ব্যক্তি মেঘনাদ সাহা
পৃথিবীতে কিছু
মানুষ আছেন যাঁরা কোন কিছু চাইলে তা সহজেই পেয়ে যান। আবার কিছু মানুষ আছেন যাঁদের
সবকিছুই অর্জন করতে হয় প্রচন্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মেঘনাদ সাহা ছিলেন শেষের দলের
মানুষ যাঁকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে নিজের অবস্থা বদলানোর জন্য।
সেই সংগ্রাম তাঁকে চালিয়ে যেতে হয়েছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সারাজীবন তিনি নিজের
আদর্শ মেনে চলেছেন এবং সেজন্য বেশিরভাগ সময়েই স্রোতের বিপরীতে চলতে হয়েছে তাঁকে।
ফলে তাঁর ব্যক্তিত্ব হয়ে পড়েছে অনেক বেশি গম্ভীর এবং জটিল।
হিন্দুধর্মের জাতপ্রথার কুৎসিত দিক তিনি
দেখে এসেছেন একেবারে নয়-দশ বছর বয়স থেকেই। নিচু জাতির সন্তান বলে তাকে একা আলাদা
জায়গায় বসে খাবার খেতে হয়েছে। হোস্টেলের সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে গেলে তাকে
মন্ডপ থেকে বের করে দিয়েছে উঁচুজাতির ছেলেরা। সেই থেকে জাতপ্রথার প্রতি প্রচন্ড
ঘৃণা জন্মেছে। তা থেকে জন্মেছে উঁচু জাতির মানুষের প্রতি একটা অন্ধ আক্রোশ। ধর্ম ও
সংস্কার যে মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায় তা তিনি বুঝেছিলেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা
থেকে।
তাই ছাত্রজীবনের পরে তিনি আর কোনদিন কোন
পূজার্চনা করেননি। তাঁর নিজের বাড়িতে কোন পূজার ঘর ছিল না। নিজের কাজে নিজের হাত ও
বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছেন। জীবন ধারণের জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেননি।
ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি ঘৃণা ছিল তাঁর। এলাহাবাদে থাকতে তাঁর অনেক
ব্রাহ্মণ সহকর্মী তাঁদের ছেলেদের উপনয়ন অনুষ্ঠানে তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সেই
নিমন্ত্রণ তিনি প্রকাশ্যে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
১৯১৯ সালে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি
নিয়ে ইওরোপে যাত্রা করার বিশ দিন আগে মেঘনাদ সাহার মা মারা যান। সামাজিক নিয়মে তাঁকে এক মাস অশৌচ পালন করার পর মায়ের শ্রাদ্ধ করতে হবে।
কিন্তু সেটা করতে গেলে তাঁর বিদেশ যাওয়া পিছিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
তখন তিনি চাইলেন পনের দিন অশৌচ পালন করে শ্রাদ্ধ করে ফেলতে। কিন্তু ব্রাহ্মণরা
বাধা দিলেন তাতে। বললেন শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদেরই অধিকার আছে এগার দিন অশৌচ পালন করে
শ্রাদ্ধ করার। সাহাদের সেই অধিকার নেই - কারণ তাঁরা ব্রাহ্মণের চেয়ে নীচু জাতি।
এসব অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনে রেগে গেলেন মেঘনাদ। তিনি ব্রাহ্মণদের বললেন যুক্তি
দিয়ে তাঁকে বুঝাতে। কিন্তু যুক্তিবোধ থাকলে তো আর জাতিভেদ থাকে না। মেঘনাদ পনের
দিন পর মায়ের শ্রাদ্ধ করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণদের আস্ফালনকে তিনি
পাত্তাই দেননি।
এই অসার জাতপ্রথার
বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত কড়া ভাষায় যুক্তি
দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন জাতপ্রথার সামাজিক অনিয়মের কুফল। ১৯৩৯-৪০ সালে ভারতবর্ষ
পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন - তাঁতি ও মুচি কঠোর পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
কাপড় বুনে, জুতা তৈরি করে। তাদের পরিশ্রমের ফসল ভোগ করে সমাজের মানুষ। কিন্তু
সমাজের মানুষ তাঁতি ও মুচিকে সম্মান করে না। অথচ অশিক্ষিত বামুন যে কি না কোন
ধরনের দরকারি কাজ জানে না, শুধুমাত্র অং বং করে কিছু মুখস্থ বুলি না বুঝে উচ্চারণ
করে মানুষকে ঠকায় - সমাজ তাকে উঁচু আসনে বসায়। ইওরোপে প্রতিভা থাকলে কসাইয়ের ছেলে
