জন্ম ও শৈশব
মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর, বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার সেওড়াতলী গ্রামে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময় বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, গাজীপুর জেলাও গঠিত হয়নি। সেওড়াতলী গ্রাম তখন ছিল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ঢাকা জেলায়।
বাংলাদেশের
অন্য দশটি গ্রামের মতোই একটি সাধারণ গ্রাম সেওড়াতলী। তখনকার পূর্ব বাংলার
প্রাদেশিক শহর ঢাকা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে, অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ
ছিল যে ঢাকা থেকে সেখানে যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যেতো।
সেওড়াতলী
গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল হতদরিদ্র। গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং তাঁদের
সর্বোচ্চ শিক্ষার দৌড় বড়জোর সেই প্রাইমারি স্কুলের দু’একটি শ্রেণি
পর্যন্ত।
সেওড়াতলী ও আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের
মানুষের জন্য একটিই বাজার ছিল - বলিয়াদী বাজার। সেই বাজারে ছোট্ট একটা মুদি দোকান
ছিল মেঘনাদের বাবা জগন্নাথ সাহার। খুবই সীমিত আয় এবং সেই আয়ে সংসার চালাতে হিমসিম
খেতেন মেঘনাদের মা ভুবনেশ্বরী। টানাটানির সংসারে আটটি ছেলেমেয়ে। আট ভাই-বোনের
মধ্যে মেঘনাদ পঞ্চম।
মেঘনাদের মা ভুবনেশ্বরী সাহা ও বাবা জগন্নাথ সাহা |
সেই সময় গ্রামে হাসপাতাল তো দূরের কথা, কোন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারও ছিল না।
তিন-চার গ্রাম মিলে হয়তো একজন হোমিওপ্যাথ কিংবা কবিরাজ পাওয়া যেতো। সব শিশুরই জন্ম
হতো বাড়িতে। মেয়েদের খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যেতো এবং কম বয়সে মা হতো বলে প্রথম
সন্তান হবার সময় মেয়েরা বাপের বাড়িতে চলে যেতো। কিন্তু পরবর্তী সন্তানগুলো
শ্বশুরবাড়িতেই হতো।
দুই ছেলে এবং দুই মেয়ের পর
ভুবনেশ্বরী পঞ্চম বার মা হবার জন্য যেদিন আঁতুড় ঘরে[1] ঢুকলেন সেদিন প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিলো। মুষলধারে বৃষ্টি আর প্রচন্ড
বজ্রপাতের মধ্যে জন্ম নিলো ভুবনেশ্বরী ও জগন্নাথ সাহার পঞ্চম সন্তান। জন্মের
কিছুক্ষণ পরেই প্রচন্ড ঝড়ে আঁতুড় ঘরের চাল উড়ে গেলো। মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে
নবজাতককে বুকে নিয়ে মূল ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলেন ভুবনেশ্বরী।
সেওড়াতলীর এই বাড়িতে জন্মেছিলেন মেঘনাদ সাহা |
জন্মের এক মাস পর নামকরণ অনুষ্ঠান করে শিশুর নাম রাখা হলো মেঘনাথ।
হিন্দুদের বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রের আরেক নাম মেঘনাথ। ঝড়-বৃষ্টির দিনে জন্ম বলে
বৃষ্টি-দেবতার নামও হলো আবার বড় দুই ছেলে জয়নাথ ও বিজয়নাথের সাথে মিল রাখাও হলো।
গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত
পরিবারের আর দশটা শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে - মেঘনাথও সেভাবেই বেড়ে উঠতে লাগলো। একটু
বৃষ্টি হলেই গ্রামের রাস্তা-ঘাট পানিতে ডুবে যায়। ফলে বছরের বেশিরভাগ সময় পানিতে
থৈ থৈ করে চারদিক। ছোট বাচ্চারা হাঁটতে শেখার সাথে সাথে সাঁতরাতেও শিখে ফেলে।
চার বছর বয়সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে
ভর্তি করানোর পাশাপাশি মেঘনাথকে দোকানে নিজের পাশে বসিয়ে কাজও শেখাতে শুরু করলেন
বাবা জগন্নাথ সাহা।[2] তিনি জানেন
তাঁর ছেলেদেরকে এই দোকান চালিয়েই ভরণপোষণ চালাতে হবে। তাই ছেলে যদি স্কুলে সামান্য
একটু লিখতে পড়তে পারে এবং ছোটখাট হিসেব করতে শিখে তাতেই কাজ চলবে।
সেওড়াতলী প্রাইমারি স্কুল। এখানেই প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। |
কিন্তু দোকানে
মন বসে না মেঘনাথের। মন পড়ে থাকে স্কুলের বইতে, অংকের খাতাতে। মেঘনাথের প্রতিভায়
মুগ্ধ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা। প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা শেষ হবার পর তাঁরা
মেঘনাথের বাবাকে অনুরোধ করলেন মেঘনাথের লেখাপড়া বন্ধ না করতে।
কিন্তু বাবা ভাবলেন - অনেক হয়েছে, আর
পড়াশোনার দরকার নেই। এবার পুরোপুরি দোকানে বসুক। বড় ছেলে জয়নাথকে হাইস্কুল পর্যন্ত
পড়িয়ে অনেক শিক্ষা হয়েছে তাঁর। মাধ্যমিক-ই পাশ করতে পারলো না ছেলেটা। মাঝখান থেকে
অতগুলো টাকা গচ্চা গেলো। ম্যাট্রিক ফেল করে ছেলে এখন জুট মিলে কাজ করে মাসে বিশ
টাকা পায়। সংসারের কী লাভ হলো তাতে? জগন্নাথ সাহা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন -
মেঘনাথকে আর পড়াবেন না। পুরোপুরি দোকানেই বসিয়ে দেবেন।
অসহায় মেঘনাথ কী করবে বুঝতে পারে না।
মা-কে বলে কোন লাভ নেই। কারণ সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে মায়ের কোন ভূমিকা
নেই। দোকানে বসতে একটুও ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে বাড়ি থেকে পালিয়ে হাইস্কুলে গিয়ে
ভর্তি হতে। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি কোথাও কোন হাইস্কুল নেই।
সেই সময় ঢাকার দক্ষিণ দিকের থানাগুলোতে
বেশ কয়েকটি হাইস্কুল ছিল। কিন্তু মেঘনাথদের বাড়ি ছিল ঢাকার উত্তর দিকে। সেদিকে
হাইস্কুল বলতে গেলে ছিলই না। দশ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া গ্রামে একটি জুনিয়র
হাইস্কুল ছিল। কিন্তু নিজে নিজে সেখানে যাবার তো কোন উপায় নেই মেঘনাথের।
তবে উপায় একটা হয়ে গেলো। প্রাইমারি
স্কুলে মেঘনাথকে যাঁরা পড়িয়েছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন লেখাপড়ার সুযোগ পেলে মেঘনাথ
অনেক বড় হবে একদিন। মেঘনাথের প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটুক তা তাঁরা চাননি। সবাই মিলে
মেঘনাথের বাবাকে অনুরোধ করলেন মেঘনাথকে হাইস্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্য। মেঘনাথ
যদি ভালো না করতে পারে তাহলে লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেই হলো। জগন্নাথ সাহা রাজি হলেন।
শিমুলিয়া শ্যামাপ্রসাদ জুনিয়র হাই স্কুল। (১৯৭০ সালে তোলা ছবি) |
শিমুলিয়া
জুনিয়র হাই স্কুলে লেখাপড়া শুরু হলো মেঘনাথের। খুব ভোরে উঠে দুই তিন ঘন্টা
ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে পৌঁছানো, ছুটির পর আবার দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া।
বৃষ্টি হলে হাঁটার রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। তখন অনেকটা পথ নৌকায় যেতে হয়। বাবা
ভাবলেন এভাবে চললে ছেলে দু’দিনেই স্কুল
ছেড়ে দেবে। স্কুল থেকে ফিরে ক্লান্ত মেঘনাথ আবার বই নিয়ে বসে। রাতে তার পড়ার শব্দে
ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেন বাবা। কিন্তু কিছুতেই দমে যাবার পাত্র নয়
মেঘনাথ।
বড় ভাই জয়নাথ মেঘনাথের চেয়ে তেরো বছরের
বড়। জয়নাথ বোঝেন ভাইয়ের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহের ব্যাপারটা। তিনি নিজে তেমন মেধাবী
ছিলেন না বলে স্কুলের পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। তাই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পাটের কলে
কাজ করতে হচ্ছে। তাঁর বিশ্বাস সুযোগ পেলে মেঘনাথ অনেক বড় বিদ্বান হবে। তাদের বংশে
তখনো পর্যন্ত কেউ ম্যাট্রিকুলেশানও পাস করতে পারেনি। মেঘনাথের লেখাপড়ার জন্য
যথাসাধ্য চেষ্টা করতে শুরু করলেন জয়নাথ। মেঘনাথকে যদি শিমুলিয়া গ্রামে স্কুলের
কাছাকাছি কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে মেঘনাথের প্রতিদিন বিশ
কিলোমিটার আসা-যাওয়ার কষ্টটা বেঁচে যায়।
একদিন শিমুলিয়া গ্রামে গিয়ে সেখানকার
অবস্থাপন্ন কবিরাজ অনন্ত কুমার দাসের হাতে পায়ে ধরলেন জয়নাথ। অনন্তবাবুকে রাজি
করালেন মেঘনাথকে তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা
করার সুযোগ দেয়ার জন্য। পরের দিনই বইপত্র ও সামান্য জামা-কাপড় যা ছিল তা নিয়ে
মেঘনাথকে অনন্তবাবুর বাড়িতে রেখে এলেন জয়নাথ। নয় বছর বয়সে শুরু হলো মেঘনাথের
জীবন-সংগ্রাম।
কবিরাজ অনন্তবাবু দয়ালু মানুষ। মেঘনাথকে
বাড়িতে রাখার জন্য এবং খাওয়ার জন্য কোন টাকা-পয়সা দাবি করলেন না। তবে শর্ত হলো
মেঘনাথকে বাড়ির কাজ করতে হবে। গরুর দেখাশোনা, ঘাসকাটা আর গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা। তারপর
যেটুকু সময় থাকবে তা লেখাপড়ায় দিতে পারবে।
প্রথম দিন খেতে বসতে গিয়ে জাত-প্রথার
স্বরূপ দেখলো মেঘনাথ। অনন্তবাবুরা দাস পদবিভুক্ত। সাহাদের ছোঁয়া তাঁরা খান না। তাই
খাওয়ার সময় বাড়ির অন্যান্যদের সাথে বসার অনুমতি নেই মেঘনাথের। এতদিন নিজের বাড়ি ও
পাড়ার বাইরে অন্য কোথাও থাকা বা খাওয়া হয়নি বলে মেঘনাথ এসব কিছু জানতো না। জাত-প্রথার
এরকম অপমানজনক নিয়মনীতির সাথে পরিচিত হয়ে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা মেনে নিতে শিখে
গেলো মেঘনাথ। অনন্তবাবুর বাড়িতে তার ছোঁয়া কোন কিছু কেউ খায় না। এঁটো থালা-বাসন
নিজেকেই ধুতে হয় মেঘনাথের। মনে ক্ষোভ থাকলেও তাতে কিছুই যায় আসে না। কবিরাজবাবু যে
তাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন তাতেই সে কৃতজ্ঞ।
স্কুলের বাংলা বইতে মাইকেল মধুসূদন
দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের কিছু অংশ আছে। সেটা পড়ে মেঘনাথের মনে হলো রামায়নের আসল
বীর রাম-লক্ষণ নয়। রাবণকে বধ করার জন্য অনেক প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে দেবতারূপী রাম।
সেই তুলনায় রাবণ বা মেঘনাদ অনেক বেশি সৎ এবং অনেক বেশি বীর। নিজের নাম মেঘনাথের
বদলে মেঘনাদ লিখতে শুরু করলো সে।
মন দিয়ে
লেখাপড়া করলো মেঘনাদ। নিম্ন-মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান
অধিকার করে সরকার থেকে মাসিক চার টাকা বৃত্তি পেলো মেঘনাদ।
[1] সে সময় অনেক
হিন্দু পরিবারে সন্তান জন্মের ব্যাপারটাকে অসূচি বলে মনে করা হতো। তাই সন্তান জন্ম
দেয়ার জন্য প্রসূতিকে মূল বাড়ির বাইরে একটি অস্থায়ী ঘর বানিয়ে সেখানে রাখা হতো।
সেখানেই ধাত্রীর হাতে সন্তানের জন্ম হতো। জন্মের পরেও প্রায় এক মাস নবজাতকসহ নতুন
মা-কে আঁতুড় ঘরে থাকতে হতো।
[2] শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য
সংসদ
No comments:
Post a Comment