35
“আয়েশা ৬৪ টাকা দিয়ে ৮টি পেন্সিল কিনল।
২৪টি পেন্সিল কেনার জন্য সে দোকানদারকে একটি ৫০০ টাকার নোট দিলো। দোকানদার তাকে কত
টাকা ফেরত দেবে? এটা কে কে – “
জিজ্ঞেস
করতে চাচ্ছিলাম এটা কে কে করতে পারবে না? কিন্তু আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই দেখলাম
ক্রিকেট খেলার আম্পায়ার আউট দেবার সময় যেভাবে হাত তোলেন সেভাবে হাত তুলে বসে আছে একজন।
“কী
হলো শারমিন? আমার প্রশ্ন তো এখনো শেষ হয়নি।“
“আমার
নাম শারমিন নয় স্যার, ওর নাম শারমিন। আমার নাম শারমিনা।“
শারমিনা
বেশ গম্ভীরভাবে বললো।
“ঠিক
আছে তোমার নাম শারমি না। এই তোমরা কেউ একে শারমি বলে ডাকবে না। তার নাম আর যাই হোক,
শারমি না।“
আমি
গম্ভীরভাবে কথাটা বললেও ক্লাসের সবাই হেসে উঠলো। যেকোনো ক্লাসে আনন্দময় পরিবেশের ভেতর
দিয়ে যতটুকু শেখা যায়, বা শেখানো যায় – কঠিন গাম্ভীর্যের ভেতর দিয়ে তার সিকিভাগও শেখানো
যায় না। অবশ্য এটা আমার দর্শন। আমার সিনিয়র সহকর্মীদের অনেকেই আমার এই দর্শন পছন্দ
করেন না। তাঁদের ধারণা আমি স্টুডেন্টদের সাথে হাসি-তামাশা করতে করতে ‘ডিসিপ্লিন লুজ’
করে ফেলছি।
“এবার
বলো হাত তুলেছো কেন?”
“স্যার,
আমাদের বইতে তো অংকটি অন্যভাবে আছে।“
“কীভাবে
আছে?”
“স্যার
আছে - আয়েশা ৬৪ টাকা দিয়ে ৮টি পেন্সিল কিনল। ২৪টি পেন্সিল কেনার জন্য সে কত টাকা দেবে?”
“বইতে
যেরকম আছে সেরকম না হলে তুমি অংকটি করতে পারবে না?”
“পারবো
স্যার।“
“তবে?
বইতে যে অংকগুলি আছে সেগুলি তো কিছু নিয়মের উদাহরণ। একই নিয়মের হাজার হাজার অংক হতে
পারে। তোমরা নিজেরাই অনেক অংক তৈরি করতে পারো। বইতে আছে ২৪টি পেন্সিল কেনার জন্য আয়েশা
কত টাকা দেবে? যত দিতে হবে সে হয়তো ঠিক ঠিক তত টাকা নিয়ে যায়নি। সে একটা ৫০০ টাকার
নোট নিয়ে গিয়েছিল। এখানে ব্যাপারটা আরো অনেক বাস্তব করে দিলাম। করতে পারবে না?”
“পারবো
স্যার।“ – সবাই এক সাথে বলে উঠলো।
এধরনের
অংক ইতোমধ্যে অনেক করানো হয়ে গেছে এই ক্লাসে। ক্লাস ফাইভের অংক বইটা খুব একটা স্বাস্থ্যবান
নয়। এই ক্লাসের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতোই বইটা লিকলিকে পাতলা। প্রথম মেয়াদী পরীক্ষার
আগেই বইয়ের সবগুলো অংক ক্লাসে করে ফেলা যায়। হয়তো করেই ফেলতাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা
মনে করিয়ে দিলো যে তাদের প্রথম মেয়াদী পরীক্ষার সিলেবাসে অংক বই থেকে যতটুকু করানোর
কথা – ততটুকু আমরা ইতোমধ্যেই করে ফেলেছি।
বছরে
তিনবার পরীক্ষা হয় স্কুল সেকশানে। সব সাবজেক্টের তিন বার পরীক্ষা। তার উপর আছে ক্লাস
টেস্ট। ক্লাস টেস্ট কোন্ দিন হবে আগে থেকে বলে দেয়া হয় না। শিক্ষক যেদিন খুশি হঠাৎ
ক্লাস টেস্ট নিতে পারেন। ক্লাস টেস্টের নম্বর মেয়াদী পরীক্ষার নম্বরের সাথে যোগ হয়।
“স্যার,
একটা কথা বলি?”
“বলো
সুতপা।“
“অংকটা
খুব বেশি বাস্তব হয়নি স্যার।“
“কেন?”
“আয়েশা
২৪টি পেন্সিল কেন কিনবে? আমি তো এক সাথে দুইটা পেন্সিলও পাই না।“
আমি
সুতপার কথায় হাসতে হাসতে বললাম, “হয়তো তোমাকে দেবার জন্যই কিনেছে। তুমি অংকটা করো।“
“স্যার,
হয়ে গেছে।“ – ওসমান গণি বললো।
“আমারও
হয়ে গেছে স্যার।“
“আমারও”
অনেকগুলি
হাত উপরে উঠে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কত হয়েছে?”
“স্যার
৩০৮ টাকা।“
“সবার
হয়েছে?”
“জ্বি
স্যার।“ – সবাই একসাথে বলে উঠলো।
“তাহলে
দোকানদার আয়েশাকে ৩০৮ টাকা ফেরত দেবে। তাই না?”
“জ্বি
স্যার।“
সবাই
“জ্বি স্যার” বললেও – আমার মনে হলো খুব চিকন গলায় কেউ যেন বললো “না স্যার।“
“না
কে বললে?”
“স্যার
আমি”
দেখলাম
শারমিন সরফুদ্দিন হাত তুলেছে।
“তোমার
কত হয়েছে?”
“স্যার,
আয়েশা তো আরো ৮টি পেন্সিল কিনেছে। তার টাকা দেবে না? সেই ৬৪ টাকাও দোকানদার ৫০০ টাকা
থেকে নেবে না?”
শারমিনের
স্বতন্ত্র চিন্তার ধরন দেখে ভালো লাগছে। এরা যে গৎবাঁধা নিয়ম মুখস্থ করছে না তাতেই
আমি খুশি। ঠিক করলাম পরের দিনই তাদের ক্লাসটেস্ট নিয়ে নেবো। প্রথম মেয়াদী পরীক্ষার
রেজাল্টের গুরুত্ব অনেক বেশি এদের। কারণ ক্লাস ফোরের রেজাল্ট এবং ক্লাস ফাইভের প্রথম
মেয়াদীর রেজাল্ট বিবেচনা করে এদেরকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।
যারা বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে সবাইকে একটা সেকশানে নিয়ে আসা হবে এবং সেই সেকশানকে
বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হবে। আর যারা বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে না – তারা
সবাই এক সেকশানে থাকবে। তাদের জন্য কোন এক্সট্রা ক্লাস থাকবে না। আমি এরকম শ্রেণিবৈষম্যের
ঘোর বিরোধী। যারা একটু দুর্বল তাদেরকে আলাদা করে ফেলা হবে, কিন্তু তাদের কোন আলাদা
যত্ন নেয়া হবে না। অথচ তাদেরই বেশি দরকার আলাদা যত্নের। কিন্তু নিয়ম তৈরি করার সময়
তো আমার পরামর্শ নেয়া হয়নি। আমার বিরোধিতায় কার কি এসে যায়।
>>>>>>>>>>>>>
“প্রদীপবাবু,
আপনাকে আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।“
দেখলাম
ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখ জ্বলন্ত চুল্লির মত গনগনে লাল হয়ে আছে রাগে। এখন সিক্সথ
পিরিয়ড চলছে। ফিফ্থ পিরিয়ডে আমার ক্লাস ছিল ইলেভেন এ সেকশানের সাথে। আর কিছুদিন পরেই
তাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাবে। এই সময় তাদের একটু সিরিয়াস হওয়া উচিত।
কিন্তু সেরকম কোন চিহ্ন দেখছি না। ক্লাস থেকে বের হবার আগেই পিয়ন মিজান হন্তদন্ত হয়ে
এসে বললো, “ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। ইমার্জেন্সি স্যার।“
কী
ইমার্জেন্সি হতে পারে বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাস থেকে সরাসরি চলে এসেছি ভাইস-প্রিন্সিপাল
ম্যাডামের রুমে। আমাকে দেখেই যেন তাঁর রাগ চড়ে গেল। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “প্রদীপবাবু,
আপনাকে আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।“
আমিও
ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কী করেছি – যার কারণে তিনি আমাকে কী করবেন – কিলিয়ে কাঁঠাল
পাকাবেন, নাকি বরখাস্ত করবেন – বুঝতে পারছেন না। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কী করেছি
ম্যাডাম?”
“কী
করেননি সেটা বলেন। আপনাকে বলেছিলাম ক্লাস ফাইভের ক্লাস টেস্ট না নিতে। আমি মানা করা
সত্ত্বেও আপনি টেস্ট নিয়েছেন।“
“হ্যাঁ
নিয়েছি। টেস্ট নেয়া তো দোষের কিছু নয়।“
“কিন্তু
দু’বার টেস্ট নিলেন কেন?”
