শিক্ষক মেঘনাদ
সাহা
শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সংগঠক, লেখক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, সাংসদ - সব
দায়িত্বেই দারুণভাবে সফল অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। শুধুমাত্র একটিমাত্র পরিচয়ে মেঘনাদ
সাহাকে সম্পূর্ণ জানা যাবে না। তবে তাঁর জীবন সংগ্রামের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে
শুরুতে শিক্ষক হবার কোন ইচ্ছে তাঁর ছিল না। একটা সরকারি চাকরি তিনি খুঁজছিলেন যা
দিয়ে ভালোভাবে চলতে পারবেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার আশুতোষ মুখার্জি মেঘনাদকে
ডেকে না নিয়ে এলে তাঁর জীবন নদীর স্রোত হয়তো অন্যদিকে ঘুরে যেতো।
শিক্ষক হয়েছিলেন বলেই বাকি
সব ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেছে। শিক্ষকতা করতে এসেই তিনি গবেষক হয়েছেন, বিজ্ঞানী
হয়েছেন, বিজ্ঞান সংগঠক হয়েছেন। ছিলেন মিশ্র গণিতের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায়
পদার্থবিজ্ঞান সেভাবে পড়েনওনি। কিন্তু ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বখ্যাত
পদার্থবিজ্ঞানী।
ভারত ও বাংলাদেশের স্নাতক
পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার A Text Book of Heat অথবা/এবং A Treatise on Heat বই দুটোর সংস্পর্শে আসে। তাপীয় পদার্থবিজ্ঞানের ক্ল্যাসিক বইয়ের মর্যাদা
অর্জন করেছেন এই বই দুটো। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে
প্রথমবারের মতো তাপ ও তার তত্ত্ব পড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। বাধ্য
হয়েছিলেন এই কারণে যে সেই সাবজেক্টটা পড়ানোর মতো আর কেউ ছিল না তখন। কিন্তু মেঘনাদ
নিজেও সেই সাবজেক্ট পড়েননি তার আগে কখনো। পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়েননি মেঘনাদ
সাহা, পড়েছেন বিষয়টাকে জানার জন্য। সে কারণে তিনি বিষয়টাকে এমন ভালোভাবে জেনেছেন
যে তাঁর পড়ানোর ক্লাসনোটগুলো পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ক্ল্যাসিক টেক্সট
বইতে।
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা (১৯২৮)
১৯৩১ সালে সাহা
তাঁর সহকর্মী শ্রীবাস্তবের সাথে যৌথভাবে প্রকাশ করলেন তাঁর বিখ্যাত বই A Text book of Heat। এই বইটি ছিল
পদার্থবিজ্ঞানের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের জন্য। ১৯৩৫ সালে এই বইয়ের সম্প্রসারিত এবং
গবেষণাসমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ বই A Treatise on
Heat প্রকাশিত হয়। এই বইতে ক্যালরিমিতি থেকে শুরু করে সেই সময়ের সাম্প্রতিক
আবিষ্কার তাপগতিবিদ্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ব্যাখ্যাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বইয়ের
ভূমিকায় স্যার সি ভি রামন বইটার মৌলিকত্ব ব্যাখ্যার পাশাপাশি সাহার কাজের গভীরতা ও
উৎকর্ষতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। প্রকাশিত হবার পর আশি বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। অথচ বই দুটোর এখনো ব্যাপক
চাহিদা আছে।
১৯৩৪ সালে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলো - অণু, পরমাণু ও নিউক্লিয়াস
সম্পর্কিত টেক্সট বই A Treatise of
Modern Physics: Atoms, Molecules and Nuclei প্রকাশ করেন প্রফেসর সাহা। এই বইটিতে পদার্থবিজ্ঞানের সেই সময়ের সদ্য
আবিষ্কৃত তথ্যগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কারের পর পরমাণুর
নিউক্লিয়াসের গঠন ও সেখানে নিউট্রনের ভূমিকা সংক্রান্ত তথ্যগুলো পদার্থবিজ্ঞানের
একেবারে নতুন বিষয় ছিল।
শিক্ষক হিসেবে তিনি
শিক্ষার্থীর ক্ষমতা বুঝতে পারতেন। বুঝতে পারতেন কাকে দিয়ে কী হবে। তাঁর ছাত্রদের
বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন জীবনে ও কর্মে। ভালো ছাত্র হলেই বা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভালো রেজাল্ট করলেই যে গবেষণা করতে হবে বা শিক্ষক হতে হবে এমন ভাবতেন না অধ্যাপক
সাহা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে লেখাপড়া আর গবেষণার মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। ধৈর্য
এবং অধ্যবসায় থাকলেই লেখাপড়া করা যায়, কিন্তু গবেষণা করতে গেলে আরো কিছু লাগে। তা
হলো প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা। তিনি প্রায়ই বলতেন যে গবেষণায় সাফল্যের পেছনে
যদি দুই ভাগ উৎসাহ থাকে, ৯৮ ভাগ থাকে
মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রম। শুধুমাত্র পরীক্ষার রেজাল্ট থেকে শিক্ষার্থীর এই
ক্ষমতা আছে কি না বোঝা সম্ভব নয়।
যেসব শিক্ষার্থীর ভেতর
কিছু করার ক্ষমতা দেখতেন তিনি তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। একটা উদাহরণ দেয়া যাক
এখানে। দৌলতরাম সিং (ডি এস) কোঠারি ছিলেন অধ্যাপক সাহার প্রিয় ছাত্র। কোঠারিদের
ব্যাচে মাস্টার্সে ছাত্র ছিল আট জন। পরীক্ষা সেবার এত কঠিন হয়েছিল যে আট জনের
মধ্যে একমাত্র কোঠারিই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন, বাকিরা সবাই সেকেন্ড ক্লাস।
কিন্তু সবাই এত ভালো ছিল যে সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সেকেন্ড
ক্লাস পাওয়া সবাই চাকরি পেয়ে গেলেন।
প্রফেসর সাহা কোঠারিকে কোন
নিয়োগ পরীক্ষা দিতে মানা করেছিলেন। কোঠারির মতো ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্রের মধ্যে সাহা
গবেষক হওয়ার সমস্ত যোগ্যতা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি কোঠারির জন্য ইওরোপের
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ জোগাড় করে দিলেন। যথাসময়ে ইওরোপ থেকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে
অনেক ভালো ভালো কাজ করে ডক্টরেট ডিগ্রি
নিয়ে ফিরে এলেন কোঠারি। কিন্তু তাঁকে কোথায় চাকরি দেবেন প্রফেসর সাহা? তাঁর নিজের
ডিপার্টমেন্টে মাসে ১৮০ টাকার একটা ডেমোনেস্ট্রেটরের চাকরি ছাড়া আর কোন চাকরি দিতে
পারলেন না ডক্টর কোঠারিকে। দিনের পর দিন ডেমোনেস্ট্রেশন করতে করতে হীনমন্যতায়
ভুগতে ভুগতে পুরো বিজ্ঞানের প্রতিই বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল কোঠারির। প্রফেসর সাহা
এর জন্য নিজেকেই দায়ি মনে করতে লাগলেন।
এই সময় দিল্লি
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিডার পদ খালি হলে অধ্যাপক সাহা কোঠারিকে সেই চাকরিটা পাইয়ে
দিলেন। দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারটা সেই সময়েও ছিল।
কোঠারি ইওরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন,
অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষণায় নিজের যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন - তারপরও তাঁর জন্য
বিশিষ্ট ব্যক্তির সুপারিশের দরকার হলো।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের
প্রধান বিচারক স্যার শাহ মোহাম্মদ সুলেইমান ছিলেন মেঘনাদ সাহার বন্ধু। বিচারপতি
সোলাইমান বিজ্ঞানের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল
অনেক। তিনি নতুন করে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্তু অনেক
জটিল বিষয় তিনি বুঝতে পারেন না। ফলে তিনি অধ্যাপক সাহাকে অনুরোধ করেছিলেন সাহার
কোন ছাত্রকে তাঁর কাছে পাঠাতে যে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় সহজ করে বুঝিয়ে দিতে পারবে।
অধ্যাপক সাহা ডক্টর কোঠারিকে পাঠালেন বিচারপতি সুলেইমানের কাছে। কোঠারির বোঝানোর
ক্ষমতা দেখে বিচারপতি সুলেইমান বেশ খুশি। তারপর সময় বুঝে বিচারপতি সুলেইমানকে দিয়ে
সুপারিশ করানো হলো দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলারকে। ডক্টর কোঠারির
চাকরি হলো দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের
ব্যাপারে সাংঘাতিক কড়া ছিলেন মেঘনাদ সাহা। একবার ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের ছাত্র এস বি করমহামাত্র ল্যাবে কাজ করছেন। এমন সময় প্রফেসর সাহা সেখানে
গিয়ে দেখলেন করমহাপাত্র একটি স্পেক্ট্রোমিটার বসিয়েছে একটি বইয়ের উপর। সাহা দেখলেন
বইটি লাইব্রেরির বই। প্রফেসর সাহা সাথে সাথে বললেন কাজ বন্ধ করতে। লাইব্রেরিয়ানকে
ডেকে আদেশ দিলেন করমহাপাত্রের লাইব্রেরি কার্ড বাতিল করে দিতে। ভয়ে লজ্জায় কিছুদিন
প্রফেসর সাহাকে এড়িয়ে চললেন করমহাপাত্র। একদিন মন খারাপ করে লাইব্রেরির সামনে
ঘুরছিলেন, এমন সময় লাইব্রেরিয়ান তাঁকে দেখতে পেয়ে বললেন, "আপনি লাইব্রেরি
থেকে যে কোন বই নিতে পারবেন। সাহা স্যার আমাকে বলে দিয়েছেন আপনি বই চাইলে স্যারের
নামে ইস্যু করে আপনাকে বই দিতে।"[1]
সেই সময় সায়েন্স নিয়ে
মাস্টার্স পড়তে মেয়েরা খুব একটা আসতো না। তার আগেই বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যেতো।
বিয়ের পর পড়াশোনা করাটা নির্ভর করতো পুরোপুরি শ্বশুরবাড়ির মর্জির ওপর। শোভনা ধর
ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি গবেষণা করতে এলেন মেঘনাদ সাহার কাছে। সাহা স্যার শোভনার
বাবার সাথে কথা বলে নিশ্চয়তা আদায় করলেন যে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগে মেয়ের
বিয়ে দেবেন না। শোভনা গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। একটা
স্কলারশিপ না পেলে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। প্রফেসর সাহা এসব জানার পরেও
শোভনাকে স্কলারশিপ দিলেন না। স্যারকে সেদিন খুবই হৃদয়হীন বলে মনে হয়েছিল শোভনার।
কিন্তু কিছুদিন পর কলকাতার একটা গার্লস কলেজ থেকে লেকচারার পদে নিয়োগপত্র পেলেন
শোভনা। জানতে পারলেন সাহা স্যার শোভনার জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের জন্য
প্রফেসর সাহার বাড়ির দরজা, অফিসের দরজা, হৃদয়ের দরজা ছিল সবসময় খোলা।
মেঘনাদ সাহার শিক্ষক
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলতেন - একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ছাত্রদের
ভালোবাসা। সাংসদ মেঘনাদ সাহাকে অনেক রাজনীতিবিদ অপছন্দ করতেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও
অনেকের মতের সাথে মেঘনাদ সাহার মতের মিল হয়নি। কিন্তু মেঘনাদ সাহার শিক্ষার্থীদের
মধ্যে এমন একজনও পাওয়া যাবে না যে সাহা স্যারকে ভালোবাসেনি।
শিক্ষক কি শুধু ক্লাসেই
পড়ান? সেই ১৯৩০-৩৫ সালের মধ্যে লেখা মেঘনাদ সাহার বইগুলো আমরা আজও পড়ছি, পড়ে
শিখছি। তিনি তো গত আশি বছর ধরে উপমহাদেশের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সফল
শিক্ষক।
No comments:
Post a Comment