ইওরোপে 'স্যার'
ও 'লেডি' রামন
১৯২৮ সালের অক্টোবর
মাসে কলকাতায় এসেছেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড। কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন সামারফেল্ড। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই
নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, উল্ফগং পাউলি ছিলেন সামারফেল্ডের ছাত্র। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর পাঁচটি বক্তৃতা দিলেন সামারফেল্ড ওয়েভ মেকানিক্সের সাম্প্রতিক
অগ্রগতির ওপর।
রামনের ছাত্র কৃষ্ণান সবগুলো বক্তৃতা
শুনলেন এবং নিজের মত করে নোট নিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করার
জন্য পান্ডুলিপি তৈরি করে সামারফেল্ডকে দিলেন। সামারফেল্ড পান্ডুলিপি পড়ে অবাক হয়ে
গেলেন। তাঁর মনে হলো তিনি নিজে লিখলেও এর চেয়ে ভালো লিখতে পারতেন না। সামারফেল্ড
কৃষ্ণানকে বইটির সহ-লেখক হবার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু কৃষ্ণান বিনীত ভাবে
প্রত্যাখান করলেন সামারফেল্ডকে। ‘লেকচার্স অন
ওয়েভ মেকানিক্স’ এর ভূমিকায় আর্নল্ড সামারফেল্ড কৃষ্ণানের অবদানের কথা
স্বীকার করে অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছেন কৃষ্ণানকে। কৃষ্ণান নিজের পায়ে দাঁড়ানোর
শিক্ষা পেয়েছিলেন রামনের কাছ থেকে। রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারে রামন অনেকবার স্বীকার
করেছেন কৃষ্ণানসহ সবার অবদানের কথা। অ্যাসোসিয়েশানের যারা যারা রামন-ইফেক্ট
আবিষ্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন রামন সবার কৃতিত্বই স্বীকার করেছেন সবসময়।
কৃষ্ণান, সামারফেল্ড ও রামন
রামন-ইফেক্ট আবিষ্কার
নিয়ে দেশে বিদেশের পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ১৯২৮ সালে
তেরোটি গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছে কৃষ্ণানের। কিন্তু রামনের নামের নিচে কৃষ্ণানের
নাম চাপা পড়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণানের মনে অভিমান জন্ম নেয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি
এমনই নম্র এবং গুরুভক্তি তাঁর এতই প্রবল যে প্রাণ গেলেও রামনের বিরুদ্ধে একটা
শব্দও উচ্চারণ করবেন না। তিনি নিরবে রামনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেন।
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার পদের জন্য দরখাস্ত করলেন কৃষ্ণান। তাঁর
দরখাস্তের সাথে সুপারিশপত্র লিখে দিয়েছিলেন প্রফেসর সি ভি রামন, দেবেন্দ্রমোহন
বসু, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ। নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষ্ণানের
ইন্টারভিউ হলো। ১৯২৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন কৃষ্ণান।
কৃষ্ণান কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে গেলেও
রামনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন। রামনের আরো অনেক ছাত্র দেশের বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো পদে যোগ দিচ্ছেন। এদিকে আরো নতুন নতুন ছাত্র দরখাস্ত
করছে প্রফেসর রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য।
১৯২৯ সালের ১৮ মে রামন ও লোকমের
দ্বিতীয় পুত্র রাধাকৃষ্ণানের জন্ম হয়। রামনের বয়স তখন চল্লিশ আর লোকমের পয়ঁত্রিশ।
রামন এখন আগের চেয়েও ব্যস্ত হয়ে গেছেন। আগের গবেষণা ও অধ্যাপনা তো আছেই। তার সাথে
এখন যোগ হয়েছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠন থেকে আসা আমন্ত্রণ। বিদেশের
বিভিন্ন কনফারেন্স থেকেও ডাক পাচ্ছেন রামন।
ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারছেন রামনের
গুরুত্ব। ১৯২৯ সালের জুনমাসে রামনকে নাইটহুড প্রদান করা হলো। অধ্যাপক সি ভি রামন
আনুষ্ঠানিকভাবে হলেন 'স্যার রামন'। ব্রিটিশ সরকারের দেয়া এই খেতাবটা রামন খুব
পছন্দ করতেন। 'স্যার' খেতাব পাওয়ার পর থেকে তিনি 'স্যার রামন' সম্বোধনটাই পছন্দ
করতেন সবসময়। আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে। খুব বেশি ফর্মাল না
হলে পদবি ধরে কেউ সম্বোধন করে না। এক আমেরিকান সাংবাদিক রামনের সাথে ইনফর্মাল হবার
জন্য জিজ্ঞেস করেছিলেন, "রামন তো আপনার ফেমিলি নেম। আপনার ফার্স্টনেম
কী?" রামন গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, "আমার ফার্স্টনেম হলো
স্যার"।
ভারতের স্বাধীনতার পর অনেকেই তাঁদের
ব্রিটিশ-খেতাব বর্জন করেছিলেন। কিন্তু রামন তাঁর খেতাব বর্জন করেননি। তিনি বলতেন,
"এটা আমার গবেষণার জন্য দেয়া হয়েছে, রাজনীতির জন্য নয়। সুতরাং বর্জন করার
প্রশ্নই ওঠে না।"
ইংল্যান্ডের ফ্যারাডে সোসাইটির
বার্ষিক কনফারেন্সের একটা সম্পূর্ণ অধিবেশন হবে রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের ওপর। স্যার
রামনকে তাঁরা বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ ব্রিস্টল
ইউনিভার্সিটিতে ফ্যারাডে কনফারেন্সে যাবার জন্য তৈরি হলেন রামন। শুধু কনফারেন্সে
যোগ দেয়া নয়, তাঁর মনে আরো একটা পরিকল্পনা ছিল। তিনি লোকমকেও সাথে নিয়ে গেলেন
ইওরোপে।
রামনের নাইটহুডের বদৌলতে লোকম হলেন
'লেডি রামন'। স্যার ও লেডি রামন ১৯২৯ সালের শেষের চার মাস ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়
ভ্রমণ করেন। রামন এর আগে দু'বার ইওরোপ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু লেডি রামনের এটাই
প্রথম। লোকমের কিন্তু মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না। তাঁর শরীরও পুরোপুরি সুস্থ নয়।
তাঁর ছোট ছেলের বয়স মাত্র তিন মাস। এত ছোট বাচ্চা সাথে নিয়ে যাওয়াও যাবে না, আবার
রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রামন কোন কথাই শুনতে চান না। আগস্ট মাসের ২৮
তারিখের জাহাজের টিকেট পাওয়া গেলো। জাহাজ ছাড়বে বোম্বে থেকে। কিন্তু সরাসরি বোম্বে
যাওয়ার উপায় নেই। যাবার পথে মাইসোর (মহীশূর) হয়ে যেতে হবে। ২৪ আগস্ট মাইসোর
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হবেন বলে কথা দিয়েছেন স্যার
রামন।
২০ আগস্ট বিকেলে কলকাতা থেকে ট্রেনে
পুরো রামন পরিবার মাদ্রাজে রওনা দিলেন। ২২ আগস্ট সকালে মাদ্রাজে পৌঁছে লোকমের বিধবা
বোন মেনকার হাতে আট বছরের রাজা ও মাত্র তিন মাসের শিশু রাধাকৃষ্ণানকে তুলে দিলেন।
মেনকা তাদের নিয়ে কয়েমবাটোরে চলে গেলেন লোকমের বড়বোন লক্ষ্মী ও ভগ্নিপতি শিবানের
বাড়িতে।
২২ তারিখ রাতের ট্রেনেই স্যার ও লেডি
রামন মাদ্রাজ থেকে ব্যাঙ্গালোরে চলে গেলেন। তারপর ব্যাঙ্গালোর থেকে মাইসোর পৌঁছলেন
২৩ তারিখ দুপুরে। স্যার ও লেডি রামন মাইসোরের মহারাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের খাস
অতিথি। মহারাজার অতিথিশালায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো। টানা তিন দিনের পথের
ক্লান্তিতে রামন ও লোকম দুজনই কাহিল। তাছাড়া বাচ্চাদের চিন্তায় লোকমের মন খারাপ।
রাতে দুজনের জ্বর এলো। পরদিন লোকম সারাদিন বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না।
স্যার রামন জ্বর নিয়েই সমাবর্তন
অনুষ্ঠানে ভাষণ দিলেন। রামনের বাগ্মীতা অসাধারণ। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তিনি এত সহজ
ভাষায় বোঝাতে পারতেন যে অনেকে মনে করতেন বিজ্ঞান বোঝার জন্য বিজ্ঞানের ছাত্র না
হলেও চলে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রামন তাঁর সাম্প্রতিক আবিষ্কারের কথা বললেন। তারপর তরুণদের
কাছে আশাবাদ প্রকাশ করলেন, “অদূর ভবিষ্যতে
সারাপৃথিবীর মানুষ ভাবতে বাধ্য হবে যে আমাদের প্রতিভা ইওরোপ আমেরিকার ছেলেদের প্রতিভার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।“
লোকমের অসুস্থতার জন্য ২৫ তারিখ
বোম্বে যাওয়া হলো না, ২৬ তারিখ তাঁরা বোম্বে রওনা হয়ে গেলেন।
২৮ তারিখ সকালে এস এস ক্রাকোভিয়া
জাহাজে চড়ে বসলেন স্যার ও লেডি রামন। জাহাজে সহযাত্রীদের মধ্যে পরিচিত অনেকেই
ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন স্যার রামস্বামী আয়ার। স্যার রামস্বামী ছিলেন
স্বদেশী রাজনীতিবিদ। জওহর লাল নেহেরুর সাথে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুগ্ম-সম্পাদক
ছিলেন ১৯১৭-১৮ সালে। রামনের তিন বছর আগে ১৯২৬ সালে তাঁকে নাইটহুড উপাধি দেয়া
হয়েছে। রামন ও লোকমকে খুব সমাদর করলেন তিনি।
জাহাজ ছাড়ার পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন
লোকম। তিনি কেবিনে মড়ার মতো পড়ে রইলেন তিন দিন তিন রাত। কেবিনের জানালা খুলে দিলে
ভালো লাগবে ভেবে জানালা খুলেছিলেন। কিন্তু সমুদ্র ছিল উত্থাল। বড় ঢেউয়ের সাথে
পানি ঢুকে তাঁর বিছানা ভিজিয়ে দিলো। রামনের বিছানা ছিল জানালা থেকে দূরে। সেটার
কিছু হলো না। রামন সারাদিন ডেকের উপর ঘুরে বেড়ান, খাবার খেতে যান, সমুদ্র দেখেন, ভবিষ্যত
গবেষণার পরিকল্পনা করেন, লোকজনের সাথে কথা বলেন। আর রাতের বেলা কেবিনে এসে ঘুমিয়ে
পড়েন। লোকম যে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন সেদিকে তাঁর কোন খেয়ালই নেই। রেঙ্গুন যাওয়ার সময়েও তিনি
এরকমই করেছিলেন। সি-সিকনেসে কিছু করার নেই বলে কিছু করেননি। এখানেও তিনি কিছু না
করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালেন তিন দিন।
তিন দিন পরে স্যার রামস্বামী রামনকে
জিজ্ঞেস করে যখন জানলেন যে লোকম অসুস্থ এবং রামন জাহাজের ডাক্তারকে পর্যন্ত খবর
দেননি - তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এত বড় একজন দায়িত্বশীল বিজ্ঞানী স্বামী হিসেবে এরকম
দায়িত্বহীন কীভাবে হতে পারেন!
স্যার রামস্বামী লোকমের জন্য ডাক্তার
ডাকলেন। জাহাজের ক্রুদের ডেকে লোকমকে উপরের ডেকে খোলা বাতাসে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা
করলেন। লোকম কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে তার বাচ্চাদের কাছে।
প্রতিদিনই তিনি চিঠি লিখছেন তার বোনের কাছে বাচ্চাদের খবরের জন্য। কিন্তু কোন
বন্দরে জাহাজ না ভিড়লে তো চিঠি পোস্ট করা যাবে না। কিন্তু মায়ের মন তো মানে না।
সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ তাঁরা সুয়েজ
খালে পৌঁছলেন। সেখানে জাহাজ থামলে তাঁরা অন্য সবার সাথে জাহাজ থেকে নেমে মিশরের
পিরামিড দেখে এলেন। ১১ সেপ্টেম্বর জাহাজ থামলো ইতালিতে। সেখানে তাঁরা নেমে গেলেন।
নেপল্স থেকে তাঁরা গেলেন রোমে। রামন ইতালিয়ান সোসাইটি অব সায়েন্স এর মাত্তেউচ্চি
(Matteucci) মেডেল
পেয়েছেন গতবছর। রোমের অনেক বিজ্ঞানীর সাথে সাক্ষাৎ হলো রামনের। লোকমকে নিয়ে রামন
রোমের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। কলোসিয়াম, মিউজিয়াম, ক্যাথিড্রাল সব
দেখেন ঘুরে ঘুরে। পরের দিন ভ্যাটিকান সিটিতে ঘুরলেন। সেখানে সিসটিন চ্যাপেলে
মাইকেলেঞ্জেলোর শিল্পকর্ম দেখে খুবই ভালো লাগলো রামনের। আলো ও রঙ রামনের অত্যন্ত
প্রিয় বিষয়।
ইতালি থেকে তাঁরা জেনেভায় যান
সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ। সেখান থেকে মার্সেলিস হয়ে প্যারিস। প্যারিসে ঘুরে সেখান
থেকে লন্ডনে পৌঁছান ২২ সেপ্টেম্বর। লন্ডনে তাঁরা পৌঁছলেন রাত সাড়ে আটটায়। তাঁদের
হোটেল ঠিক করা ছিল না। সেই সময় অবশ্য হোটেল রিজার্ভেশান করা এখনকার মতো এত সহজ ছিল
না। একটার পর একটা হোটেলে তাঁরা যান, গিয়ে শোনেন - কোন রুম খালি
নেই। এভাবে সাতটি হোটেল ঘুরে হোটেল গ্রোসভেনর হোটেলে রুম পেলেন। সেই সময়
ইংল্যান্ডে বর্ণবিদ্বেষ খুবই মোটা দাগে ছিল। রামন ও লোকমকে হয়তো এই কারণেই হোটেলে
রুম দেয়া হয়নি।
রামন এর আগেও বর্ণবিদ্বেষ দেখেছেন ইওরোপ ও আমেরিকায়। ১৯২৪ সালে রামন যখন
আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন কম্পটন-ইফেক্টের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন রামনকে
একদিন লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। রামন যথাসময়ে লাঞ্চে গেলেন একটা রেস্টুরেন্টে।
কম্পটন তাঁকে সাদরে বসালেন। কম্পটন আরেকজন বিজ্ঞানী ডিন গেইলকেও নিমন্ত্রণ
করেছিলেন রামনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন ভেবে। ডিন গেইল অপটিক্স নিয়ে গবেষণা
করছিলেন সেই সময়। কিন্তু ডিন রেস্টুরেন্টে এসে যখন দেখলেন যে কম্পটন একজন বাদামী
রঙের মানুষের সাথে বসে লাঞ্চ করার জন্য ডেকেছেন তাঁকে, চুপচাপ পেছন ফিরে চলে
গেলেন। রামন দেখলেন সব, কিছু বললেন না। অনেক বছর পরে তিনি তাঁর ছাত্র ও সহকর্মী
রামসেশানকে বলেছিলেন, "এরকম মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। ভারতেও যেমন আছে, আমেরিকাতেও
আছে।"[1]
২৪ সেপ্টেম্বর তাঁরা লন্ডন থেকে
ব্রিস্টলে যান। সেখানে ফ্যারাডে সোসাইটির কাউন্সিল মেম্বার প্রফেসর মরিস উইলিয়াম
ট্রেভার্স তাঁদের স্বাগত জানালেন। প্রফেসর ট্রেভার্স ও মিসেস ট্রেভার্স
ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন
(১৯০৯-১৯১৪)। সেই সময় রামনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিলো। ব্রিটিশ রসায়নবিদ প্রফেসর
ট্রেভার্স ক্রিপ্টন, জেনন ও রেডন গ্যাস প্রথম শনাক্ত করেছিলেন। প্রফেসর ট্রেভার্স
ও মিসেস ট্রেভার্স রামন ও লোকমকে নিয়ে গেলেন তাঁদের নিজের বাড়িতে।
২৫ সেপ্টেম্বর রামন ফ্যারাডে সম্মেলনে
রামন-ইফেক্ট ব্যাখ্যা করলেন। বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানীর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় হলো
রামনের। রামন এই ব্যক্তিগত পরিচয়কে খুবই গুরুত্ব দিতেন। কারণ তিনি জানতেন নোবেল
পুরষ্কারসহ আরো বড় বড় পুরষ্কারের জন্য সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করে থাকেন।
কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এই পুরষ্কার দেয়া হয় সেখানে বাছাই পর্বে সুপারিশের মূল্য
অনেক।
রামন যখন বিজ্ঞানীদের সাথে ব্যস্ত সময়
কাটাচ্ছিলেন, লোকম তখন সময় কাটাচ্ছিলেন মিসেস ট্রেভার্সের সাথে। মিসেস ট্রেভার্স
গাড়িতে করে ব্রিস্টলের আশেপাশে ঘুরিয়ে দেখালেন লোকমকে।
অক্টোবরের শুরুতে লন্ডনে ফিরে এলেন
রামন ও লোকম। শুরুতে আবার এসে উঠলেন গ্রোসভেনর হোটেলে। রামন প্রতিদিনই সকালে
বেরিয়ে যান বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের সাথে দেখা করার জন্য। লোকম একা একা
হোটেলে সময় কাটান আর বাচ্চাদের জন্য কাঁদেন বসে বসে। আট বছরের রাজা হয়তো কষ্ট
পাচ্ছে না মায়ের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু তিন মাসের শিশু রাধাকৃষ্ণানের জন্য আকুল
হচ্ছে মায়ের প্রাণ। লোকম রামনকে বলেছেন তাঁর কষ্টের কথা। রামন বলেছেন, শিশুরা এত
কষ্ট বোঝে না। তাছাড়া লোকম তাদের জন্য যা যা করতো, লোকমের বোন তার চেয়ে বেশি করছে।
সুতরাং চিন্তার কিছু নেই। লোকম বুঝতে পারেন না রামনের আচরণ। বাবা হয়েও সন্তানদের
একটুও মিস করছেন না মানুষটা!
