একাদশ অধ্যায়
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইওরোপ থেকে
ফিরে ১৯২৬ সালের অক্টোবরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন সত্যেন বসু। বেশ
কিছু পরিবর্তন হয়েছে ইউনিভার্সিটির এবং তাঁর ডিপার্টমেন্টেরও। ভাইস চ্যান্সেলর
হার্টগ অবসর নিয়েছেন ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে। প্রফেসর জর্জ হ্যারি ল্যাংলি (G H Langley) নতুন ভিসি
হয়েছেন। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর জেনকিন্স ইংল্যান্ডে চলে
গেছেন। ড. আর এন ঘোষ
ডিপার্টমেন্টের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। প্রফেসর জেনকিন্সের পদে নিয়োগের জন্য যখন দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল
সত্যেন বসু তখন বার্লিনে ছিলেন। প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধানের পদ। পিএইচডি ডিগ্রি
ন্যূনতম যোগ্যতা। কিন্তু সত্যেন বসুর পিএইচডি ডিগ্রি নেই। গবেষণা করে ডক্টরেট করার
কোন ইচ্ছে তাঁর হয়নি কখনো। তাঁর ক্লাসমেট বন্ধু সহকর্মী মেঘনাদ সাহা মাত্র
দু'বছরের মধ্যে ডিএসসি ডিগ্রি পেয়ে গেছেন। অথচ সত্যেন বসুর কোন আগ্রহই জন্মায়নি
রিসার্চ ডিগ্রি নেয়ার। এখন পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কীভাবে দরখাস্ত করা যায়? তিনি ভেবে
দেখলেন আইনস্টাইনের লেখা একটি পোস্টকার্ড যেভাবে তাঁর ইওরোপে আসা ত্বরান্বিত
করেছে, সেখানে আইনস্টাইনের কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিতে পারলে নিশ্চয় কাজ হবে।
আইনস্টাইনকে বলতেই খুব
আগ্রহ সহকারে প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন।
16.3.26
The
recent works of Mr S N Bose, especially his theory of radiation
equilibrium, signify in my opinion an important and enduring progress of the
physical theory. Also in personal discussion with Mr Bose, I have got the.
impression that he is a man of unusual gift and depth, from whom science has
much to expect. He has also at his command an extensive knowledge and
certain ability in our science. As university teacher he will certainly develop
a successful and prosperous activity.
Sd. A. Einstein
আইনস্টাইন লিখেছেন,
"মিস্টার এস এন বোসের সাম্প্রতিক গবেষণা কাজ, বিশেষত তাঁর বিকিরণ
সাম্যতার তত্ত্ব, আমার মতে ভৌতিবিজ্ঞানের এক বিরাট অগ্রগতি সাধন করেছে। তাছাড়া
মিস্টার বোসের সাথে ব্যক্তিগত আলোচনায় আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে তিনি অত্যন্ত
প্রতিভাশালী মানুষ এবং বিজ্ঞান তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে। আমাদের বিজ্ঞানে
তাঁর বিশেষ দক্ষতা এবং ব্যাপক জ্ঞান আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি অবশ্যই
একটি সার্থক ও সমৃদ্ধিশালী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।"
শুধু আইনস্টাইন নয়, সত্যেন বসু প্রফেসর পল লাঁজেভি এবং কাইজার উইলহেলম
ইন্সটিটিউটের ড. হারমান
মার্কের কাছ থেকেও প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরা সবাই সত্যেন বসুর যোগ্যতার
প্রশংসা করেছেন।
প্রফেসর লাঁজেভির প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ:
Paris, the 26th April 1926
10 Rue Vauquelin
...q
uc Francaise
re'
Egalite' Fraternite'
Ecole
Municipale de
Physique
et de Chimie
Industrielles
Office
of Director
I the
undersigned, Paul Langevin, Professor at College de France, Director of
Ecole de Physique et Chimie de Paris, certih that Mr Satyendranuth Bose, Reader
of Physics at the University of Dacca, has spent a year in Paris in 1924-25 and
worked under my direction.
I have the highest esteem for the personal merit and the
works of Mr Bose whose own researches have been pursued here and whosepresence
has contributed to increasing the scientific activity of our university. I am
particularly happy that the initiative of the University of Dacca has permitted
this useful stay of Mr Bose in Paris.
Sd. P Langevin
ড. হারমান মার্ক
লিখেছিলেন:
Berlin,
9 May 1926
Mr
Satyendranath Bose is at present conducting a physical experimental
investigation about
the refractive index of Roentgen rays in the Kaiser Wilhelm Institute in
Berlin-Dahlem. His
large and profound
knowledge which stretches over the whole ofphysics as well as the wider territory of chemistry marks Mr Bose out
prominently. His most valuable quality
which tnakes him of inestimable value to a collaborator is his deep and clear insight in the fundamentals of our science, his wealth of
fruitful ideas and his capacity to
combine theoretically important questions with experimentally feasible tests in
an exceedingly happy manner. From the presence of Mr Bose,
our institute derives thegreatest benefit all the more as he understands, in a masterly
way, how to make the most difficult questions clear through discussion - a quality which seems to make Mr Bose eminently suitable specially to the profession of teaching.
Dr.
Hermann Mark
Kaiser
Wilhelm Institute
for
Chemistry of Fibrous Materials
16 Fambay Road, Berlin-Dahlem
এইসব প্রশংসাপত্রসহ প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন সত্যেন বসু। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসুও দরখাস্ত করেছিলেন। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় এই পদের প্রার্থীদের মূল্যায়ন করার জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত চাইলেন আর্নল্ড
সমারফেল্ডের কাছে। সমারফেল্ড টেলিগ্রাম পাঠালেন, "সত্যেন বসু ও দেবেন্দ্রমোহন
বসু দুজনই যোগ্য। সত্যেন বসু বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। আর দেবেন্দ্রমোহন
বসু প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষণ এবং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। আমার মতে দেবেন্দ্রমোহন
বসুকেই নিয়োগ দেয়া উচিত।"
১৯২৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মাসিক এক হাজার রুপি
বেতনে ডক্টর দেবেন্দ্রমোহন বসুকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয়
প্রধান পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য নিয়োগপত্র পাঠানো হবে। কোন কারণে যদি দেবেন্দ্রমোহন
বসু অসম্মতি প্রকাশ করেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সেই পদে নিয়োগ করা হবে। দেবেন্দ্রমোহন
বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে রাজী হলেন না। সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান পদে যোগ দিলেন। কিছুদিন পরে তিনি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন
নিযুক্ত হয়েছিলেন।
তারপর আঠারো বছর ধরে সত্যেন
বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে গড়ে তুলেছেন ভারতের একটি প্রথম
শ্রেণির শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রে। ইওরোপের বিখ্যাত সব ল্যাবোরেটরিতে কাজ করে
এসেছেন তিনি। মেরি কুরির রেডিয়েশান ল্যাবে কাজ করেছেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ও
এক্স-রে স্পেকট্রোসকোপি নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এক্স-রে ল্যাব তৈরি হলো। গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত হলো
ক্রিস্টালোগ্রাফি, ম্যাগনেটিক প্রোপার্টিজ, রামন স্পেকট্রা ইত্যাদি সব আধুনিক
বিষয়ে।
সত্যেন বসুর আগ্রহ ছিল
বিভিন্ন বিষয়ে। যে কোন বিষয়ের অনেক গভীরে যেতেন তিনি। কিন্তু সে তুলনায় তাঁর