শেক্সপিয়ার হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় হিন্দু সমাজে প্রতিভা থাকলেও একজন নীচু জাতির
ছেলে কখনো কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথ হতে পারবে না। যদি হতে চায় - সমাজের মানুষ স্বয়ং
ভগবান রামের রূপ ধরে সেই ছেলের হাত কেটে নিয়ে জাত রক্ষা করবে।[1]
এক শ্রেণির গোঁড়া ধর্মান্ধ মানুষ মনে
করে যে বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার ধর্মগ্রন্থ থেকে নেয়া। তারা এতটাই অন্ধ যে নিউটন,
কেপলার, আইনস্টাইন সবাইকে বাতিল করে দেয় ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে। মাসিক ভারতবর্ষ
পত্রিকায় ১৩ নভেম্বর ১৯৩৮ সংখ্যায় 'একটি নতুন জীবন দর্শন' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন
অধ্যাপক সাহা। সেখানে "সবই ব্যাদে আছে" - এরকম একটা কটাক্ষমূলক মন্তব্য
তিনি করেছিলেন। এর জবাবে অনিল বরণ রায় নামে এক হিন্দুত্ববাদী মেঘনাদ সাহাকে অপদস্থ
করার চেষ্টা করেন। তার জবাবে "আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম" প্রবন্ধে
মেঘনাদ সাহা যা বলেছিলেন তা নিচে উদ্ধৃত হলো:
প্রায় ১৮ বছর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হতে ফিরেছি। বৈজ্ঞানিক
জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হয়েছে। ঢাকা শহর নিবাসী (অর্থাৎ আমার
স্বদেশবাসী) কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করেছি জানবার ইচ্ছা
প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে
(অর্থাৎ সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা যা Therory of Ionisation of Elements দিয়ে সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়)
সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলে উঠতে লাগলেন, "এ আর নূতন কী
হলো, এ সমস্তই 'বেদে' আছে। আমি দুই একবার মৃদু আপত্তি করবার পর বললাম,
"মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহ পূর্বক দেখিয়ে দিবেন
কি?" তিনি বললেন, "আমি কখনও 'ব্যাদ' পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস,
তোমরা বিজ্ঞানে যা নূতন বলে দাবি কর তার সমস্তই 'ব্যাদে' আছে।" অথচ এই
ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
বলা
বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বছরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দু
শাস্ত্র-গ্রন্থ এবং হিন্দু জাতি ও অপরাপর বিজ্ঞান সমন্বয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন
তন্ন করে খুঁজে আমি কোথাও আবিষ্কার করতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন
গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্য দেশের পন্ডিত
বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, নক্ষত্রাদির গতি, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে
নানারূপ কথা বলে গেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত
তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পন্ডিতদের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায়প্রসূত।
একটি
দৃষ্টান্ত দিই, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি
অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করে গেছেন, সুতরাং, তিনি নিউটনের সমতুল্য।
অর্থাৎ নিউটন আর নূতন কী করেছেন? কিন্তু এই সমস্ত অল্প-বিদ্যা ভয়ঙ্করী শ্রেণীর
তার্কিক ভুলে যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে
উপবৃত্তাকার (eliptical) পথে ভ্রমণ করেছেন এমন কথা বলেননি। তিনি কোথাও
প্রকাশ করেননি যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করলে পৃথিবীর ও
অপরাপর গ্রহের ভ্রমণকক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু,
গ্রিক বা আরবি পন্ডিত কেপলার, গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব
আবিষ্কার করেছেন এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। দুঃখের বিষয় এইরূপ
অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাঁরা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করেছেন
মাত্র।"
শুধুমাত্র ধর্মীয়
জাত-প্রথার বিরুদ্ধেই যে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে তা নয়। তিনি দেখেছেন অর্থ-বিত্ত
আর ক্ষমতার ভিত্তিতেও একটি কঠিন শ্রেণিভেদ উপস্থিত আছে আমাদের সমাজের প্রতিটি
স্তরে। তিনি সেই আমলাতান্ত্রিক শ্রেণিভেদ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ইন্ডিয়ান সিভিল
সার্ভিস বা আই-এ-এস অফিসারদের কিছু পদ এতই ক্ষমতাশালী যে তাদেরকে ব্রাহ্মণের সাথে
তুলনা করা যায়। অন্য কেউ তাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান রাখলেও এই পদে যাঁরা থাকেন
তাঁদের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেন না। আই সি এস অফিসার - ডিস্ট্রিক্ট
ম্যাজিস্ট্রেট, বা ডিস্ট্রিক্ট জজ, বা কোন ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক - এধরনের
আমলাতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ-জাতি সমাজের সব ক্ষমতা ভোগ করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের এমন
ক্ষমতা দেয় যে তারা ভালোভাবে কোন কিছু না জেনেই সব কাজে হস্তক্ষেপ করে। দেখা যায়
একজন আজ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে তো কিছুদিন পর বস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে, কিছুদিন পর করে
শিক্ষা। এভাবে আসলে তার শুধুমাত্র ক্ষমতাভোগ করা ছাড়া কোন কিছুতেই আর তেমন কোন
আগ্রহ থাকে না। আগ্রহ না থাকার মূল কারণ হলো জ্ঞান না থাকা।[2]
মেঘনাদ সাহা শুধুমাত্র
প্রশাসনের আমলাতন্ত্র নিয়ে ক্ষুদ্ধ ছিলেন তা নয়, বৈজ্ঞানিক সংগঠন করতে গিয়ে
দেখেছেন সেখানেও ধীরে ধীরে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। একটা রিপোর্ট লিখতে
গেলেও দেখা যায় সেটা দশ জনের টেবিলে টেবিলে ঘুরছে। নেহেরু সরকার যখন ভারতে
অনেকগুলো সরকারি গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিল তখন মেঘনাদ সাহা তার
প্রতিবাদ করেছিলেন এই যুক্তিতে যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞানচর্চার চেয়েও
আমলাতন্ত্রের চর্চা হবে বেশি। সরকারি সুযোগ-সুবিধার দিকে যতটা নজর সেখানে থাকবে
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তার চেয়ে অনেক কম থাকবে বিজ্ঞান গবেষণার দিকে। তাঁর যুক্তি
অনেকাংশে সত্যি হলেও অনেকে মনে করেছেন তিনি বিরোধিতা করছেন এই সব ইন্সটিটিউট
পরিচালনার দায়িত্বে তাঁকে রাখা হয়নি বলে। কথাটা একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়ার
সুযোগ নেই। কারণ তিনি নিজে ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স গড়ে তুলেছেন।
আমলাতন্ত্রকে পছন্দ করতেন
না মেঘনাদ সাহা, অথচ শুরুতে তিনিও আমলা হতে চেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ফাইন্যান্সিয়্যাল সিভিল
সার্ভিস ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের রিপোর্টের কারণে তাকে যখন
পরীক্ষা দিতে দেয়া হলো না তখন তিনি নিজেকে বঞ্চিত মনে করেছেন। যখন সি ভি রামনকে
দেখলেন ইন্ডিয়ান ফাইন্যান্সিয়্যাল সিভিল সার্ভিসের বড় আমলা হয়েও সেই চাকরি ছেড়ে
দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে এলেন, তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন।।
কিন্তু তিনি নিজে যে ফাইন্যান্সিয়্যাল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে পারেননি সেই
ক্ষোভ তাঁর যায়নি পুরোপুরি।
স্যার রামনের সাথে তাঁর
সম্পর্কটা কখনোই মধুর ছিল না। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় - এই তিক্ততার পেছনে
রামনের চেয়ে মেঘনাদ সাহাই বেশি দায়ি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম 'পালিত অধ্যাপক' ছিলেন সি ভি রামন। তার অনেক আগে থেকেই তিনি
সরকারের অর্থ বিভাগের ডিরেক্টর। চাকরির আগে-পরে তিনি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানে
গবেষণা করছেন। গবেষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। ভারতের বিভিন্ন
জায়গা থেকে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত থেকে প্রচুর ছাত্র রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা
করার জন্য কলকাতায় এসে ভীড় করছে। রামনের পরীক্ষণের হাত খুবই ভালো। সেই তুলনায়
মেঘনাদ সাহা অনেক পিছিয়ে ছিলেন। প্রথমত তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না।
দ্বিতীয়ত তাঁর পরীক্ষণের দক্ষতা ছিল না। রামন ছিলেন ঠোঁটকাঁটা। যা সত্য তা সরাসরি
বলে দিতেন। মেঘনাদও ছিলেন ঠোঁটকাঁটা। কিন্তু সমস্যা হলো অপ্রিয় সত্য কথা বলা যত
সহজ, সহ্য করা তত সহজ নয়। রামন বা মেঘনাদ কেউই অপ্রিয় সত্য কথা সহজে সহ্য করার লোক
ছিলেন না।
প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরে
এসে মেঘনাদ দেখলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট শুধু নয় - পুরো
কলকাতার ফিজিক্স গবেষণাই রামনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে চলছে। এটা সহ্য করতে
পারেননি মেঘনাদ। তিনি এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেন। কিন্তু রিসার্চ ফান্ড
জোগাড় করার জন্য তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিতে হচ্ছে। ততদিনে রামন কিন্তু
পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন। ঝড়ের বেগে পেপার পাবলিশ করছেন। সাহা
ছিলেন মূলত ইওরোপের গবেষণা দ্বারা প্রভাবিত। তাই তাঁর সব প্রকল্পের জন্য অনেক
টাকার দরকার ছিল। টাকার জন্য তিনি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছেও হাত পাততে দ্বিধা
করতেন না। অন্যদিকে রামন ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর গবেষণা পরিচালনার জন্য তিনি
কোন ধরনের অনুদান নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। মেঘনাদ মনে করেছেন এই কারণেই বিদেশীরা
মেঘনাদের প্রজেক্টের জন্য অনুদান দেননি।
মহেন্দ্রলাল সরকার
প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স কলকাতার বউবাজারে
অনেক বছর থেকেই ছিল। মেঘনাদ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করছেন তখন থেকেই রামন
সেখানে গবেষণা করছিলেন। মেঘনাদ কিন্তু তখন কোন কৌতূহল দেখাননি। রামন যখন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তখনো তাঁর সব গবেষণা ছিল অ্যাসোসিয়েশানের ল্যাবে। তখনো
মেঘনাদ কোন কৌতূহল দেখাননি। তিনি কৌতূহলী হয়েছেন তখনই যখন তাঁর দরকার হয়েছে।
১৯৩০ সালে রামন যখন নোবেল
পুরষ্কার পান, তখন সারা ভারত উদ্বেলিত হলেও মেঘনাদ সাহা ভুগেছেন হীনমন্যতায়। কারণ
তিনি জেনেছিলেন যে ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের জন্য তাঁকে মনোনয়ন
দেয়া হয়েছে। নোবেল পুরষ্কারের মনোনয়নের ব্যাপারটা আমরা আগে একটা পরিচ্ছেদে আলোচনা
করেছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ও
শিশিরকুমার মিত্র মেঘনাদ সাহার নাম পাঠিয়েছিলেন নোবেল কমিটির কাছে। সেটা গোপন
রাখার কথা হলেও তাঁরা তা বলে দিয়েছিলেন সাহাকে। সাহা নিজেও নিলস বোরকে চিঠি
লিখেছিলেন নোবেল কমিটির কাছে তাঁর নাম সুপারিশ করার জন্য। কিন্তু রামন ছিলেন আরো
অনেক বেশি তৎপর। এবং রামনের আবিষ্কার মৌলিক আবিষ্কার। তিনি অনেক বেশি মনোনয়ন
পেয়েছিলেন এবং সর্বোচ্চ যোগ্যতার ভিত্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সাহা তা
সহজভাবে নিতে পারেননি।
তবুও কোন সমস্যা হয়নি।
কারণ মেঘনাদ তখনো এলাহাবাদে। স্যার রামন মেঘনাদের A Treatise on Heat বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন এবং সেখানে মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক দক্ষতার
ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তারপর রামন যখন ব্যাঙ্গালোরে চলে যান তখন রামনের 'পালিত
প্রফেসর' পদে যোগ দেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। সাহা তখন এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় ফিরতে
চাচ্ছেন। তখনো অ্যাসোসিয়েশান চালাচ্ছিলেন রামন। তিনি ব্যাঙ্গালোরে চলে যাওয়ার আগে
'ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রফেসর' পদ সৃষ্টি করে সেই পদে যিনি আসবেন তাঁকেই
অ্যাসোসিয়েশানের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময় মেঘনাদ সাহা আগ্রহী হয়ে
উঠলেন সেই পদ পাওয়ার জন্য। সেটাই ছিল অ্যাসোসিয়েশানের প্রতি প্রফেসর সাহার প্রথম
আগ্রহ। কিন্তু রামন সেই পদে সাহার চেয়ে তরুণ কাউকে খুঁজছিলেন এবং উপযুক্ত মনে
করলেন কৃষ্ণানকে। সাহা রামনের উপর তো রাগলেনই - কৃষ্ণানের উপরও রেগে গেলেন।
রামনের উপর প্রতিশোধ
নিয়েছেন মেঘনাদ সাহা। তিনি অ্যাসোসিয়েশান থেকে রামনকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন
কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি ভদ্রলোকদের সাথে হাত মিলিয়ে।[3] বাঙালি-অবাঙালি বিভাজন সাহার মতো মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না। কিন্তু
হয়েছিল বিভাজন। এই বিভাজনের দোহাই দিয়েই তিনি তৎপর হয়েছিলেন রামনকে অ্যাসোসিয়েশান
থেকে একেবারে বের করে দিতে। তাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্গালোরে
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এর ডিরেক্টর পদ থেকেও রামনকে পদত্যাগে বাধ্য
করেছিলেন মেঘনাদ সাহা রামনের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে।
শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের
সাথে মেঘনাদ সাহার বন্ধুত্ব হয়েছিল লন্ডনে। সেখানে বসে তাঁরা ভারতের বৈজ্ঞানিক
উন্নয়নের অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন। দেশে ফিরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুজনই
আলাদা আলাদাভাবে কাজ করেছেন যার যার ক্ষেত্রে। কিন্তু যেই ভাটনগর নেহেরুর কাছে
মেঘনাদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে - মেঘনাদ ভাটনগরকে আর বন্ধু ভাবতে
পারলেন না। তিনি বলতে শুরু করলেন ভাটনগর কোন উঁচু মাপের বিজ্ঞানীই নন। অথচ তিনিই
এস এস ভাটনগরের কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন 'স্টিমশিপ ভাটনগর'।
বিজ্ঞানী হোমি ভাবার সঙ্গে
ব্যক্তিগতভাবে কোন যোগাযোগ ছিল না বা তেমন বন্ধুত্বও গড়ে ওঠেনি। হোমি ভাবা ছিলেন
ভারতের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভদ্রলোক। প্রচন্ড মেধাবী, পৈত্রিক সূত্রে প্রচন্ড ধনী এবং
প্রচন্ড অভিজাত। ধীরস্থির এই বিজ্ঞানী ভারতে গড়ে তুলেছেন টাটা ইন্সটিটিউট অব
ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে ভারতের
অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং কমিশনের অধীনে গবেষণাগারগুলো। রামনের ছাত্র ছিলেন হোমি
ভাবা। বিদেশী সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে তিনিও ছিলেন রামনের নীতিতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ
বিদেশ থেকে কোন সাহায্য না নেয়ার পক্ষে। সেই সময় মেঘনাদ সাহা তাঁর জার্নাল
'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার'-এর জন্য অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন ইউনেস্কোর কাছে। কিন্তু
ইউনেস্কোর সেই মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন হোমি ভাবা। তিনি বললেন বিদেশী সাহায্যের
দরকার নেই। নিজস্ব অর্থায়নেই এটা চালানো যাবে। এটাকেও ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে
দেখেছেন মেঘনাদ সাহা। তাঁর চেয়ে আঠারো বছরের ছোট হোমি ভাবাকেও মেনে নিতে পারেননি তিনি
- কারণ ভাবার কাছ থেকে তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। এখানে যুক্তির
চেয়েও মেঘনাদের ব্যক্তিগত অহংবোধ কাজ করেছে বেশি।
১৯৫৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী
নেহেরুকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিতে প্রফেসর সাহা লিখেছেন, “রামন, ভাটনগর,
ভাবা, কৃষ্ণান এরা সবাই কোন না কোন অজুহাতে আপনাকে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু যেই আপনি
ক্ষমতায় এলেন সাথে সাথে তারা সবাই মধুর চাঁকে মৌমাছির মত আপনার চারপাশে ঘুরঘুর
করতে শুরু করেছে”।[4]
একই চিঠির আরেক জায়গায় লিখলেন, “আমাকে একের পর
এক অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলা হচ্ছে। আমাকে ভাটনগরের আদেশ মেনে চলতে হচ্ছে - যে
ভাটনগরকে আমি বিজ্ঞানী হিসেবে খুব একটা ভালো বলে মনে করি না। ভাবার আদেশ আমাকে
মানতে হচ্ছে - ভাবা যদিও একজন ভাল বিজ্ঞানী - কিন্তু সে আমার চেয়ে আঠারো বছরের ছোট।”
এই চিঠিতে রামনের নাম নেয়াটা নেহায়েৎ
ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে। কারণ সাহা ভালো করেই জানতেন যে স্যার রামন কোনদিন কারো
কাছে যাননি। ব্যাঙ্গালোরে নিজের গবেষণা নিয়ে থেকেছেন। নেহেরু নিজের থেকে রিসার্চ
ফান্ড দিতে চাইলে রামন তাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
প্রফেসর সাহা বিজ্ঞানকে প্রচন্ড
ভালোবাসতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি চাইতেন বিজ্ঞান ব্যবহার করে রাতারাতি
সবকিছু ঠিক করে ফেলতে। কিন্তু সেটা যে বাস্তবে সম্ভব নয় তা যখন মেনে নিতে হতো তখন
ভীষণ রেগে যেতেন তিনি। নিজের ভেতর তৈরি হতে থাকতো নানারকম জটিলতা। তাঁকে যাঁরা খুব
কাছ থেকে দেখেছেন - বিশেষ করে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা - তাঁরা দেখেছেন যে প্রফেসর সাহা
ছিলেন খুবই শক্ত একটি আবরণের ভিতর খুবই সংবেদনশীল একজন মানুষ।
নিজের গ্রাম সেওড়াতলীতে একটি পাঠশালা
ছাড়া আর কিছু ছিল না। কাছে হাইস্কুল ছিল না বলে গ্রামের মেয়েরা কেউই পড়ালেখা শিখতে
পারেনি। মেঘনাদের মা-ও ছিলেন নিরক্ষর। মেঘনাদের যখন সামর্থ্য হয়েছে সেই গ্রামে
মায়ের নামে স্থাপন করেছেন 'ভুবনেশ্বরী গার্লস হাইস্কুল'।
এলাহাবাদের বেলি রোডে নিজের বাড়ি তৈরি
করিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। সেই বাড়ির নাম দিয়েছিলেন 'সায়েন্স ভিলা'। তিন তলা সেই
বাড়িতে নিজের পরিবারের সদস্যদের চেয়েও বেশি থাকতো বাইরের মানুষ। শিক্ষার্থী,
চাকরিপ্রার্থী যখনই যার দরকার হয়েছে মেঘনাদ সাহার বাড়ি হয়ে উঠেছে তাদের আশ্রয়স্থল।
কলকাতায় আসার পর সেখানেও একই অবস্থা। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর দলে দলে উদ্বাস্তু
মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু কখনো কাউকেই বলেননি যে তিনি নিজে কত
বড় কাজ করেছেন।
[1] Abha Sur, Dispersed Radiance,
Navayana, Delhi, 2011, page 100.
[2] G. Venkataraman, Saha and His Formula,
University Press, Delhi, 1995, page 180.
[3] এ ব্যাপারে
বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন আমার "চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন", মীরা
প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।
[4] Abha
Sur, Scientism and social justice:
Meghnad Saha's critique of the state of science in India. Historical
Studies in the Natural Sciences, 2002. 33(1): p. 87-105.
No comments:
Post a Comment