“প্রথম
টেস্টে অনেকেই ভালো করতে পারেনি। আমি তাই তাদেরকে আবার টেস্ট নেবো বলেছিলাম। দুই টেস্টের
গড় হিসেব করে তাদের ক্লাস টেস্টের মার্ক দেয়া হবে।“
“কিন্তু
আমি তো আপনাকে মানা করেছিলাম আবার টেস্ট নিতে। প্রথম টেস্টে যারা ভালো করেছিল তাদের
অভিভাবকরা আপত্তি করেছে আবার টেস্ট নেবেন বলাতে।“
আমি
বুঝতে পারছি না যারা টেস্টে ভালো করেছে তাদের অভিভাবকরা আবার টেস্ট নেবার ব্যাপারে
কেন আপত্তি করবেন। যারা ভালো তারা তো সব টেস্টেই ভালো করবে। এমন তো নয় যে টেস্ট হচ্ছে
লটারি। একবার কোন কারণে ভালো নম্বর পেয়েছে – পরের বার তত ভালো নাও করতে পারে। এরকম
যদি হয় তাহলে তো আমার পরীক্ষা নেয়ার সিস্টেমে কোন সমস্যা আছে। আমাকে তো সেই সমস্যার
সমাধান করতে হবে। আমার তো আরো বেশি টেস্ট নেয়া দরকার যেন সবাই ভালো করার সুযোগ পায়।
তাছাড়া পুরো ক্লাস ফাইভকে ভালো আর মন্দ এই দুই-ভাগে ভাগ করে ফেলা হবে প্রথম মেয়াদী
পরীক্ষার পরেই। তাহলে? সিলেবাস শেষ হয়ে গেছে কত আগে। এখন ক্লাসে তাদের নতুন নতুন অংক
তৈরি করে করতে দিচ্ছি – যা হুবহু কোন বইতেই নেই। এরকম যত বেশি হবে ততই তো তারা শিখবে।
প্রথম টেস্টের রেজাল্টে দেখলাম অনেকেই খারাপ করেছে। কেন খারাপ করেছে তা আমার বোঝা দরকার।
সেকেন্ড টেস্ট না হলে তো আমি তা বুঝতে পারবো না। আমি তো চাই প্রত্যেকের ভালো হোক। বিষয়
শিক্ষক হিসেবে এটুকু অধিকার তো আমার আছে। কিন্তু ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে ডেকে
বলেছিলেন যেন আবার টেস্ট না নিই। আমি বলেছিলাম, ‘আমি স্টুডেন্টদের বলেছি আবার টেস্ট
নেবো। তাদের কাছে তো আমি গুরুত্বহীন হয়ে যাবো যদি আমার কথা আর কাজে মিল না থাকে। তবে
আপনি যদি লিখিত আদেশ দেন, তাহলে আমি তাদেরকে বলতে পারবো যে ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম
টেস্ট নিতে মানা করেছেন।‘ তখন আমাকে লিখিত আদেশ দেয়া হয়নি। আমি আজ সকালে আবার টেস্ট
নিয়েছি। এখনো ছুটি হয়নি, অথচ অভিভাবকরা নাকি এর মধ্যেই অভিযোগ করেছেন – কেন আবার টেস্ট
নিলাম।
“কতজন
অভিভাবক আপত্তি করেছেন জানতে পারি কি?”
“একজন”
“ক্লাস
ফাইভে একশ’র উপরে স্টুডেন্ট। তার মধ্যে মাত্র একজন অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, আর তা আমাদের
শুনতে হবে?”
আমার
কথা শেষ হবার আগেই রুমে ঢুকলেন নাসির স্যার। তিনি তাঁর চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে?”
