ভোল্টা কনফারেন্স ১৯২৭
রয়্যাল
সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার গ্রহণযোগ্যতা
অনেক বেড়ে গেলো। ১৯২৭ সালে ইতালির রয়্যাল ফিজিক্যাল সোসাইটি আলেসান্দ্রো ভোল্টার
মৃত্যুর শততম বার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম ভোল্টা কনফারেন্সের আয়োজন করে।
ইতালির গৌরব আলেসান্দ্রো ভোল্টা।
সম্মেলনের আয়োজন করা হয় মিলানের কাছে কোমো হ্রদের তীরে। ভোল্টার জন্মস্থান কোমো।
সেই সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এই
কনফারেন্সে। কনফারেন্সের মূল আয়োজক ছিলেন ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি।
হাইজেনবার্গের
আনসার্টিনিটি প্রিন্সিপ্যল (Uncertainty
Principle) সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হয় এই কনফারেন্সে। এই গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্সে
উপমহাদেশ থেকে মাত্র দু'জন বিজ্ঞানী আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তাঁদের একজন মেঘনাদ সাহা
এবং অন্যজন দেবেন্দ্রমোহন বসু[1]। অধ্যাপক সাহা
কমপ্লেক্স স্পেকট্রা এনালাইসিসের ওপর একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেই সম্মেলনে।
এই কনফারেন্সে গিয়ে ফার্মি, সামারফেল্ড,
রাদারফোর্ড, মিলিক্যান, লরেন্টজ, কম্পটন, ব্র্যাগসহ ইওরোপের অনেক বিজ্ঞানীর সাথে
সাহার আলাপ হয় এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতারও সূচনা হয়।
ভোল্টা কনফারেন্সে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের স্বাক্ষর। মেঘনাদ সাহা বাংলায় নিজের নাম লিখে দিয়েছিলেন তাঁর স্বাক্ষরের নিচে। |
বিজ্ঞানী
এনরিকো ফারমির সাথে আলোচনার পর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স সম্পর্কে আগ্রহ জন্মে মেঘনাদ
সাহার এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সূত্রপাত হয় তাঁর হাতে।
কোমো হ্রদের এক প্রান্তে কোমো শহর থেকে
অন্য প্রান্তের মেনাজো শহর পর্যন্ত স্টিমার ভ্রমণের ব্যবস্থা ছিল সম্মেলনে আগত
অতিথিদের জন্য। বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে এই ভ্রমণ খুব উপভোগ করেছিলেন মেঘনাদ সাহা। তারপর
কোমো থেকে পাভিয়া (Pavia)
ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। পাভিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণা
করেছিলেন বিজ্ঞানী ভোল্টা। পাভিয়ার লর্ড মেয়র তাঁদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন
করেছিলেন। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান সেই অনুষ্ঠানে
একটি মনোগ্রাহী বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, "বর্তমান মানুষ মন্ত্রবলে বা শাস্ত্র
ও ধর্মের নামে প্রকৃতিকে বশ করেনি। সহজ সরল উপায়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগ করে
প্রকৃতিকে আয়ত্ত্ব করেছে। এই প্রকৃতি-বিজয়ের কাজে পৃথিবীর সব জাতি ও দেশ সাহায্য
করেছে এবং এক দেশের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও জ্ঞান দ্রুত দেশান্তরে প্রচারিত
হচ্ছে।" মেঘনাদ সাহা দেখলেন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর মূলসুর সব দেশেই একরকম।
কোমো থেকে স্পেশাল ট্রেনে করে
বিজ্ঞানীদের রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি গাইডের মাধ্যমে রোমের সব বিখ্যাত স্থাপত্য
ও শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হন মেঘনাদ সাহা। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনীর সরকারি
বাসভবনে বিজ্ঞানীদের সম্মানে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়। মুসোলিনীর কাজে ও ব্যবহারে
বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন অধ্যাপক সাহা।
ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে যান প্রফেসর
সাহা। সেখান থেকে হল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্ক হয়ে নরওয়ের অসলোতে যান উত্তর
মেরুতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য। হল্যান্ডের বিখ্যাত লাইডেন (Leiden) ইউনিভার্সিটিতে
তাঁর বন্ধু প্রফেসর পল এরেনফেস্টের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন অধ্যাপক সাহা। লাইডেন
শহরটি গড়ে উঠেছে ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করে। লাইডেন ইউনিভার্সিটিতে একটি সেমিনার
লেকচার দিলেন প্রফেসর সাহা।
তারপর হল্যান্ড থেকে অসলো। পথে
জার্মানির হামবুর্গে গাড়ি বদলাতে হলো। বাল্টিক সাগর পার হওয়ার সময় পুরো ট্রেন
জাহাজে উঠে যায়। সেই জাহাজ পরের দিন সুইডেনের ট্রেলিবার্গ বন্দরে ট্রেনসহ
যাত্রীদের পৌঁছে দেয়। ট্রেলিবার্গ থেকে অসলো পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাতে হোটেলে
থেকে পরের দিন সকালে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য যাত্রা।
অসলো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ভেগার্ড এই
সূর্যগ্রহণ দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। অসলো থেকে তাঁরা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে
রিঙ্গেবু স্টেশনে গিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখেন। রিঙ্গেবুর অক্ষাংশ ৬৭ ডিগ্রি।
তাই ঐসময় সেখানকার আকাশে দিনের ২২ ঘন্টা সূর্যের আলো থাকে। প্রফেসর সাহা অন্যান্য
বিজ্ঞানীদের সাথে সূর্যগ্রহণ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে
সাহা তাঁর বিখ্যাত আয়নাইজেশান ফর্মূলা দিয়েছেন। সূর্যগ্রহণ থেকে সেই বর্ণালীর
চাক্ষুষ প্রমাণ দেখলেন।
ইওরোপ থেকে এলাহাবাদে ফিরে সাহা
স্পেকট্রোমেট্রির যন্ত্রপাতি স্থাপন করে বর্ণালী তত্ত্বের কিছু পরীক্ষা শুরু করেন।
প্রায় একই রকম কাজ সি ভি রামন করছিলেন তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯২৮ সালের শেষের দিকে এলাহাবাদে সাহার কাজকর্ম
দেখতে আসেন আর্নল্ড সামারফেল্ড। সে সময় তিনি কলকাতায় সি ভি রামনের সাথেও দেখা
করেছিলেন। অধ্যাপক সাহা সামারফেল্ডকে তাঁর ডিপার্টমেন্টে সংবর্ধনা দিলেন। সামারফেল্ড
এলাহাবাদে প্রফেসর সাহার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। ইওরোপে ফিরে গিয়ে সামারফেল্ড রামন
ও সাহার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার অতিথি হয়ে। ছবিতে প্রফেসর সাহার পাশে প্রফেসর সামারফেল্ড। |
[1] বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু সম্পর্কে বিস্তারিত জানার
জন্য পড়ুন আমার 'উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী' (২য় সংস্করণ, মীরা প্রকাশন,
ঢাকা ২০১৭)।
No comments:
Post a Comment