ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স
১৯৩৩ সালের ১লা
এপ্রিল ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদে যোগ দিলেন
রামন। যোগ দিয়েই রামন বুঝতে পারলেন প্রতিষ্ঠানটি সমস্যায় জর্জরিত। জামসেদজি টাটা
উচ্চপর্যায়ের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। ১৯১১ সালে টাটা শিল্পগোষ্ঠী,
মাইসোরের মহারাজা ও ব্রিটিশ-ভারত সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হয় এই ইন্সটিটিউটের
ফান্ডের ব্যাপারে। টাটাগোষ্ঠী বছরে এক লাখ পঁচিশ হাজার রুপি দেবে, মাইসোরের
মহারাজা ইন্সটিটিউটের জন্য তিনশ একর জমি দেন, আর বছরে পঞ্চাশ হাজার রুপি করে দেবেন
বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় ইন্সটিটিউটের বাৎসরিক
উপার্জনের অর্ধেক দেবে। ইন্সটিটিউটের লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরির বিভিন্ন
ক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি করা, যেন দেশের শিল্পবিকাশে নেতৃত্ব দিতে পারে।
টাটাগোষ্ঠী বিশ্বমানের শিক্ষা ও
প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রথম থেকেই ইওরোপিয়ান অধ্যাপক নিয়োগের পক্ষে মত দেয়।
ফলে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো এখানকার ব্রিটিশ অধ্যাপকরা যে বেতন পান তা
ব্রিটেনের ইন্সটিটিউটের অধ্যাপকদের বেতনের চারগুণ। ইন্সটিটিউটের প্রথম পরিচালক
ছিলেন অধ্যাপক মরিস ট্রেভার্স। তিনি পৃথিবীবিখ্যাত রসায়নবিদ। ইন্সটিটিউট চালু হবার
দুবছর আগে থেকেই তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও
ইন্সটিটিউটের কোন উন্নতি করতে না পেরে পদত্যাগ করেন। পরবর্তী ডিরেক্টর আলফ্রেড
বোর্ন ১৯১৫ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করার পরেও কোন ধরনের
উন্নতি হয়নি এই ইন্সটিটিউটের। তৃতীয় ডিরেক্টর হিসেবে আসেন মার্টিন ফরস্টার। তিনি
ছিলেন ১৯২২ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত। তাঁর সময়ে সামান্য কিছু উন্নতি হয়। তিনি ইন্সটিটিউট
থেকে বিজ্ঞান সাময়িকী 'কারেন্ট সায়েন্স' প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ইন্সটিটিউট থেকে
ততদিনে চারশ ছাত্র পাস করে বেরিয়েছে।
১৯৩৩ সালে রামন যখন ইন্সটিটিউটের
ডিরেক্টর পদে যোগ দেন তখন সেখানে ডিপার্টমেন্ট ছিল ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি,
বায়োকেমিস্ট্রি, ও জেনারেল অ্যান্ড অর্গানিক কেমিস্ট্রি। ইন্সটিটিউটে তখন কোন
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না। রামনের সবচেয়ে প্রথম কাজ হলো ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট
খোলার ব্যবস্থা করা।
কাজ করতে গিয়ে রামন দেখলেন এখানে
বিরাট মাথাভারি প্রশাসনিক দপ্তর বসে আছে। প্রতিটি পদক্ষেপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
আজ সিদ্ধান্ত নিলে সেটা অসংখ্য কমিটির হাত ঘুরে আসতে আসতে কয়েক মাস লেগে যায় বাস্তবায়িত হতে। এরকম শামুকের
গতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত নন রামন। তিনি কোন ধরনের আমলাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের
ক্ষমতাবলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে শুরু করলেন। তিনি ইন্সটিটিউটে
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট খোলার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু প্রয়োজনমত বাজেট পাওয়া গেলো
না। তিনি দেখলেন কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সের অনেককিছুই কমন। তাই এই দুই ডিপার্টমেণ্ট
