Tuesday, 16 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১২



খয়রা প্রফেসর

১৯২১ সালের নভেম্বরে কলকাতায় ফিরে এসে 'খয়রা প্রফেসর' পদে যোগ দিলেন মেঘনাদ সাহা। পদটি নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে খয়রা রাজ্যের নামে।

            স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দিয়েছেন আবার ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে। ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রথমবার ভিসি থাকাকালীন তিনি সায়েন্স কলেজ স্থাপন করেছিলেন। মেঘনাদ সাহা এবং আরো অনেক তরুণ প্রতিভাকে খুঁজে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন স্যার আশুতোষ। তারপর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি যখন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন তখন খয়রার রাজা কুমার গুরুপ্রসাদ সিং-এর বিরুদ্ধে তাঁর রানি বাগেশ্বরী দেবীর মামলার নিষ্পত্তি হয় ছয় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে। রানি বাগেশ্বরী টাকাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জি ওই টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা প্রফেসর পদ সৃষ্টি করেন। মেঘনাদ সাহার গবেষণায় উন্নতির সব খবর তিনি রাখেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের খয়রা প্রফেসর পদের জন্য তিনি মেঘনাদ সাহাকে মনোনীত করে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহার কাছে বার্লিনে।

            স্যার আশুতোষ মুখার্জি বিভিন্ন জনের ব্যক্তিগত অনুদান থেকে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করে বিভিন্ন বিভাগের সম্প্রসারণ করলেও সরকার থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। সরকারের সাথে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধও বাড়ছে। ব্রিটিশ সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে পড়ানোর অনুমোদন দিয়েছিল স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে। কিন্তু কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন ধরনের আর্থিক বরাদ্দের কথা বলেনি। সরকার এখন বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন স্যার আশুতোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থায় মেঘনাদ সাহা ইওরোপ থেকে ফিরে এসে যোগ দিয়েছেন ফুল প্রফেসর হিসেবে।

            মাত্র ২৮ বছর বয়সে লেকচারার থেকে সরাসরি ফুল প্রফেসর হয়ে যাওয়া খুবই আনন্দের। মেঘনাদের বন্ধু সব পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্যেন বসু তখনো মাত্র লেকচারার। সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্যেন বসু চলে গেছেন নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভাগের আরেক জন শিক্ষক শিশির মিত্র তখন প্যারিসে শিক্ষাছুটিতে। 'পালিত প্রফেসর' রামন আছেন গবেষণা ও ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর গবেষণার বেশির ভাগ চলছে সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশানের ল্যাবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ল্যাবেও সামান্য যা কিছু যন্ত্রপাতি আছে তা রামনের ছাত্ররা দখল করে আছে। 

            মেঘনাদ দেখলেন নামে প্রফেসর হলেও  গবেষণাগার তৈরি করার কোন সুযোগ-সুবিধা তিনি পাচ্ছেন না। সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেবার পরও কোন অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর নিজের একজন সহকারী পর্যন্ত নেই। স্যার আশুতোষ জানেন এসব অসুবিধার কথা। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাথে কোন ধরনের আপোষে রাজি নন।

            ১৯২২ সালে আড়াই লাখ টাকার একটা রিসার্চ গ্রান্ট মঞ্জুর হবার পরে দেখা গেলো সেই গ্রান্টের সাথে যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তা মানতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে কোন ধরনের আত্মমর্যাদা থাকে না। ফলে স্যার আশুতোষ মুখার্জি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই টাকা নেবেন না। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা পড়লেন উভয়সঙ্কটে।

            কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? এদিকে রামনের কাজের দিকে তাকালে মনেই হয় না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সমস্যা আছে। অনেক নতুন নতুন ছাত্র এসে যোগ দিচ্ছেন রামনের গ্রুপে। রামন দিন রাত গবেষণা করছেন। এসব দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে মেঘনাদের।             স্বাধীনতার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যোগ দিচ্ছে। তারা প্রায়ই ক্লাস বর্জনের ডাক দেয়। মেঘনাদ সাহার ভেতরে বিপ্লবের আগুন আছে। তাছাড়া তিনি এমনিতেই কোন ক্লাস নিচ্ছেন না। তাই ছাত্রদের ক্লাস বর্জন সমর্থন করেন। কিন্তু প্রফেসর রামন শত আন্দোলনের মধ্যেও ক্লাস বর্জন করেন না। রামনের ছাত্ররাও ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে না। মেঘনাদ ভেতরে ভেতরে রামনের উপরও রেগে যান। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন মেঘনাদ।

            মেঘনাদের বন্ধু শান্তিস্বরূপ ভাটনগর ইন্ডিয়ায় ফিরে এসে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। তিনি মেঘনাদকে আহ্বান করলেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিতে। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকেও অফার পেলেন তিনি। 

            প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদ সাহার দুবছরের সিনিয়র ছিলেন নীলরতন ধর। তিনি তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। তিনি সাহাকে উদ্বুদ্ধ করলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার জন্য।

            মেঘনাদ সাহা একটু সময় নিলেন বিবেচনা করার জন্য। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের কাছে লিখলেন, আমি এখনো কাজ করতে রাজি আছি যদি আমার বেতন ৬৫০-৫০-১০০০ টাকা স্কেলে উন্নীত করা হয় এবং আরো পনের হাজার টাকা আমাকে ব্যক্তিগত গবেষণা খাতে দেয়া হয়। সিন্ডিকেট সাহার কোন কথাতেই কান দেয়নি।

            তামিলনাড়ুর কোদাইকানাল সোলার অবজারভেটরির ডিরেক্টর জেনারেল স্যার গিলবার্ট ওয়াকার মেঘনাদ সাহাকে আহ্বান করেছিলেন আবজারভেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিতে। মেঘনাদ খুব একটা চিন্তা না করেই সেখানে যাবেন না বলে দিয়েছেন। এবার অনেক ভেবে ঠিক করলেন এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেবেন।

            ১৯২৩ সালে কলকাতা ছেড়ে অধ্যাপক সাহা যোগ দিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts