ইম্পেরিয়্যাল কলেজ লন্ডন
১৯১৯ সালের
শেষের দিকে লন্ডনে পৌঁছলেন মেঘনাদ সাহা। ইচ্ছে ছিল কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডে গিয়ে
কাজ করবেন। কিন্তু সেখানে খরচ এত বেশি যে দুটো বৃত্তি থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি
মেঘনাদের পক্ষে। মেঘনাদ গেলেন ইম্পেরিয়্যাল কলেজে। শুরুতে সুনির্দিষ্ট কোন
অধ্যাপকের সাথে কাজ করার পূর্ব-পরিকল্পনা সাহার ছিল না। প্রথম কয়েকদিন ঠিক বুঝতেও
পারছিলেন না কোত্থেকে শুরু করবেন।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদের
সহপাঠী স্নেহময় দত্ত তখন ইম্পেরিয়্যাল কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। তিনি
সাহাকে পরামর্শ দিলেন প্রফেসর ফাউলারের সাথে কাজ করতে। প্রফেসর ফাউলারের গবেষণার
সাথে মেঘনাদ পরিচিত। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্যার নরম্যান লক্ইয়ারের ছাত্র
ফাউলার ছিলেন নেচার সাময়িকীর প্রথম সম্পাদক। ফাউলার নক্ষত্রের বর্ণালী নিয়ে গবেষণা
করছিলেন সেসময়।
মেঘনাদ সাহাকে প্রথম দেখে প্রফেসর
ফাউলার মনে করেছিলেন যে অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রদের মত সাহাও পিএইচডি করতে এসেছেন
তাঁর কাছে। কিন্তু সাহা যখন বললেন যে তিনি এসেছেন মাত্র কয়েক মাসের জন্য - নিজের
তত্ত্ব যাচাই করে নিতে - তখন ফাউলার মোটেও পাত্তা দিলেন না তাঁকে। শুধু বললেন - “যাও, ল্যাবে
গিয়ে কাজ করো। দেখো যা যাচাই করতে এসেছো তা পাও কি না”।
কিন্তু কিছুদিন পরই ফিলসফিক্যাল
ম্যাগাজিনে সাহার “আয়নাইজেশান ইন দি সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার”[1] প্রকাশিত হলে
ফাউলারের ব্যবহার আগাগোড়া বদলে যায়। তিনি সাহাকে খুবই গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
ফাউলারের সাথে পাঁচ মাস কাজ করেছিলেন মেঘনাদ সাহা। এ সময় তিনি তাঁর On the Harvard Classification of Stars পেপারটি আবার নতুন করে লিখলেন। প্রফেসর ফাউলারের পরামর্শে নতুন শিরোনাম
দেন - On a Physical Theroy of Stellar Spectra।
লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে প্রফেসর ফাউলারের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ল্যাব (১৯২০-২১) |
ফাউলারের ল্যাবে কাজ করার সময়ে মেঘনাদ পদার্থবিজ্ঞানের নানামুখী অগ্রগতি
সম্পর্কে খবর রাখতে শুরু করেন। তিনি দেখেন বর্ণালীতত্ত্বের প্রভূত উন্নতি হচ্ছে
জার্মানি ও ইংল্যান্ডে। সাহা জানেন তত্ত্ব এবং পরীক্ষণ যদি একই ফল না দেয় তাহলে
অনেক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায় না। তাই তিনি তাঁর থার্মাল আয়নাইজেশান থিওরির
পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে
তখনো স্যার জে জে থমসন ছিলেন। সদ্য অবসর নিয়েছেন, কিন্তু ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে কাজ
চালিয়ে যাচ্ছেন। ইলেকট্রন আবিষ্কার করে তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নতুন যুগের
সূচনা করে দিয়েছেন। সাহা কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে স্যার জে জে থমসনের সাথে
দেখা করলেন। থমসন সাহাকে প্রায় এক ঘন্টা সময় দিলেন তাঁর অফিসে। সাহা ব্যাখ্যা
করলেন তাঁর থার্মাল আয়নাইজেশান থিওরি। এসময় সাহা স্যার জে জে থমসনের কাছে
অনুরোধ করেছিলেন কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে পরীক্ষা করে সাহার তত্ত্বের সত্যতা
যাচাই করে দেখার জন্য। কিন্তু স্যার থমসন জানালেন সাহার পরীক্ষণের জন্য যে
উচ্চ-তাপমাত্রার দরকার - সেরকম যন্ত্রপাতি তাঁর ল্যাবে নেই। তিনি পরামর্শ দিলেন
বার্লিনে গিয়ে প্রফেসর নার্নস্টের সাথে যোগাযোগ করতে। সাহা জার্মানি যাবার
প্রস্তুতি শুরু করলেন।
লন্ডনে ভারতীয় গবেষকদের সাথে মেঘনাদ সাহা (মাঝের সারিতে বাম থেকে তৃতীয়) |
স্যার জে জে
থমসন সাহার থার্মাল আয়নাইজেশান থিওরির প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করতে না পারলেও থমসন বিজ্ঞানী ম্যাকলিনানকে
অনুরোধ করেছিলেন সাহার তত্ত্বের ভিত্তিতে একটা পরীক্ষণ দাঁড় করাতে। ম্যাকলিনান
মার্কারির বাষ্পে তাপ প্রয়োগ করে আয়নাইজেশান ঘটিয়ে দেখলেন মেঘনাদের তত্ত্বের
সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল পাওয়া যায়। তবে কি সাহার তত্ত্ব ভুল? না, তত্ত্ব ভুল নয়।
সাহা দেখলেন মার্কারির আয়নাইজেশান পটেনশিয়েল ১০.৪৫ ভোল্ট - যা তত্ত্বের পক্ষে অনেক বেশি। পরীক্ষার জন্য দরকার কম
আয়নাইজেশান পটেনশিয়েলের অ্যালকালি
ইলেমেন্ট বা ক্ষারীয় পদার্থ।
সাহা আরেকটি পেপার
লিখলেন - On Elements in the Sun. এই পেপারের তিনি দেখালেন সূর্যের বর্ণালীতে কেন রুবিডিয়াম ও সিজিয়াম মৌলের
বর্ণালী রেখা দেখা যায় না। এই মৌলগুলোর আয়নাইজেশান পটেনশিয়েল অনেক কম। ফলে এগুলো
দ্রুত আয়নিত হয়ে যায়। সূর্যের উত্তপ্ত অংশে এদের দেখা না গেলেও অপেক্ষাকৃত কম
তাপমাত্রার সোলার স্পটে রুবিডিয়াম বা সিজিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে।
লন্ডনে পাঁচ মাস কাটিয়ে
এবার জার্মানি যাবার সময় ঘনিয়ে এলো মেঘনাদের। তাঁর কলেজ
জীবনের বন্ধু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি তখন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব
সায়েন্সে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছিলেন। তাদের সাথে প্রায়ই সময় কাটতো
মেঘনাদের। এখানেই মেঘনাদের সাথে পরিচয় হয়
শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের সাথে। ভাটনগর এসেছিলেন লাহোর থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের মধ্যে বেশ ভালো
বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সাহা ও ভাটনগর ভবিষ্যৎ ভারতের বিজ্ঞান প্রসার ও উন্নয়ন নিয়ে
ঘন্টার পর ঘন্টা পরিকল্পনা করতেন। পরবর্তীতে উপমহাদেশের বিজ্ঞান উন্নয়নে শান্তিস্বরূপ
ভাটনগর অনেক অবদান রেখেছিলেন। শান্তিস্বরূপের তীব্র কর্মদক্ষতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের
কারণে মেঘনাদ তাঁর নাম দিয়েছিলেন 'স্টিম শিপ ভাটনগর'।
No comments:
Post a Comment