26
“প্রদীপের খবর আছে আজকে।“ – অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাসের খাতায় সাইন করতে করতে সাঈদ স্যার বললেন। আমার আজ তিনটি পিরিয়ড অফ ছিল। সবগুলো পিরিয়ডেই অ্যাডজাস্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। সাঈদ স্যার আমার অবস্থা দেখে সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন ভেবে বললাম, “জ্বি স্যার, আজ আমার অবস্থা বারোটা বেজে যাবে। একটা পিরিয়ডও অফ নেই।“
“আমি সেটার কথা বলছি না। তুমি যে ভাই সবুজ কালি দিয়ে সাইন করেছো।“
“তাই নাকি? হায় হায় হায়।“ – মহিউদ্দিন স্যার আঁতকে উঠলেন। আমি বুঝতে পারছি না সাইন করার সাথে সবুজ কালির কী সম্পর্ক।
“বেইজের ভিতর বেইজ কমান্ডার ছাড়া আর কেউ সবুজ কালি দিয়ে সাইন করতে পারে না।“ মহিউদ্দিন স্যার বললেন।
এরকম নিয়মের কথা আগে তো কোথাও শুনিনি। এই নিয়ম কোথায় লেখা আছে তাও তো জানি না। প্রায় এক বছর হতে চললো এই কলেজে – এর মধ্যে কতদিন ধরে এই কলমটা ব্যবহার করছি। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি কখনো। লাল কালি ব্যবহার করার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধের কথা শুনেছি। যেমন পরীক্ষার খাতায় নাকি লাল কালি ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু কেন যাবে না, বা লাল কালিতে উত্তর লিখলে কেন সে উত্তর শুদ্ধ হলেও বাতিল করে দেয়া হবে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাইনি। এখন শুনছি সবুজ কালিতেও সমস্যা এই ঘাঁটিতে। কিন্তু আমাদের তো কিছু জানানোও হয়নি এব্যাপারে। এই নিয়মগুলি কোথায় লেখা আছে জানতে চাওয়াটা অনেকটা নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার মত শোনায়।
“এতদিন ধরে যে এই কলম দিয়ে লিখলাম তার কী হবে?”
“লিখলে দোষ নেই। সাইন করলে দোষ।“
অদ্ভুত নিয়ম তো। এ তো দেখি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের সামাজিক নিয়মের মতো - এক সাথে ঘর করলে কিচ্ছু হয় না, রান্নাঘরে ঢুকলেই জাত যায়।
ক্লাসে যাবার জন্য বের হলাম। কলেজে অনেক ভীড় এখন। উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তির ফরম নিতে এসেছে অসংখ্য ছেলে-মেয়ে অভিভাবক। এই স্কুল থেকে যারা পাস করেছে তারা ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হতে পারবে। অন্য স্কুল থেকে পাস করে যারা এখানে ভর্তি হতে চায় – তাদের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে মেধানুসারে ভর্তি করানো হয়। এই অঞ্চলে শাহীন কলেজের আলাদা একটি সুনাম আছে। কলেজে নিয়মিত পড়াশোনা হয়, কোন রাজনীতি নেই, রেজাল্ট ভালো করে। এসব দেখে অভিভাবকদের অনেকেই তাঁদের সন্তানদের এই কলেজে ভর্তি করাতে চান। কাছের নৌবাহিনী স্কুল থেকে পাস করে অনেকেই এই কলেজে পড়তে আসে।
ভর্তি ফরম নিতে আসা ছেলেদের অনেকের মাথায় বাহারি লম্বা চুল। সুন্দর ঝলমলে উজ্জ্বল পোশাক। সদ্য কলেজে ওঠার কত রঙিন স্বপ্ন তাদের চোখে। তাদের জন্য কিছুটা মায়া হচ্ছে। যদি চান্স পেয়ে এখানে ভর্তি হয়ে যায় – নাসির স্যারের কাঁচি অপেক্ষা করছে তাদের চুলের জন্য।
ফার্স্ট পিরিয়ডটা ক্লাস সেভেনের সাথে। রোল কল করার পর প্রতিদিনের মতোই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, “আজ আমরা কী করবো?”
কিন্তু আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই পুরো ক্লাস একসাথে বলে উঠলো, “আজ কিছুই করবো না স্যার।“
এই ক্লাসটা আমার জন্য পাওয়ার হাউজের মতো। এদের প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে উৎসাহ দেয়, শক্তি জোগায়।
জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? কী হয়েছে? কিছু করবে না কেন?
“বই তো স্যার শেষ।“
এদের অংক বই আসলেই শেষ। প্রায় সবগুলো অংকই করানো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখন পরীক্ষা নিলেও তারা সবাই লেটার মার্কস পাবে। ফারুকী স্যার ঠিকই বলেন – “স্কুলে ক্লাস নিলে আপনি কখনো হতাশ হবেন না। এখানকার স্কুল সেকশানের ছেলে-মেয়েদের আপনি যেভাবে শেখাবেন, সেভাবেই শিখবে।“
কিন্তু এরা কিছু করবে না বললেই তো হলো না। এরা কিছু না করার অর্থ হচ্ছে ঝামেলা করা। এত হৈ চৈ করবে যে পাশের ক্লাস এইট থেকে নাহার ম্যাডাম বের হয়ে এসে আমাকেসহ ধমক দেবেন। ইতোমধ্যেই তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছেন যে আমি ছেলেমেয়েদের বেশি লাই দিয়ে ফেলেছি। নইলে আমি ক্লাসে থাকাকালীন তারা কথা বলার সাহস পায় কীভাবে। আমার পাশের ক্লাসেই তিনি ক্লাস নেন, তাই তিনি সব বুঝতে পারেন। আমি নাহার ম্যাডামের অভিযোগ মাথাপেতে নিয়েছি। সবার শিক্ষাদানের পদ্ধতি তো এক রকম হবে না।
“তোমাদের সব অংক করা হয়ে গেছে?”
“ইয়েস স্যার।“ – সবাই এক সাথে বললো।
“করতে দিলে করতে পারবে?”
“জ্বি স্যার, করতে পারবো, কিন্তু করবো না।“ – রেহনুমার ঝটপট উত্তর।
“না করলে বুঝবো কীভাবে যে করতে পারবে?”
“পরীক্ষার খাতায় দেখতে পাবেন স্যার।“
এদের আত্মবিশ্বাস দেখে আমার ভালোই লাগছে। অংক করতে দিলে ক্লাসের অনেকেই করতে পারবে, কিন্তু সবাই পারবে কি? একটু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া যাক। বললাম, “একটিমাত্র অংক করতে দেবো। যাকে বলবো সে এসে বোর্ডে অংকটি করে দেবে। ঠিকভাবে করতে পারলে আজ আর কোন পড়াশুনা করবো না। রাজি?”
“রাজি স্যার।“ – প্রায় চিৎকার করে উঠলো সবাই।
“অ্যাই, আস্তে। তোমরা এত চিৎকার করলে আমাকেই স্কুল থেকে বের করে দেবে। যাকে ডাকবো তাকেই বোর্ডে আসতে হবে। দেখি কাকে ডাকা যায়।“
যার দিকে তাকাচ্ছি সেই উঠে বোর্ডের কাছে চলে আসতে চাচ্ছে।
“আবদুর রহিম, এসো দেখি।“
ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্র আবদুর রহিম। সে যদি অংক ঠিকভাবে করতে পারে তাহলে বুঝতে পারবো আমি কিছুটা হলেও আমার কাজ ঠিকমত করতে পেরেছি। পাটিগণিতের অনুপাত সমানুপাত অধ্যায় থেকে একটি অংক করতে দিলাম। করতে দিয়ে মনে হলো আরেকটু সহজ কিছু দিলেই পারতাম। অথবা আর কাউকে করতে বলতে পারতাম। সুব্রত দাস, কানিজ নাইমা, সুলতানা ইয়াসমিন, করিম মোহাম্মদ, পার্সা লোহানী, রেহনুমা নাসিম, আবদুল্লাহ আল মামুন – যে কাউকেই বলতে পারতাম। এখন আবদুর রহিম যদি অংকটা করতে না পারে – আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে।
আমি বোর্ডের দিকে তাকাচ্ছি না। দেখলাম পুরো ক্লাস উদ্গ্রীব হয়ে দেখছে আবদুর রহিম কী লিখছে। তাদের চোখ-মুখের উজ্জ্বলতাই বলে দিচ্ছে আবদুর রহিম অংকটা ঠিকমতোই করছে।
“স্যার হয়ে গেছে।“ – সুব্রত বললো।
দেখলাম আবদুর রহিম ঠিকমতোই অংকটা করেছে। মনে হলো আমি আমার কাজ ঠিকমতোই করছি।
“ভেরি গুড। আজ তাহলে আর পড়াশোনা নয়। এবার খেলাধুলা করা যাক।“
“কী খেলাধুলা?”
“সবাই এক টুকরো সাদা কাগজ নাও। এবার কলম নিয়ে রেডি হও।“
খস খস করে কাগজ ছেঁড়ার শব্দ হলো। সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে খাতা থেকে কাগজ ছিঁড়ছে। কোন কিছু ছিঁড়তে বললে এরা এত খুশি কেন হয় কে জানে।
“দেখি, আমাকে এক টুকরা কাগজ দাও।“
“স্যার এই যে এই যে এই যে” – সবাই তাদের হাতের কাগজ আমাকে দিয়ে দিতে চায়। আমি একজনের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ টেনে নিয়ে বললাম, “আমি এখানে কিছু লিখছি। এবার কাগজটি ভাঁজ করলাম। এবং এই টেবিলের উপর এই হাজিরা খাতার মধ্যে রেখে দিলাম।“
“এবার আমি তোমাদের কিছু লিখতে বলবো। তোমরা তা লিখবে। কিন্তু কেউ কাউকে দেখাবে না কী লিখছো। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে স্যার।“
“এক থেকে পাঁচের মধ্যে যে কোন একটি সংখ্যা লিখ।“
“লিখেছো? এবার এক থেকে দশের মধ্যে যে কোন একটি সংখ্যা লিখ।“
“লিখেছো? এবার যে কোন একটি ফুলের নাম লিখ।“
“লিখেছো? এবার কাগজটি ভাঁজ করো। এবার সুব্রত আর কানিজ সবার কাগজগুলো নিয়ে এই টেবিলে রেখে দাও।“
কয়েক মিনিটের মধ্যে টেবিলের উপর ভাঁজ করা কাগজের স্তুপ হয়ে গেল।
“এবার আমার দু’জন ভলান্টিয়ার দরকার। না, দু’জন নয়, পাঁচ জন ভলান্টিয়ার দরকার। না, না ঠেলাঠেলি করার দরকার নেই। পাঁচ বেঞ্চ থেকে পাঁচ জন এসো। এই তো, পাঁচ জন হয়ে গেল। রেহনুমা আর পার্সা তোমরা দুই জন ব্ল্যাকবোর্ডের দুই পাশে দাঁড়াও, আর রবিন তুমি দাঁড়াও মাঝখানে। এই নাও চক। সুব্রত টেবিল থেকে একটা করে কাগজ তুলে সেখানে কী কী লেখা আছে পড়বে। সুব্রত যখন কাগজটা পড়বে তখন রেহনুমা – লিখবে ১ থেকে ৫ এর মধ্যে সংখ্যাটি, পার্সা লিখবে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে সংখ্যাটি, আর রবিন লিখবে ফুলের নাম। বুঝতে পেরেছ?”
“স্যার, বোর্ডে তো জায়গা হবে না।“ – রবিন বললো।
“আরে হবে হবে, আগে দেখো না কী হয়।“ – রেহনুমা হাসতে হাসতে বললো।
“স্যার আমি কী করবো?” – কানিজ প্রশ্ন করলো।
“তুমি সুব্রতর কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে আবার পড়বে আর মিলিয়ে দেখবে বোর্ডে ঠিকমত লেখা হয়েছে কি না। তারপর কাগজটি টেবিলের এই পাশে সরিয়ে রাখবে। ঠিক আছে? তাহলে শুরু করো।“
“১, ৭, গন্ধরাজ”
“৩, ৭, গোলাপ”
“৩, ৭, গোলাপ”
“৩, ৭, গোলাপ”
“৫, ১০, ধুতুরা”
“১, ২, ফুলকপি”
সবাই বেশ মজা পাচ্ছে যখন দেখা যাচ্ছে প্রায় সবাই ৩, ৭, গোলাপ লিখেছে। মাত্র কয়েকজন লিখেছে অন্য সংখ্যা বা অন্য ফুলের নাম। পুরো ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে কেবল ৩, ৭, আর গোলাপ।
“দেখেছো, তোমরা সবাই, না আসলে সবাই না – বেশির ভাগই একই রকম চিন্তা করেছো। ১ থেকে ৫ এর মধ্যে ৩, ১ থেকে ১০ এর মধ্যে ৭, আর ফুলের নাম লিখেছো গোলাপ। এবার সুব্রত হাজিরা খাতার যেখানে আমার লেখা কাগজটি রেখেছিলাম সেটা খুলে বের করে পড়ো দেখি কী লেখা আছে?”
সুব্রত কাগজটি বের করে পড়লো – “৩, ৭, গোলাপ”
“দেখেছো, আমি জানতাম তোমরা কী লিখতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যাদের চিন্তাভাবনা অত্যন্ত জটিল। যেমন ফুলের নাম ফুলকপি যে লিখেছো, কিংবা ধুতরা ফুল!”
“ও লিখেছে স্যার ফুলকপি। ব্যাটা জটিল। হাহাহা”
“ঠিক আছে, আজ অনেক মজা হলো। কাল কিন্তু পড়াশোনা করতে হবে।“
খাতাপত্র চক-ডাস্টার নিয়ে বের হয়ে আসার সময় সুব্রত বললো, “বাক্স বদল স্যার।“
“তুমি জানতে?” – আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।
“সিনেমাটি দেখেছি স্যার।“ - সুব্রত লাজুক ভঙ্গিতে বললো।
“৩, ৭, গোলাপ – জানতাম স্যার।“ – রেহনুমা হাসতে হাসতে বললো।
সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য থেকে বানানো একটি সিনেমার মাইন্ড গেইম - ভেবেছিলাম এদের জানার কথা নয়। কিন্তু এরা সব জেনেশুনেই অবাক হবার ভান করেছে এতক্ষণ। এত বুদ্ধি কেন এদের? আরেকটু কম বুদ্ধিমান হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
>>>>
ফোর্থ পিরিয়ডে ক্লাস টেনের সাথে এডজাস্টমেন্ট। ক্লাস টেনের বাংলা সেকেন্ড পেপার পড়ানোর কোন যোগ্যতাই আমার নেই। সেখানে আমাকে কেন পাঠানো হলো জানি না। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ক্লাস। তিনি উপস্থিত আছেন, কিন্তু কাজের চাপে ক্লাস নিতে পারছেন না। আমাকে ডেকে বেশ মোলায়েমভাবে বললেন, “আপনি ক্লাসে গেলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। তাই আপনাকে পাঠাচ্ছি। ওদের সিলেবাস শেষ। এখন টেস্ট পেপার সল্ভ করছে। ওদের যে কোন একটা কাজ দিয়ে বসিয়ে রাখবেন।“
ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েদের কাজ দিয়ে বসিয়ে রাখা যে সহজ নয় তা বোঝা গেল একটু পরেই।
“তোমাদের এখন কী করার কথা?” – আমি বেশ হাসিখুশিভাবেই প্রশ্ন করলাম।
“আমাদের এখন কিছুই করার কথা নয় স্যার।“ – বেশ গম্ভীরভাবে বললো একজন মেয়ে। এ মনে হয় এই ক্লাসের সর্দার।
“টেস্ট পেপার থেকে কিছু করার কথা ছিল মনে হয়। ম্যাডাম বললেন একটু আগে।“
“ম্যাডাম এলে করার কথা ছিল। ম্যাডাম আসেননি – তাই আমরা কিছুই করবো না।“
এই ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের সাথে আগে কখনো কথা হয়নি আমার। ক্লাসে টুনিকে ছাড়া আর কাউকে চিনিও না। অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাস যে কার্যকর কিছু না তা শিক্ষার্থীরা ভালো করেই জানে। তাই তারা কিছুই করতে চাচ্ছে না। তাদের সোজাসাপ্টা উত্তর বেশ ভালো লাগছে আমার। বেশ ইন্টারেস্টিং ক্লাস বলে মনে হচ্ছে।
“ম্যাডাম যে বললেন – তোমাদের কোন একটা কাজ দিয়ে বসিয়ে রাখতে – তার কী হবে?”
“কাজ দিতে হবে না স্যার, আমরা তো এমনিতেই বসে আছি।“
“অ্যাই মৌসুমী, আমরা তো এমনি এমনি বসে নেই, হ্যাং ম্যান খেলছি।“
সর্দারের নাম জানা গেলো মৌসুমী।
“তবে কি আমি চলে যাবো?”
“না স্যার, চলে যাবেন না।“
“তোমরা তো কিছুই করবে না, আমি থেকে কী করবো।“
“মৌসুমী, তোরা একটা গান শোনা।“ – একজন ছেলে বললো হাসিমুখে।
মৌসুমী বললো, “ঠিক আছে, শোনাচ্ছি।“
সে টুনির সাথে ফিসফিস করে কিছু আলোচনা করলো। তারপর দু’তিন জন মিলে গান ধরলো, “মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু। তবু যারা বিশ্বাস করে না তুমি আছো, তাদের মার্জনা করো প্রভু।“ – কী সুন্দর গান করে ওরা। কী যে ভালো লাগলো।
গান শেষে প্রশংসা করার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। বললাম, “চমৎকার গাও তোমরা। মনটা ভরে গেল।“
“এবার স্যার আপনার পালা।“
“আমার পালা মানে কী?”
“আপনাকেও একটা গান গাইতে হবে।“
“আমি তো গান গাইতে পারি না।“
“তাহলে কবিতা।“
“আমি কবিতাও পারি না।“
“তা বললে তো হবে না স্যার। আমরা আপনাকে গান শুনিয়েছি। আপনি আমাদের গান অথবা কবিতা শোনাবেন।“
অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাসে এসে এ কী যন্ত্রণায় পড়লাম। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মতো গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমার পক্ষে তো মুখ গোমড়া করে গম্ভীর হয়ে থাকা সম্ভব না।
“শোনান না স্যার, একটা কবিতা শোনান। প্লিজ স্যার।“ – টুনি বললো।
“আমার কবিতা মুখস্থ নেই।“
“কোন সমস্যা নেই স্যার, কবিতার বই আছে।“ – টুনি ব্যাগ থেকে সঞ্চিতা বের করলো।
আর কোন অজুহাত টিকলো না। ভয়ে ভয়ে কী পড়লাম জানি না। এদের ক্লাসের পাশেই ম্যাডামদের কমনরুম। ক্লাস থেকে বের হবার সময় শুনলাম ম্যাডামরা সবাই হো হো করে হাসছেন। আমার কবিতা ছাড়াও হাসার মতো আরো অনেক জিনিস আছে দুনিয়ায়। কিন্তু আমার এত লজ্জা লাগছে কেন?
>>>>
ইন্দ্রাণী পদত্যাগ করে চলে গেছে কলেজ থেকে। তার জন্য কোন বিদায় অনুষ্ঠানও করা হয়নি। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম পদত্যাগ করেছেন। তাঁকে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বিদায় দেয়া হলো প্রিন্সিপালের রুমে। নতুন উপাধ্যক্ষ (শিক্ষা)র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শিরিন ম্যাডামকে। শিরিন ম্যাডামের সাথে আমার এখনো একবারের জন্যও কথা হয়নি কোনদিন।
তোমার এই কাহিনিটা অনেক সুন্দর। পড়ে মনে হলো, তুমি খুব ভালো টিচার ছিলে। সত্যিই আমার মনের বিষন্নতা তোমার লিখা পড়ে কমে গেল।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য। আমি ভালো টিচার ছিলাম কি না তা যাদের টিচার ছিলাম তারা ভালো বলতে পারবে।
Delete