রামন নিজের কাজে ব্যস্ত। বিজ্ঞানীদের
সাথে দেখা করা ছাড়াও পেপার লিখছেন ফ্যারাডে সোসাইটির জন্য, রয়েল সোসাইটির
প্রসিডিংস-এর জন্য। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ১৯২৯ সালে ১১টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে
রামনের।
ইওরোপের বিজ্ঞানীদের সাথে রামন
লোকম দেখলেন রামন তাঁকে জোর করে বিদেশে নিয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু তার দিকে ফিরে তাকানোরও দরকার মনে করছেন না। লোকম জানেন এতে মন খারাপ করে বসে থাকার কোন মানে হয় না। তাই তিনি নিজে নিজেই লন্ডন শহর ঘুরে দেখতে শুরু করলেন। টিউব রেলওয়েতে চড়তে শিখলেন। তাছাড়া লন্ডনে প্রচুর ভারতীয় আছেন। ভারতবর্ষে ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়ানোর আন্দোলন চলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে ভারতীয়দের ব্রিটেনে আসার উৎসাহে একটুও ভাটা পড়েনি।
রামনকে রয়েল সোসাইটির হিউজ (Hughes) মেডেল দেয়া হয়েছে এবছর। জার্মানির
ফ্রেইবুর্গ (Freiburg) ইউনিভার্সিটি
সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে, জুরিখ ফিজিক্যাল সোসাইটি সম্মানসূচক সদস্যপদ
দিয়েছে রামনকে। কিন্তু রামনের কিছুতেই মন ভরছে না। তাঁর দৃষ্টি নোবেল পুরষ্কারের
দিকে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১৯২৯ সালের
পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা করা হলো। লুই ব্রগলি তাঁর ম্যাটার-ওয়েভ
আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। রামন কিছুটা
হতাশ হয়ে গেলেন। তিনি শুনেছিলেন ১৯২৯ সালের নোবেল পুরষ্কারের জন্য তাঁকে মনোনয়ন
দেয়া হয়েছে।
নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়নের
ব্যাপারটা খুব গোপনে হয়। নোবেল পুরষ্কার প্রদানের বছর থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর
পর্যন্ত মনোনয়নের তথ্য গোপন থাকে। কিন্তু অনেক সময় যাঁরা মনোনয়নের জন্য সুপারিশ
পাঠান তাঁরা বলে দিতে পারেন যে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু তার সত্যতা প্রমাণের জন্য
অপেক্ষা করতে হয় পঞ্চাশ বছর।
নোবেল পুরষ্কার ঘোষিত হবার পরপরই রামন
কলকাতা ফিরে আসার উদ্যোগ নিলেন। লোকমকে আসল ব্যাপারটা না বললেও লোকম বুঝতে পারলেন
কেন তাঁকে নিয়ে এই সময় এতদিন ইওরোপে কাটিয়েছেন তাঁর স্বামী। রামন ভেবেছিলেন নোবেল
পুরষ্কার ঘোষণার সময় তিনি যদি ইন্ডিয়াতে থাকেন, তাহলে এত কম সময়ের মধ্যে
ডিসেম্বরের দশ তারিখ সুইডেনে গিয়ে নোবেল পুরষ্কার নেবার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন
না। তখনোপর্যন্ত ভারতের একমাত্র নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কারের
অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। তাই রামন ভেবেছিলেন আগেভাগেই সুইডেনের কাছাকাছি এসে
থাকলে একেবারে নোবেল পুরষ্কার নিয়ে ফেরা যাবে। নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক
যোগদান করাটা সামাজিক নিয়ম, তাই তিন মাসের শিশুকে রেখে লোকমকে জোর করে সাথে নিয়ে
এসেছিলেন।
রামন কিছুটা হতাশ হলেও এখনো তাঁর দৃঢ়
বিশ্বাস নোবেল পুরষ্কার তিনি পাবেনই।
[1] Ramaseshan,
S., The portrait of a scientist - C.V. Raman, Current Science,
1988, Vol. 57, p1207-1220
No comments:
Post a Comment