পালিত প্রফেসর
রামন
১৯০৬ সালে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেবার পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্নাতকোত্তর
পর্যায়ে পড়ানোর জন্য বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার উদ্যোগ নেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
তার অধীনস্থ কলেজগুলোতে যে স্নাতকপর্যায়ে পড়াশোনা হয় তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন
করতো। বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার জন্য অনেক টাকার দরকার। উপযুক্ত অধ্যাপক নিয়োগ
করতে হবে, গবেষণাগার স্থাপন করতে হবে। বিশাল অংকের টাকা এবং বিভিন্ন কাজের জন্য উপযুক্ত
মানুষ দরকার।
স্যার আশুতোষ সেই সময়কার ধনী
শিক্ষানুরাগী ভারতীয়দের কাছ থেকে টাকা ও প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন। তারকনাথ পালিত,
রাসবিহারী ঘোষ, খয়রা অঞ্চলের রাজা প্রমুখ টাকা দিলেন কলেজে অধ্যাপক নিয়োগ করার
জন্য। তাঁদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ সহযোগিতা-চুক্তি স্থাপিত হলো।
রাসবিহারী ঘোষের টাকায় 'ঘোষ প্রফেসর'
পদ সৃষ্টি হলো, খয়রার রাজার টাকায় 'খয়রা প্রফেসর', আর তারকনাথ পালিতের টাকায়
'পালিত প্রফেসর'। ১৯১৪ সালে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো।
উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির
আহ্বানে রসায়ন বিভাগে যোগ দিয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পদার্থবিজ্ঞান
বিভাগে ‘রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ
দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। গণিত বিভাগের 'ঘোষ প্রফেসর' হিসেবে যোগ দিয়েছেন
অধ্যাপক গণেশ প্রসাদ। প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন এক ঝাঁক তরুণমুখ - সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন ঘোষ, জ্ঞান ঘোষ, যোগেশ মুখার্জি প্রমুখ।
‘পালিত প্রফেসর’ পদের জন্য
উপযুক্ত কাউকে খুঁজছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। অনেক পি-এইচ-ডি,
ডি-এস-সি সম্পন্ন প্রার্থী দরখাস্ত করছিলেন ওই পদের জন্য। কিন্তু কাউকেই উপযুক্ত
মনে হচ্ছিল না স্যার আশুতোষের।
তাছাড়া 'পালিত প্রফেসর' পদটি সেই
সময়ের সবচেয়ে উঁচুপদ। তার জন্য বেশ কিছু শর্তও দিয়েছেন স্যার তারকনাথ। স্যার তারকনাথ
পালিত ছিলেন লাখপতি কালীশংকর পালিতের একমাত্র পুত্র। তারকনাথ ১৮৩১ সালে
কলকাতায় জন্মেছিলেন। হিন্দু স্কুল থেকে পাশ করে ইংল্যান্ডে যান আইন পড়ার জন্য।
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময়
তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তাঁর অনেক অবদান
আছে। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি পনেরো লক্ষ টাকা দিয়ে একটি ট্রাস্ট
গঠন করে দেন। সেই টাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ স্থাপনে কাজে লেগেছে
এবং পদার্থবিজ্ঞানের পালিত প্রফেসর পদ সৃষ্টি হয়েছে।
'পালিত প্রফেসর' হিসেবে স্যার জগদীশচন্দ্র
বসুকে পাবেন বলে আশা করেছিলেন স্যার আশুতোষ। কিন্তু স্যার জগদীশ তখন প্রেসিডেন্সি
কলেজে তাঁর চাকরিজীবনের শেষের কয়েকটি বছর কাটাচ্ছেন এবং প্রস্তুতি নিচ্ছেন 'বসু
বিজ্ঞান মন্দির' প্রতিষ্ঠার। তাই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে অপারগতা
প্রকাশ করেন।
তারপর স্যার আশুতোষের চোখ পড়ে সি ভি
রামনের দিকে। সেই ১৯০৭ সাল থেকেই স্যার আশুতোষ মুখার্জি রামনকে দেখছেন আই-এ-সি-এস
এ নিরলস পরিশ্রম করতে। দেখছেন রামন কীভাবে একাই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে অনবরত
গবেষণা-পত্র প্রকাশ করে চলেছেন। রামনের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।
এত চমৎকারভাবে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল বিষয় বোঝাতে তিনি সমসাময়িক আর কাউকে
দেখেননি। রামনের দরাজ কন্ঠ, কৌতুক প্রবণতা আর সোজা-সাপ্টা কথা বলার অভ্যাস সবই
খেয়াল করেছেন স্যার আশুতোষ। তাঁর মনে হয়েছে জগদীশচন্দ্র বসুর পরে রামনই হলেন পালিত
প্রফেসরের একমাত্র উপযুক্ত বিজ্ঞানী। কিন্তু রামন উচ্চবেতনের সরকারি কর্মকর্তা।
সেই চাকরি ছেড়ে প্রায় অর্ধেক বেতনের অধ্যাপকের চাকরি করতে রাজি হবেন? কিন্তু রামন
বিজ্ঞানচর্চাই তো করতে চান। সেক্ষেত্রে অধ্যাপকের চেয়ে আর কোন উপযুক্ত পেশা তো
নেই। এসব ভেবে স্যার আশুতোষ রামনকে প্রস্তাব দিলেন বিজ্ঞান কলেজে 'পালিত প্রফেসর'
হিসেবে যোগ দিতে।
রামন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
অর্থবিভাগের চাকরিতে তাঁর উন্নতি হয়েছে অনেক। ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল
থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভাইসরয় কাউন্সিলের
ফিন্যান্স মেম্বারও হয়ে যেতে পারেন। যে উচ্চ-বেতন তিনি পান সেই এগার শ' টাকায় নিজের
খরচেই গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদে তাঁকে বেতন দেয়া
হবে মাত্র ছয় শ' টাকা। কিন্তু রামন বেতন নিয়ে ভাবছেন না, ভাবছেন তাঁর গবেষণার কথা,
ভাবছেন অ্যাসোসিয়েশানে যে সময়টা তিনি দিচ্ছেন তা দিতে পারবেন কি না, এবং সবচেয়ে
জরুরি হলো তাঁর কাজের স্বাধীনতা। গবেষণাগারের একচ্ছত্র আধিপত্যে এখনো পর্যন্ত কোন
সমস্যা হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়েও যেন কোন সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে হবে।
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি কিছু শর্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার ব্যাপারে
সম্মতি জানালেন।
রামন তখন জানতে পারলেন যে যোগদানের পর
তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য ইওরোপে যেতে হবে। পালিত প্রফেসরশিপ পদে নিয়োগের শর্ত হলো
প্রার্থীকে বিদেশী ডিগ্রি থাকতে হবে। না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ইংল্যান্ডে
গিয়ে পিএইচডি করে আসার সুযোগ দেয়া হবে। সাধারণত এরকম সুযোগ পাবার জন্য মানুষ
মুখিয়ে থাকে। কিন্তু রামনের বেলায় ঘটলো উল্টো। ব্রিটেনে গিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে
আসতে হবে এটা রামনের কাছে অপমানজনক ব্যাপার বলে মনে হয়। তিনি বলেন,
"ব্রিটিশদের কাছ থেকে শেখার কিছুই নেই আমার। আমি যে বিজ্ঞান এখানে বসে
প্রতিদিন শিখছি সেগুলি দিয়ে ব্রিটিশদের আমি শিখাতে পারবো। আমার পিএইচডি ডিগ্রির
দরকার নেই।"
স্যার আশুতোষ দেখলেন রামন সবদিক থেকেই
ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বোঝালেন যে রামনের মতো
বিজ্ঞানীর অধীনে কাজ করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে শত শত গবেষক, কিন্তু
রামনের নিজের পিএইচডি ডিগ্রির কোন দরকার নেই। তিনি যে গবেষণাপত্রগুলো এপর্যন্ত
প্রকাশ করেছেন সেগুলো দিয়ে কয়েকটি পিএইচডি থিসিস রচনা করা যাবে। দরকার হলে
বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে এখনি রামনকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে দিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশ যাবার শর্ত থেকে সরে এলো। ১৯১৪ সালের ২৬মার্চ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ডক্টর ব্রুল রামনকে চিঠি দিয়ে জানালেন যে
তাঁকে বিদেশে যেতে হবে না।
১৯১৪ সালে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ চালু হয়ে গেলেও 'পালিত অধ্যাপক' পদে নিয়োগ
তখনো সম্ভব হয়নি। কারণ গবেষণাগার স্থাপনসহ আরো কিছু প্রশাসনিক জটিলতা ছিল। স্যার
তারকনাথ পালিত শর্ত দিয়েছিলেন 'পালিত প্রফেসরশিপ পদে কোন বিদেশি নিয়োগ দেয়া যাবে
না। তাঁর কথা হলো দেশের টাকা বিদেশিরা এসে নিয়ে যাবে তা হবে না। ব্রিটিশ সরকার এই
শর্তে আপত্তি তুললো।
রামনের বিদেশে না যাওয়ার শর্ত মেনে নিয়ে রেজিস্ট্রারের চিঠি
তখন
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ায় ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ব্রিটেনের কর্মকর্তাদের চেয়েও বেশি বেতন
পেতো। যেমন ব্যাঙ্গালোরে টাটাগোষ্ঠী ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা
করেছে। কিন্তু সেখানে সব প্রফেসর ব্রিটিশ। ব্রিটেনে এরকম প্রতিষ্ঠানের পরিচালক
বেতন পান বছরে বারো শ পাউন্ড। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ব্রিটিশ পরিচালকের বেতন বছরে
চার হাজার পাউন্ড। তাই অনেক ব্রিটিশই ইন্ডিয়াতে পোস্টিং নিয়ে আসতে পছন্দ করতেন।
ব্রিটিশ সরকার পালিত প্রফেসরশিপসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে ঝামেলা শুরু করলো। স্যার
আশুতোষ মুখার্জি ভাইস চ্যান্সেলার পদে ইস্তফা দিলেন। নতুন ভাইস-চ্যান্সেলর হলেন
দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
পালিত প্রফেসরের সব ঠিক হতে আরো তিন
বছর লাগলো। রামন ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল পদে কাজ
এবং অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণা চালিয়ে গেলেন নিরলস ভাবে।
১৯১৭ সালের ১১মে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিং-এ রামনের দেয়া অন্যান্য শর্তগুলো উপস্থাপন করা হয়।[1] রামনের
শর্তগুলো ছিল:
(১) যতদিন পর্যন্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার পাওয়া না যায় ততদিন পর্যন্ত মাসিক বেতনের সাথে আরো ২৫০
রুপি করে বাসাভাড়া দিতে হবে।
(২) পালিত প্রফেসর পদ
শুধুমাত্র গবেষণাপদ হলেও তাঁকে অন্য অধ্যাপকরা যেরকম এম-এ ও এম-এস-সি ক্লাসের
ছাত্রদের ক্লাস নেন, সেরকম ক্লাস নিতে দিতে হবে।
(৩) ‘স্যার তারকনাথ পালিত ফিজিক্যাল ল্যাবোরেটরি’র ডিরেক্টরের দায়িত্বও তাকে দিতে হবে যেন তিনি স্বাধীনভাবে ল্যাবোরেটরির
যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ানদের পরিচালনা করতে পারেন। ল্যাবোরেটরির যন্ত্রপাতি কেনার
জন্য পাঁচ হাজার রুপির একটা ফান্ডও তৈরি করে দিতে হবে যেন তিনি দরকারমতো
যন্ত্রপাতি কিনতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রামনের প্রথম দুটো শর্ত
মেনে নেন। কিন্তু তৃতীয় শর্তটি মানা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হলো। রামন অনেক
ভেবেচিন্তে তাতেই রাজি হলেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবোরেটরিতে কাজ না করলেও
চলবে তাঁর, অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণাগার তো আছেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কোন
পূর্ব-অভিজ্ঞতা তার নেই। ছাত্রজীবনে পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিলেন ক্লাস না করার।
তাছাড়া যদি দেখা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ভালো লাগছে না, বা এখনকার চাকরির
চেয়ে বেশি সময় দিতে হয় তখন কী হবে? এসব ভেবে তিনি অর্থবিভাগের চাকরি থেকে এক বছরের
ছুটির আবেদন করলেন। সেই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে দেখবেন ভালো লাগে কি না।
যদি লাগে তাহলে অর্থবিভাগের চাকরি ছেড়ে দেবেন, আর না লাগলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে
আবার অর্থবিভাগে যোগ দেবেন।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকার রামনের এই আবদার
রক্ষা করবেন না বলে জানিয়ে দিলো। বলা হলো, অন্য চাকরি নিতে হলে এই চাকরি ছেড়ে দিতে
হবে। রামন তাই করলেন। অর্থবিভাগের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
১৯১৭ সালে ২৯ বছর বয়সে সরাসরি প্রফেসর
পদে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিলেন রামন। তারপর থেকে তিনি হলেন
প্রফেসর রামন।
১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিয়ে প্রফেসর সি ভি রামনের নতুন জীবন শুরু হলো। আগে
দৈনিক প্রায় আট ঘন্টা সময় গবেষণার বাইরে থাকতে হতো। এখন সেই আট-ঘন্টাও যোগ হলো
তাঁর গবেষণার সময়ের সাথে। মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে প্রথম ক্লাসেই
খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলেন স্যার রামন। ছাত্রদের ভেতরে বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসা জাগানোয়
তাঁর জুড়ি নেই।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে সহকর্মীদের সাথে রামন
কিন্তু
কিছুদিনের ভেতর রামনের স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্তের কারণে এবং অতি-জনপ্রিয়তার
কারণে বাঙালি সহকর্মীদের সাথে সমস্যা তৈরি হতে শুরু করলো। তিনি বিজ্ঞান কলেজের
গবেষণাগারে কাজ করার জন্য উপযুক্ত টেকনিশিয়ান খুঁজছিলেন। কারণ তিনি জানেন
গবেষণাগারের টেকনিশিয়ানের ওপর অনেককিছু নির্ভর করে। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের
ফিজিক্স ল্যাবে গিয়ে সেখানকার ল্যাব-টেকনিশিয়ানকে সায়েন্স কলেজের ল্যাবে যোগ দিতে আহ্বান করে
আসেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবের পরিচালক ছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র। রামনের সাথে
জগদীশচন্দ্রের খুব একটা সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া রামনের
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্যার জগদীশেরও কোন উৎসাহ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
স্যার জগদীশ রামনের ওপর রেগে গিয়ে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি লিখলেন, "আমার অনুপস্থিতিতে আমার
ল্যাবের টেকনিশিয়ানকে তিনগুণ বেতন দেবার লোভ দেখিয়ে সায়েন্স কলেজে নিয়ে যেতে চান
প্রফেসর রামন। এটা দুঃখজনক। ..."[2]
১৯১৯ সালে অমৃতলাল সরকারের মৃত্যুর পর
অ্যাসোসিয়েশানের অবৈতনিক সেক্রেটারি নির্বাচিত হন রামন। বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েশানের
দুটো গবেষণাগারের সব দায়িত্ব তাঁর হাতে। সমানে চলছে গবেষণার কাজ। পরবর্তী তিন
বছরের মধ্যে আরো পঁচিশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় রামনের।
এই সময় সারাদেশ থেকে অসংখ্য
প্রতিভাবান তরুণ রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য কলকাতায় ভীড় জমাতে শুরু
করে। বাঙালি ছেলেদের তুলনায় দক্ষিণ ভারতের ছেলেদের আগ্রহ বেশি রামনের সাথে গবেষণা
করার ব্যাপারে। রামন তাঁর সব গবেষণাই চালাচ্ছেন অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণাগারে। সেখানে তিনি
সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কারো সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে
পারেন। তাতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন সময় নষ্ট হয় না। রামন সময় নষ্ট করার ঘোর
বিরোধী।
গবেষণার ফলাফল প্রকাশের ব্যাপারে
একটুও দেরি করতেন না রামন। যে কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা মনে এলে প্রাথমিক ধারণাটুকু
লিখে সায়েন্টিফিক নোটের আকারে বা চিঠিপত্রের আকারে পাঠিয়ে দিতেন নেচার বা এরকম
উঁচু পর্যায়ের জার্নালে। সেগুলো প্রকাশিত হতো। প্রকাশিত হবার অর্থ হলো এই বিষয়ে
তিনি কাজ করছেন। তারপর একের পর এক পরীক্ষামূলক গবেষণার ফল প্রকাশ করতেন - অর্থাৎ
কী কী কাজ হচ্ছে তাও জানিয়ে দিতেন। তারপর ফল বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন
তত্ত্বীয় ব্যাপারটা অর্থাৎ যা ঘটছে তার পেছনে বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব কাজ করছে।
এভাবে প্রতিটি বিষয়ে তাঁর প্রচুর গবেষণাপত্র থাকতো। তিনি নিজের হাতে যেসব পেপার
লিখতেন শুধু সেগুলোতে নিজের নাম দিতেন। তাঁর ছাত্ররা তাঁর আইডিয়া নিয়ে কাজ করে
গবেষণায় চমৎকার ফল পেলে সেই পেপার তিনি ছাত্রদেরকেই লিখতে বলতেন এবং তাদের নামেই
প্রকাশিত হতো। রামন কখনো তত্ত্বাবধায়ক এবং সুপারভাইজার হিসেবে নিজের নাম সেইসব
পেপারে দিতেন না। রামন বিজ্ঞানের জগতে পরিচিত নাম। তাঁর নাম পেপারের সাথে দেখলে
যেন রিভিউয়াররা যেন পক্ষপাতিত্ব করতে না পারেন সেজন্যই তিনি
ছাত্রদের পেপারে নিজের নাম দিতেন না। তাতে তাঁর গবেষক-ছাত্ররা অনেক বেশি
আত্মবিশ্বাসী এবং অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এসসি ক্লাসে রামন
পড়াতেন ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম, ও ফিজিক্যাল অপটিক্স। তাঁর ক্লাসে
ছাত্ররা একজনও অনুপস্থিত থাকতো না। আর রামনও একটা ক্লাসও মিস দিতেন না।
প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি মাস্টার্স পড়ার সময় প্রথম ক্লাসের পর আর একটা ক্লাসও
করেননি, কারণ তখনকার শিক্ষকদের চেয়ে তিনি নিজে বেশি জানতেন। কিন্তু তার প্রায় এক
যুগ পর তিনি যে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন তারা কেউই তার চেয়ে বেশি জানে না। প্রতিদিন ছাত্রদের নতুন নতুন
জ্ঞান দেবার ব্যাপারে তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। যে কোন অবস্থাতেই ঠিক সময়ে ক্লাসে
উপস্থিত থাকতেন তিনি। সময়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ নিষ্ঠাপরায়ণ।
সেই সময় মহাত্মা গান্ধীর ডাকে
ভারতজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুই হয়েছিল বাংলা
থেকে। সে হিসেবে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা আন্দোলনমুখর। ছাত্ররা ক্লাস বর্জন
করে আন্দোলন করছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। রামন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সমর্থক
ছিলেন, কিন্তু সেজন্য ক্লাসবর্জন সমর্থন করতেন না। তিনি ক্লাস নিতেন। তাঁর
ছাত্ররাও ক্লাস মিস করতে চাইতো না। ফলে আন্দোলনকারীরা রামনকে ভালো চোখে দেখতেন না।
অধ্যাপকদের মধ্যেও যাঁরা স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে অধ্যাপক
মেঘনাদ সাহা, প্রফেসর রামনের এই 'আন্দোলন-বিরোধী' কাজ খুবই অপছন্দ করলেন। কিন্তু রামনের
কথা পরিষ্কার। তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বর্জন করলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
বেতন নেয়াও বন্ধ করতে হবে। কাজ না করে বেতন নেয়া অনৈতিক। এই নীতির জন্য রামনকে বলা
হলো 'ব্রিটিশ-প্রেমিক'। অথচ একথা যারা বলছেন তাঁরা বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন,
আর রামন বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার
হয়েছেন রামন। সেখানেও তিনি সোজাসুজি তাঁর মতামত জানাতেন কোন রকম রাখঢাক না করেই।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে সরাসরি আপত্তি
জানান তিনি। তিনি বলেন, পঞ্চাশ বছর বয়সের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মতৎপরতা
সৃষ্টিশীলতা অনেক কমে যায়। তখন শুধুমাত্র আগে কী কী কাজ করেছেন তার স্মৃতিচারণ
করেই সময় কাটান। সিনিয়র শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকার যে একটা দার্শনিক মূল্য থাকে
ষাট বছর বয়সের পর সেটাও চলে যায়। সেক্ষেত্রে অবসরের বয়স বাড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের
কোন উপকার হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট আসে জনগণের টাকা থেকে, সেটা আমাদের মনে
রাখতে হবে। সরকারি সাহায্য আসলে জনগণেরই টাকা।
রামনের সোজাসাপ্টা কথাবার্তা ও
স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্রের সংখ্যা যত বাড়ছিল, তাঁর
সহকর্মীদের মধ্যে তার প্রতি ঈর্ষার মনোভাবও দানা বাঁধছিলো। রামনের কিন্তু ওসব
দেখার কোন সময় নেই। তিনি ঝড়ের মতো কাজ করে চলেছেন।
১৯২০ সালের মধ্যেই রামনের প্রচুর
মেধাবী গবেষক-ছাত্র জুটে গেলো। গবেষক-ছাত্র নির্বাচনের সময় খুবই যাচাই বাছাই করে
দেখতেন রামন। তাঁর সাথে কাজ করার উপযুক্ত না হলে তিনি কাউকে সুযোগ দিতেন না।
ছাত্রদের সাথে কিছুক্ষণ আলোচনা করেই তিনি বুঝতে পারতেন কার কেমন ক্ষমতা আছে। সারা
উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্ররা আবেদন করতে লাগলো রামনের তত্ত্বাবধানে
গবেষণা করার জন্য। অনেকে চাকরি-বাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলো রামনের গবেষণাগারে
গবেষণা করার জন্য। বিজ্ঞান গবেষণায় তখন রামন-ঝড় শুরু হয়ে গেছে। পরবর্তীতে
রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারে যে দু'জন গবেষক সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তাঁরা ছিলেন রামনাথন
ও কৃষ্ণান।
কে আর রামনাথন জন্মেছিলেন কেরালায়
১৮৯৩ সালে। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করে
ত্রিভানদ্রাম মহারাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স পড়াচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন রামনের চেয়ে
বয়সে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট। কিন্তু রামনের সাথে কাজ করার জন্য সাত বছরের চাকরি
ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন ১৯২১ সালে। রামনের গবেষণাগারে যোগ দেবার পর রামনের
তত্ত্বাবধানে আলোর বিচ্ছুরণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তাঁর
দশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
কৃষ্ণানের জন্ম ১৮৯৮ সালে তামিলনাডুতে।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কৃষ্ণান বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দশম শ্রেণিতে
ওঠার পর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক যখন আর্কিমেডিসের নীতির ওপর একটি রচনা লিখতে দিয়েছিলেন কৃষ্ণান শুধু রচনা লিখেই ক্ষান্ত
হননি - আর্কিমেডিসের নীতি কাজে লাগিয়ে কঠিন পদার্থের ঘনত্ব নির্ণয় করার জন্য একটি
যন্ত্রও তৈরি করে দিয়েছিলেন। মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজ থেকে ভৌত বিজ্ঞানে বিএ পাশ
করলেন কৃষ্ণান। গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে সমান দক্ষতা থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি
বেশি টান কৃষ্ণানের। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করবেন বলে তামিলনাড়ুর বাইরে যাবার
চিন্তা করেননি শুরুতে। খ্রিস্টান কলেজে রসায়নের প্রদর্শক পদ খালি হলে সেখানে যোগ
দিলেন কৃষ্ণান।
কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের প্রিয়
শিক্ষক হয়ে উঠলেন কৃষ্ণান। শুধু রসায়নের পরীক্ষণ নয়, দেখা গেলো গণিত,
পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের যে কোন বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলেই শিক্ষার্থীরা ছুটে আসছে
কৃষ্ণানের কাছে। লাঞ্চের ছুটির সময় কৃষ্ণানের কাছে শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগে যায়।
দ্রুত প্রসিদ্ধ হয়ে গেলো কৃষ্ণানের ‘লাঞ্চ লেকচার’। পরবর্তীতে
অনেকেই স্বীকার করেছেন “সারা বছরের পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার শুনে আমি যা শিখেছি
তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি স্যার কৃষ্ণানের লাঞ্চ আওয়ার লেকচার থেকে”।[3] খ্রিস্টান
কলেজে চাকরি করার সময় বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’ নিয়মিত পড়তেন
কৃষ্ণান। সেখানে প্রফেসর রামনের গবেষণাপত্রগুলো পড়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করার
ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন। প্রফেসর রামনের কাছ থেকে পদার্থবিজ্ঞান শিখবেন ভেবে
চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে এলেন ১৯২০ সালে।
কিন্তু প্রফেসর রামন কৃষ্ণানকে শুরুতে
কোন সুযোগই দিলেন না। বাধ্য হয়ে রামনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় রামনের ক্লাসে
গিয়ে বসতে শুরু করলেন কৃষ্ণান। নিজের চেষ্টায় গণিত শিখছেন, রসায়ন শিখছেন, আর
পদার্থবিজ্ঞান তো আছেই। রামন কৃষ্ণানের আগ্রহ ও মেধার পরিচয় পেয়ে গেলেন কয়েকদিনের
মধ্যেই।
বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে জানানো হলো ১৯২১ সালের জুলাই মাসের ৫ থেকে ৮ তারিখ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে
অনুষ্ঠিতব্য ইউনিভার্সিটি কংগ্রেসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের সাথে
প্রফেসর রামনকেও যেতে হবে। প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশে যেতে আপত্তি নেই রামনের। প্রথম
বিদেশ যাত্রার জন্য তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
No comments:
Post a Comment