Tuesday, 23 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১৬



নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন

 

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত ধরনের পুরষ্কার আছে, নোবেল পুরষ্কার হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার। বিজ্ঞানের যে তিনটি বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় - পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান - ধরে নেয়া হয় যে সবচেয়ে যোগ্য বিজ্ঞানীদেরই এই পুরষ্কার দেয়া হয়। পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে নোবেল কমিটি চিঠি পাঠায় উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য মনোনয়ন বা সুপারিশ পাঠানোর জন্য। কে কাকে পুরষ্কারের জন্য সুপারিশ করেছেন তা পুরষ্কার দেয়ার পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন থাকে।

          ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া শুরু হয়েছে। ১৯৫১ সালে প্রকাশ করা হয়েছে ১৯০১ সালে যাঁরা পুরষ্কার পেয়েছেন তাঁদের জন্য কে কে সুপারিশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই বছর আর কোন্‌ কোন্‌ বিজ্ঞানীকে পুরষ্কার দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল।

          ২০১৭ সালে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার ১১৭ বছর পূর্ণ হলো। এখন ১৯০১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নোবেল পুরষ্কারের জন্য যত সুপারিশ নোবেল কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছিল তার সম্পূর্ণ তালিকা নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়।

          যদিও কাউকে মনোনয়ন দিলে তা গোপন রাখতে বলা হয়, অনেকেই পরিচিত কাউকে মনোনয়ন দেয়ার পর সেটা তাদের জানিয়ে দেন। আবার অনেকেই মনোনয়ন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে দেন-দরবার শুরু করেন। কিন্তু নোবেল পুরষ্কার পাওয়াটা শুধুমাত্র মনোনয়নের উপর নির্ভর করে না। মূলত নির্ভর করে কাজের উপর। বিশেষ করে বিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের ক্ষেত্রে তা বলা চলে। সাহিত্য ও শান্তির নোবেল পুরষ্কার এখন পুরোটাই রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে।

          মেঘনাদ সাহা ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত মোট সাত বার মনোনয়ন পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার জন্য। তাঁর থার্মাল আয়নাইজেশান ফর্মূলা আবিষ্কারের জন্য তাঁকে এই মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। ১৯৩০ সালের নোবেল পুরষ্কারের জন্য অধ্যাপক মেঘনাদ সাহাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র।[1] অবশ্য একই বছর অধ্যাপক সি ভি রামনকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন ডি ব্রগলি, রাদারফোর্ড, উইলসন, বোর প্রমুখ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। রামন পেয়েছেন ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার। এরপরে ১৯৩৭ সালে আর্থার কম্পটন, ১৯৩৯ সালে শিশিরকুমার মিত্র এবং ১৯৪০ সালে আবার আর্থার কম্পটন, এবং ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে আবার অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য।[2] [3]

          ১৯১৯ থেকে ১৯২১ এই দুই বছর ইওরোপের অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসেন মেঘনাদ সাহা। তাঁদের অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল তাঁর। তারপর ১৯২৭ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়ার পর ইতালিতে ভোল্টা কনফারেন্সে গিয়ে এনরিকো ফার্মি, নিল্‌স বোরসহ আরো অনেকের সাথে কথা বলে প্রফেসর সাহা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর থার্মাল আয়োনাইজেশান সম্পর্কিত গবেষণা নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য। ১৯২৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আর্থার কম্পটন। তিনি প্রফেসর সাহাকে বলেছিলেন যে থার্মাল আয়োনাইজেশান ফর্মূলা নোবেল পাওয়ার যোগ্য।

          সেই সময় নোবেল কমিটির কাছে তাঁর নাম সুপারিশ করার ব্যাপারে প্রফেসর সাহা কয়েকজন বিজ্ঞানীকে অনুরোধ করেছিলেন। ১৯২৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞানী নিল্‌স বোরকে প্রফেসর সাহা লিখেছিলেন: "Prof. A. H. Compton has been kind enough to discuss the matter with me, and subsequently he has written to me that he is going to send up my name for the award of the Nobel prize and he has secured the assent of Dr. I. Langmuir. Probably he will also get more support from the Britishers and others. Our relations with the Brithishers are a bit delicate and I do not know whether I shall be wise in writing to them. Moreover I am sailing for India on Oct. 3, hence I shall have very little opportunity of meeting any of them and I do not wish to commit myself in writing. I shall be glad if you can see your way in supporting Prof. Compton's proposal. I shall be glad to give any further information, if you are kind enough to take up the matter."[4]

            ১৯১৭ সালে প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবার বারো বছরের মধ্যে আরো পঞ্চাশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে প্রফেসর সাহার। ১৯২০ সালে থার্মাল আয়নাইজেশান পেপার প্রকাশিত হবার এক বছরের মধ্যে ২২৫ বার উল্লেখিত (cited) হয়েছে অন্যান্য গবেষণাপত্রে।

          ইওরোপ ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রফেসর সাহাকে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার আশ্বাস দিলেও একমাত্র আর্থার কম্পটন ছাড়া আর কোন বিদেশী বিজ্ঞানী প্রফেসর সাহাকে মনোনয়ন দেননি। আর্থার কম্পটন প্রফেসর সাহাকে দু'বার মনোনয়ন দিয়েছিলেন ১৯৩৭ ও ১৯৪০ সালে। অথচ প্রফেসর সাহা আশা করেছিলেন ১৯৩০ সালের নোবেল পুরষ্কারের। নিল্‌স বোরকে চিঠি লিখলেও ১৯২৯ ও ১৯৩০ সালে নিল্‌স বোর মনোনয়ন দিয়েছিলেন সি ভি রামনকে। আবার ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র ও অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু তাঁদের সহকর্মী সি ভি রামনকে মনোনয়ন না দিয়ে মনোনয়ন দিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহাকে। ১৯৩০ সালের পর দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রফেসর সাহাকে আর মনোনয়ন দেননি। তবে প্রফেসর শিশিরকুমার মিত্র আরো তিন বার মনোনয়ন দিয়েছিলেন তাঁকে ১৯৩৯, ১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালে।

          ১৯৩০ সালে নোবেল কমিটি প্রফেসর সাহার আবিষ্কারের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেয় তা হলো: "Saha's work is proved to be very important for modern astrophysics, but this can hardly be seen as a new physical discovery, more as an application to known physical accumulated astrophysical data. With all recognition for the value of Saha's achievements, the Committee find itself not in the position, to reccommend him for the reception of the Nobel Prize for Physics."[5]

          নোবেল কমিটির মতে প্রফেসর সাহার গবেষণা ও আবিষ্কার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ক্ষেত্রে খুবই দরকারি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর ফর্মূলাকে কিছুতেই একটি মৌলিক আবিষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তাঁর ফর্মূলা মূলত অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল ডাটাগুলোর প্রায়োগিক দিক নির্দেশ করে। সাহার বৈজ্ঞানিক অর্জনের সবকিছু বিবেচনা করে নোবেল কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য সাহাকে বিবেচনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

          ১৯৩০ সালের নোবেল পুরষ্কার ঘোষিত হলে দেখা যায় যে প্রফেসর রামনকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। হতাশ হয়েছিলেন প্রফেসর সাহা। কিন্তু দমে যাননি।

          ১৯৩৬ সালে প্রফেসর সাহা যখন ইওরোপে তখন কলকাতার কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে প্রফেসর সাহা নোবেল পুরষ্কার পাচ্ছেন বলেই ইওরোপে গেছেন। সাহার স্ত্রী রাধারাণী চিঠি লিখে খবরের সত্যতা জানতে চাইলে প্রফেসর সাহা স্ত্রীকে লিখেছিলেন, "আমার Nobel prize পাওয়ার খবর সম্পূর্ণ ভুয়ো, কেহ গল্প রচনা করিয়াছে। এ'তে কোনরকম বিশ্বাস করিও না। তবে খবরের কাগজে একটু নাম হয়, তাহা মন্দ নয়।"[6]



[1] দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন আমার "উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী", মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।

[2] Rajinder Singh, India's physics and chemistry nobel prize nominators and nominees in colonial and international context. Notes and Records of the Royal Society, 2007. 61: p. 333-345.

[3] www.nobelprize.org

[4] Rajinder Singh and Falk Riess, C. V. Raman, M. N. Saha and the Nobel prize for the year 1930,  Indian Journal of History of Science, Vol. 34(1), 1999.

[5] Report of the Nobel Committee, Document No 711. Sept 30, 1930.

[6] প্রশান্ত প্রামাণিক, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী, আগরতলা, ২০০৯।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts