স্বামী ও পিতা রামন
রামন নিজের ইচ্ছায় ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ত্রয়োদশী কিশোরী
লোকসুন্দরীকে। তাঁদের বয়সের পার্থক্য বেশি ছিল না। একটা চমৎকার রোমান্টিক জুটি
হবার সম্ভাবনা ছিল তাঁদের। যে বয়সে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল সেই বয়স প্রেমে পড়ার বয়স।
অন্যসব মেয়েদের মতো লোকসুন্দরী ওরফে লোকমও আশা করেছিলেন একজন প্রেমময় স্বামীর,
ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি সুন্দর সংসারের। কিন্তু বিয়ের দু'সপ্তাহের মধ্যেই লোকম বুঝতে
পারেন তাঁর স্বামী রামনের প্রথম ভালোবাসা বিজ্ঞান, আর সেই ভালোবাসা এত তীব্র যে
সেখানে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার কোন স্থান নেই।
বিয়ের দু'সপ্তাহের
মধ্যেই রামন লোকমকে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন সাথে করে। কিন্তু তারপর দিনরাত মেতে
রয়েছেন গবেষণার পেছনে। ধরতে গেলে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব
সায়েন্স এর ল্যাবোরেটরিতেই থেকেছেন দিনরাত। সংসারে কী হচ্ছে, কীভাবে চলছে, কোন
কিছুর দিকেই কখনো ফিরে তাকাননি রামন। এটা নিয়ে লোকম যখন অভিযোগ করতেন, রামন উত্তর
দিতেন - "আমি জানি সংসারের কাজটা তুমি একাই খুব ভালোভাবে করতে পারবে। সেখানে
আমার নাক গলানোর তো দরকার নেই। একই কাজে দু'জনের মেধা ও পরিশ্রম দেয়াটা মেধা ও
শ্রমের অপব্যয়।"
লোকম কিছুদিনের মধ্যেই
বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁর স্বামী অন্যরকম। বিবাহিত হলেও একজন ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী।
তবে কেন বিয়ে করেছিলেন রামন? লোকমের ধারণা বিবাহিত অফিসাররা যে পারিবারিক ভাতা
পেতেন সেটা পাবার জন্যই রামন বিয়ে করেছিলেন। কথাটা আক্ষরিকঅর্থে হয়তো সত্য নয়,
কিন্তু এটা বলার পেছনে যে ক্ষোভ কাজ করে সেটা খুবই সত্যি।
রামন লোকমকে বিয়ে করে
স্বামী হয়েছিলেন, কিন্তু স্বামীর কোন দায়িত্ব তিনি পালন করেননি। রামন অসুস্থ হলে
লোকম দিনরাত তাঁর সেবা করেছেন - স্ত্রীর কর্তব্য করেছেন। আর ঘরের কথা দূরে থাক,
জাহাজে যখন লোকম অসুস্থ হয়ে পড়েন, যেখানে রামন ছাড়া আর কেউ ছিল না লোকমকে দেখার,
সেখানেও রামন কিছুই করেননি লোকমের জন্য। এতবড় বিজ্ঞানী, অথচ এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন
স্বামী ছিলেন রামন।
কলকাতায় অ্যাসোসিয়েশানের
কাছে থাকার জন্য প্রায় বস্তির ভেতর একটা বাসাতেও থাকতে হয়েছে তাঁদের। বাসাটি ছিল
রাস্তা থেকে অনেক নিচে। একবার প্রচন্ড বর্ষায় তাদের ঘরে বন্যার পানি ঢুকে যায়।
রামন অফিসে যাবার জন্য ছটফট করছেন, চিৎকার চেঁচামেচি করছেন, কিন্তু বন্যার পানির
ব্যাপারে কিছুই করছেন না। লোকম তখন নিজে বন্যার পানিতে ভিজে ভিজে স্বামীর পায়ের
নিচে টুল পেতে দিয়েছেন, আর রামন সেই টুলে পা ফেলে জুতা না ভিজিয়ে অফিসে গেছেন।
এভাবে সারাজীবনই সংসারের ঝড়বৃষ্টিতে লোকম একাই ভিজেছেন, আর রামন নিজের কাজ করে গেছেন।
সংসারের খরচের জন্য রামন
প্রতি মাসে কিছু টাকা দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ করতেন। রামন মনে করতেন তিনি লোকমকে
যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন সংসারের ব্যাপারে। কিন্তু লোকম যখন নিজের নামে
ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট খুললেন রামন রেগে গিয়ে ব্যাংকের পাস-বই ছিঁড়ে ফেললেন।[1]
রামন নিজের চেষ্টায়
বিখ্যাত হয়েছেন। আর লোকম নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন সেই বিখ্যাত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কলকাতায়
বাংলা শুনতে শুনতে নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখেছেন লোকম। রামন ইংরেজি, হিন্দি, তামিল
ও সংস্কৃত ভাষা শিখে ফেলেছিলেন ছোটবেলাতেই, কিন্তু পঁচিশ বছর কলকাতায় থেকেও বাংলা
শিখেননি। লোকম স্বদেশী আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীর স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ
দিয়েছিলেন। ছেলে রাজাকে বাড়ির কাজের লোকের কাছে রেখে লোকম মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে
খাদি কাপড় বিক্রি করেছেন। অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে সেবা দিয়েছেন লোকম।
রামন বিয়ের আগেই
পরিকল্পনা করেছিলেন বেশি ছেলেমেয়ের জন্ম দেবেন না তিনি। তাই ১৯০৭ সালে বিয়ের পর
থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি লোকমের দিকে সেভাবে ফিরেও তাকাননি। তারপর নিজের যখন
ইচ্ছে হলো প্রথম সন্তানের বাবা হলেন ১৯২১ সালে। বাবা হওয়ার পর ছেলেকে বড় করার
দায়িত্ব পুরোটাই পালন করতে হলো লোকমকে। ছেলের জন্যও কোন বাড়তি সময় সংসারে দেননি
রামন। তার আট বছর পর ১৯২৯ সালে দ্বিতীয়বার বাবা হলেন রামন। কিন্তু সন্তান জন্মের
তিন মাসের মধ্যেই লোকমকে টেনে নিয়ে গেলেন ইওরোপে নিজের সাথে - নোবেল পুরষ্কার পেতে
পারেন এই আশায়। তিন মাসের শিশুকে রেখে এতগুলো মাস লোকম কীভাবে ইওরোপে থেকেছেন সেটা
দেখেও দেখেননি রামন। লোকম ইওরোপেও নিজে নিজে শহর ঘুরে দেখেছেন - কারণ স্বামীর সময়
নেই।
লোকম নিজের ব্যক্তিত্বে
নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে স্বামীর পাশে থেকে প্রোটোকল পালন করেছেন, সুইডেনের
রানির সাথে আলাপ করেছেন। মিশেছেন ইওরোপের বিজ্ঞানীদের সাথে।
ইওরোপে লোকম
মেয়েদের দরকারে পাশে থেকেছেন লোকম
১৯৫৫ সালে লোকম প্রতিষ্ঠা করেন কর্নাটক রাজ্যের শিশুকল্যাণ পরিষদ। নিজের
বাড়ি পঞ্চবটিতে তিনি দুস্থ শিশুকিশোরদের জন্য একটি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
আমৃত্যু তিনি সেই স্কুল চালিয়েছেন। এসব কাজে রামন কখনো বাধা দেননি। কিন্তু চেষ্টা
এবং পরিশ্রমের পুরোটাই ছিল লোকমের।
রামনকে অনেক রাষ্ট্রীয় ও
সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হতো। লোকম সেসব অনুষ্ঠানে আপন ব্যক্তিত্বে পাশে
থেকেছেন রামনের। রামনের প্রবল ব্যক্তিত্বের নিচে চাপা পড়েননি লোকম। অনেকে এটাকেই
রামনের মহত্ব বলে মনে করেন। অনেকে মনে করেন যে রামন লোকমের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে
বাড়তে দিয়েছেন, এটাই তো নারী-স্বাধীনতা! লোকম কি আসলেই স্বাধীন ছিলেন?
নারীসংঘে লোকম ও তাঁর সঙ্গীরা
২০১১ সালের আগপর্যন্ত রামনের জীবন সম্পর্কে যতগুলো বই লেখা হয়েছে তার
কোনটাতেই রামন ও লোকমের প্রথম সন্তান ভেঙ্কটরামন চন্দ্রশেখর ওরফে রাজা সম্পর্কে
কোন তথ্যই পাওয়া যায় না। ২০১১ সালে রামনের ভাইয়ের মেয়ের মেয়ে ডক্টর উমা
পরমেশ্বরনের লেখা রামনের জীবনী[2] থেকেই রাজা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় প্রথমবারের মতো।
১৯২১ সালের ১৬ নভেম্বর
রামন ও লোকমের প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। রামনের বাবার নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখা
হলো চন্দ্রশেখর, ডাকনাম রাজা। বাবার মতোই প্রখর মেধাসম্পন্ন রাজা। রামন ছেলের মাঝে
নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে চান। বাবার স্নেহে ছেলেকে বুকে-কোলে নেয়ার সময় রামনের নেই,
কিন্তু যেই দেখলেন ছেলের প্রতিভা আছে - ছেলেকে জোর করে পদার্থবিজ্ঞানী বানাতে
চাইলেন। ১৯৩৯ সালে রাজাকে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিলেন পদার্থবিজ্ঞান
পড়ার জন্য। রাজার বয়স তখন মাত্র সতের।
কিন্তু ইওরোপে তখন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রাজা সেখানে অসুস্থ হয়ে গেলো। মায়ের কাছে চিঠি
লেখে কিশোর রাজা। তার ভালো লাগছে না সেখানে। কিন্তু রামনের কাছে কিশোর ছেলের
আবেগের কোন দাম নেই। রাজাকে পদার্থবিজ্ঞানের ডিগ্রি নিতেই হবে। কেমব্রিজ
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ সবাই পায় না। এখানে একটা জিনিস লক্ষ্যণীয় - রামন নিজে
বিশ্বাস করতেন দেশের পড়াশোনা বিদেশের পড়াশোনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। নিজে বিদেশে
পড়তে যাবার সুযোগ পেয়েও যাননি। সেখানে নিজের ছেলেকে তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে
পাঠিয়েছেন আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে পড়াশোনা করার জন্য। সে যাই হোক, কয়েক মাস পরেই রাজা
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে আর ওখানে থাকবে না, দেশে ফিরে আসবে। মায়ের কাছে চিঠি লিখে
তার সিদ্ধান্তের কথা জানালো। শুনে রামন প্রচন্ড রেগে গেলেন। বললেন পড়াশোনা শেষ না
করে দেশে আসা যাবে না।
রাজাকে দেশে ফিরতে মানা
করে লেখা লোকমের চিঠি কেমব্রিজে পৌঁছানোর আগেই বাড়িতে ফিরে এলো রাজা। তখন দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইওরোপে পড়তে যাওয়া অনেক ভারতীয় ছাত্রই দেশে ফিরে আসছিলেন।
বিক্রম সারাভাই ও হোমি ভাবাও দেশে ফিরে এসে রামনের কাছে গবেষণা করেছিলেন। সেটা ঠিক
আছে, অথচ রামন নিজের ছেলের পড়াশোনা
শেষ না করে ফিরে আসাটা মেনে নিতে পারলেন না। রামন ছেলের সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে
দিলেন।
রাজা তখন আঠারো বছরের
টগবগে মেধাবী রাগী জেদি তরুণ। আঠারো বছর বয়সে রামন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই
নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের আঠারো বছর বয়সী ছেলের উপর জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে
দিচ্ছেন। রাজা পুরোটাই বিগড়ে গেলো।
দেশে তখন ব্রিটিশ বিরোধী
আন্দোলন জোরেশোরে চলছে। রাজা ভারতীয় কমিউনিস্টদের সংস্পর্শে এলো এবং তাদের সাথে
জড়িয়ে গেলো। ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ তখন আন্দোলনরত তরুণদের দেখলেই ধরে হাজতে পুরছে।
একদিন রাজা পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। রামন ও লোকমকে ভেলোর জেলে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে
রাজাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হলো। রামন বললেন তিনি রাজাকে আর নিজের ছেলে বলে স্বীকার
করেন না। বাবা একথা বলতে পারলেও মা কি পারেন?
রাজা পদার্থবিজ্ঞান ও
বাড়ি দুটোই ছেড়ে দিয়ে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল ডিগ্রি পাস করলো। কমিউনিস্টদের
সাথে তার গোপন সম্পর্ক রইলো। কিন্তু সে আর কোথাও বাবার পরিচয় দিলো না। আইন পাস
করলেও কখনো আইনের পেশায় গেলো না। অন্য কোন চাকরিও করলো না।
লোকম ছেলের জন্য সংসারের খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমিয়ে রাখেন। রাজা কোথায় থাকে
কেউ জানে না। টাকার দরকার হলে বাড়ির বাইরে এসে মাকে ডাকে। লোকম ছেলের হাতে টাকা
তুলে দেন। রাজা টাকাটা নিয়ে চলে যায়। মায়ের কান্নার দিকে ফিরেও তাকায় না। রামন
জানেন লোকম ছেলেকে টাকা দেন। কিন্তু কখনো একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেন না ছেলে কেমন
আছে।
আর ছেলে রাজা? সে বাবার
প্রতি তার সমস্ত রাগ ঝাড়তো মায়ের উপর। মাকে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো বাড়ির
বাইরে দাঁড়িয়ে। একটা অখ্যাত পাড়ায় মুসলমান পরিচয়ে একা একা থাকতো রাজা। টাকার দরকার
হলে মায়ের কাছে আসতো, টাকা নিতো, আর গালিগালাজ করে চলে যেতো। আর লোকম বুকফাঁটা
কান্নায় মা হওয়ার দায় মেটাতেন।
একবার রাজা এসেছে টাকা নিতে। বাড়ির পেছনে গাছের
নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে বাগানে বড় বড় গর্ত হয়েছে। লোকম রাজাকে টাকা দিতে
যাওয়ার সময় একটা গর্তে পড়ে গেলেন। গর্ত থেকে উঠতে পারছিলেন না নিজে। কাছেই দাঁড়িয়ে
আছে রাজা। মা মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন, হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ডাকছেন টেনে
তোলার জন্য। অথচ রাজা মা-কে তুললো না। রাগি রাগি গলায় বললো, "আমি প্রতিজ্ঞা
করেছি জীবনে কোনদিন কোন মেয়েকে স্পর্শ করবো না। তাই তোমাকে ধরে তুলতে পারছি
না।"
রাজা কোথায় থাকতো কেউ
জানতো না। লোকম অপেক্ষা করে থাকতেন কখন রাজার টাকার দরকার হবে, রাজা আসবে, আর মা
একবার অন্তত ছেলেকে দেখতে পাবেন। যতই গালাগালি করুক, নিজের গর্ভের সন্তান তো। ১৯৮০
সালে লোকমের মৃত্যুর আগপর্যন্ত লোকম রাজাকে সাহায্য করে গেছেন। শোনা যায় রাজা ১৯৯০
সালে মারা যায় একটা মুসলমান পাড়ায়। সেখানে নামগোত্রহীন অবস্থায় একটা কবরস্থানে কবর
দেয়া হয় তাকে।
রামনের ছোটছেলের কথা
সবাই জানেন। রামন ও লোকমের দ্বিতীয় ছেলে ভেঙ্কটরামন
রাধাকৃষ্ণানের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৮ মে। রাধাকৃষ্ণানও বাবার মতোই মেধাবী ছিলেন। তিনি
মহাকাশ বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাবার সাথে তাঁর খুবই ভালো
সম্পর্ক ছিল। রামনের মৃত্যুর পর রাধাকৃষ্ণান রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক
ছিলেন।
ভেঙ্কটরামন রাধাকৃষ্ণান
ট্রাস্টকে তাঁর সবকিছু দিয়ে দেয়ার আগে রামন দুই ছেলের কাছে চিঠি লিখে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। বড় ছেলে রাজা তিক্ত ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন - যেহেতু তিনি রামনের পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন, সেহেতু রামন তাঁর সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন না করবেন তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। ছোট ছেলে রাধাকৃষ্ণান জানিয়েছিলেন যে রামনের বিবেচনাবোধের প্রতি তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন আছে। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য তিনি যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিচ্ছেন তাতে রামনের সন্তান হিসেবে তাঁর গর্ব হচ্ছে। তবে তাঁর মা যতদিন বেঁচে থাকবেন যেন ভালোভাবে চলতে পারেন সেই ব্যবস্থা যেন করে যান।
রামন বিজ্ঞান ছাড়া আর কোন কিছু কি ভালোবেসেছিলেন কোনদিন? হ্যাঁ, প্রকৃতির
সৌন্দর্যকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু সেটাও তো তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার উৎস
বলেই ভালোবেসেছিলেন। কোন মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন? উত্তর পাওয়া যায় না। যতটুকু
প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে মনে হয় রামন শুধু নিজেকেই ভালোবেসেছিলেন। সারাজীবন তিনি
শুধু নিজেরটাই দেখে গেছেন। নিজের বিজ্ঞান, নিজের মত, নিজের স্বাধীনতা, নিজের
অর্জন, নিজের ইন্সটিটিউট। স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের গুরুত্ব তাঁর কাছে ততটুকুই ছিল
যতটুকু তাঁর নিজের দরকার ছিল।
রামন যখন ফিজিওলজি অব
ভিশান নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন প্রায়ই বলতেন "এই কাজের জন্য আমাকে আরো একটি
নোবেল পুরষ্কার দেয়া উচিত।"[3] উত্তরে লোকম বলেছিলেন, "একটা নোবেল পেয়েই তুমি যেরকম অসহ্য হয়ে
উঠেছো, দুইটা নোবেল পুরষ্কার পেলে আর দেখতে হবে না।"[4]
রামনকে একটা সাইক্লোনের
সাথে যদি তুলনা করা যায়, তাহলে বলতে হবে লোকম সেই সাইক্লোনের সাথে বাস করেছেন
তেষট্টি বছর। সাইক্লোনকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, কিন্তু সামলে রাখতে
পেরেছিলেন।
[3] সেই সময় দুবার নোবেল পুরষ্কার
পেয়েছেন দু'জন বিজ্ঞানী। মেরি কুরি ১৯০৩ সালে পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে এবং ১৯১১
সালে রসায়নে। লিনাস পাউলিং রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে এবং ১৯৬২
সালে পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার। তারপর জন বারডিন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল
পুরষ্কার দু'বার ১৯৫৬ সালে ও ১৯৭২ সালে। ফ্রেডেরিক স্যাংগার রসায়নে নোবেল পুরষ্কার
পেয়েছেন দু'বার, ১৯৫৮ সালে ও ১৯৮০ সালে।
No comments:
Post a Comment