ডিউটি নেই। ব্যাপার কী? কাছে গিয়ে ফিস্ফিস করে জানতে চাইলাম, 'কী ব্যাপার স্যার?'
'না, এমনি দেখতে এলাম। সবকিছু ঠিক আছে?'
'হ্যাঁ। কোন সমস্যা নেই।'
আমি ভাবলাম অঞ্জন স্যার মনে হয় পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তাই সব রুম ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কর্তব্যপরায়ণতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ চোখের সামনে দেখে ভালোই লাগলো। কিন্তু দেখলাম অঞ্জন স্যার সামনের বেঞ্চে বসা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করছেন, 'সব ঠিক আছে রুবায়েৎ? তোমার মনে হয় গরম লাগছে, ফ্যানটা ছেড়ে দিই' - বলেই তিনি সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে খটাস খটাস করে রুমের সব লাইট জ্বালিয়ে দিলেন, ফ্যান ছেড়ে দিলেন। ফ্যানের বাতাসে কয়েকজন ছাত্রের খাতাপত্র উড়ে নিচে পড়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কী হচ্ছে এখানে।
"আমার গরম লাগছে না স্যার।" - রুবায়েৎ নামের ছাত্রটি খুব ভদ্রভাবে বললো।
"ও তাই, গরম লাগছে না? ঠিক আছে।" খট খট করে দ্রুত লাইট-ফ্যান সব অফ করে দিলেন।
"রুবায়েৎ, তোমার কিছু লাগলে আমাকে জানাবে।" - বলে অনেকটা বিগলিতভাবে চলে গেলেন তিনি।
ব্যাপারটা কী? এই ছাত্রটি কি অন্যদের চেয়ে আলাদা? তার কি এক্সট্রা কেয়ার দরকার? কিন্তু তাকে দেখে মনে হয়েছে একটু আগের এক্সট্রা কেয়ারে সে খুবই বিরক্ত হয়েছে। শুধু সে নয়, রুমের সব ছাত্রই যে বিরক্ত হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে।
পরীক্ষা শেষ হলো। 'স্টপ রাইটিং' বলার সাথে সাথে সবাই লেখা থামিয়ে খাতা বন্ধ করে যার যার সিটে বসে রইলো। সব খাতা নিয়ে রুম থেকে বের হবার পর ছাত্ররা বের হলো। খাতাগুলো ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমে রেখে এসে ফারুকী স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, "পরীক্ষার হলে কি কারো এক্সট্রা কেয়ারের দরকার ছিল?"
"কেন কী হয়েছে?"
এ ক'দিনে দেখেছি ফারুকী স্যার অপ্রয়োজনীয় কোন কথা বলেন না। নীতির ব্যাপারে এই মানুষটি কোন আপোষ করেন বলে মনে হয় না। তাঁকে বললাম পরীক্ষার হলে কী কী হয়েছে।
"আপনি সত্যিই জানেন না উনি কেন এটা করেছেন?"
"না"
"ও তো বেস কমান্ডারের ছেলে। তাই উনি ভেবেছেন এসব করলে ছেলে গিয়ে বাপকে বলবে যে এই স্যারটা খুব ভালো।"
"কিন্তু ছেলে তো এসবে বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো।"
"হ্যাঁ, তারা এসব চায় না। কিন্তু আমরাই তো তেল দিতে থাকি।"
পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে মোটেই ভালো লাগলো না। তৈলমর্দনের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ কেন?
এক সপ্তাহ পর প্রিন্সিপালের রুমে আবার ডাক পড়লো সবার। প্রিন্সিপাল এমনিতেই গম্ভীর, আজ আরো গম্ভীর মুখে বললেন, "লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, লাস্ট উইকে আপনাদের রিকোয়েস্ট করেছিলাম বিতর্কের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি লিখে জমা দিতে। ম্যাডাম রিফাৎ আরা, আপ্ডেটস কী?"
"স্যার, আমরা কমিটি মেম্বাররা - আমি, নাসরীন, সুচরিত বসেছি স্ক্রিপ্ট নিয়ে। বিতার্কিক সিলেক্ট করার কাজ চলছে। টিচারদের মধ্যে প্রদীপ কিছু যুক্তি দিয়েছেন।"
"আর কেউ কিছু দেয়নি?"
"এখনো হাতে পাইনি। লেডি টিচারদের কয়েকজন বলেছেন আরো কয়েকদিন সময় লাগবে।"
"কতদিন সময় লাগে কিছু যুক্তি লিখে দিতে? ইউ ডিডন্ট ইভেন ট্রাই। সবাই ব্যস্ত তা জানি। কিন্তু মিস্টার প্রদীপ দিতে পারলে আপনারা পারলেন না কেন? হোয়াই?"
প্রিন্সিপালের গলা বেশ চড়া। মনে হচ্ছে তিনি শিক্ষকদের ডেকে এনে ধমক দিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর যুক্তিতে আমি শিউরে উঠলাম। আমি সময় করে কিছু একটা লিখে দিয়েছি, তার অর্থ এই নয় যে সবাই তা করতে পারবেন। এখন প্রিন্সিপাল যদি কোনদিন আমাকে ডেকে বলেন যে কলেজের ম্যাগাজিনের জন্য একটা প্রচ্ছদ জমা দেন, বা প্রোগ্রামের জন্য একটা স্টেজ ডিজাইন করে দেন, আমি কি দিতে পারবো? তিনি যদি যুক্তি দেখান যে আইভি ম্যাডাম পারলে আপনি পারবেন না কেন? সেই যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য হবে? প্রিন্সিপালকেই যদি বলা হয় আপনাকে টুনির মত করে 'ও তোতা পাখি রে' গানটি গাইতে হবে, তিনি কি পারবেন? কিন্তু ক্ষমতার ঘোড়ায় যে চড়ে সে চাবুক মারবেই, এমনকি কাঠের ঘোড়ায় চড়লেও।
সবাই বিরক্ত হয়ে টিচার্স রুমে এসে অনেকটা আমার উপরেই বিরক্তিটা ঝাড়তে শুরু করলেন। বিমল স্যার বললেন, "প্রদীপবাবু, আপনি আমার জন্য যুক্তি-টুক্তি কী আছে লিখে দেবেন।"
মহিউদ্দিন স্যার বললেন, "কী নতুন আপদ নিয়ে এলে ভাই? যে জিনিস আমি জীবনে কখনো লিখি নাই, তা কেমনে লিখি?"
সোলায়মান স্যার বললেন, "বিতর্কের বিষয়টা কি একটু বলেন তো।"
কামরুজ্জামান স্যার বললেন, "আমি থাকি লেফ্ট রাইট নিয়া। আমার কাজ হলো ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করানো, আমি যুক্তি কোথায় পাবো?"
দেখলাম বিতর্ক কমিটির মেম্বার সুচরিত স্যার কিছুই না বলে মিটিমিটি হাসছেন আর গোঁফ টানছেন। নিজের উপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। কেন যে এক পাতা লিখতে গেলাম! ইচ্ছে হচ্ছে রিফাৎ আরা ম্যাডামের কাছে গিয়ে বলি, 'সরি ম্যাডাম, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার লেখাটা আমাকে ফেরৎ দেন'। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে কথা বলা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাঁরা বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলেন, অশুদ্ধ উচ্চারণ শুনলে তাঁদের এলার্জি হয়। শোনার সাথে সাথে শুদ্ধ করে দিতে পারলে কিছুটা ভালো লাগে, কিন্তু তা না পারলে গলার ভেতর চুলকানি হয় তাদের। তাই তাঁকে লেখাটা জমা দিতে গিয়ে আমি শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম - 'ম্যাডাম'। তারপর কাগজটা টেবিলে তাঁর সামনে রেখে চলে এসেছিলাম। এখন লেখাটা ফেরত চাইতে গিয়ে তো আমি শুদ্ধভাবে 'সরি ম্যাডাম'ও বলতে পারবো না - বলে ফেলবো 'চরি মেডাম'।
No comments:
Post a Comment