04
"আপনি পদিব ছার?"
একটা র-ফলা লাগবে - বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। প্রথম দিন এসেই এটা লাগবে ওটা লাগবে করাটা ঠিক হবে না। বললাম, জ্বি।
"ভাইস পিঞ্চিপাল মেডাম আপনাকে সালাম দিছে।"
"যাচ্ছি" - বলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বললেন, "এখন না ছার, দশ মিনিট পরে যেতে বলছে। ভাইস পিঞ্চিপাল মেডাম এখন রিফাতারা মেডামের সঙ্গে মিটিং করছে।"
"ঠিক আছে, দশ মিনিট পরে যাবো।" - বলে রুমের ভেতর এসে বসলাম। ভদ্রলোকও ঢুকলেন রুমের ভেতর।
"ছার আমার নাম আবুল হোসেন। আমি ছার আপনার এপন্মেন লেটার নিয়া গেছিলাম আপনার দুলাভাইর অফিসে। অনেকদূর যাইতে হইছে ছার। হেই কালুরঘাট। অনেক ঘুরতে হইছে।"
আমি আবুল হোসেনের দিকে খুব কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালাম। আমার জীবনের প্রথম চাকরির নিয়োগপত্র যিনি নিজের হাতে দিয়ে এসেছিলেন তাঁর প্রতি আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ। আবুল হোসেন বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছেন কীভাবে তিনি শাহীন গেট থেকে বাসে উঠে শহরে গিয়ে কত অলিগলি ঘুরে বাস বদলে কালুরঘাট গিয়ে আমার দুলাভাইয়ের অফিসের ঠিকানা খুঁজে বের করেছেন। কথা বলার সময়
আবুল হোসেনের ছোট ছোট চোখ আরো ছোট হয়ে যায়। টকটকে লাল জিভ ও দাঁত দেখে বোঝা যাচ্ছে
প্রচুর পান খান তিনি।
"আপনার দুলাভাই ছার খুব ভালা মানুষ। আমারে একশ টাকা বখশিস দিছে।"
আবুল হোসেন কথা বলতে পছন্দ করেন। শুনতে ভালোই লাগছে আমার। আপনজনদের প্রশংসা শুনতে তো ভালোই লাগে আমাদের। কিন্তু প্রশংসা মাত্রা ছাড়িয়ে তৈলাক্ত হয়ে ওঠার আগেই থামানো দরকার। বললাম, "দশ মিনিট হয়ে গেছে, এবার যাই-"
"জি ছার, চলেন ছার। আমি আগে দেখে আসি মেডামের মিটিং শেষ হইছে কি না।" আবুল হোসেন আমাকে বারান্দায় রেখে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে চলে গেলেন।
টিচার্স রুমের পাশে ছোট্ট একটা অফিস রুম। দেখলাম একজন লিকলিকে ভদ্রলোক বিশাল সাইজের একটি টাইপরাইটারে কিছু টাইপ করছেন। আমাকে দেখেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন। আমার মনে হলো তিনি নাক তুলে তাকালেন। কোলাব্যাঙের মত নাকের মালিক হিসেবে কিছুটা গর্ব ছিল আমার। কিন্তু এই ভদ্রলোকের নাকের কাছে আমার নাক নেহায়েতই শিশু।
অফিসের পাশেই প্রিন্সিপালের রুম। রুমে ভারী পর্দা ঝুলছে। দরজার চৌকাঠের উপরে লাল বাতি জ্বলছে। তার পাশেই আছে সবুজ বাতি। বুঝলাম এগুলো প্রিন্সিপালের রুমের ট্রাফিক লাইট। ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমের দরজায় কোন ট্রাফিক লাইট নেই। দেখলাম একজন ম্যাডাম বেরিয়ে
বারান্দার অন্যদিকে চলে গেলেন। ম্যাডামদের কমনরুম ওদিকে। ইনিই সম্ভবত 'রিফাতারা' ম্যাডাম, ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এতক্ষণ যার সঙ্গে মিটিং করছিলেন।
আবুল হোসেনের ইঙ্গিত পেয়ে রুমে ঢুকলাম। ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের টেবিলে অনেক কাগজপত্র।
"প্রদীপ বসেন। এখানে সাইন করেন।" - একটা বড় খাতা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। দেখলাম হাজিরা খাতা। একদম সবার নিচে আমার নাম লেখা। সম্ভবত একটু আগেই লেখা হয়েছে।
"আপনার রুটিনটা লিখে দিচ্ছি। আপাতত আপনি ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস নেবেন। সায়েন্সে আমাদের তিনটি সেকশান। সপ্তাহে আপনার পনেরটি ক্লাস। ভালো করে প্রিপারেশান নিয়ে ক্লাসে যাবেন। ফার্স্ট ইয়ারের কোন সেকশানে কী কী পড়ানো হয়েছে আয়েশা ম্যাডামের কাছ থেকে জেনে নেবেন।"
আমি রুটিনটা হাতে নিয়ে দেখলাম - ম্যাডামের হাতের লেখা খুবই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। কাল সোমবার সকাল ন'টায় আমার প্রথম ক্লাস একাদশ বি সেকশানের সাথে। দ্বিতীয় ক্লাস একাদশ সি সেকশানের সাথে সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে। অর্থাৎ ৪০ মিনিটে একটা ক্লাস।
"আপনি কি শহরে থাকেন?"
"জ্বি ম্যাডাম।"
"শহরে কোথায়?"
"চকবাজার।"
"তা হলে তো আপনি আমাদের বাসে আসতে পারবেন। সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে বাস আসে ওখান থেকে।"
"কোত্থেকে ছাড়ে ম্যাডাম?"
"আজকে আমাদের সাথে বাসে যাবেন। চকবাজারে যেখানে নামবেন, সেখান থেকে উঠবেন কাল সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে।"
"ঠিক আছে ম্যাডাম।"
"ম্যাডাম আসি?" বলেই রুমে ঢুকলেন সংযুক্তা ম্যাডাম।
"ম্যাডাম, স্টুডেন্টরা যে রিহার্সাল করছে সেখানে তো কোন টিচার নেই।" - সংযুক্তা ম্যাডামকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডানদিকের দেয়ালে তাকালেন। দেখলাম সেখানে বিশাল এক ক্লাস-রুটিন। কোন্ টিচারের কখন কী ক্লাস সব লেখা আছে সেখানে।
"ম্যাডাম, প্রদীপকে নিয়ে যাই?"
ভাইস-প্রিন্সিপালের ঠোঁটের কোণে সামান্য একটু হাসির রেখা দেখা দিল। বললেন, "নিয়ে যান।"
"প্রদীপ, আপনাকে একটা দায়িত্ব দেবো।" - রুমের দরজা পার হতে না হতেই বললেন সংযুক্তা ম্যাডাম।
"বলুন ম্যাডাম"
"আমার সঙ্গে আসুন। স্টুডেন্টরা রিহার্সাল করছে। আপনি ওখানে একটু বসবেন।"
"আমাকে কী করতে হবে?"
"আপনাকে কিছু করতে হবে না। একজন টিচার থাকলে স্টুডেন্টরা
কন্ট্রোলে থাকে। আপনি শুধু বসে থাকবেন।"
রিহার্সালে বসে থাকতে আমার আপত্তি নেই। দেখা যাক কী রিহার্সাল।
একটু আগে মাহফুজের সাথে কথা বলার সময় যে রুমে তবলা-হারমোনিয়াম দেখেছিলাম সেই রুমের বন্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সংযুক্তা ম্যাডাম। দরজা খোলার সাথে সাথে হারমোনিয়ামের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
"অ্যাই শোন, তোমাদের প্রদীপ স্যার - আজকে জয়েন করেছেন। তোমাদের রিহার্সাল মনিটর করবেন। প্রদীপ, কাম ইনসাইড।"
আমি এতক্ষণ দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। সংযুক্তা ম্যাডামের ডাকে রুমে ঢুকতেই একটা চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল। সংযুক্তা ম্যাডাম কড়া ধমক দিলেন, "অ্যাই, কোন গোলমাল করবে না। চুপচাপ রিহার্সাল করো।" - বলেই তিনি চলে গেলেন।
কী অদ্ভুত আদেশ! চুপচাপ থাকলে কি রিহার্সাল করা যায়? গানের রিহার্সাল করতে হলে তো শব্দ করেই গান গাইতে হবে। দেখলাম টেবিলের একপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মেয়ে, দু'জন ছেলে। ছেলেদের একজনের হাত তবলায়, একজন মেয়ের হাত হারমোনিয়ামে। তাদের সামনের বেঞ্চে বসে আছে আরো সাত-আটজন ছেলেমেয়ে। বুঝতে পারছি সবাই অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। ক্লাসের চেয়ারটা দেয়ালের কাছে রাখা ছিল। আমি গম্ভীরভাবে সেখানে বসে পড়লাম। রুমের ভেতর ফিসফিস গুঞ্জন চলছে, কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। এরা কি সংযুক্তা ম্যাডামের আদেশে "চুপচাপ রিহার্সাল" করবে? সামনের বেঞ্চে বসা দু'জন মেয়েকে ঘন্টাখানেক আগে দেখেছিলাম কাইয়ুম স্যারের সাথে কথা বলতে। এদের একজনকে অঞ্জন স্যার নাসরিন বলে ডেকেছিলেন। কোন্জন নাসরিন জানি না।
কেউ কোন কথা বলছে না। বুঝতে পারছি আমার উপস্থিতি একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে এখানে। আমারই উচিত কিছু বলা। জিজ্ঞেস করলাম, "তোমরা কিসের রিহার্সাল করছো?"
"স্যার গানের রিহার্সাল" - তবলাবাদক বললো।
"না, আমি জানতে চাচ্ছি কী অনুষ্ঠানের জন্য এই রিহার্সাল?"
"কাইয়ুম স্যারের বিদায় উপলক্ষে স্যার।"
"ঠিক আছে, রিহার্সাল শুরু করো।"
"অ্যাই রূপা, শুরু কর।" - সামনের বেঞ্চের একজন মেয়ে আদেশ করলো।
যে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে সে রূপা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু হলো, "আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় একদিন, উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে ..."
এই ছেলেমেয়েদের গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী চমৎকার গান করে রূপা। অবশ্য গান-বাজনার আমি কিছুই তেমন বুঝি না। গান জানা তো দূরের কথা গান শোনারই তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না আমাদের। সেই সময় গ্রামের যাত্রাপালা দেখতাম। যাত্রাপালা নাটকের বই পেলে গোগ্রাসে গিলতাম। নাটকের সংলাপ পড়তে পড়তে অভিনয় করার স্বপ্ন দেখতাম। ক্লাস এইটে পড়ার সময় এধরনের একটা নাটকের একটা গানে সুরও দিয়ে ফেলেছিলাম। আমার সঙ্গীসাথীদের গানের জ্ঞান ছিল আমার চেয়েও কম। তাই তারা আমার দেয়া সুরের ব্যাপক প্রশংসা করেছিল। একদিন বড়দের দরবারে যখন নিজের সুরে পাড়লাম সেই গান - চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো - তেড়ে মারতে এসেছিল অনেকে - "রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর দিচ্ছিস ছাগল"। তারপর ইউনিভার্সিটি লাইফে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে গান শুনতে শুরু করলাম। শুনতে শুনতে গাইতে শুরু করলাম। নিজের কাছে নিজের গান ভালোই লাগে। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যদের। আগ্রহভরে গান
শোনাতে গেলে প্রথম লাইনের পরেই সবাই কেমন মারমুখী হয়ে ওঠে।
আমার এরকম সঙ্গীত-অভিজ্ঞতার কথা তো এখানে বলা যাবে না। এখানে আমি শিক্ষক। শিক্ষকেরা কখনো কোন কিছু জানেন না বলে স্বীকার করেন না। শিক্ষার্থীদের
কাছে তাঁরা সবসময় সবজান্তা ভাব নিয়ে থাকেন।
এত সুন্দর গান হচ্ছে - আমার উচিত এখানে কিছুই না বলে তালে তালে মাথা দোলানো। আমি তাই করছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের নতুন পাওয়া শিক্ষককে একটু বাজিয়ে দেখবে না তা কি হয়? রূপা গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "গান কি ঠিক আছে স্যার?"
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম সে কি আসলেই জানতে চাচ্ছে তার গানের ব্যাপারে, নাকি আমার পরীক্ষা নিচ্ছে আমি গানের ক-খ কিছু জানি কি না। মনে হলো আমি যে গান জানি না তা তো আমার গায়ে লেখা নেই। আমি যতক্ষণ গান না ধরছি, ততক্ষণ সে আমাকে ধরতে পারবে না। গান-বিশেষজ্ঞের মত গম্ভীরভাবে বললাম, "তোমরা এক লাইন বাংলা, এক লাইন ইংরেজি এভাবে না গেয়ে, বাংলার প্রথম অংশটা পুরোটা বাংলায় গাও। তারপর ইংরেজির প্রথম অংশটা পুরো গাও - এভাবে মনে হয় ভালো হবে।"
রূপা খুব সিরিয়াসলি নিলো আমার পরামর্শ। আবার নতুন করে গানটা গাইতে শুরু করলো। একটু গায় আর আমার দিকে তাকায়। আমি ওস্তাদের মত মাথা নাড়তে থাকি আর পালাবার পথ খুঁজতে থাকি।
আগের পর্ব
আগের পর্ব
আপনি যে রবীন্দ্রনাথের গানে সুর দেন এটা শুনে মজাই লেগেছে। আপনার লিখা পড়ে আমার আপনার গলায় গান শুনতে ইচ্ছা করছে।
ReplyDeleteআমি সেই সময় জানতাম না যে ওটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আমার গলায় সুর নেই। সে হিসেবে আমাকে অসুর বলা চলে।
Delete