পারমাণবিক শক্তি কমিশন
১৯৩৯ সালে
বিজ্ঞানী অটো হ্যান এবং লিজ মেইটনার নিউক্লিয়ার ফিশান আবিষ্কার করার পর নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের বিশাল শক্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা উৎসাহিত হয়ে উঠেন। তার বছরখানেক পরেই
১৯৪১ সালের মার্চ মাসে ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটির মিটিং-এ নিউক্লিয়ার ফিশান
সম্পর্কে সেমিনার বক্তৃতা দেন প্রফেসর সাহা। আমেরিকায় তখন যে গোপনে নিউক্লিয়ার
ফিশানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে সে সম্পর্কিত কোন খবর পৃথিবীর কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে মেঘনাদ সাহাই প্রথম ব্যক্তি যিনি এই বিষয়ে গবেষণা এবং কথা বলতে
শুরু করেন। সাধারণ মানুষের বুঝার সুবিধার্থে তিনি লিখেছিলেন, "হোমিওপ্যাথিক
ওষুধের ছোট্ট একটা দানার সমান ইউরেনিয়ামের দানা থেকে যে শক্তি পাওয়া যাবে তা দিয়ে
একটা বিরাট যুদ্ধজাহাজ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়া যায়।"
ইতোমধ্যে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার
দিল্লিতে Board for Sientific and
Industrial Research (BSIR) গঠন করে। ডক্টর ভাটনগরকে এই বোর্ডের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আর
প্রফেসর সাহাকে করা হয় বোর্ডের একজন সাধারণ সদস্য। এই বোর্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল
বিশ্বযুদ্ধে ভারতের শিল্পকারখানাগুলো কীভাবে অবদান রাখতে পারে সে সম্পর্কে পরামর্শ
দেয়া। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি করা, সৈনিকদের পোশাকসহ
যুদ্ধক্ষেত্রে যা যা লাগে তার কী কী ভারতের শিল্পকারখানাগুলো সরবরাহ করতে পারবে
ইত্যাদি। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার BSIR-এর চেয়েও উচ্চক্ষমতার আরেকটি কাউন্সিল - Council of Scientific and Industrial Research
(CSIR) গঠন করে। ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল CSIR-এ শুধুমাত্র আমলা ও শিল্পপতিদের অন্তর্ভুক্ত করা।
কিন্তু সেটা জানার পর BSIR-এর সব বিজ্ঞানী একযোগে পদত্যাগ করার হুমকি দেন। ফলে সরকার CSIR-এও মেঘনাদ
সাহাসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীকে অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৪৪ সালের দিকে জাপান ও
জার্মানির পরাজয় প্রায় নির্ধারিত হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধোত্তর দেশকে
পুনর্নিমাণ করার প্রস্তুতি শুরু করে। ব্রিটিশ ভারতের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেয়ার
জন্য রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানী প্রফেসর হিল ভারতে এসে ভারতের শীর্ষস্থানীয়
বিজ্ঞানীদের সাথে বৈঠক করেন। প্রফেসর সাহার সাথেও আলোচনা করেন প্রফেসর হিল।
প্রফেসর হিলের পরামর্শ মতো ভারতের একদল বিজ্ঞানীকে ইওরোপে বৈজ্ঞানিক মিশনে পাঠানোর
ব্যবস্থা করা হয় যাতে বিজ্ঞানীরা সেখানকার যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে কী কী পদক্ষেপ
নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা দেখে আসতে পারেন। Indian Scientific
Mission (ISM)-এর সদস্য হয়ে ১৯৪৪ সালের
অক্টোবরে ইওরোপ ও আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন প্রফেসর সাহা।
১৯৪৪-৪৫ সালে সায়েন্টিফিক গুড উইল মিশনে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে তোলা ছবি
লন্ডনে হাই কমিশনারের অফিসে ১৯৪৪ |
ইংল্যান্ডে ১৯৪৪ |
ইওরোপের বিভিন্ন দেশ, এবং আমেরিকায় গিয়েও পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কিত
গবেষণার কোন খোঁজ পেলেন না মেঘনাদ সাহা। আমেরিকা যে গোপনে ম্যানহাটান প্রজেক্টের
আওতায় পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না কারো। বৈজ্ঞানিক
অনুসন্ধিৎসায় প্রফেসর সাহা যেখানেই যাচ্ছেন জানতে চাচ্ছেন পারমাণবিক শক্তির
অগ্রগতি সম্পর্কে। তাঁর এক আমেরিকান বন্ধু বিজ্ঞানী তাঁকে সাবধান করে দিলেন যে
পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে কোন প্রশ্ন না করতে। কিন্তু প্রফেসর সাহা শুরুতে বুঝতেই
চাইলেন না। পরে দেখা গেলো এফ-বি-আই এর এজেন্টরা মেঘনাদ সাহাকে অনুসরণ করতে শুরু
করলো। এক সময় তাঁকে এফ-বি-আই অফিসে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ইন্টারোগেশান করলো। এফ-বি-আই
এজেন্টরা দেখলেন যে প্রফেসর সাহা পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে অনেক বেশি জানেন এবং
সেই জানাটা অ্যাকাডেমিক, এবং তাতে কোন ষড়যন্ত্র নেই।
বৈজ্ঞানিক মিশন থেকে ফিরে প্রফেসর সাহা পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে জাতীয়
পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সাথে বৈঠক করলেন। সেই সময়
নেহেরুসহ অন্যান্য নেতাদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রফেসর সাহা আশা করেছিলেন
যে স্বাধীনতার পর পারমাণবিক শক্তির বিকাশ ঘটবে স্বাধীন ভারতে।
স্বাধীনতার পর BSIR-এর সদস্য হিসেবে প্রফেসর সাহা আশা করেছিলেন যে পারমাণবিক শক্তির বিকাশে তিনি প্রধান ভূমিকা রাখবেন। এসময় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবাও ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়নের পরিকল্পনা নিয়ে নেহেরুর সাথে কাজ শুরু করেন। ক্রমে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে নেহেরু ভাবাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন সাহার চেয়ে বেশি।
স্বাধীনতার আগেই হোমি ভাবার নেতৃত্বে অ্যাটমিক রিসার্চ কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৬ সালের ১০ই মে অ্যাটমিক রিসার্চ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় হোমি ভাবার সভাপতিত্বে। সিদ্ধান্ত হয় ভারত সরকার পারমাণবিক গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে এবং এ সংক্রান্ত সব কাজ ও গবেষণা নিয়ন্ত্রিত হবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। অধ্যাপক সাহা চেয়েছিলেন তাঁর ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সই হবে সেই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যখন দেখা গেলো সেই নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হোমি ভাবার প্রতিষ্ঠা করা বোম্বের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-কে ঠিক করা হয়েছে - সাহা ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। তিনি এর বিরোধিতা করলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না।
১৯৪৮ সালে হোমি ভাবাকে প্রেসিডেন্ট করে
যখন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন গঠন করা হলো - সাহা তার তীব্র বিরোধিতা করলেন। তিনি
যুক্তি দিলেন দেশে প্রয়োজনীয় পরমাণু-জনশক্তির অভাব যেরকম রয়েছে, তেমনি এখনো কোন
সুষ্ঠু শিল্পনীতি গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় পরমাণু শক্তি কমিশন গড়ে তোলার অর্থ হলো ঘোড়ার
আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া। অধ্যাপক সাহার মতে আগে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিউক্লিয়ার
ফিজিক্স ও নিউক্লিয়ার এনার্জির উচ্চতর কোর্স চালু করতে হবে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি
হবার পর বিবেচনা করা যেতে পারে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন গঠন করা যায় কি না।
No comments:
Post a Comment