বার্লিনে
লন্ডন থেকে যাবার সময় প্রফেসর ডোনানের
কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একই সময়ে সাহার মত আরো চৌদ্দ জন ছাত্র
এরকম চিঠি নিয়ে গেছেন নার্নস্টের কাছে। প্রফেসর ওয়াল্টার নার্নস্ট তখন
বিশ্ববিখ্যাত। সে বছরই (১৯২০) নার্নস্ট রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
নার্নস্ট শুরুতে লন্ডন থেকে আসা কোন
ছাত্রকেই তাঁর ল্যাবে ঢুকতে দিতে রাজী হননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে
যাওয়ার কারণে ইংল্যান্ডের ওপর অনেক রাগ নার্নস্টের। পরে অবশ্য তিনি সাহাকে তাঁর
ল্যাবে কাজ করতে দিতে রাজী হয়েছেন। কারণ হিসেবে সাহাকে তিনি বলেছেন - “ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যের গালে শেষ চড়টা ভারতই মারবে”।[1]
প্রফেসর ওয়াল্টার নার্নস্ট |
বার্লিনে থাকাকালীন মেঘনাদ সাহার সুযোগ হয় ম্যাক্স প্ল্যাংক, আর্নল্ড সামারফেল্ড ও আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম অনুবাদক মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু। শুধু তাই নয়- ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের সার্বিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়ার পর আইনস্টাইন যখন রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেছেন[2], তখন ভারতীয় সংবাদপত্রে আইনস্টাইনের কাজ সম্পর্কিত প্রথম রচনাটিও মেঘনাদ সাহাই লিখেছিলেন।
মেঘনাদ সাহা তাঁর On a Physical Theory of Stellar Spectra পেপারটি
প্রফেসর আর্নল্ড সামারফেল্ডকে পাঠিয়েছিলেন। সামারফেল্ড তখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের
তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান। সাহার পেপারটি পড়ে সামারফেল্ড বুঝতে পারলেন তার
গুরুত্ব। তিনি মেঘনাদকে আমন্ত্রণ জানালেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা
দেওয়ার জন্য।
সেই সময় মিউনিখে
সামারফেল্ডের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সামারফেল্ড
রবীন্দ্রনাথের কাছে ভূয়ষী প্রশংসা করলেন মেঘনাদ সাহার। রবীন্দ্রনাথ মেঘনাদ সাহাকে
এর আগে চিনতেন না। চেনার কথাও নয়। মেঘনাদ তখনো মাত্র একজন তরুণ গবেষক। মেঘনাদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করলেন তাঁর হোটেলে গিয়ে। বিশ্বকবির সাথে একটা
আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো তাঁর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য
নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন মেঘনাদ সাহাকে।
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে
মেঘনাদ সাহা যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মানির
বিখ্যাত সাময়িকী Zeitschrift fur Physik-এ প্রকাশিত হয়
১৯২১ সালে।[3]
১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
গ্রিফিথ মেমোরিয়াল প্রাইজ পান মেঘনাদ সাহা। ছদ্মনামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ জমা দিতে
হতো এই প্রাইজের জন্য। মেঘনাদ ‘হিলিওফিলাস’ ছদ্মনামে ‘অরিজিন্স অব
লাইন্স ইন স্টেলার স্পেক্ট্রা’ প্রবন্ধটি
পাঠিয়েছিলেন ইওরোপ থেকে। অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ছিলেন গ্রিফিথ পুরষ্কারের
অন্যতম বিচারক।[4]
১৯১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১ সালের
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইওরোপে ছিলেন মেঘনাদ। লন্ডন থেকে বার্লিনে যাবার পর একমাস
সুইজারল্যান্ডে ছিলেন। ১৯২১ সালের প্রথম দিকে এম্পায়ার ইউনিভার্সিটিস কনফারেন্স হয়
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে যোগ
দেন সেই কনফারেন্সে।
সেবার মেঘনাদ সাহাকে নিমন্ত্রণ করে
নিজের বাড়িতে নিয়ে যান স্যার এডিংটন। এডিংটনের সহকারী প্রফেসর মিল্নি মেঘনাদকে
বলেন তাঁর পেপার থেকে মিলনি এবং ফাউলার কীভাবে অনেক আইডিয়া পেয়েছেন। সাহার থার্মাল
আয়নাইজেশান থিওরি সূচনা করেছে এক নতুন অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের।
স্যার চার্লস ডারউইনের নাতি
পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর চার্লস গ্যালটন ডারউইনের সাথেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়
মেঘনাদ সাহার।
এসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন
অফার পেলেন মেঘনাদ সাহা। স্যার আশুতোষ মুখার্জি মেঘনাদ সাহাকে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের 'খয়রা প্রফেসর' নিযুক্ত করেছেন। লেকচারার
থেকে সরাসরি ফুল প্রফেসর। কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা।
[1] Robert S. Anderson, Building
scientific institutions in India: Saha and Bhabha. 1975, Montreal: McGill University.
[2] প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল. ২০০৬, ঢাকা: মীরা প্রকাশন.
[3] M. N. Saha, Versuch einer Theorie der Physikalischen Erscheinungen bei hohen
Temperaturen, etc. Z. f. Physik, 1921. 6: p. 40.
[4] D. M. Bose, Meghnad
Saha Memorial Lecture, 1965.
Proceedings of the National Institute of Sciences of
India, 1967. 33A(3 & 4): p. 111-132.
No comments:
Post a Comment