একই ল্যাব ও ওয়ার্কশপ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তাতে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের
সবাই রেগে গেলেন। ফিজিক্সের জন্য সহকারী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হলো। রামন চেষ্টা
করতে শুরু করলেন পুরো ইন্সটিটিউটের গবেষণা-কাজে গতিসঞ্চার করতে।
১৯৩২-৩৩ সালে ইন্সটিটিউট থেকে সব
ডিপার্টমেন্ট মিলে মাত্র ৩২টি পেপার প্রকাশিত হয়েছিল। রামনের পদক্ষেপে প্রবীণ
অধ্যাপকদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও ১৯৩৫-৩৬ সালে ইন্সটিটিউট থেকে ১৪৮টি গবেষণাপত্র
প্রকাশিত হয়।
১৯৩৪ সালে রামন প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্ডিয়ান
অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এবং সারা ভারতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের অ্যাকাডেমির
ফেলোশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। রামন ছিলেন অ্যাকাডেমির প্রথম সভাপতি। অ্যাকাডেমির
প্রসিডিংস-এর এডিটরও ছিলেন তিনি। পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব
সায়েন্সের প্রসিডিংস পৃথিবীর সেরা সায়েন্স-জার্নালের তালিকাভুক্ত হয়।
প্রশাসনিক শত কাজের মধ্যেও রামনের
গবেষণা থেমে নেই। তিনি আলো ও শব্দের মিশ্রণের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন।
তাঁর সাথে গবেষণা করার জন্য আগে যেমন সবাই কলকাতায় ভিড় করতো, এখন সবাই
ব্যাঙ্গালোরে ভিড় করতে শুরু করেছে। রামন ছাত্র নির্বাচন করতেন অনেক দেখেশুনে।
ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্টের চেয়েও তিনি বেশি গুরুত্ব দিতেন ছাত্রদের নিজস্ব
উদ্ভাবনী শক্তির ওপর। তাঁর অন্যতম ছাত্র নগেন্দ্রনাথ এসেছিলেন বিহার থেকে।
নগেন্দ্রনাথ ছিলেন গণিতজ্ঞ। রামনের আরেক ছাত্র পার্থসারথি সেই সময় তরল পদার্থের
ভেতর দিয়ে আলো যাবার সময় শব্দতরঙ্গ প্রয়োগ করলে কী হয় পরীক্ষা করে দেখছিলেন। কয়েক
বছরের ভেতর রামন ও নগেন্দ্রনাথ আলোর-বেগে শব্দ তরঙ্গ পাঠাবার একটা উপায় খুঁজে
পেলেন। রামন-নাথ থিওরি অপটিক্যাল ফাইবার টেকনোলজির দরজা খুলে দেয়। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮
এই পাঁচ বছরে রামনের আঠারোটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের কনফারেন্সে প্রতিনিধিদের সাথে রামন
হিটলারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে
আইনস্টাইনসহ আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ইওরোপ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন এসময়। রামন
ভাবলেন এঁদের কাউকে যদি ভারতে নিয়ে আসা যায় তাহলে ভারতের বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার
ঘটানো সম্ভব। কাজ শুরু করে দিলেন রামন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পথিকৃৎ এরভিন শ্রোডিংগারের
কাছে চিঠি লিখলেন রামন। কিন্তু চিঠি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় শ্রোডিংগার ডাবলিনে
চলে গেছেন।
বিজ্ঞানী ম্যাক্স
বর্নের জন্য ইনস্টিটিউটে পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষ প্রফেসর পদ সৃষ্টি করার উদ্যোগ
নিলেন রামন। ইন্সটিটিউটের কাউন্সিলে পদটি পাস হবার আগে বর্নকে ছয় মাসের জন্য ভিজিটিং
প্রফেসর হিসেবে ইন্সটিটিউটে এসে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান রামন। ১৯৩৫ সালের নভেম্বর
মাসে ব্যাঙ্গালোরে এলেন ম্যাক্স বর্ন। ম্যাক্স বর্নের স্ত্রী হেইডির সাথে লোকমের
বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
ইন্সটিটিউটে রামনের বামে ম্যাক্স বর্ন ও ডানে হেইডি
১৯৩৫ সালে ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি
বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজ প্রফেসর কেনেথ অ্যাস্টন। অ্যাস্টন যখন আসেন তখনো তাঁর
কোয়ার্টার রেডি হয়নি। ম্যাক্স বর্ন এসেছেন তার কিছুদিন আগে। অ্যাস্টনের কোয়ার্টার
রেডি হতে যতদিন লাগলো, ততদিন তিনি ম্যাক্স বর্নের কোয়ার্টারেই থাকলেন ম্যাক্স বর্ণ
ও হেইডির অতিথি হয়ে। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল অ্যাস্টন ও বর্নের মধ্যে। শিক্ষক
প্রতিনিধি হিসেবে অ্যাস্টন ইন্সটিটিউটের কাউন্সিল মেম্বার মনোনীত হন।
১৯৩৬ সালের মে মাসে কাউন্সিল মিটিং-এ
ম্যাক্স বর্নের জন্য স্থায়ী অধ্যাপক পদের প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। রামন এই প্রস্তাব
পাস হওয়ার ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি ম্যাক্স বর্নকেও সেই মিটিং-এ নিয়ে
যান। রামন তাঁর প্রস্তাবে ম্যাক্স বর্ন সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেন। কিন্তু দেখা
গেলো কাউন্সিলের মেম্বাররা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। প্রফেসর অ্যাস্টন
ম্যাক্স বর্নের নামে অনেক বাজে কথা বললেন। তিনি বললেন, ম্যাক্স বর্ন ইওরোপের তৃতীয়
শ্রেণির বিজ্ঞানী। নিজের দেশে কাজ না পেয়ে এদেশে এসেছেন। নিজের কানে নিজের
সম্পর্কে অ্যাস্টনের কাছ থেকে এরকম কথা শুনে ম্যাক্স বর্ন ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন।
কাউন্সিল মিটিং-এর পরদিনই ম্যাক্স বর্ন ও হেইডি চলে গেলেন ইন্সটিটিউট ছেড়ে।
রামনের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিয়োগ করার
সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, রামনের ডিরেক্টরশিপ নিয়েও আপত্তি উঠলো
কাউন্সিলে। রামন নিজের ইচ্ছামতো ইনস্টিটিউট চালাচ্ছেন, কমিটির কারো কথা শুনছেন না,
শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান দিচ্ছেন না, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট খুলতে গিয়ে কেমিস্ট্রি
ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করছেন ইত্যাদি অনেক অভিযোগ।
রামন অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
পছন্দ করতেন না। তাঁর কথা ও কাজ এতটাই সরাসরি যে তাতে কাউন্সিলের প্রায় সবাই তাঁর
বিপক্ষে চলে গেলেন। এটা সত্য যে রামন নিজের আকাশচুম্বী অহংবোধের কারণে ইনস্টিটিউটের
পরিচালক হিসেবে নিজে যেটা ভালো মনে করেছেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন পরিচালনা পরিষদের
অনুমোদন ছাড়াই। যেমন ম্যাক্স বর্ন যে বাংলোতে থাকতেন রামন সেটাকে ছাত্রদের
হোস্টেলে পরিণত করে ফেলেছেন। অথচ ঐ বাংলোটাতে উঠতে চেয়েছিলেন কেনেথ অ্যাস্টন।
কাউন্সিলে
কলকাতার প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ও মেঘনাদ সাহা। তাঁরা
রামনকে কলকাতার অ্যাসোসিয়েশান থেকে যেভাবে সরিয়েছেন - ব্যাঙ্গালোরের ইন্সটিটিউট অব
সায়েন্স থেকেও সেভাবেই সরাতে চান। রামনের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের একটা রিভিউ কমিটি
গঠন করা হলো।
রিভিউ কমিটির সদস্যরা হলেন স্যার জেম্স
ইরভিন, এ এইচ ম্যাকেঞ্জি, এবং শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। ভাটনগর ছিলেন মেঘনাদ সাহার
ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৩৬ সালের মে মাসে রিভিউ কমিটি রিপোর্ট দিলো। রিপোর্টে বলা হলো যে
রামনের পরিচালনায় ইন্সটিটিউটের গবেষণায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাঁর
প্রশাসনিক দক্ষতা নেই। প্রশাসক হিসেবে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলো
আপত্তিজনক এবং ক্ষতিকারক। সুতরাং কমিটির দৃষ্টিতে রামন ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের
ডিরেক্টর পদে থাকার যোগ্য নন।
১৯৩৭ সালের মধ্যে ধরতে গেলে রামন
প্রায় একা হয়ে গেলেন। তিনি রিভিউ কমিটির রিপোর্টের জবাব দিয়েছেন। কী কী উন্নয়ন ঘটিয়েছেন
তার পূর্ণ তালিকা দিয়েছেন, জমা-খরচের হিসেব দাখিল করেছেন এবং তাঁর সব কাজের
ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কমিটির কাছে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য হলো না। কমিটির রায়
হলো - রামন ইন্সটিটিউটে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে থাকতে পারবেন, কিন্তু
পরিচালক পদ থেকে সরে যেতে হবে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে ভালো, না করলে তাঁকে অপসারণ
করা হবে।
রামন ডিরেক্টরের পদ থেকে সরে
দাঁড়ালেন। নতুন ডিরেক্টর হলেন মেঘনাদ সাহার সহপাঠী বন্ধু অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ।
১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের
প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন রামন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৮ এই চৌদ্দ বছরে তিনি অনেক
বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা করেছেন। কঠিন পদার্থের থার্মো-অপটিক, ফটো-ইলাস্টিক,
ম্যাগনেটো-অপটিক বিহেভিয়ার, সেকেন্ড অর্ডার রামন ইফেক্ট, ইনফ্রারেড
স্পেক্ট্রোস্কপি ইত্যাদি বিষয়ে রামনের বিখ্যাত সব গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছে এই
সময়। এই চৌদ্দ বছরে তাঁর ৮৩টি গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়।
এই সময়ের মধ্যে তিনি অনেকবার
বিদেশে গিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞানীর আমন্ত্রণে, দেশ বিদেশের বিভিন্ন
সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন।
১৯৩৫ সালে মাইসোরের
মহারাজা রামনকে "রাজসভা ভূষণ" উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। এই উপাধির সাথে
অনেকগুলো হীরা বসানো একটি পদক তাঁকে উপহার দেন। রামন হীরার উজ্জ্বলতা এবং তার ভেতর
আলোর খেলা দেখে হীরা সম্পর্কিত গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরপর হীরা-মণি-মুক্তার
ওপর অনেকগুলো গবেষণা করেন।
ইওরোপে যখন দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে রামন তখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটে বসে একমনে গবেষণা করছেন,
গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই সময় ভারতীয় বিজ্ঞানের দুই প্রতিভাবান এবং ধনবান তরুণ
হোমি ভাবা ও বিক্রম সারাভাই ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ
গবেষণা করছিলেন। যুদ্ধের কারণে দেশে এসে আটকে পড়েছেন। কেমব্রিজের বিকল্প
হিসেবে তাঁরা আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাঙ্গালোরে এসে রামনের সান্নিধ্যে গবেষণা চালিয়ে
যান।
হোমি ভাবা একটু বিশেষ
সুবিধা নিয়ে ইন্সটিটিউটে এসেছিলেন। ইন্সটিটিউট চলে টাটা কোম্পানির টাকায়, আর হোমি
ভাবা টাটা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। তাই ইন্সটিটিউটে ‘স্পেশাল রিডার
ইন কসমিক রে রিসার্চ ইউনিট’ পদ তৈরি করা
হলো হোমি ভাবার জন্য। এজন্য ‘দোরাব টাটা
ট্রাস্ট’ থেকে টাকা দেয়া হলো।
এসময় হোমির পরিচয় হয় গণিতবিদ মাধব
রাওয়ের সাথে। ম্যাক্স বর্ন যখন রামনের আমন্ত্রণে ইন্সটিটিউটে এ কাজ করছিলেন তখন
মাধব রাও কিছুদিন কাজ করেছিলেন বর্নের সাথে। ভারতে সর্বপ্রথম গ্রুপ থিওরি পড়ানো
শুরু করেন মাধব রাও। এডিনবরায় হোমি ভাবা যখন ম্যাক্স বর্নের সাথে দেখা করেছিলেন
তখন ম্যাক্স বর্ন বলেছিলেন মাধব রাওয়ের কথা। মাধব রাওয়ের গাণিতিক দক্ষতার সাথে
পরিচিত হয়ে খুশি হলেন হোমি। ১৯৪০ সালে মাধব রাওয়ের সাথে যৌথভাবে গবেষণাপত্র লিখলেন
হোমি ভাবা। ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে প্রকাশিত হলো এ গবেষণাপত্র
- ‘স্ক্যাটারিং অব চার্জড মেসন”।[1]
শান্তিস্বরূপ ভাটনগর, হোমি ভাবা, স্যার রামন, ও বিক্রম সারাভাই
বিক্রম সারাভাই কেমব্রিজ থেকে ফিরে এসে স্যার সি ভি রামনের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। রামনের পরামর্শে এবং তত্ত্বাবধানে মহাজাগতিক রশ্মির ধর্ম ও প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করলেন বিক্রম সারাভাই। মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা মাপার জন্য গেইগার মুলার কাউন্টার লাগিয়ে যন্ত্রপাতি সেট করেন তিনি। ব্যাঙ্গালোরে কসমিক রে'র তীব্রতা মাপার পর কাশ্মির ও হিমালয়ে গিয়েও মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা মাপেন বিক্রম। বিশাল আকৃতির বিপুল যান্ত্রিক আয়োজনে মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেন বিক্রম সারাভাই। গবেষণা শুরুর দু'বছরের মাথায় বিক্রমের প্রথম গবেষণাপত্র "টাইম ডিস্ট্রিবিউশান অব কসমিক রে" প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংস-এ।
আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক জটিলতা রামন
নিজের চোখে দেখেছেন, এবং দু'বার তিনি এই জটিলতার শিকার হয়েছেন। তাই তিনি ঠিক
করেছেন আর কোন ধরনের সাংগঠনিক কাজে, বিশেষ করে সরকারি কাজে নিজেকে জড়াবেন না।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতারা বুঝতে পারছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসন্ন। তাই তাঁরা
ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন গঠন করেছেন। কংগ্রেসের নেতারা রামনকে অনুরোধ করলেন
সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ কমিটির সদস্য হবার জন্য। রামন রাজি
হলেন না। সেজন্যও রামনের সমালোচনা শুরু হলো। তিনি দেশের কোন কাজে লাগতে চান না,
শুধু নিজের জন্যই কাজ করেন এরকম অনেক কথা বলা হলো রামনের বিরুদ্ধে। রামন নিজের
সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তিনি আরো রেগে যান। ফলে তাঁর একটা প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে
যায়।
রামন সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞান
গবেষণাগার বা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে
সরকারি তদারকিতে যতটুকু গবেষণা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় রাজনৈতিক প্রচার এবং
অপ্রয়োজনীয় দলাদলি। কিন্তু ন্যাশনাল কংগ্রেস অনেকগুলো সরকারি বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠান
গড়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পর দিল্লীতে স্থাপিত ন্যাশনাল
ফিজিক্যাল ল্যাবের পরিচালক পদে যোগ দিয়েছেন তাঁর প্রিয় ছাত্র কৃষ্ণান। এতে তিনি
কৃষ্ণানের ওপরও রেগে গেলেন।
রামন নিজের গবেষণা ও ইন্ডিয়ান
অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শব্দবিজ্ঞান (Acoustics), আলোকবিজ্ঞান (Optics), আলোর ব্যতিচার (Diffraction of
light), হীরার গঠন (structure of diamond), এবং দৃষ্টির তত্ত্ব (theory of vision) - এই সবগুলো শাখায় রামনের বৈজ্ঞানিক অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৪৮ সালে ষাট বছর বয়সে
ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স থেকে অবসর গ্রহণ করেন স্যার রামন।
No comments:
Post a Comment