প্রেসিডেন্সি কলেজ কলকাতা
১৯১১ সালে ১৮
বছর বয়সে মেঘনাদ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে বিএসসি অনার্স ক্লাসে
ভর্তি হলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন তারার মেলা। পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন স্যার
জগদীশ চন্দ্র বসু, রসায়নের অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, গণিতের অধ্যাপক
প্রফেসর ডি এন মল্লিক।
জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র
রায়ের মত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়ালেও মেঘনাদ
পরীক্ষানিরীক্ষার চেয়েও গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
পরীক্ষাগারে যন্ত্রপাতি ব্যবহারে খুব একটা দক্ষ ছিলেন না মেঘনাদ। তাই পারতপক্ষে
পরীক্ষণ-বিজ্ঞান এড়িয়ে চলতে চাইতেন।
মেঘনাদের সহপাঠীদের মধ্যে আছেন
সত্যেন্দ্রনাথ বসু - যিনি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। আছেন
জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নিখিল রঞ্জন সেন, শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ
প্রমুখ - পরবর্তীতে এঁদের সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রশান্ত
চন্দ্র মহ্লানবীশ ছিলেন মেঘনাদের এক বছর সিনিয়র, আর নীলরতন ধর ছিলেন দু'বছর
সিনিয়র।
ক্লাসের ফার্স্টবয় সত্যেন বসু অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান, কলকাতায় নিজের বাড়ি থেকেই কলেজে যাতায়াত করেন। কিন্তু মেঘনাদের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। থাকেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। সেখানে জাত-প্রথার প্রচন্ড বাড়াবাড়ি। ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা আলাদা থাকা ও খাবার ব্যবস্থা। শিক্ষিত ছেলেদের মধ্যে জাত-পাতের ক্ষুদ্রতা দেখে মন খারাপ হয়ে যায় মেঘনাদের। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না তিনি। নীচুজাতি বলে তাঁকেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়।
প্রেসিডেন্সি
কলেজের ইডেন হিন্দু হোস্টেল |
হোস্টেলের সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে
গেলে কিছু ব্রাহ্মণ সন্তান মেঘনাদকে অপমান করে মন্ডপ থেকে বের করে দেয়। যে
ধর্ম-জাতি-বর্ণ মানুষে মানুষে বিভক্তি তৈরি করে সেই ধর্মের প্রতি ক্রমশ বিশ্বাস
হারাতে থাকেন মেঘনাদ সাহা। হোস্টেলের পরিবেশ অসহ্য লাগতে শুরু করে তার। হোস্টেল
ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের একটা মেসে গিয়ে উঠলেন ১৯১৩ সালে। সে বছরই গণিতে অনার্স
সহ বিএসসি পাশ করলেন মেঘনাদ। পরীক্ষায় মেঘনাদ সাহা প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান
অধিকার করলেন, আর প্রথম হলেন সত্যেন বসু।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং সহপাঠীদের সাথে মেঘনাদ সাহা |
কলেজ স্ট্রিটের
মেসে এসেও ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ইত্যাদি শব্দাবলী ও তাদের অনুশাসন
থেকে মুক্তি পেলেন না মেঘনাদ। এখানেও ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণদের সাথে বসে খান না। আর
মেঘনাদের সাথে তো কেউই খেতে বসেন না। তবে অন্য একটা ব্যাপারে মেঘনাদের মিশ্র অনুভূতি
হলো। মেসে আসার পর অনেক তরুণ ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মীর সাথে পরিচয় হলো তাঁর।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন
মেঘনাদের তিন বছরের জুনিয়র। মেসে যাওয়া আসা ছিল তাঁর। অনুশীলন সমিতির তরুণ নেতা
পুলিন দাস, শৈলেন ঘোষ, যুগান্তরের নেতা যতীন মুখার্জি- যিনি নিজের হাতে একটা
ভোজালি দিয়ে বাঘ মেরে বাঘা যতীন নামে পরিচিত হয়েছেন - সবার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো
মেঘনাদ সাহার। বাঘা যতীন মেঘনাদকে প্রায়ই বলতেন বিপ্লবীদের সাথে একটা দূরত্ব রেখে
চলতে। কারণ দেশের কাজে শুধু বিপ্লবীদের নয় মেঘনাদের মত মেধাবী ছাত্রদেরও দরকার আছে
- যারা জাতি গঠন করবেন। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে নজর
রাখছে। মেঘনাদ নিজেও বুঝতে পারেন সেটা। সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে
রাখার চেষ্টা করেন তিনি। কারণ তিনি জানেন তাঁর ওপর সংসারের অনেক দায়িত্ব। মা-বাবা
ভাইবোনদের দেখতে হবে, ছোট ভাইকে লেখাপড়া করাতে হবে। এমএসসি পাশ করে ফাইনেন্সিয়াল
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার পরিকল্পনা করে রেখেছেন মেঘনাদ।
১৯১৫ সালে মিশ্র-গণিতে এমএসসি পাশ
করলেন মেঘনাদ সাহা। এবারেও তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হলেন আর সত্যেন বসু হলেন প্রথম।
No comments:
Post a Comment