Saturday, 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ২২

22

“আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।“
কর্ণফুলির মাঝখানে এসে প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকাটা দুলে উঠতেই সুচরিত স্যার আমাকে জাপটে ধরে বিড়বিড় করতে শুরু করেছেন “আমি সাঁতার জানি না। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।“
দেখলাম তাঁর সারা শরীর কাঁপছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি অভয় দেবার চেষ্টা করলাম, “ভয় পাবার কারণ নেই। এরকম ঢেউয়ে কিচ্ছু হবে না।“
বলার সাথে সাথেই আরেকটা বড় ঢেউ এসে নৌকাটা আরো দুলিয়ে দিলো। সামনের দিকে বসেছিলেন বিমল স্যার। তাঁর শার্টের কিছু অংশ ভিজে গেল পানির ঝাপটায়। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছেন বলে সুচরিত স্যার দেখতে পাচ্ছেন না কালো পানির বড় বড় ঢেউগুলোকে দেখতে কেমন বিশালাকৃতি সাপের ফণার মত লাগছে। ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা মদমত্ত মাতালের মত টলে উঠলেই সুচরিত স্যার আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠেন, “না, আমি সাঁতার জানি না।“
তাঁর কথার কোন জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে বসে রইলাম। তিনি আমাকে যেভাবে ধরে আছেন, তাতে নৌকা যদি ডুবে – আমার সাঁতার জেনেও কোন লাভ হবে না। তিনি বেহুঁশ হয়ে এমন শক্ত হয়ে যাবেন যে তাঁর হাত পায়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে সাঁতার কাটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। মানুষ লেখাপড়া, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাচ, কুটনামি এরকম হাজার রকমের বিদ্যা শিখে ফেলে, অথচ সাঁতারটা কেন শিখে নেয় না কে জানে।
“আজকের হরতাল তো উইথড্র করেছে।“ – সুপাল স্যার বললেন। সুপাল স্যার বসেছেন আমাদের সামনে আমাদের দিকে মুখ করে। তাঁর পেছনে বিমল স্যার।
“হ্যাঁ, মহিউদ্দিন সাহেবের অনুরোধে। আওয়ামী লীগের মেয়র অনুরোধ করেছেন – তাই আওয়ামী লীগ হরতাল তুলে নিয়েছে।“ – ছোলাইমান স্যার বললেন গম্ভীর ভাবে। তাঁর গলার স্বরে কিছুটা বিরক্তি। হরতাল তুলে নেওয়াতে তো ছোলাইমান স্যারের খুশি হবার কথা। হয়তো সরকারের কথায় হরতাল না তুলে, মেয়র সাহেবের অনুরোধে হরতাল তুলে নিয়েছে তাই বিরক্ত। আমি জানতাম না যে হরতাল তুলে নেয়া হয়েছে। জানলে তো নৌকা করে কলেজে যেতে হতো না।
“তাহলে তো আমরা গাড়িতেই যেতে পারতাম।“ – অনেকটা নিজে নিজেই বললাম আমি।
“না, আজকে গাড়ি দেবে না তো। পতেঙ্গার ভেড়িবাঁধ ভেঙে রাস্তার অনেকটা পানির নিচে চলে গেছে। বন্যা হয়ে গেছে ওদিকে।“ – সুপাল স্যার বললেন।
বুঝতে পারলাম কী কারণে আজকের হরতাল তুলে নেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ঘন ঘন হরতাল হচ্ছে ইদানীং। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করছে। বাজেট অধিবেশনেও যোগ দেয়নি তারা। বেশ কয়েকটি হরতালে কলেজে যাইনি। সেগুলোর জন্য ছুটি কাটা হয়েছে। এখন প্রিন্সিপাল স্যারের কড়া হুকুম – হরতালের সময় কলেজে না গেলে বেতন কাটা হবে। অবশ্য বেতন কাটার ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল স্যার নিজে বলেননি, তাঁর নাম করে বলেছেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাদের সাহেব। আগামী সপ্তাহে কলেজে ইন্সপেকশান টিম আসবে ঢাকা থেকে। তার প্রস্তুতি হিসেবে সকল ছুটি বাতিল। এমনকি শুক্রবারেও কলেজে যেতে হতে পারে। কাল কলেজ থেকে আসার সময়ও জানতাম আজ হরতাল। তাই সুপাল স্যার প্রস্তাব করেছিলেন সদরঘাট থেকে নৌকা করে কলেজে আসার। কথা ছিল সাড়ে ছ’টার মধ্যে সদরঘাটে চলে আসার।

ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কাল সারা রাত অনবরত ঝরেছে। আমার বাসায় পানি না উঠলেও – বাসার গলিপথে এক হাঁটু পানি। এত সকালে রিক্সা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ডিসি রোড ধরে প্রায় অন্ধকারে ময়লা কাদা-পানি মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিদার মার্কেটের দিকে বের হয়ে সিরাজদৌল্লা রোডে এলাম। বর্ষা শুরু হতেই রাস্তার পাশে খোঁড়াখুড়িও শুরু হয়েছে। এখন নালার পাশে আরেকটি নালা তৈরি হয়েছে – যেখানে থিকথিকে ময়লা পানি জমে আছে। বর্ষাকালে চামড়ার জুতো পরে কলেজে যাওয়ার উপায় নেই। তাই রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে এক জোড়া প্লাস্টিকের জুতা কিনেছি। দেখতে চামড়ার মতোই লাগে, কিন্তু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়। তবে এই জুতা পরে বৃষ্টির পানিতে হাঁটতে কোন সমস্যা হয় না।
আন্দরকিল্লা পর্যন্ত আসার পর বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু রাস্তার পাশের ইলেকট্রিকের তার থেকে বড় বড় ফোঁটায় পানি পড়ছে তো পড়ছেই। আকাশে ঘন কালো মেঘ। জুলাই মাসের সূর্য উঠেছে কত আগে – অথচ তার আলো দেখা যাচ্ছে না। কাটাপাহাড় লেন দিয়ে হেঁটে রাইফেল ক্লাবের সামনে এসে দুটো খালি রিক্সার দেখা পেলাম। কিন্তু রিক্সায় উঠতে ইচ্ছে করলো না। হাতে সময় আছে। ভোরের ভেজা বাতাসে শ্বাস নিতে ভালোই লাগছে। নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে সদরঘাট রোড। বাম পাশের সাইকেলের দোকানগুলো বন্ধ। লায়ন সিনেমার সাথে লাগানো চায়ের দোকান খুলছে। ঝড়-বৃষ্টি-হরতাল কিছুতেই জীবন-যাপন থেমে থাকে না।

মেইন রোড থেকে ভেতরের দিকে একটা চিকন রাস্তা ধরে যেতে হয় নৌকার ঘাটে। এই রাস্তার মুখে দাঁড়ানোর কথা আমার। সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে মিনিট পাঁচেক আগে। এখনো আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আরো দশ মিনিট পরে সুপাল স্যার আর বিমল স্যার এলেন একটা রিকশা করে। একটু পরে এলেন সুচরিত স্যার। একটা মাত্র ছোট্ট নৌকা ঘাটে বাঁধা। আঠারো-উনিশ বছরের একজন লিকলিকে তরুণ নৌকার কাছে দাঁড়ানো। সুচরিত স্যার যে দরাদরিতে এত ওস্তাদ লোক – তা জানতাম না। বার্মা ইস্টার্নের ঘাট পর্যন্ত এক শ আশি টাকা দাবি করছিলো ছেলেটা। সুচরিত স্যার ধমক-টমক দিয়ে সেটাকে দেড়শো টাকায় নামিয়ে আনলেন। আমরা নৌকায় উঠছি – সেই সময় ছুটতে ছুটতে হাজির হলেন ছোলাইমান স্যার। নৌকায় উঠে বসার পর ফিস ফিস করে জানতে চাইলেন, “ভাড়া কত?”
সুচরিত স্যার বললেন, “দেড়শ টাকা।“
“ওহ্‌” মুখে আর জিভ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বললেন, “বেশি হয়েছে। জনপ্রতি ত্রিশ টাকা। অনেক বেশি।“
সুচরিত স্যার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নৌকার মাঝি ইঞ্জিন চালু করে দেয়াতে আর কিছু বলতে পারলেন না। শক্ত করে নৌকার কিনারা ধরে বসে রইলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বড় বড় ঢেউয়ের দোলায় কাবু হয়ে “আমি সাঁতার জানি না” বলে আর্তনাদ করতে শুরু করেছেন।
বৃষ্টি শুরু হলো আবার। বিমল স্যার তাঁর ছোট্ট ছাতাটি খুলতেই প্রচন্ড বাতাসে তা উলটে গেল। তিনি হায় হায় করে উঠলেন। বার্মা ইস্টার্নের ঘাটের কাছে একটা বড় তেলের জাহাজ। ঘাটে আমাদের নৌকা ভেড়ার উপায় নেই। আমাদেরকে নামতে হলো ভেজা মাটিতে। মাটি দেখার পর সুচরিত স্যারের ভয় কাটলো। সবাই আধভেজা হয়ে গেছি। বার্মা ইস্টার্নের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা খালের পাড় দিয়ে মেঠো পথ বেয়ে গার্ড রুমের সামনে দিয়ে এসে যখন কলেজে ঢুকলাম – ততক্ষণে প্রিন্সিপালের রুমে মিটিং শুরু হয়ে গেছে।
ভেজা জামাকাপড়ের উপর মোটা অ্যাপ্রোনটি জড়িয়ে ঢুকলাম প্রিন্সিপালের রুমে। সব স্যার-ম্যাডামরা প্রিন্সিপালের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর চেয়ারে বসে সিরিয়াসভাবে কিছু বলছিলেন। আমরা ঢুকতেই গম্ভীরভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইউ আর লেট।“
সুচরিত স্যার খুব সপ্রতিভভাবে বললেন, “উই আর সো সরি স্যার। উই হ্যাড টু হ্যাভ দি জার্নি বাই বোট।“
আহা, ইংরেজির কী গুণ। প্রিন্সিপাল স্যারের থমথমে মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠলো। আমি একা হলে হয়তো বলে ফেলতাম, পাঁচ মিনিট দেরিটাই দেখলেন? এত কষ্ট করে এই ঝড়-বাদলের দিনে যে নৌকা করে কলেজে এসেছি সেটার কি কোন দাম নেই?
“প্লিজ লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান” – প্রিন্সিপাল স্যার যা বললেন তার সারাংশ হলো ১৭ জুলাই’র ইন্সপেকশান আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিদর্শক টিম আমাদের সবার কর্মদক্ষতা পরীক্ষা করে দেখবেন। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে হতে হবে। তারা শিক্ষকদের পাঠদান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন এবং মূল্যায়ন করবেন।
কলেজের মধ্যে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বয়ে গেল পরের কয়েকটা দিন। ক্লাসটিচারদের দায়িত্বের মধ্যে পড়লো শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, পাঠ-পরিকল্পনা ইত্যাদি অনেক কিছু। ঘাঁটি থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা এসে প্রিন্সিপালের রুমে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। কী বলেন কে জানে। তারপর আমাদের ওপর নির্দেশ জারি হয় – এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে।
ইন্সপেকশানের আগের দিন ফাইনাল চেকিং করতে আসবেন ঘাঁটির প্রশাসক – যিনি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সম্পাদক। সকাল থেকে সবার ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা। ছোলাইমান স্যার ইলেভেন ক্লাসের মানবিক শাখার ক্লাসটিচার। তাঁর ক্লাসরুম টিচার্স রুমের কাছে। দেখলাম সেই ক্লাসরুমের দেয়ালে লাগানো হয়েছে হরেক রঙের কাগজের ফুল। সবাই “কী সুন্দর” “কী সুন্দর” করছে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ক্লাসরুমের ধবধবে সাদা দেয়ালে কেন হলুদ-লাল কাগজের ফুল লাগাতে হবে।
“তোমার ক্লাসরুম কী ঠিকমতো সাজিয়েছ?” – অঞ্জন স্যার প্রশ্ন করলেন।
“ক্লাসরুম সাজাতে হবে কেন?”
“সাজাতে হবে না? সৌন্দর্য বলে একটা ব্যাপার আছে না? আমি ক্লাসটিচার থাকতে ক্লাস সেভেন প্রতিবার ফার্স্ট হতো?”
“কিসে ফার্স্ট হতো? ক্লাসরুমের কি বিউটি কনটেস্ট হয় নাকি?”
অঞ্জন স্যার কিছু না বলে হে হে করে একটু হাসলেন। যার অর্থ হলো – কালকে বুঝবা মজা।
মজা বুঝে কাজ নেই আমার। ইন্সপেকশানের মজা যে কী জিনিস তা আমি এখনো জানি না। স্কুলে পড়তাম যখন তখন মাঝে মাঝে ইন্সপেক্টর আসতেন। ক্লাসে এসে ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতে বলতেন। বেশিরভাগ সময় শীতকালে হলো এই ইন্সপেকশান। একবার আমার সর্দি হয়েছিল। ইন্সপেক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার সর্দি হয়েছে ইংরেজিতে অনুবাদ কর।“ সর্দি হয়েছে ইংরেজি কি আমি তখনো জানতাম না, এখনো জানি না। এখন গরম কাল – সর্দির ইংরেজি না জানলেও চলবে। কিন্তু অন্য কোন ট্রান্সলেশন কি আমাকে জিজ্ঞেস করবে? ইন্সপেক্টররা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করবেন বলেছেন। তাহলে আমাকে কি আবার পরীক্ষা দিতে হবে? স্টুডেন্টদের সামনে কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হলো। কিন্তু বলা তো যায় না। আমাকে কি দুইবার মূল্যায়ন করবে? একবার ক্লাস সেভেনের অংকে, আরেকবার ইলেভেনের ফিজিক্সে?
ক্লাস সেভেনের ক্লাসরুমে গিয়ে একবার দেখা দরকার। মনিটর সুব্রতকে কিছু দায়িত্ব দেয়া দরকার। লাস্ট পিরিয়ডে সময় পেলাম। গিয়ে দেখলাম ক্লাসরুম ঝকঝকে পরিষ্কার। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। সুব্রত তার ক্ষুদে বাহিনী নিয়ে ইতোমধ্যেই সবকিছু পরিপাটি করে ফেলেছে। কিন্তু শিক্ষক হয়ে কোন ভুল ধরতে না পারলে প্রেস্টিজ বাড়ে না। তাই পরিষ্কার জানালা আবার মোছার নির্দেশ দিলাম। রবিনকে ডেকে বললাম, “তুমি এদিকের জানালাগুলি মুছে ফেল।“ রবিন খুব উৎসাহের সাথে জানালার কাচ মুছতে শুরু করলো।
সুব্রত জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, দেয়ালে কি কিছু বাণী টাঙিয়ে দেবো?”
“কী বাণী?”
“এই যে স্যার – অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।“ – রেহনুমা এক নিশ্বাসে বলে ফেললো। আমি তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, “অন্যায় হয়তো করছি না, কিন্তু যেভাবে সহ্য করছি – তাতে তো তোমাদের ঘৃণায় আমি তৃণসহ দগ্ধ হবো।“
“পছন্দ হয়নি স্যার? তবে স্যার এটা কেমন, কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন, কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?” – রেহনুমা মহা উৎসাহে আরো বাণী দিতে থাকে।
তার দেখাদেখি ক্লাসের প্রায় সবাই একেকজন বাণী-বিশারদ হয়ে উঠতে শুরু করলো।
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নেই ওরে ভয় নেই …” – এরকম আরো কত কী। করিম মোহাম্মদ বিদ্যুৎ বললো, ‘ম্যান ইজ মরট্যাল’। এটা কেন বাণী হবে বুঝতে পারছি না। এটা তো একটা ফ্যাক্ট। এটা লিখে রাখলে তো ‘ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য’ কিংবা ‘গরু একটি উপকারী প্রাণী’ এগুলোও লিখতে হয়।
বললাম, “না, বাণীর দরকার নেই। আমাদের সিম্পল ইজ বিউটিফুল। পরিপাটি থাকলেই হলো। আর ভালো কথা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার চেয়েও বেশি জরুরি হলো মেনে চলা।“

এসময় বারান্দা দিয়ে হেঁটে এলেন একজন নাতিদীর্ঘ ভদ্রলোক। চেহারাটা পরিচিতি মনে হচ্ছে। তাঁর পেছনে প্রিন্সিপাল স্যার যেভাবে বিগলিতভঙ্গিতে হাঁটছেন – তাতে বুঝতে পারছি ভদ্রলোক যথেষ্ট ক্ষমতাবান। তিনি ক্লাস্রুমের সামনে একটু থেমে দেখলেন কী হচ্ছে। তারপর চলে গেলেন অন্য ক্লাসের দিকে। তিনি চলে যাবার পর মনে পড়লো – ভদ্রলোক আমার ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন। এয়ারফোর্সের বড় অফিসার হবেন। সিভিল ড্রেসে এসেছেন বলে অন্যরকম মনে হচ্ছে।

একটু পর ছুটি হয়ে গেল। আমি টিচার্স রুমের দিকে যাবার সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন পিয়ন ইদ্রিস। তার হাতে ফিজিক্স ল্যাবরেটরির বড় খাতা। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “স্যার, আপনি রবিনকে দিয়ে জানালা মুছিয়েছেন!”
“তাতে কী হয়েছে?”
“তাঁর বাবা দেখে ফেলেছেন।“
“ওই অফিসার তার বাবা?”
“হ্যাঁ।“
“তাতে কী হয়েছে? তিনি কি কিছু বলেছেন?”
“না। তিনি কিছু বলেননি। আপনি জানতেন না?”
“না। আমি তো জানি না।“
“স্যার – আপনি বিপদে পড়বেন। সব স্যার-ম্যাডামরাই অফিসারের ছেলে-মেয়েদের চেনেন। আপনি কোন খবরই রাখেন না।“
“রাখার দরকার হলে রাখবো। আর কিছু বলবেন?”
“আয়শা ম্যাডাম আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।“
বারান্দাতেই দেখা হয়ে গেল আয়শা ম্যাডামের সাথে।
“অ্যাই প্রদীপ, আমরা তো বিপদে পড়ে গেছি।“ – আয়শা ম্যাডামের গলায় উৎকন্ঠা।
“কী হয়েছে ম্যাডাম?”
“খান সাহেবকে ল্যাব-এর খাতা লিখতে বলেছিলাম একভাবে। তিনি লিখেছেন। এখন হেড কোয়ার্টার থেকে নাকি চিঠি এসেছে অন্যভাবে লিখতে হবে। খান সাহেব তো বাসায় চলে গেছেন। তুমি কি আজ একটু থাকতে পারবে?”
থাকতে পারবো কি না জিজ্ঞাসা করার অর্থ হলো – থাকতে হবে। আগামীকাল ইন্সপেকশান। আর আজ ছুটির পর বলা হচ্ছে পুরো একটা অফিসিয়াল খাতা – মানে ল্যাবের যন্ত্রপাতির লিস্ট করতে হবে অন্যভাবে। কিন্তু কীভাবে?
ইদ্রিসের কাছ থেকে বড় খাতাটি নিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক লেখা আছে বলে মনে হলো।
“আমি তো এখানে কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না ম্যাডাম। সবকিছু তো ঠিকই আছে।“
“আমিও বুঝতে পারছি না। চলো তো প্রিন্সিপালের রুমে। জিজ্ঞেস করে দেখি আসলে কী হয়েছে?”
প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকলাম আমি আর আয়শা ম্যাডাম। সুপাল স্যার আর সুচরিত স্যারও আছেন সেখানে। প্রিন্সিপালের সামনে চেয়ারে বসে আছেন নাসির স্যার আর সাঈদ স্যার। ইন্সপেকশানের সার্বিক তদারকির ভার সম্ভবত নাসির এই দুজনের উপর।
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি ল্যাবের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির তালিকা যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে – বা লেখা হয়েছে তা ঢাকা থেকে যেভাবে লেখার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে করা হয়নি।
আমি জানতে চাইলাম, “স্যার, নির্দেশটা কখন এসেছে?”
সুপাল স্যার আর আয়শা ম্যাডাম প্রায় একই সঙ্গে বললেন, “আমরা তো এই এখন জানলাম।“
আমি আবার জানতে চাইলাম, “স্যার নির্দেশটা কি আজকে এসেছে?”
প্রিন্সিপাল স্যার আমার কথার উত্তর না দিয়ে কলিং বেল টিপলেন। কর্কশ কলিং বেলের শব্দ আজ আরো কর্কশ মনে হচ্ছে।
“অ্যাই গাউসকে ডাকো।“
একটু পরে অফিস সহকারী গাউস সাহেব রুমে ঢুকলেন।
“গাউস সাহেব, ল্যাবরেটরির চিঠিটা ঢাকা থেকে কখন এসেছে?”
“স্যার ফেব্রুয়ারিতে।“
ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে। এখন জুলাই মাস। আমার মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, “এই ছয় মাস চিঠিটি কোথায় ছিল?”
“ফাইলে ছিল স্যার।“
“আমাদের কাউকে তো কিছু জানানো হয়নি। চিঠি ফাইলে আছে ছয় মাস ধরে, আর আজকে জানাচ্ছেন আমাদের?”
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গলার স্বর উঁচু হয়ে যাচ্ছে। আয়েশা ম্যাডাম বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা। তিনি আমাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য বললেন, “এখন কীভাবে লিখতে হবে বলে দিলে আমরা লিখে ফেলতে পারবো।“
“এখন কিছু বলার পর একটু পরে যদি আরেকটা চিঠি বের হয়? ধরেন মার্চে আরেকটা চিঠি এসেছে, কিংবা এপ্রিলে।“
আমার কথায় হয়তো একটু বেশি শ্লেষ ছিল। প্রিন্সিপাল স্যার ভাবলেন আমি তাঁর কমান্ডকে চ্যালেঞ্জ করছি বা সমালোচনা করছি। তিনি রেগে গেলেন। কঠিন স্বরে বললেন, “লুক মিস্টার প্রদীপ, আপনি সামান্য একটু বেশি কাজ করতে হচ্ছে বলে এত বিরক্ত হচ্ছেন। অথচ এই দু’জন ভদ্রলোক দিনরাত কাজ করছেন। কোনদিন কোন বিরক্তি দেখেছেন এদের মধ্যে?”
প্রিন্সিপাল স্যার সাঈদ স্যার আর নাসির স্যারের প্রশংসা করলেন। তাঁরা দু’জন আরো উৎসাহিত হলেন। কিন্তু আমার যেখানে চুপ করে থাকা উচিত, সেখানে চুপ করে থাকতে পারছি না। বললাম, “উনারা বেশি কাজ করছেন সেটা উনাদের ব্যাপার। কিন্তু আমার প্রশ্ন সেখানে নয়। আমার প্রশ্ন হলো একটা আদেশ ছয়মাস ধরে ফাইলবন্দী করে রেখে দিয়ে এখন বলা হচ্ছে দু’ঘন্টার মধ্যে করে দিতে। এটা কেন হবে?”
সুপাল স্যার আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরে আমাকে থামতে ইঙ্গিত করছেন। একজন প্রিন্সিপালের সাথে এভাবে তর্ক করা যায় না। কিন্তু আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। আয়শা ম্যাডাম আমাকে বললেন, “চলো চলো প্রদীপ, আর সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করে দিই।“
প্রিন্সিপাল স্যার আর কিছুই বললেন না। একটু পরে তিনি সপারিষদ চলে গেলেন। টিচার্স রুমে সুপাল স্যার আর সুচরিত স্যার বসলেন এক টেবিলে – রসায়নের কাজ করতে। আমি বসলাম অন্য টেবিলে। আয়শা ম্যাডামকে দেখে কেমন যেন মায়া লাগছে। মানুষটি এত নরম – যে খান সাহেবকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন তিনি। খানের কাজ আছে। আয়েশা ম্যাডামের ছেলে মুফতি স্কুল ছুটির পর মায়ের সাথে বাসায় যায়। আজ এখনো যেতে পারেনি। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের কাছে। আমি আয়েশা ম্যাডামকে বললাম, “ম্যাডাম আপনি বাসায় চলে যান। আমি সব ঠিক করে ফেলতে পারবো।“
“তুমি একা পারবে?”
“জ্বি পারবো। আপনি চলে যান।“
আয়েশা ম্যাডামকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দিলাম বাসায়। ইদ্রিস এসে জিজ্ঞেস করলেন, “সার্জেন মেস থেকে খাবার এনে দিই স্যার?”
আমার রাগ কমেনি একটুও। খাওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষিধে কিছুই নেই। বললাম, দরকার নেই। ইদ্রিস আর কিছু না বলে চলে গেলেন। সুচরিত স্যার আর সুপাল স্যারের জন্য খাবার আনা হলো। পরবর্তী ছয়-সাত ঘন্টা ধরে যা করলাম তা হলো স্রেফ কেরানির কাজ।
সন্ধ্যায় আয়শা ম্যাডাম আবার এলেন। বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। এত মায়া মানুষটার ভেতর।
রাত দশটা বেজে গেলো বাসায় আসতে আসতে।
পরের দিন প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ইন্সপেকশান টিম এলো। কোথায় কী দেখলেন তেমন কিছু টেরও পেলাম না। ক্লাস চললো রুটিন অনুযায়ী। টিচারদের কার কীভাবে মূল্যায়ন হয়েছে আমি জানি না। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
>>>>>
পোস্ট-ইন্সপেকশান ব্রিফিং-এ প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, ইন্সপেকশান টিম আমাদের কলেজের পারফর্মেন্সে খুব খুশি। ফিজিক্স কেমিস্ট্রির ল্যাব দেখেও খুব সন্তুষ্ট তাঁরা। তারপর বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিলেন আমাদের। বললেন, “মিস্টার প্রদীপ, আপনাকে পরশুদিন আমি না খাইয়ে রেখেছিলাম সারাদিন। আমার কাছ থেকে একটা লাঞ্চ পাওনা রইল আপনার।“
প্রিন্সিপাল স্যার যে মনে রেখেছেন সেটাই অনেক বেশি। লাঞ্চের ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। একবার বায়বীয় চা খেয়ে যে অবস্থা হয়েছিল। বায়বীয় লাঞ্চ খেলে না জানি কি অবস্থা হয়!

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts