এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি
ব্রিটিশ ভারতের
স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের আওতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এলাহাবাদ
ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাসরুমে পড়ানো শুরু হয়েছে। এর আগে ক্লাস হতো শুধুমাত্র
কলেজগুলোতে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিতো আর ডিগ্রি দিতো। কিন্তু এখন কলেজগুলোর
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদান শুরু হলো। ফলে দেখা গেলো নতুন সমস্যা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অটো-প্রমোশন চালু হয়ে গেলো। অর্থাৎ কোন গবেষণা না করলেও
যে কোন লেকচারার একটা নির্দিষ্ট সময় পরে প্রফেসর হয়ে যাবেন। এতে সত্যিকারের
পরিশ্রমী ও মেধাবী গবেষকরা নিজেদের অনেকটাই বঞ্চিত মনে করলেন। গবেষণার ব্যাপারটা
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে শুরু করলো।
এই অবস্থায় এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে
যোগ দেবার কয়েক দিনের মধ্যেই সাহা বুঝতে পারলেন এখানের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির পার্থক্য অনেক। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার যে একটা গভীর শান্ত পরিবেশ ছিল এখানে সেরকম কিছুই নেই।
এখানে বড় গলায় অনেকে গবেষণার কথা প্রচার করে, কিন্তু আসলেই কোন গবেষণা হয় না।
গবেষণার পরিবেশই এখানে গড়ে ওঠেনি এখনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একটা কলেজ চলছে
এখানে। কলকাতায় প্রফেসররা শুধুমাত্র মাস্টার্স পর্যায়ের ক্লাস নেন। এলাহাবাদে
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ১২০ জন বিএসসি স্টুডেন্ট এবং ২০ জন মাস্টার্স স্টুডেন্ট।
এতগুলো স্টুডেন্টের জন্য মেঘনাদ একাই
অধ্যাপক। সাথে আছেন মাত্র একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন প্রভাষক ও দু’জন প্রদর্শক। শুধুমাত্র
একটা ব্যাপারেই অখন্ড স্বাধীনতা মেঘনাদের। তা হলো ডিপার্টমেন্টে অন্য কোন প্রফেসর
না থাকাতে তিনি যা খুশি তা করতে পারেন অন্য কারো মতামতের তোয়াক্কা না করেই।
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ও ছাত্রদের সাথে প্রফেসর মেঘনাদ সাহা।
সবকিছুই
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হলো। কিন্তু তা করতে গিয়ে কারো সহযোগিতা পাওয়া তো
দূরের কথা, বরং পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বিএসসি ক্লাসের উপযুক্ত ল্যাব ছিল।
কিন্তু এমএসসি ক্লাসের উপযোগী কোন যন্ত্রপাতিই ছিল না সেখানে। বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকা
সত্ত্বেও হাতে টানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো।
লাইব্রেরিতে সামান্য কিছু পুরনো বই
আছে আর আছে কিছু প্রচলিত ব্রিটিশ জার্নাল। লাইব্রেরিকে আধুনিক করার লক্ষ্যে নতুন
বই ও জার্নাল কেনার জন্য টাকা চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।
তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের
ট্রেজারার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক পন্ডিত কানহাইয়ালাল ডেইভ। তিনি একদিন দেখতে
এলেন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরি। দেখলেন লাইব্রেরির তাকে অনেক বই আছে।
সেগুলোর দিকে আঙুল তুলে তিনি প্রফেসর সাহাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই সবগুলো বই কি
আপনি পড়ে ফেলেছেন?"
"না। এসব পুরনো দিনের বই তো কেউ
পড়বে না।"
"তাহলে আবার নতুন বই কেনার জন্য
টাকা চাচ্ছেন কেন? আগে এগুলো সব পড়ে শেষ করুন। তারপর দেখা যাবে।"
প্রফেসর সাহা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন
এরকম বুদ্ধি ও মানসিকতার মানুষেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে বসে আছেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবোরেটরির
তুলনায় একেবারে হতদরিদ্র মানের হলেও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফুলানো-ফাঁপানো
ইমেজ ছিল ইউনাইটেড প্রভিন্সগুলোর মধ্যে। প্রচার করা হতো যে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি
হলো ইন্ডিয়ার সবচেয়ে ভালো ইউনিভার্সিটি। এই অন্তসারশূন্য ইমেজের ফলে সবাই মনে করতো
যে এই ইউনিভার্সিটির আর কোন উন্নয়নের দরকার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের
বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে গেলে যে গবেষণার দরকার হয় এবং গবেষণা করতে হলে যে
গবেষণাগারের আধুনিকায়ন দরকার তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বোঝানোও যে বড় কঠিন কাজ
তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে শুরু করলেন প্রফেসর সাহা। তিনি তাঁর গবেষণাগারের ভিন্ন ভিন্ন
ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি আলাদা করে রাখার জন্য চারটি বাক্সের অর্ডার দেন। এগুলোকে
পোস্ট-বক্স বলা হয় বলে তিনি তাঁর অর্ডারে 'ইলেকট্রিক ইক্যুইপমেন্ট পোস্ট বক্স'
লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বিজ্ঞ' ফাইন্যান্স অফিসার অধ্যাপক সাহাকে জিজ্ঞেস
করলেন, "আপনি চারটি পোস্ট-বক্স দিয়ে কী করবেন? একটা বাক্সে বুঝি চিঠি পোস্ট
করা যায় না?"
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক
সিনিয়র প্রফেসরও মেঘনাদ সাহার অ্যাস্ট্রোনমিকে মনে করেন অ্যাস্ট্রোলজি - যেখানে
গ্রহ-নক্ষত্র ও হাতের রেখা দেখে ভাগ্য গণনা করা হয়!
মেঘনাদ সাহা যেভাবে পারেন সরকারি ও
বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণায় অনুদানের জন্য হাত পাতেন। মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষকদের
রিসার্চ গ্রান্ট পাওয়ার জন্য যে কত প্রতিষ্ঠানের কাছে আক্ষরিক অর্থেই ভিক্ষা চাইতে
হয় - তা অনেকেই জানেন না।
সাহা তাঁর তত্ত্বীয় গবেষণার ফলাফল
উন্নতমানের যন্ত্রপাতির অভাবে পরীক্ষা করে দেখতে পারছিলেন না। যন্ত্রপাতি কেনার
টাকার জন্য তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও হাত পেতেছেন অনেকের কাছে। প্রিন্সটন
ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হেনরি নরিস রাসেলের সাথে গবেষণা সংক্রান্ত অনেক আলোচনা
হয়েছে সাহার। প্রফেসর সাহার পেপার পড়ে প্রফেসর রাসেল মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে
পর্যবেক্ষণ করে সানস্পটে রুবিডিয়ামের রেজোন্যান্স লাইন পেয়েছিলেন।
১৯২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রফেসর
সাহা প্রফেসর রাসেলের কাছে লেখা এক চিঠিতে একটা ভালো কোয়ার্টজ স্পেক্ট্রোমিটার
কেনার জন্য দুই হাজার পাউন্ড কোন ভাবে জোগাড় করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।[1] কিন্তু কোন
সাহায্য পাওয়া যায়নি।
অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় ১৯২৭ সালে
প্রফেসর সাহা রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়ার পর। কয়েক বছর আগেই এই ফেলোশিপ পাওয়ার
কথা ছিল তাঁর। লন্ডনে প্রফেসর ফাউলার রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য প্রফেসর
মেঘনাদ সাহার নাম প্রস্তাব করেন কয়েক বছর আগে। সাহার বৈজ্ঞানিক অর্জন যেটুকু হয়েছে
তা রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ
গোয়েন্দারা সাহার নামে রিপোর্ট পাঠালো যে সাহা স্বদেশী আন্দোলনসহ সব ধরনের ব্রিটিশবিরোধী
রাজনৈতিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। ফেলোশিপ কমিটির মেম্বাররা বিভক্ত হয়ে গেলেন।
সিদ্ধান্ত ঝুলে রইলো পরবর্তী দু’বছর। ১৯২৭ সালে
রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পেলেন মেঘনাদ সাহা।
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সাথে অধ্যাপক সাহা |
তখন ইউনাইটেড প্রভিন্সের গভর্নর ছিলেন স্যার উইলিয়াম ম্যারিস। ম্যারিস ছিলেন বিদ্যানুরাগী এবং লর্ড রাদারফোর্ডের ক্লাসমেট। প্রফেসর সাহাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি তাঁর গবেষণার জন্য বছরে পাঁচ হাজার রুপি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলেন গভর্নর ম্যারিস। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহার সম্মান অনেক বেড়ে গেলো।
আস্তে আস্তে অবস্থার কিছুটা উন্নতি
হতে শুরু করলো। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে সহকর্মীদের সাথে সাহার ব্যক্তিগত সম্পর্ক
শুরুতে খুব একটা ভালো ছিল না। প্রথম কয়েক বছর সাহার সাথে সহযোগিতা করেননি কেউ।
কিন্তু আস্তে আস্তে সেই অবস্থা কেটে যায়। সহযোগী অধ্যাপক শালিগ্রাম ভার্গব বিএসসি
পর্যায়ের সব ক্লাস ও ল্যাবের দায়িত্ব নেন। মেঘনাদ শুধু মাস্টার্স পর্যায়ের ক্লাস
নেয়া ও সাথে গবেষণার দিকে মনযোগ দেয়ার সুযোগ পেলেন।
কিন্তু গবেষণার জন্য অর্থের অভাব রয়েই
গেলো। কত সরকারি বেসরকারি দফতরে যে অনুদানের জন্য চিঠি লিখতে হয় তার কোন হিসেব
নেই। স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু ছিলেন এলাহাবাদের বিশিষ্ট নাগরিক। ব্রিটিশ সরকারের
খেতাব পাওয়া এই মানুষের সুপারিশপত্র নিয়ে মেঘনাদ দেখা করলেন একজন উচ্চ পর্যায়ের
ব্রিটিশ অফিসারের সাথে। ব্রিটিশ অফিসার খুব অমায়িক হেসে অনেক আশ্বাস দিয়ে মেঘনাদকে
বিদায় দিলেন। তারপর দুই বছর চলে গেলো, কোন অনুদান পাওয়া গেলো না। মেঘনাদ আবার তাঁর
সাথে দেখা করলেন। এবার ইংরেজ অফিসার আরো অমায়িকভাবে বললেন, "প্রফেসর সাহেব,
এলাহাবাদের মতো একটা প্রাদেশিক ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করার নামে সরকারি টাকার অপচয়
করার তো কোন মানে হয় না।"[2]
১৯৩১ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি
থেকে একটি বিশেষ অনুদান সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন প্রফেসর সাহা। বৈজ্ঞানিক
যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দেড় হাজার পাউন্ডের একটি অনুদান। সেই টাকায় কিছু যন্ত্রপাতি
কিনে থার্মাল আয়নাইজেশানের কিছু পরীক্ষা করা গেলো।
বছরের পর বছর প্রচন্ড
পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে ভারতের
নামকরা ডিপার্টমেন্টে উন্নীত করেন মেঘনাদ সাহা। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহার
সহকর্মী ও ছাত্রদের অনেকেই পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন এন কে
সুর, পি কে কিচলু, ডি এস কোঠারি, আর সি মজুমদার,
আত্মারাম, কে বি মাথুর, বি ডি নাগচৌধুরি, বি এন শ্রীবাস্তব প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment