ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন
জওহরলাল
নেহেরুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির কাজ শুরু হয়েছিল কিছুটা ধীরস্থিরভাবে।
ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ও দুটো সাব-কমিটির সভাপতি ছিলেন
মেঘনাদ সাহা। ‘শিক্ষা’ এবং ‘জ্বালানি ও
শক্তি’ উপকমিটির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক সাহা দেশের জন্য
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং জ্বালানি ও শক্তি সমস্যা সমাধানের
বিস্তারিত পরিকল্পনা জাতীয় কমিটিতে পেশ করেন। নৌপরিবহন ও সেচ-প্রকল্পের উপ-কমিটিরও
সদস্য ছিলেন মেঘনাদ সাহা। সেচ প্রকল্পের কমিটির সদস্য হিসেবে মেঘনাদ সাহা বন্যা
নিয়ন্ত্রণ ও নদী শাসনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দেন।
আমেরিকার টেনেসি নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মত করে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন
গঠন করার জন্য সাহার প্রস্তাব ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে গৃহীত হয়। পরিকল্পনা কমিটির
সবগুলো উপকমিটির দেয়া রিপোর্ট মোট ২৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়। কিন্তু যতটা আশা নিয়ে কাজ
শুরু করেছিলেন তার কিছুদিনের মধ্যেই বেশ হতাশ হতে হয়েছিল প্রফেসর সাহাকে।
১৯৩৭ সালে ইউনাইটেড প্রভিন্সের
নির্বাচিত কংগ্রেস সরকারের নেহেরু মন্ত্রীসভায় একজন মন্ত্রী ছিলেন ডক্টর কৈলাস নাথ
কাটজু। মন্ত্রী হবার আগে তিনি ছিলেন এলাহাবাদের নামকরা উকিল। মন্ত্রী হওয়ার পর
১৯৩৮ সালে তিনি এলাহাবাদে একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে
তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, "এই ফ্যাক্টরি হলো বৃহৎ শিল্পায়নের দিকে একটি বিরাট
পদক্ষেপ।"
প্রফেসর সাহা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তাঁর কাছে মন্ত্রী কাটজুর কথাগুলোকে বড়ই হাস্যকর এবং বিপজ্জনক বলে মনে হলো। একটি
সামান্য ম্যাচ-ফ্যাক্টরি যদি বৃহৎ শিল্প-কারখানার উদাহরণ হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে
বৃহৎ-শিল্পায়ন বলতে কী বুঝায় সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই সরকারের মন্ত্রীদের এবং
পার্টির নেতাদের। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস পার্টি দেশের হাল ধরবে। তখন কি শিল্পায়ন
বলতে ম্যাচ ফ্যাক্টরি আর গরুর গাড়ি কিংবা চরকায় সুতা-কাটাকে বুঝাবে? বৃহৎ শিল্পায়নের
ক্ষেত্রে কংগ্রেসের নীতির সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখেন মেঘনাদ সাহা তাঁর ‘সায়েন্স এন্ড
কালচার’-এ।
কংগ্রেসের সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র
বসুর প্রতি আস্থা আছে মেঘনাদ সাহার। কংগ্রেসে সুভাষ বসু ও জওহরলাল নেহেরুর মধ্যে
আদর্শগত বিরোধ না থাকলেও পদ্ধতিগত বিরোধ ছিল। সুভাষবসু ছিলেন সরাসরি এবং দ্রুত ফল
লাভের পক্ষে, আর নেহেরুর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল অনেক বেশি গান্ধী দ্বারা প্রভাবিত।
মেঘনাদ সাহা রাজনৈতিক আচার-ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তিনি রেখে ঢেকে কথা বলতে জানতেন
না। যা বলার সরাসরি মুখের উপর বলে দিতেন। গান্ধীর যে নীতি কংগ্রেস মেনে চলতো -
যেমন বিদেশী বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে দেশীয় চরকায় সুতো কেটে খদ্দর তৈরি
করা - এগুলোর প্রশংসা করা মেঘনাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। তিনি সুট-কোট পরাকে
অন্যায় মনে করেন নি কখনো। চরকায় সুতো কেটে যে ভারতের উন্নতি ঘটানো যাবে না তা তিনি
প্রকাশ্যেই বলতেন। ফলে নেহেরুসহ আরো অনেক কংগ্রেসী নেতার সাথে তাঁর মানসিক দূরত্ব
তৈরি হয়।
১৯৩৮ সালের ২১ আগস্ট ইন্ডিয়ান সায়েন্স
নিউজ অ্যাসোসিয়েশানের পক্ষ থেকে ডাকা এক সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রফেসর
সাহা সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, "স্বাধীনতার পর দেশগঠনের কাজে কংগ্রেস কি
চরকায় সুতা কাটা আর গরুর গাড়ি চড়ার নীতিতেই চলবেন? নাকি সত্যিকারের
বৃহৎ-শিল্পায়নের নীতি গ্রহণ করবেন?"
উত্তরে নেতাজী বলেছিলেন স্বাধীন
ভারতবর্ষের উন্নয়নে গ্রেট ব্রিটেন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বাধ্যতামূলক শিল্পায়নের
নীতি গৃহীত হবে। সাহা খুশি হয়ে প্ল্যানিং কমিটিতে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরের
বছর ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসে নতুন সমস্যা দেখা দিলো। মহাত্মা গান্ধী সুভাষ বসুর নীতিকে
উগ্র মনে করতেন এবং সমর্থন করতেন না। ১৯৩৯ সালে সুভাষ বসু আবার কংগ্রেসের সভাপতি
হতে চাইলে গান্ধীজী তাতে বাধা দেন। তারপরও কংগ্রেসের সদস্যদের ভোটে সভাপতি
নির্বাচিত হয়েছিলেন সুভাষ বসু। কিন্তু গান্ধীজীর সমর্থন ছাড়া পার্টি চালানো অসম্ভব
দেখে সুভাষ বসু সভাপতির পদ ত্যাগ করলেন। নেহেরু হলেন কংগ্রেসের সভাপতি।
কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে সুভাষ বসুর চলে
যাওয়ায় অস্থির হয়ে পড়লেন প্রফেসর সাহা। তিনি নেহেরুর নীতির প্রতি আস্থা রাখতে
পারছিলেন না। ন্যাশনাল প্ল্যানিং-এ গান্ধীবাদ ঢুকে গেলে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত হবে
এরকমই বিশ্বাস তাঁর। সায়েন্স অ্যান্ড কালচারে প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও কংগ্রেসের অনেক
প্রভাবশালী নেতার কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলেন তিনি। এতে সাহার উপর খুবই বিরক্ত
হলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। ভারতবর্ষে তখনো ইংরেজ রাজত্ব। যুদ্ধে জড়িয়ে গেলো তারাও।
কংগ্রেস পার্টি যুদ্ধে জড়াতে অস্বীকার করে সমস্ত প্রাদেশিক সরকার থেকে পদত্যাগ
করলো। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো' আন্দোলন শুরু করলে ইংরেজ সরকার
সব স্বদেশী নেতাকে জেলে পুরলো। নেতাজী সুভাষবসু পালিয়ে জাপান চলে গেলেন এবং তারপর
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করলেন। মেঘনাদ সাহাকেও বছরখানেক কলকাতা ছেড়ে
রাজশাহীতে কাটিয়ে আসতে হলো। প্ল্যানিং কমিটি মুলতবি হয়ে গেলো।
১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর নেহেরু
প্রধানমন্ত্রী হলেন। সাহা আশা করেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সাহার পরিকল্পনাকে
প্রাধান্য দেবেন। জেলে বসে নেহেরু তাঁর বিখ্যাত বই Discovery of India লিখেছেন। সেখানে স্বাধীন ভারতের শিল্পোন্নয়নের জন্য যে মডেলের বর্ণনা
দিয়েছেন সেই মডেলের সাথে মেঘনাদ সাহার দেয়া মডেলের মিল আছে। প্রফেসর সাহা নেহেরুর
পদক্ষেপের দিকে খেয়াল রাখছিলেন। কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন তিনি নেহেরুর আর
কাছের মানুষ নেই। পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার চেয়েও হোমি জাহাঙ্গির
ভাবার[1] উপর বেশি আস্থা রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু।
পরিকল্পনা কমিশনে প্রফেসর
সাহাকে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হলো না। তবে একেবারে বাদও দেয়া হয়নি।
ইউনিভার্সিটি এডুকেশান কমিশনের সদস্য মনোনীত করা হয়েছে তাঁকে।
ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে
আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রফেসর সাহার অনেক সুনির্দিষ্ট
পরিকল্পনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ডক্টর সর্বপল্লী
রাধাকৃষ্ণন। তিনি পরে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি এবং আরো পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ডক্টর
রাধাকৃষ্ণণ অত্যন্ত গুণী মানুষ। তাঁর সাথে কাজ করার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী হয়ে
উঠলেন প্রফেসর সাহা।
সাহা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করতেন যে, কোন দেশের শতকরা একশ ভাগ নাগরিক শিক্ষিত না হলে সেই দেশে পুরোপুরি
গণতন্ত্র প্রবর্তন করা সম্ভব নয়। সদ্য স্বাধীন দেশের শতকরা একশ ভাগ মানুষকে
শিক্ষিত করে তুলতে হলে স্কুল পর্যায়ের লেখাপড়া বাধ্যতামূলক করে আইন তৈরি করতে হবে।
সব ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হলে যে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে তাতে রাষ্ট্রের
প্রচুর খরচ হবে। রাষ্ট্রের মোট বাজেটের একটি বিরাট অংশ ব্যয় করতে হবে। প্রচুর
স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করলেন প্রফেসর সাহা এবং শিক্ষা কমিশন।
সারা দেশের ২৫টি
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোতে তাঁরা গেলেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা হয়
এমন সব কলেজও সফর করলেন। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রধান, এলাকার বিশিষ্ট মানুষের
পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মতামতও নিলেন তাঁরা। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের
কথাও শুনলেন তাঁরা।
বঙ্গবাসি কলেজে ইউনিভার্সিটি এডুকেশন কমিশনের সদস্যদের সাথে প্রফেসর সাহা |
ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের সরকারের শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথেও
মতবিনিময় করলেন। সামগ্রিক শিক্ষাচিত্র পাওয়ার পর পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক এবং
কার্যকরী করার ব্যাপারে কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশগুলোর কিছু কিছু
বাস্তবায়নের ফসল সামগ্রিক শিক্ষার উন্নয়ন।
কমিশনের ফাইনাল রিপোর্ট
লেখার জন্য কমিশনের সকল সদস্য তাঁদের পরিবারবর্গসহ ১৯৪৯ সালের মে-জুন মাস সিমলায়
চলে যান। সেখানে ঠান্ডা পরিবেশে মাস দুয়েক থেকে শিক্ষা কমিশনের ফাইনাল রিপোর্ট
লেখা হয়।
মেঘনাদ
সাহা তাঁর দ্বিতীয় কন্যা কৃষ্ণা, তৃতীয় কন্যা চিত্রা এবং কনিষ্ট পুত্র প্রসেনজিৎকে
সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন সিমলায়।
[1] হোমি ভাবা
সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন আমার "উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী",
মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।
No comments:
Post a Comment