শেষের দিনগুলি
১৯৬০ থেকে ১৯৭০
পর্যন্ত স্যার রামন একেবারে একাকী গবেষণা চালিয়েছেন। রামন ইন্সটিটিউটের সব ছাত্র
যখন দেশে বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন, রামন আর কোন ছাত্র
নেননি। তিনি আশা করেছিলেন ছাত্রদের মধ্যে কেউ তাঁর প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেবেন।
তাঁর গবেষণার উত্তরাধিকার বহন করবে। ভাইয়ের ছেলে সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরকে তিনি
আহ্বান করেছিলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়ন্সে প্রফেসর হিসেবে আসতে। কিন্তু
চন্দ্রশেখর কাকার ছায়ায় বড় হতে চাননি। রামন তারপর নিজের ছেলেকে নিয়ে আশা করেছিলেন।
বেশি জোর করাতে ছেলেটাকেই হারালেন। তারপর থেকে আর কাউকে তিনি জোর করেননি।
তাঁর ছোটবোন সীতালক্ষ্মীর তিন ছেলে
পঞ্চরত্নম, রামশেসন, ও চন্দ্রশেখর। তিনজনই রামনের কাছে গবেষণা শিখেছেন। ১৯৫৬ সালে
পঞ্চরত্নম কোয়ান্টাম অপটিক ইফেক্ট 'পঞ্চরত্নম দশা' আবিষ্কার করেছিলেন। পঞ্চরত্নমকে
নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন রামন। কিন্তু পঞ্চরত্নমও মামার ছায়ায় বড় হতে চাইলেন না।
তিনি মাইসোর ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেন, সেখান থেকে চলে গেলেন অক্সফোর্ডে।
তারপর থেকে একা একা নিজের গবেষণাগারে নিজে
গবেষণা করেছেন। বাইরের জগত থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেললেন। কিন্তু তিনি তখনো অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট।
অ্যাকাডেমির দুটো জার্নালের সম্পাদক। সেই কাজগুলো তিনি ঠিকমতোই করছিলেন।
১৯৬৮ সাল
পর্যন্ত গবেষণা করলেন মানুষের চোখ, চোখের গঠন, আলোর সাথে তার সম্পর্ক, আমরা কীভাবে
দেখি এসব নিয়ে। নিয়মিতভাবে সেগুলো প্রকাশ করেছেন নিজের জার্নালে। ১৯৬৮ সালে বই
আকারে প্রকাশ করলেন, "ফিজিওলজি অব ভিশান"। তিনি এই কাজকে একটি
উন্নতমানের কাজ বলে মনে করতেন। আশা করেছিলেন এই কাজের জন্য তিনি আরেকটি নোবেল
পুরষ্কার পাবেন। কিন্তু ততোদিনে ইওরোপ আমেরিকা প্রযুক্তিতে এত বেশি এগিয়ে গেছে যে
রামন পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে যেসব পরীক্ষা করেছেন সেগুলোর ফলাফল ততটা সূক্ষ্ম ছিল
না। ফলে রামনের 'ফিজিওলজি অব ভিশান' খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বহির্বিশ্বের
কাছে।
যখন তিনি কারো সাথে দেখা করছিলেন না,
ইন্সটিটিউটে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না, সারাদিন একা একা কাজ করেন আর বাগানে ঘুরে
বেড়ান - তখন লোকম তাঁকে বোঝালেন। শিশুরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী, তাই রামনের
উচিত শিশুদের সাথে গল্প করা, শিশুদের পথ দেখানো। লোকম তাঁর দুস্থ শিশুদের স্কুল
থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতে শুরু করলেন ইন্সটিটিউটে। রামন আবার খুশি হয়ে
উঠলেন। তিনি মহা উৎসাহে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাতে লাগলেন তাঁর গবেষণাগার, বাগান,
জাদুঘর, হীরার সংগ্রহ, আর তাদের সামনে খুলে দিতে লাগলেন বিজ্ঞানের আশ্চর্য জগৎ।
ইন্সটিটিউটে শিশুদের সাথে রামন |
১৯৬৮ সালে রয়েল
সোসাইটির ফেলোশিপ ফিরিয়ে দেন রামন। রয়েল সোসাইটির ইতিহাসে এটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী
ঘটনা। কেন তিনি এটা করেছিলেন তার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ
বলেন তিনি নাকি একটা পেপার পাঠিয়েছিলেন রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশের জন্য।
সেটা প্রত্যাখ্যাত হয় বলেই তিনি অভিমানে পদত্যাগ করেছেন।
১৯৬৯ সালে তাঁর প্রিয় ছাত্র এবং
ভাগ্নে পঞ্চরত্নম অক্সফোর্ডে শ্বাসকষ্টে মারা যান। মাত্র ৩৫ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর।
রামনের কাছে এটা ছিল পুত্রশোকের মতো। তাঁর নিজের বয়স তখন ৮১। তিনি খুব ভেঙে পড়লেন।
১৯৭০ সালের শুরুতে অসুস্থ শরীরেও রামন
কানপুরে গেলেন বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতে। সেখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা করে
বলেছেন, "আমি লেডি রামনকে কথা দিয়ে এসেছি যে স্যার রামন কানপুর থেকে জীবন্ত
অবস্থায় বাড়িতে ফিরবে।"
১৯৭০ সালের মে মাসে রামনের একটা
মাইল্ড স্ট্রোক হলো। প্রাণে বেঁচে গেলেও বুঝতে পারলেন তাঁর আর সময় নেই। ১৯৩৪ সালে
অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স গঠন করার পর থেকে তিনি তার প্রেসিডেন্ট। তাঁর নেতৃত্বে
প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে ভারতের বিভিন্ন শহরে অ্যাকাডেমির অ্যানুয়েল কনফারেন্স হয়ে
এসেছে এত বছর। কিন্তু ১৯৭০ সালে রামন সেই কনফারেন্স সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাঙ্গালোরে
করার ব্যবস্থা করলেন।
তিনি গত দশ বছর ধরে গান্ধী জয়ন্তীতে
তাঁর ইন্সটিটিউটে 'গান্ধী স্মারক বক্তৃতা' দেন বিজ্ঞানের সাধারণ শ্রোতার জন্য।
১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসেও তিনি গান্ধী স্মারক বক্তৃতা দিলেন মানুষের কানের গঠন এবং
কীভাবে শুনি সেই সম্পর্কে।
শেষের দিনগুলিতে স্যার রামনের আরেক
ছাত্র ও ভাগনে রামশেসন কাছাকাছি থাকতেন। রামনের ছোট ছেলে রাধাকৃষ্ণান তখন বিদেশে।
বড় ছেলে রাজা মাঝে মাঝে এসে টাকা নিয়ে গেছে তার মায়ের কাছ থেকে, কিন্তু একবারও তার
বাবার খবর জিজ্ঞেস করেনি।
১৯৭০ সালের ৩ নভেম্বর রামনকে হাসপাতালে
ভর্তি করা হলো। রামন একটা কথা পরিষ্কারভাবে সবাইকে বলে দিলেন যে তাঁকে যেন কোন
ধরনের লাইফ-সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা না হয়, এবং তিনি বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে
মারা যেতে চান।
রাধাকৃষ্ণানকে টেলিগ্রাম পাঠানো
হয়েছিল। তিনি চলে এসেছেন। রামনের তখন শেষ অবস্থা। তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁকে হাসপাতাল
থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। রামন ১৯ নভেম্বর ইন্সটিটিউটের কার্যকরী পরিষদের সভা
ডেকে তাঁর ইন্সটিটিউটের দায়িত্ব ইত্যাদি সব বুঝিয়ে দিলেন। লোকম, রাধাকৃষ্ণান ও
রামশেসনকে নির্দেশ দিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন ইন্সটিটিউটের বাগানের কোথাও তাঁর
মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং অহেতুক লম্বা কোন শ্রাদ্ধ ইত্যাদি না করা হয়।
১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর সকালে মারা যান
স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে
মানুষের ঢল নামে রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। ব্যাঙ্গালোরে সেদিন সব প্রতিষ্ঠানে
ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সেদিন বিকেলেই ইন্সটিটিউটের বাগানে
রামনের শবদেহ খুবই সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দাহ করা হয়। রামনের
ইচ্ছানুসারে সেখানে কোন স্মৃতিস্মম্ভ স্থাপন করার বদলে একটি প্রিমা ভেরা (prima vera) গাছ লাগানো হয়
১৯৭৩ সালে।
রামনের মৃত্যুর
পর তাঁর উইল অনুসারে সব বিষয় সম্পত্তি রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটকে দিয়ে দেয়া হয়।
রামন বেঁচে থাকতে কোন সরকারি সহায়তা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও মৃত্যুর আগে তিনি
অনুমতি দিয়েছিলেন দরকার হলে সরকারি সাহায্য নিতে। ১৯৭২ সালে রামন রিসার্চ
ইন্সটিটিউট ইন্ডিয়ান গর্ভমেন্ট এর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধীনে চলে আসে।
রামনের ছেলে বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরামন রাধাকৃষ্ণান রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক
নিযুক্ত হন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সেই পদে ছিলেন।
রামনের জীবনের তেষট্টি বছরের সাথী
লেডি লোকসুন্দরী রামন মারা যান ১৯৮০ সালের ২২ মে।
রাধাকৃষ্ণান মারা যান ২০১১ সালের ৩
মার্চ। রাধাকৃষ্ণান ও ফ্রাঁসোয়া ডোমিনিকের ছেলে বিবেক রাধাকৃষ্ণান এখন রামন
রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
রামন ইফেক্ট
আবিষ্কারের দিনটি স্মরণে ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখ-কে ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান দিবস
ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিনটিতে সারা ভারতের সবগুলো বিজ্ঞান
গবেষণাগার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে এ
দিনটির ভূমিকা অনেক।
মৃত্যুর
কিছুদিন পূর্বে রামন নীল আকাশের দিকে হাত তুলে রামশেসনকে বলেছিলেন “এর চেয়ে সুন্দর
আর কোন কিছু দেখেছো তুমি?” “এই সৌন্দর্য-ই
সুখ।”
রামন তাঁর আবিষ্কৃত নানা রঙের আলোর
খেলায় প্রকৃত সৌন্দর্য তথা প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment