কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম স্যেকুলার
বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পশ্চিমা ধারার মুক্তচিন্তা ও
জ্ঞানচর্চার সূচনা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেকগুলো
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজ স্থাপিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদান অর্থাৎ
ক্লাস হতো এই কলেজগুলোতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার অধীনস্থ কলেজগুলোতে যে
স্নাতকপর্যায়ে পড়াশোনা হয় তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতো। এভাবে চললো পঞ্চাশ
বছর।
১৯০৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য পদে যোগ দিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ভিসি হবার পর তিনি স্নাতকোত্তর
পর্যায়ে পড়ানোর জন্য বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার উদ্যোগ নেন। বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন
করার জন্য অনেক টাকার দরকার। উপযুক্ত অধ্যাপক নিয়োগ করতে হবে, গবেষণাগার স্থাপন
করতে হবে। বিশাল অংকের টাকা এবং বিভিন্ন কাজের জন্য উপযুক্ত মানুষ দরকার। স্যার
আশুতোষ সেই সময়কার ধনী শিক্ষানুরাগী ভারতীয়দের কাছ থেকে টাকা ও প্রতিশ্রুতি আদায়ে
সচেষ্ট হলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার
আশুতোষ। আর এই আট বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো বিভাগ খুলতে
সমর্থ হলেন তিনি।
স্যার আশুতোষ মুখার্জি |
রাসবিহারী ঘোষের টাকায় 'ঘোষ প্রফেসর'
পদ সৃষ্টি হলো, আর তারকনাথ পালিতের টাকায় 'পালিত প্রফেসর'। রসায়ন বিভাগে যোগ
দিয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ
দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। গণিত বিভাগের 'ঘোষ প্রফেসর' হিসেবে যোগ দিয়েছেন
অধ্যাপক গণেশ প্রসাদ।
বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করার কিছুদিন
পর স্যার আশুতোষ মুখার্জির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নতুন ভিসি হিসেবে যোগ দেন দেবপ্রসাদ
সর্বাধিকারী। ভিসির পদ ছেড়ে দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ
কমিটিতে ছিলেন স্যার আশুতোষ। বিজ্ঞান কলেজের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক খুঁজে বের করার
দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজ |
বিগত কয়েক বছরের এমএসসি পরীক্ষায় যারা ভালো করেছে তাদেরকে প্রভাষক হিসেবে
নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছিলেন স্যার আশুতোষ। সেই সময় তাঁর ভাবনাকে আরো উসকে দিলেন
মেঘনাদদের সাথে ফিজিক্স থেকে পাস করা শৈলেন ঘোষ।[1] প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করে অন্যান্যদের মতো তিনিও বেকার। তিনি স্যার
আশুতোষের সাথে দেখা করে অনুরোধ করলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের যে সব বিষয়
পড়ানো হয় না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সব বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা করতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
সায়েন্স কলেজ খোলার সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্সি
কলেজগুলো সরকারের অধীনে ভালোই চলছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স পড়ানো শুরু
হলে প্রেসিডেন্সি কলেজের আধিপত্য কমে যাবে, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় সরকারের আধিপত্য
খর্ব হবে। কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশিরভাগই স্বদেশী ভাবধারায়
উদ্বুদ্ধ। তাছাড়া সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা টাকা দিচ্ছেন তাঁরা শর্ত
জুড়ে দিয়েছেন যে তাঁদের টাকায় কেবল ভারতীয়দেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে।
স্যার আশুতোষের পরিকল্পনা তো ছিলই - তরুণ শৈলেন ঘোষের কথায় তাঁর পরিকল্পনায় গতি
সঞ্চারিত হলো। তিনি শৈলেন ঘোষের মাধ্যমে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুকে ডেকে পাঠালেন।
স্বয়ং আশুতোষ মুখার্জির
কাছ থেকে ডাক পেয়ে কিছুটা ভীত ও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লেন মেঘনাদ। পরের দিন বন্ধু শৈলেন
ও সত্যেনের সাথে উপস্থিত হলেন স্যার আশুতোষের খাস কামরায়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর সেই
সময় পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো নতুন শাখা বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। কোয়ান্টাম
থিওরি, নিউক্লিয়ার থিওরি, রিলেটিভিটি, রেডিওঅ্যাক্টিভিটি, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স
সবকিছুই একসাথে বিকশিত হচ্ছে ইওরোপে। কিন্তু ভারতবর্ষের কোথাও এইসব নতুন তত্ত্ব
পড়ানো শুরু হয়নি। স্যার আশুতোষ নিজে গণিতের পন্ডিত। তিনি নিজের আগ্রহেই খবর রাখেন
বিজ্ঞানের কী কী অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু তাঁর জানা দরকার এই সদ্য পাস করা তরুণরা কী
কী পড়াতে পারবে।
"তোরা কী পড়াতে
পারবি?" - স্যার আশুতোষ জিজ্ঞেস করলেন।
"আপনি যা বলবেন তাই
যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।"
মেঘনাদদের উত্তর শুনে খুশি হলেন স্যার আশুতোষ। চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেল।
১৯১৬ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন মেঘনাদ সাহা
ও সত্যেন বসু। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিলেন শৈলেন ঘোষ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তাঁদের
আগে পাস করা শিশির কুমার মিত্রও যোগ দিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
হবার কোন পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও সুযোগ পাওয়ার পর মেঘনাদ বুঝতে পারলেন অধ্যাপনা
ও গবেষণাই হবে তাঁর কাজ। তেইশ বছরের তরুণ প্রভাষক মেঘনাদ সাহা মন দিয়ে কাজ শুরু
করলেন গণিত বিভাগে।
গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গণেশ
প্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঘোষ প্রফেসর'। জার্মানির প্রফেসর ক্লাইনের তত্ত্বাবধানে
পিএইচডি করে এসেছেন। বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে
এসেছেন স্যার আশুতোষ। কিছু কিছু মানুষের প্রবণতা থাকে নিজেকে খুবই বড় মনে করা।
নিজেকে বড় ভাবার পাশাপাশি তারা অন্যকে ছোট ভাবতে এবং ছোট করতে পছন্দ করেন। অধ্যাপক
গণেশ প্রসাদ ছিলেন সেরকম একজন। তাঁর নামডাক শুনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করা
অনেক ছাত্র তাঁর কাছে এসেছিলেন উচ্চতর গবেষণা করার ইচ্ছায়। এই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া
ভালো ছাত্রদের উদ্ভট অপ্রাসঙ্গিক জটিল প্রশ্ন করে অপদস্থ করতেন গণেশ প্রসাদ আর
বলতেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকরা কিছুই জানেন না বলেই সেখান থেকে ফার্স্ট
ক্লাস পাওয়া ছেলেরাও কিছু জানে না। কোথাও চাকরি না পেয়ে সত্যেন বসুও গিয়েছিলেন
অধ্যাপক গণেশ প্রসাদের কাছে গবেষণা করার জন্য। যে সত্যেন বসু জীবনে কোন পরীক্ষাতে সেকেন্ড
হননি তাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছিলেন গণেশ প্রসাদ। সেই অপমান নিরবে সহ্য
করেছিলেন সত্যেন বসু। কিন্তু গণেশ প্রসাদ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের
সম্পর্কে বাজে কথা বলতে শুরু করলেন তখন আর সহ্য করতে পারেননি। প্রতিবাদ করে চলে
এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন সত্যেন বসু জানতেন না যে বছর খানেক পরে গণেশ প্রসাদের
ডিপার্টমেন্টেই তাকে যোগ দিতে হবে।
মেঘনাদ আগে গণেশ প্রসাদের কাছে না
গেলেও সত্যেন বসুর বন্ধু এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হওয়ার কারণে গণেশ প্রসাদের
আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হলেন। গণেশ প্রসাদের কারণে কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়লো তাঁদের।
অধ্যাপক গণেশ প্রসাদ মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুকে যখন তখন অপমান করেন। বলেন - ‘পরীক্ষায় অনেক
অনেক নম্বর পেয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর যোগ্যতা হয়ে যায় না
কারো। আশুবাবু কিছু না বুঝেই দুটো বাচ্চা ছেলে ধরে এনেছেন’।
এত অপমান সহ্য করা যায় না। মেঘনাদ ও
সত্যেন্দ্রনাথ আবার গেলেন স্যার আশুতোষের কাছে। সব শুনে তিনি বললেন পদার্থবিজ্ঞান
বিভাগে যোগ দিতে। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ যোগ দিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে
তাঁদের আগে যোগ দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র। পদার্থবিজ্ঞানের অনার্স বা মাস্টার্স
না হয়েও পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হয়ে বিরাট দায়িত্বের মুখোমুখি পড়ে গেলেন মেঘনাদ।
সত্যেন্দ্রনাথেরও একই অবস্থা। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পড়েছেন
মাত্র এক বছর - বিএসসি’র সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে। মেঘনাদের কাছে “জগদীশ বসুর
পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসের চেয়েও বেশি ভাল লাগতো প্রফেসর ডি এন মল্লিকের
গণিতের ক্লাস”।[2]
সাহা পদার্থবিজ্ঞানের উচ্চতর ক্লাসের
ছাত্রদের পড়াতে শুরু করলেন - স্পেকট্রোস্কোপি ও থার্মোডায়নামিক্স। নিজে নিজে পড়তে
পড়তে শিখতে শিখতে পড়ানো। পড়তে পড়তে পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেন
মেঘনাদ সাহা। শক্ত গাণিতিক বুনিয়াদ তো আগেই ছিল - এখন পদার্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন
তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করতে তেমন কোন অসুবিধে হলো না। অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানের
গবেষণাগার বলতে তেমন কিছুই শুরুতে ছিল না। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়
মেঘনাদের সবচেয়ে বড় গবেষণাগার হিসেবে কাজ করেছে প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরি।
পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে কাজ চলছে ইউরোপে। বিশেষ করে জার্মানিতে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি রচিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব
প্রকাশিত হয়েছে ১৯১৬ সালে।[3]
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় মেঘনাদ যে
জার্মান শিখেছিলেন তা কাজে লেগে গেলো। সত্যেন্দ্রনাথও জার্মান শিখেছেন। এর মধ্যে
জার্মান প্রফেসর ব্রুলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে তাঁদের। প্রফেসর ব্রুল শিবপুরের
বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বোটানির প্রফেসর ছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে
বোটানির ফিল্ডট্রিপে যেতে পারতেন না বলে ফিজিক্স পড়ানো শুরু করলেন।[4] ব্রুল
জার্মানি থেকে নিয়ে আসা অনেকগুলো ফিজিক্সের বই দিয়ে মেঘনাদকে সাহায্য করেছেন।
জার্মানি থেকে ফেরার সময় দেবেন্দ্রমোহন বসুও কিছু বই নিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ
ও মেঘনাদের জন্য।[5] ম্যাক্স
প্লাংকের থার্মোডায়নামিক্সের বই, ব্র্যামস্টারলাং এক্স-রে সম্পর্কিত বই,
আইনস্টাইনের পেপার ইত্যাদি। ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে তরতাজা বিষয়গুলো
সম্পর্কে জানতে শুরু করলো সাহা ও বসুর কাছ থেকে।
১৯১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন
সি ভি রামন। ১৯০৭ থেকে তিনি ইন্ডিয়ান ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসে কাজ করার পাশাপাশি
ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স-এ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের এত বড় চাকরি ছেড়ে
অর্ধেকেরও কম বেতনের প্রফেসর পদে যোগ দিয়েছেন। মেঘনাদ সাহা ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের
জন্য পরীক্ষা দিতে না পেরে যে কষ্ট পেয়েছিলেন - রামনকে দেখে তা দূর হয়ে গেলো।
মেঘনাদ বুঝতে পারলেন যে তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনা ও
গবেষণায় একনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করলেন সাহা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগে থেকেই
সি ভি রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য দক্ষিণ ভারতের অনেক ছাত্র কলকাতায় চলে
আসতে শুরু করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ রামনের
কাছে গবেষণার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন। মেঘনাদ সাহাও উৎসাহিত হয়ে গেলেন রামনের
ল্যাবে। কিন্তু মেঘনাদ পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে ততটা দক্ষতা দেখাতে পারলেন না। রামন
ছিলেন ভীষণ ঠোঁটকাটা মানুষ। তিনি মেঘনাদকে সরাসরি বলে দিলেন যে পরীক্ষণ
পদার্থবিজ্ঞানে তিনি সুবিধা করতে পারবেন না। আঁতে ঘা লাগলেও মেঘনাদ বাস্তবতা মেনে নিলেন।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে রামনের প্রতি একটা ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করেছে তাঁর মধ্যে। তিনি পরীক্ষণ
পদার্থবিজ্ঞানের দিকে না গিয়ে নিজের মত করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের দিকেই
এগোলেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও
থার্মোডায়নামিক্সের তত্ত্বগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেন মেঘনাদ সাহা। আইনস্টাইনের
আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, সার্বিক তত্ত্বসহ ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত
সবগুলো গবেষণা-পত্র মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজে হাত দিলেন মেঘনাদ
ও সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রিন্সিপল্স
অব রিলেটিভিটি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয় এ অনুবাদ। বইয়ের ভূমিকা
লিখেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। এই বই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সর্বপ্রথম
ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয় যে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়াম। তিনি জানতেন সাহা ও বসুর অনুবাদের কথা। তিনি বিজ্ঞানীদের জানালেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুর অনুবাদের কথা। সুব্রাহ্মনিয়ামের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পাওয়া গেলো। সাহা ও বসুর অনুবাদ এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে রাখা আছে। এই অনুবাদের মাধ্যমেই আইনস্টাইনের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয় সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের।
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি চালনা এবং
এক্সপেরিমেন্ট করার দক্ষতা খুব একটা নেই মেঘনাদের। তাছাড়া যন্ত্রপাতিও তেমন কিছু
তখনো নেই নতুন প্রতিষ্ঠিত সায়েন্স কলেজে। তারপরও মেঘনাদ বইপত্র পড়ে - রিচার্স
জার্নাল দেখে দেখে কিছু পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করলেন।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব
সম্পর্কিত গবেষণাপত্রগুলো পড়ে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তত্ত্বের ওপর তাঁর প্রথম
গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেন মেঘনাদ সাহা। লন্ডনের
ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয় সেই গবেষণাপত্র “অন
ম্যাক্সওয়েলস স্ট্রেসেস”।[6] একই বছর
আমেরিকার ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় “অন দি লিমিট অব
ইন্টারফিয়ারেন্স ইন দি ফ্যাব্রে-পেরট ইন্টারফেরোমিটার”।[7] আপেক্ষিকতার
বিশেষ তত্ত্ব প্রয়োগ করে ইলেকট্রনের গতি সম্পর্কিত লিনার্ড-বিকার্ট (Lienard-Wiechert) পটেনশিয়ালের
গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন সাহা। ১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
হয় এ গবেষণাপত্র।[8]
১৯১৮ সালে স্থিতিস্থাপকতার নতুন
তত্ত্ব প্রকাশ করেন মেঘনাদ সাহা। ‘অন এ নিউ থিওরম
ইন ইলাস্টিসিটি’ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে।[9]
মেঘনাদ দেখলেন ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণে
লাইট প্রেসার বা আলোর চাপের যে ব্যাপারটা বলা হয়েছে সেটা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা
হয়েছিল প্রায় বিশ বছর আগে। ১৯০০ সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানী লেবেডিউ এবং ১৯০২ সালে
আমেরিকার বিজ্ঞানী নিকল্স ও হাল। কিন্তু তাঁদের কেউই সন্তোষজনক ফলাফল পাননি।
মেঘনাদ আলোর চাপ মেপে দেখার চেষ্টা করলেন। সায়েন্স কলেজের ল্যাবে বসে কিছু
যন্ত্রপাতি জোগাড় করে তিনি পরীক্ষা করলেন। প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে আলোর চাপের
ওপর তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে। সহকর্মী এস
চক্রবর্তীর সাথে যৌথভাবে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ‘অন দি প্রেসার
অব লাইট’ শিরোনামে।[10]
কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়েও কাজ শুরু
করেছেন তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। সাহা ও বসুর প্রথম যৌথ-গবেষণাপত্র ‘অন দি
ইনফ্লুয়েন্স অব দি ফাইনাইট ভলিয়্যুম অব মলিকিউল্স অন দি নিউ ইকুয়েশান অব স্টেট’[11] প্রকাশিত হয়
১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।
১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ছয়টি
গবেষণা-পত্রের ওপর ভিত্তি করে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য থিসিস জমা দেন মেঘনাদ
সাহা ১৯১৮ সালে। কোন গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের সাহায্য ছাড়াই কাজ করতে হয়েছে
মেঘনাদকে। তাঁর তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব ও বিকিরণের চাপ সংক্রান্ত থিসিসটি পাঠানো হয়
প্রফেসর রিচার্ডসন (O. W. Richardson), ক্যাম্পবেল
(N. R. Campbell) ও পোর্টারের (Porter) কাছে।
পরীক্ষকরা সবাই প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানী। (রিচার্ডসন থার্মিয়নিক এমিশান
আবিষ্কারের জন্য ১৯২৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।) তিনজন
পরীক্ষকই ভূয়সী প্রশংসা করেন মেঘনাদের গবেষণার। ১৯১৮
সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে মেঘনাদ সাহাকে। মাত্র
২৫ বছর বয়সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেন মেঘনাদ সাহা।
[1] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃ: ২৩৪-৩৫।
[2] Robert S. Anderson, Building scientific institutions in India: Saha and Bhabha. 1975, Montreal: McGill University.
[3] প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল. ২০০৬, ঢাকা: মীরা প্রকাশন.
[4] Pranab Bandyopadhyay, Great Indian Scientists. 1993, Delhi: Book Club.
[5] D. M. Bose, Meghnad
Saha Memorial Lecture, 1965.
Proceedings of the National Institute of Sciences of
India, 1967. 33A(3 & 4): p. 111-132.
[6] M. N. Saha, On
Maxwell's stresses. Philosophical Magazine, 1917. 33: p. 256.
[7] M. N. Saha, On the limit of
interference in the Fabry-Perot interferometer. Physical Review, 1917.
10: p. 782.
[8] M. N. Saha, On
the dynamics of the electron. Philosophical Magazine, 1918.
36: p. 76.
[9] M. N. Saha, On a
new theorm in elasticity. Journal of Asiatic Society Bengal, 1918.
14: p. 421.
[10] M. N. Saha and S. Chakravarti, On the pressure of light. Journal of Asiatic Society Bengal, 1918.
14: p. 425.
[11] M. N. Saha and S. N. Bose, On the
influence of the finite volume of molecules on the new equation of state. Philosophical Magazine, 1918. 36: p. 199.
No comments:
Post a Comment