“ওই
যে …… সাহেবের ওয়াইফ কমপ্লেন করেছেন।“ – ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন।
“ওহ্।
উনি খুব জটিল মানুষ। উনার কাজই হচ্ছে কমপ্লেইন করা। এখানে কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি।
উনার সাথে আরেক গার্ডিয়ানের কম্পিটিশান চলছে। উনার মেয়ে সম্ভবত প্রথম টেস্টে আরেকজনের
চেয়ে ভালো করেছে। এখন সেকেন্ড টাইম টেস্টে যদি সেরকম ভালো না করতে পারে – তাহলে কম্পিটিশানে
এগিয়ে থাকবে কীভাবে? এসব কোন ব্যাপার না। তুমি যাও।“
নাসির
স্যার আমাকে বাঁচালেন। কিন্তু মাথার ভেতর খচখচ করতে লাগলো যে অভিভাবকরা এধরনের সংকীর্ণ
প্রতিযোগিতায় কীভাবে নামতে পারেন! তবুও ভালো যে এই অভিভাবক আমার সাথে সরাসরি কথা বলতে
আসেননি। এলে কী হতো আমি জানি না।
>>>>>>>>>>
ফিজিক্স,
কেমিস্ট্রি আর বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস একই সময়ে হয়। কলেজের মেইন বিল্ডিং-এর
সাথে লাগানো বিল্ডিং-এর দোতলায় পাশাপাশি তিনটি রুমে এই ল্যাবগুলি। ফিফ্থ আর সিক্সথ
পিরিয়ডে আমার ল্যাব ক্লাস আছে সি সেকশানের সাথে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখা হলো তসলিমা
ম্যাডামের সাথে। কেমিস্ট্রির নতুন শিক্ষক তিনি। যোগ দিয়েছেন মাত্র ক’দিন হলো। এর মধ্যেই
ছেলে-মেয়েদের মন জয় করে ফেলেছেন।
সুচরিত
স্যারের কথা মনে পড়লো। আমি যোগ দেয়ার পর থেকে সুচরিত স্যারসহ আরো অনেকেই কলেজ থেকে
বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু কাইয়ুম স্যারকে যেভাবে অনুষ্ঠান করে শিক্ষার্থীরা বিদায় দিয়েছিল,
সেরকম করে আর কোন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিদায় দেয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরা
সুচরিত স্যারকে যে কী রকম ভালোবাসতো – তা আমরা সবাই জানি। অথচ সুচরিত স্যারের জন্যও
শিক্ষার্থীরা কোন বিদায় অনুষ্ঠান করতে পারেনি। শুনেছি সুচরিত স্যার বাংলাদেশ শিপিং
কর্পোরেশনে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে তাঁকে ঘরোয়াভাবে আনুষ্ঠানিক বিদায় দেয়া
হয়েছে। অফিস থেকে কয়েক ঘন্টার ছুটি নিয়ে কলেজে এসেছিলেন সুচরিত স্যার। আমরা সবাই একটি
ক্লাসরুমে বসেছিলাম। সুচরিত স্যার আমাদের সবার জন্য ‘থ্যাংক ইউ’ কার্ড নিয়ে এসেছিলেন।
সেই কার্ডে নিজের হাতে লিখেছিলেন “আমি তোমাদেরই লোক।” কী চমৎকার ঝকঝকে হাতের লেখা সুচরিত
স্যারের।
যে
কোন প্রতিষ্ঠানের নিয়মই এই। কোন পদেই মানুষ চিরদিন থাকবে না। কোন পদই খালি পড়ে থাকবে
না। নতুন মানুষ আসবে কালের নিয়মে। কিন্তু পুরনো মানুষের স্মৃতি রয়ে যাবে – বিভিন্ন
মানুষের মনে বিভিন্নভাবে।
ফিজিক্স
ল্যাবের দরজা খোলা। ভাবলাম ইদ্রিসভাই সম্ভবত খুলে রেখেছেন আমার জন্য। ভেতরে ঢুকে দেখি
আয়শা ম্যাডাম চেয়ারে বসে ল্যাবরেটরির মোটা খাতাটি দেখছেন।
“প্রদীপ
আসো। এখন প্র্যাকটিক্যাল আছে না?”
“জ্বি
ম্যাডাম।“
“আবার
ইন্সপেকশান আসছে জানো তো।“
“জুলাইতে
না ম্যাডাম?”
“এবার
আগে আসবে মনে হয়। জুলাইতে তো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। তার আগেই আসবে সম্ভবত। আমাদের
সবকিছু রেডি করে রাখতে হবে। তাই দেখছি এখানে সব ঠিক আছে কি না। তুমি প্র্যাকটিক্যাল
করাও। পরে কথা হবে।“
আয়শা
ম্যাডাম টিফিন আওয়ারে বসে বসে ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতির খাতা দেখেছেন। একটুও বিশ্রাম
করার সময় পান না টিচাররা। খাতা বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বললেন, “ইদ্রিস
কিন্তু নেই। ক্লাস শেষ হবার আগে না এলে তুমি স্টুডেন্টদের বলো দরজা জানালা বন্ধ করতে।“
আমাদের
শিক্ষার্থীদের কোন কিছু করতে বললে খুশি হয়ে করে। আজ অবশ্য তাদের কিছু করতে হলো না।
ইদ্রিস ভাই একটু পরেই ফিরে এসেছেন।
ক্লাস
শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে মূল-ভবনে ঢুকতেই দেখি চারজন ছেলে ঘাসের উপর কুস্তি লড়ছে।
কলেজ চত্বরের ঘাসের উপর কলেজ চলাকালীন কুস্তি! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এরা তো ইলেভেন
ক্লাসের ছেলে। এদের মধ্যে দু’জন আমার সেকশানের। আর কুস্তি তো নয়, এক ধরনের শারীরিক
কসরত চলছে। একজন আরেকজনকে পিঠের উপর নিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছে। সেখানে পিঠ থেকে
রাখছে। এবার অন্যজন তার পিঠে উঠছে। এভাবে দিক পরিবর্তন হচ্ছে, আর পিঠ পরিবর্তন হচ্ছে।
চারজনই প্রচন্ড ঘেমে গেছে, প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে।
“কী
রে, কী হচ্ছে এসব?”
“আমরা
কিছু করিনি স্যার। আমাদের শুধু শুধু শাস্তি দিচ্ছেন।“ – কাঁদতে কাঁদতে বললো একজন। এই
কান্না শারীরিক কষ্টের কান্না নয়, অপমানের কান্না।
এই
ছাত্ররা কী করেছে আমি জানি না। কিন্তু এভাবে শারীরিক শাস্তি দেয়া কি যায়? দেখলাম বারান্দায়
দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম। এঁদের মধ্যে কে এই শাস্তির হুকুম দিয়েছেন আমি জানি
না। কিন্তু এই শাস্তি তো বন্ধ করা দরকার। কিন্তু কীভাবে? কিছু না জেনেই যদি আমি বলি
যে তোমরা থামো, উঠে আসো – তাহলে তো আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। এমনিতেই আমি আইন-শৃঙ্খলার
ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর নই বলে রিপোর্ট আছে কর্তৃপক্ষের কাছে। বুঝতে পারছি না কী করবো।
স্যার-ম্যাডামদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কি জানেন, কী হচ্ছে এখানে?”
“বুঝতে
পারছি না, কী হচ্ছে।“
সবারই
আমার মতো অবস্থা। শাস্তির পদ্ধতি দেখে মনে হচ্ছে রেজিমেন্টাল শাস্তি। কোন ধরনের মারধর
করার দরকার নেই। কিন্তু শরীর এত কাহিল হয়ে যাবে যে একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারবে না।
তবে কি শরীরচর্চা শিক্ষকের মাথা থেকে বের হয়েছে এই শাস্তি? তাঁকে দেখা যাচ্ছে বারান্দার
এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি শাস্তি দিচ্ছেন?”
“আমাকে
অর্ডার করা হয়েছে। আমি অর্ডার পালন করছি।“
শরীরচর্চা
শিক্ষকের অবস্থা এখানে পুলিশের সিপাহীদের মতো। সিনিয়র অফিসারের হুকুমে তারা লাঠিচার্জ
করতে বাধ্য হয়, কিন্তু সব দোষ হয় তাদের। এখানে কী অপরাধে কার হুকুমে এই শাস্তি দেয়া
হচ্ছে কিছুই জানি না। কিন্তু ছেলেদের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। বললাম, “কাইন্ডলি
শাস্তি কি বন্ধ করা যাবে? অনেক হয়েছে তো।“
“এখন
করা যাবে না। আপনি চলে যান। তারপর শাস্তি বন্ধ হবে। এখন শাস্তি বন্ধ করলে ওরা ভাববে
আপনার অনেক ক্ষমতা, আপনি শাস্তি বন্ধ করতে পারেন। ওদের জানা উচিত শাস্তি বন্ধ করার
ক্ষমতা আপনার নেই।“
তাঁর
কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ছাত্রদের অপমানকে আমার নিজের অপমান মনে হচ্ছে। কলেজ চত্বরের
সবগুলো ক্লাসরুম থেকে শিক্ষার্থীরা দেখছে কী হচ্ছে। প্রিন্সিপাল স্যার নিশ্চয় জানেন
এখানে কী হচ্ছে। ছুটে গেলাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের দিকে।
স্যারের
রুমের দরজায় লাল বাতি জ্বলছে। থমকে দাঁড়ালাম। দরজা জানালার ভারী পর্দা সরানো থাকলে
প্রিন্সিপাল স্যার নিজের চেয়ারে বসেই দেখতে পেতেন বাইরে কী হচ্ছে। লাল বাতি অতিক্রম
করা উচিত হবে কি হবে না বুঝতে পারছি না। কিন্তু ভেতর থেকে পর্দা ভেদ করে ভেসে আসছে
পরিচিত গানের শব্দ “ এ তিথি শুধু গো যেন দখিন হাওয়ার। এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান
শুনাবার।“
সাহস
করে পর্দার ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার আসবো?”
“আরে,
মিস্টার প্রদীপ, প্লিজ কাম ইন।“ – প্রিন্সিপাল স্যার হঠাৎ উচ্চস্বরে আহ্বান করলেন আমাকে।
রুমের
ভেতর অন্ধকার। টিভি চলছে। আসলে টিভি নয়, ভিসিআর চলছে। এওসি নিজে এসে টেলিভিশন উদ্বোধন
করে গিয়েছেন। তারপর সেই টিভিটা প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে বসানো হয়েছে একটা উঁচু স্ট্যান্ডের
উপর। এখন সেখানে সিনেমা চলছে।
“আসেন
মিস্টার প্রদীপ। পথে হলো দেরী – হ্যাভ ইউ সিন ইট? ফ্যান্টাস্টিক মুভি। ওয়ান অব দি মোস্ট
রোম্যান্টিক মুভি আই হ্যাভ এভার সিন।“
পথে
হলো দেরী – আমি দেখেছিলাম হালিশহরের বিডিআর অডিটরিয়ামে – প্রায় দশ বছর আগে। এখন আবার
দেখার মতো মুড নেই। গানে যতই বলা হোক ‘এ লগন গান শোনাবার’ – আমার তা মনে হচ্ছে না।
রুমে মনে হচ্ছে আরো কেউ আছেন। কিন্তু টিভির সাদা-কালো আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিছুই।
মনে হচ্ছে এখন প্রিন্সিপাল স্যারকে বাইরে চলমান শাস্তির কথা বললে বিব্রত করা হবে।
“হোয়াট
ক্যান আই ডু ফর ইউ জেন্টলম্যান?” – প্রিন্সিপাল স্যারের মুড মনে হচ্ছে খুবই ভালো। মনে
হচ্ছে “পথে হলো দেরী” মানুষের মুড ভালো করে দেয়।
বললাম,
“কিছু না স্যার। নাসির স্যারকে খুঁজছিলাম।“
“আই
থিংক হি হ্যাজ গন টু দি বেজ। হি হ্যাজ এ মিটিং উইথ ও-সি-এডমিন।“ – প্রিন্সিপাল স্যারের
ইংরেজিতে আজ বুলেটের তীব্রতার বদলে বিটল্স এর সুর।
“থ্যাংক
ইউ স্যার।“
রুম
থেকে বের হয়ে এলাম। মাঠে এখন কেউ নেই। যাক্ শাস্তি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু শাস্তি দেবার
অর্ডারটা কে দিয়েছিলেন জানা গেল না।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>
আজ
আমার অনেকগুলি ক্লাস। থার্ড পিরিয়ড অফ ছিলো। ক্লাস এইট এ সেকশানে এডজাস্টমেন্ট দেয়া
হয়েছে সেই পিরিয়ডে। ১৯৯৫ সালের পাঁচ মাস চলে গেছে। এর মধ্যে ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে
টুয়েল্ভ ক্লাস পর্যন্ত প্রায় সব ক্লাসেই কোন না কোন এডজাস্টমেন্ট ক্লাস নিতে হয়েছে।
কিন্তু ক্লাস এইটের কোন সেকশানেই আমাকে এডজাস্টমেন্ট ক্লাস দেয়া হয়নি। আজ হয়তো আর কাউকে
না পেয়ে আমাকে দেয়া হয়েছে। এই ক্লাসের প্রতি আমার একটা অদ্ভুত টান আছে। আর তাদের টানটা
যে কী তা বুঝতে পারলাম তাদের ক্লাসে পা দেয়ার সাথে সাথে।
পুরা
ক্লাস হঠাৎ খুশিতে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো – আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ছুটতে ছুটতে
ক্লাসে চলে এলেন সাঈদ স্যার, নাসির স্যার, আর ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। সাঈদ স্যার
অগ্নিশর্মা হয়ে ক্লাসে ঢুকে আমার সামনেই ছেলে-মেয়েদের এমন বকাবকি শুরু করলেন যে আমার
খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ক্লাসটা তো আমার। আমি আছি তো ক্লাসে। ক্লাস ম্যানেজ করার দায়িত্ব
যে আমার সেটা তো আমি জানি।
ভাইস-প্রিন্সিপাল
ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “বেস থেকে সিনিয়র অফিসাররা
এসেছেন। সবাই প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে আছেন। আর তোমরা সবাই এত জোরে চিৎকার করছো!”
নাসির
স্যার ঠান্ডা মাথার মানুষ। এই পরিস্থিতিতেও হাসতে হাসতে বললেন, “ওরা আসলে এতদিন পর
প্রদীপকে ক্লাসে পেয়েছে তো, তাই খুশিতে এরকম করেছে। আর করবে না। চলেন আমরা যাই।“
উনারা
চলে গেলেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যাবার আগে একবার পিছন ফিরে দেখলেন আমাকে। হয়তো
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে এই ক্লাসে তিনি আমাকে আর কখনোই পাঠাবেন না।
ভেবেছিলাম
এত জনের বকা একসাথে খেয়ে এরা সবাই চুপচাপ হয়ে যাবে। কিন্তু কিসের কী। চল্লিশ মিনিট
মনে হলো চার মিনিটেই শেষ হয়ে গেল।
ক্লাস
থেকে বের হয়ে আশংকা করেছিলাম হয়তো প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ডাক পড়বে আমার। ক্লাসের
ছেলে-মেয়েরা কেন এত জোরে চিৎকার করেছিল তার কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু আসন্ন ইন্সপেকশান
উপলক্ষে সবাই এত ব্যস্ত যে আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করার কথা ভুলে গেলেন।
>>>>>>>>>>>>>>>>
“এবার
মুনশি সাহেব এসেছেন। খবর আছে ভাইজান।“ – সকালে টিচার্স রুমে ঢুকে এটাচি-কেস টেবিলে
রাখতে রাখতে বললেন অঞ্জন স্যার।
কাশেম
স্যার তর্জনিতে লাগানো চুনসহ আঙুলটা মুখে পুরে চুষতে চুষতে বললেন, “আর কইয়েন না দাদাভাই।
ওগো জ্বালায় লেসন প্ল্যান লেখতে লেখতে জান শ্যাষ।“
লেসন
প্ল্যান লিখতে হয়েছে সবাইকে। কোন্ ক্লাসে কোন্দিন কী পড়ানো হবে তার বিস্তারিত বিবরণ
লিখতে হয়েছে। পি-টি-আই কিংবা বি-এড ট্রেনিং-এ নাকি এসব শেখানো হয়। পড়ানোর একটা পরিকল্পনা
থাকা অবশ্যই ভালো। কিন্তু পড়ানোর চেয়ে পরিকল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেই সমস্যা।
দু’দিনের
ইন্সপেকশান শুরু হয়েছে কলেজে। শাহীন কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর একটা বোর্ড
আছে। সেই বোর্ডের প্রধান কার্যালয় ঢাকা। সেখান থেকে পরিদর্শক টিম এসেছে। এই টিমের প্রধান
মুনশি সাহেব নাকি পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ। শুনে বেশ খুশি লাগলো। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের
মানুষ সাধারণত যুক্তিপূর্ণ ব্যবহার করেন। আমার পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস যদি মুনশি সাহেব
পরিদর্শন করেন, তাহলে খুব আনন্দ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ ফিজিক্সের মানুষ তাঁর
জানা বিষয় দেখলে খুশি হবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু
আমার ধারণায় কিছু ভুল ছিল তার টের পেলাম একটু পরেই। মুনশি সাহেব আমার ক্লাসে গেলেন
– তবে কলেজের ফিজিক্স ক্লাসে নয়। গেলেন হ্যাংগারে ক্লাস ফাইভের গণিত ক্লাসে। মিনিট
পনেরো ছিলেন তিনি ক্লাসে। তাঁর জন্য চেয়ার পেতে দেয়া হয়েছিল সামনের বেঞ্চের সামনে।
হ্যাংগারের ক্লাসরুমগুলিতে আলো কম। একদিকে হ্যাঙ্গারের ছাদের কারণে সূর্যের আলো সরাসরি
ঢুকতে পারে না জানালা দিয়ে। ফলে সারাক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয় ক্লাসে। মুনশি সাহেব
নিশ্চয় আলোর ব্যাপারে কথা বলবেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে।
দ্বিতীয়
দিন প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে এক এক করে সব শিক্ষকের ডাক পড়লো। মুনশি সাহেব সবাইকে
এক এক করে ডেকে ফিডব্যাক দিচ্ছেন। কার কী ভালো, কী মন্দ এসব বলছেন। এই ব্যাপারটা আমার
কাছে মনে হলো বেশ ভালো। আমি আমার কাজে কী ঠিক করছি, কী ভুল করছি তা যদি একজন এক্সপার্টের
কাছ থেকে জানতে পারি – তাহলে তো অনেক উপকার হয়। ভালো কিছু করছি জানলে উৎসাহ বাড়বে।
আর কী ভুল করছি তা জানলে ভুলটা শুধরে নেয়া যাবে।
এক
এক জন স্যার প্রিন্সিপালের রুম থেকে ফিরে এসে অন্য একজনকে যেতে বলছেন। আমরা টিচার্স
রুমে কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন ডাক পড়বে। ফারুকী স্যার এসে বললেন এবার
আমার পালা।
প্রিন্সিপাল
স্যারের রুমে ঢুকলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের পাশে দুটো চেয়ারে বসে আছেন মুনশি সাহেব এবং
তাঁর সহকারী পরিদর্শক। প্রিন্সিপাল স্যার বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার প্রশংসা করলেন। আমি
যে পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ হয়েও টেলিভিশন বিতর্কের টিমেও টুকটাক কাজ করি তাও বললেন।
কিন্তু মুনশি সাহেব সেই প্রশস্তিতে ভুললেন না। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন আমি
ক্লাসে কী কী করেছি। তিনি একে একে বলতে শুরু করলেন।
“আপনার
ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডে আপনার নাম লেখা ছিল না।“
“লেখা
ছিল তো স্যার। প্র কু দেব।“
“প্র
কু দেব দিয়ে কিছু বোঝা যায়? পুরো নাম না লিখলে কীভাবে হবে?”
“স্যার,
ক্লাসটা যাদের তারা তো জানে আমি কে।“
“তর্ক
করবেন না। এটা আপনার টেলিভিশন বিতর্ক নয়।“
বুঝতে
পারলাম এই ভদ্রলোক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হতে পারেন, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল সুর
ভুলে গেছেন অনেকদিন আগে। এখানে কথা বলার কোন মানে হয় না।
“আপনি
কথা বলার সময় হাত নাড়েন বেশি। হাসেন বেশি।“
“ক্লাসে
হাঁটাহাঁটি বেশি করেন।“
“আপনার
অনেক উচ্চারণ ভুল। ভুল উচ্চারণে কথা বলেন আপনি।“
বলতে
ইচ্ছে করছিল, “আমি তো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্লাস নিচ্ছি না যে উচ্চারণ ভুল হলে রাগ বদলে
যাবে। করাচ্ছি তো অংক।“ – কিন্তু বললাম না। যারা যুক্তি পছন্দ করে না, তাদের কখনো যুক্তি
দিতে নেই।
“আপনি
ক্লাস ফাইভ বলেন দেখি”
“ক্লাস
ফাইভ” – বললাম।
“ফাইভ
– ফ ফ” – মনে হলো মুনশি সাহেবের ঠোঁটে কিছু একটা লেগে গেছে – যা তিনি ফ ফ করে ফু দিয়ে
ছাড়াতে চাচ্ছেন।
“বলেন,
ফ ফ এফ”
“ফ-অ
ফ-অ এফ”
“হচ্ছে
না – অ্যা-ফ্”
মুনশি
সাহেবের এফ উচ্চারণ একেক বার একেক রকম হচ্ছে। আমি যাই বলি – তাই ভুল হচ্ছে।
“হ্যাফ”
“এ-এফফ্”
“হচ্ছে
না। আপনি এফ্ ওয়ার্ড প্র্যাকটিস করবেন।“
“এফ্
ওয়ার্ড?” – আমি একটু অবাক হই।
“হ্যাঁ,
যত প্র্যাকটিস করবেন, তত উচ্চারণ ঠিক হবে।“
“এফ্
ওয়ার্ড?”
“এফ্
না, এফ্ না, এয়াফ্ -“
মুনশি
সাহেবের গলায় এফ্ এর কসরত দেখে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাঁর গলায় কোন কারণে
মাছি ঢুকে গেছে, তিনি এয়াফ্ এয়াফ্ করে তা বের করার চেষ্টা করছেন। আমি ক্লাস ফাইভে
পড়াচ্ছি, অথচ ফাইভ উচ্চারণ করতে জানি না। এফ্ উচ্চারণ করতে জানি না। মুনশি সাহেবের
আগে এ-কথা আমাকে আর কেউ বলেননি। এখন আমাকে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন এফ-ওয়ার্ড প্র্যাকটিস
করতে।
“ঠিক
আছে। আপনি যান। শংকর মন্ডলকে পাঠিয়ে দেবেন।“
প্রিন্সিপাল
স্যারের রুম থেকে বের হবার সময় দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইভা। সে প্রায় ফিসফিস
করে জানতে চাইলো, “তোমাকে কী বললো?”
“এফ্
ওয়ার্ড প্র্যাকটিস করতে বললো।“
ইভা
হঠাৎ এত জোরে হেসে উঠলো কেন কে জানে।
No comments:
Post a Comment