গবেষণাপত্রের সংখ্যা খুবই কম। যে কোনো সমস্যার সমাধান যখন তিনি পেয়ে যেতেন তখন সেই
সমাধান প্রকাশ করার বদলে তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিতেন।
রসায়নের অধ্যাপক
সুশীলচন্দ্র বিশ্বাসের সাথে যৌথভাবে তিনি রসায়নেও গবেষণা করেন। ১৯২৭ সালে তাঁর
রসায়নে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জার্মানির বিখ্যাত রাসায়নিক জার্নালে।[1] ১৯২৯ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় বেরিলিয়াম স্পেকট্রামের
উপর একটি গবেষণাপত্র।[2] তার পরবর্তী সাত বছর তিনি কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি। অথচ
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-পরিবেশ গড়ে তুলেছেন শুধু পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নয়, আরো
অনেক বিভাগে।
১৯২৮ সালে আর্নল্ড সামারফেল্ড ভারত সফরে এসেছিলেন। ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স-এ কিছুদিন কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সত্যেন বসুর সাথে
দেখা করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে এস অসুস্থ হয়ে যাবার পর আর ঢাকায়
আসতে পারেননি। ব্যাঙ্গালোর থেকে তিনি কলকাতায় সিভি রামনের সাথে দেখা করতে
গিয়েছিলেন। কলকাতায় যাবার আগে তিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে চিঠি লিখেছিলেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-কে যে তিনি ঢাকায় আসতে পারছেন না অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ১৪
দিন হাসপাতালে নষ্ট হয়েছে তাই সময় পাচ্ছেন না বলে। কিন্তু সত্যেন বসুর সাথে তিনি
দেখা করতে খুব আগ্রহী। সত্যেন বসু যদি কলকাতা যান - তাহলে তিনি খুব খুশি হন।
সত্যেন বসু কলকাতায় গিয়ে দেখা করেছিলেন তাঁর সাথে। সেই সময় সিভি রামন 'রামন
ইফেক্ট' আবিষ্কার করেছেন। যদিও তখনো সেই আবিষ্কারের নাম তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়নি।
সত্যেন বসু সিভি রামনকে ১৯২৮ সালে বলেছিলেন, "প্রফেসর রামন, আপনি একটি মহান
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কারের নাম হবে 'রামন ইফেক্ট', আর আপনি নোবেল
পুরষ্কার পাবেন এই আবিষ্কারের জন্য।"[3] সত্যেন বসুর কথা ঠিক হয়েছিল। দু'বছরের মধ্যেই ১৯৩০ সালে নোবেল পুরষ্কার
পেয়েছিলেন সিভি রামন।
রামনের প্রধান সহকারী কে এস কৃষ্ণানকে[4] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার পদে নিয়োগ দিয়েছেন সত্যেন
বসু। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন কৃষ্ণান। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি
ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পাঁচ বছরে তিনি প্রচুর গবেষণা করেছেন ক্রিস্টালের
চৌম্বকধর্ম নিয়ে। বিভাগীয় প্রধান সত্যেন বসু তাঁকে গবেষণার জন্য যা যা লাগে সবকিছু
দিয়ে সহায়তা করেছেন। এই পাঁচ বছরে কৃষ্ণানের বিশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু
সত্যেন বসু কৃষ্ণানের সাথে যৌথভাবে কোন গবেষণা করেননি।
১৯২৯ সালে মাদ্রাজে
অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে ফিজিক্স ও ম্যাথম্যাটিক্স সেকশানের সভাপতিত্ব
করেন সত্যেন বসু।
১৯৩১ সালে ডিপার্টমেন্টে
যোগ দিয়েছিলেন শান্তিরঞ্জন খাস্তগীর। তিনি ১৯৪৫ সালে সত্যেন বসুর পদত্যাগের পর
ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রফেসর খাস্তগীরের সাথে একটি যৌথ গবেষণাপত্র
প্রকাশ করেছিলেন সত্যেন বসু। সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করবো।
১৯৩৩ সালে কে এস কৃষ্ণান
কলকাতায় 'মহেন্দ্রলাল সরকার প্রফেসরশিপ' নিয়ে চলে গেলে তাঁর স্থলে রামনের আরেকজন
ছাত্র কেদারেশ্বর ব্যানার্জিকে নিয়োগ দেন সত্যেন বসু। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন কেদারেশ্বর ব্যানার্জি। তিনি তরল পদার্থে এক্স-রে ডিফ্রাকশান
নিয়ে গবেষণা করেন। সত্যেন বসু ব্যানার্জিকেও সমস্ত গবেষণা-সহযোগিতা দিয়েছিলেন
কিন্তু যৌথভাবে কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু
পদার্থবিজ্ঞান নয়, সব বিভাগেরই গবেষণার বিস্তার, অগ্রগতি ও মানোন্নয়নে সদাসচেষ্ট
ছিলেন সত্যেন বসু। কোন্ বিভাগে কী কাজ হচ্ছে তার খবর রাখতেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন
হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তিগত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকেও। রসায়ন বিভাগের প্রধান
প্রফেসর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন তাঁর বন্ধু। রসায়নের অনেক গবেষণায় সরাসরি অংশ
নিয়েছেন সত্যেন বসু। জৈব রসায়নে সেই সময় প্রচুর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকাজ সম্পাদিত
হয়েছে সেই সময়। এ প্রসঙ্গে সত্যেন বসু নিজেই লিখেছেন,
"সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি।
আমার এক ছাত্র Sulphonamide নিয়ে নানা গবেষণায় ব্যস্ত। ওদিকে জৈব-রসায়নের
গবেষণা-কেন্দ্রে ড. কালীপদ বসু নানাপ্রকার চাউল ও অন্যান্য
খাদ্যদ্রব্যের বিশ্লেষণ করে চলেছেন। তাদের প্রত্যেকটির মধ্যে স্নেহ-কার্বোহাইড্রেট
ও প্রোটিনের শতকরা কয়ভাগ করে বর্তমান রয়েছে, তা নিরূপণ করে তালিকা করছেন। তার
মধ্যে vitamin (খাদ্যপ্রাণ) সমূহের অবস্থানের খবরও থাকছে ও
তাদের পরীক্ষণ নিরূপণের প্রয়াসও চলেছে। ঢাকার খুব কাছেই আমেরিকান বোমারু বিমানের
ঘাঁটি। ঢাকা শহরের মধ্যে আমেরিকান, ইংরেজ ও ভারতীয় পল্টনের নানা হাসপাতাল বসেছে।
নানাদেশের ডাক্তার ও বিজ্ঞানী এসে ঢাকায় রয়েছেন। তাঁরা মধ্যে মধ্যে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-মন্দিরে বেড়াতে আসেন ও আমরাও তাঁদের কাছ থেকে নানা খবর
পাই।
সেই
সময় খবর এলো চীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব-রসায়নে অভিজ্ঞ পর্যটক এসেছেন ভারত ভ্রমণে।
ভারতে নানাস্থানে কীভাবে নানা খাদ্যপ্রাণসমন্বিত বটিকা তৈরি হচ্ছে দেখতে। দক্ষিণ
ভারতে টুটিকোরিনে দেখলেন মাছের তেল থেকে vitamin D এর সংগ্রহ,
আবার আফ্রিকা দেশের লাল তালের তেল থেকে vitamin-এর সংগ্রহ। vitamin-এর অভাবে চীনা শিশুদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তারই প্রতিকারের চেষ্টায় এই
পর্যটন। রাজপুতানা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, দিল্লী বেড়ানো শেষ হলো, সব শেষে
পূর্বপ্রান্তের শহর ঢাকায় তিনি উপস্থিত হলেন।
শ্রী
কালীপদ বসুর খাদ্যবিশ্লেষণ ও সংগ্রহের তালিকার কথা তিনি শুনেছিলেন। নিজেরও ওই
বিষয়ে কিছু কাজ করা ছিলতাঁর, তাই কৌতূহলের উদ্রেক হয়েছে - কীভাবে ভারতে ওই প্রকারের
অনুসন্ধান চালানো হয়।
চীনা
বিজ্ঞানীকে সাদরে অভ্যর্থনা করলাম আমরা। ঢাকা-হল অফিসের একটি কামরা প্রয়োজনীয়
আসবাবপত্র দিয়ে তাঁর বাসের উপযোগী করে দেওয়া হলো। এক সপ্তাহেরও বেশী দিন তিনি
আমাদের সঙ্গে কাটালেন।
নানা
প্রসঙ্গের আলোচনা হচ্ছে। নিজে কীভাবে চীনদেশের উদ্ভিজ্জের মধ্যে vitamin B ও C এর সন্ধান পেয়েছেন, তার কথা। চীনদেশে রসায়ন
শিল্পের তখন সবে পত্তন হয়েছে। গন্ধকাম্লের কারখানা মাত্র কয়েক জায়গায় গড়ে উঠেছে,
অন্যান্য দরকারী জিনিস ও ঔষধপত্র তখনও আসছে বিদেশ থেকে। পুরনো কেতায় জীবনযাত্রা
চলেছে সাধারণ চৈনিকের, যদিও কয়েক বছর আগেই সুন-নত-সে-ন বিপ্লবের বন্যায় মাঞ্চু
সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজেই Sulphonamide ও তাঁর নানা যৌগিকের প্রস্তুতি চলেছে শুনে প্রথমে তাঁর বিশ্বাস হলো না।
আমাদের নিমন্ত্রণে এসে স্বচক্ষে প্রক্রিয়ার সব ধাপগুলিই ছাত্রকে অতিক্রম করে
শুদ্ধবস্তুতে উপনীত হতে দেখলেন। এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানদানের পরিবর্তে আমরা চাইলাম
তাঁর কাছে সয়াবিন থেকে কীভাবে চীনদেশে দুধ তৈরী হয়, তার সন্ধান। কাশ্মীর থেকে আনা
অনেক সয়াবিন শ্রীমান কালীপদ যত্ন করে রেখেছিলেন। তা থেকে যথানিয়মে দুধ তৈরি হলো,
দুধ থেকে ছানা।"[5]
দেখা যাচ্ছে ৫০-৬০ বছর আগেও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিকভাবে চীনের
চেয়েও উন্নত ছিল। আমরা সেদিন তাদের বিজ্ঞানীদের শিখাতে পারতাম এবং সমানে সমানে
দাঁড়িয়ে শিখতেও পারতাম। এই ক'বছরের মধ্যেই তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোথায় উঠে গেল, আর
আমরা কোথায় গেলাম!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ খোলার পেছনে সত্যেন বসুর অবদান অনেক।
তিনি সহকর্মী ড. কাজী মোতাহার
হোসেনকে শিক্ষাছুটি দিয়ে কলকাতায় বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কাছে
পাঠিয়েছিলেন পরিসংখ্যান বিষয়ে শিক্ষা নেয়ার জন্য। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন
স্মৃতিচারণ করেছেন সে প্রসঙ্গে:
"একদিন আমাদের
পদার্থবিদ্যা অনুষদের ১০/১১ জন শিক্ষককে একসঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বাজিয়ে নিলেন। ওঁর
কাছে একখানে উচ্চ পর্যায়ের পাটিগণিত ছিল, অনেক কূট অংকে ভরা। অংকগুলো দেখতে অনেক
সহজ মনে হয়, কিন্তু করতে গেলে জ্যামিতি, বীজগণিত, স্থানাংক জ্যামিতি বা কলন
প্রণালীর জ্ঞানের আবশ্যক হয়। সেই বই থেকে আমাদের সবাইকে সাত-আটটা বাছা বাছা অংক
করতে দিয়ে বললেন, "সাতদিন পরে যে যতটা পার এনে আমাকে দেখাবে।" আমি
পরদিনই সবগুলো সমাধান করে তাকে দেখালাম। (অন্যেরা কে কয়টা করতে পারলো সেটা উল্লেখ
করা শোভন হবে না)। যাহোক সত্যেনবাবু খুব খুশী হয়েছেন, বোঝা গেল। মন্তব্য করলেন,
তোমার ত ম্যাথেমেটিক্স-এ অ্যাকুমেন (প্রকৃষ্ট পারদর্শিতা) আছে হে!"
সত্যেনবাবুর মুখে এ খুব বড় প্রশংসা। অতঃপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি
স্ট্যাটিস্টিক্স পড়বে?" বললাম, "তা সুযোগ পেলে পড়তে পারি, কিন্তু সে
সুযোগ কোথায়?" তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, "আমি তোমাকে বেতনসহ নয় মাসের ছুটি
দেব, আর বছরে তিনমাস তো এমনিই ছুটি আছে।" গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলেই তিনি
আমাকে সঙ্গে করে কলকাতা নিয়ে গেলেন, আর (ড.
প্রশান্তচন্দ্র) মহলানবিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, - "দেখ, এ আমার
ছোট ভাই-এর মত। একে বছরখানিকের মধ্যে যতটা পার পরিসংখ্যান শিখিয়ে দেও। একে যোগ্য
মনে করেছি বলেই, আমি তোমার হাওয়ালায় রেখে যাচ্ছি।"
বুঝলাম সত্যেনবাবুর
নির্বাচনী পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়েছি। এর মধ্যেই তাঁর মাথায় এসে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
সংখ্যাগণিত চালু করতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষক সৃষ্টি করতে হবে। আর সত্যেনবাবুর
স্নেহ অনুগ্রহেই আস্তে আস্তে আমার পাঠনের মোড় ফিরে গেল পদার্থবিজ্ঞান থেকে
পরিসংখ্যানে বা তথ্যগণিতের দিকে।
এই মহাপুরুষের কাছে
হিন্দু-মুসলিমের কোনও প্রশ্নই ছিল না; ছিল গুণের আদর আর সূক্ষ্ম বিচারবোধ। তিনি
প্রথমে তথ্যগণিতকে অংক শাস্ত্রের সহিত সংযোজিত করে দিলেন। এর ফলে ১৯৩৯ সাল থেকে আমি
তথ্যগণিত পড়াতে লাগলাম, আর পদার্থবিদ্যার ফলিত অংশ ত্যাগ করে অনার্স ক্লাসে
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাও পড়াতে লাগলাম। এইভাবে কিছুদিন চলার পর তথ্যগণিতের একটা
পুরো বিভাগ সৃষ্টি করা হল। প্রথমে তথ্যগণিতের পাস কোর্স আর অনার্স কোর্স একসঙ্গে
আরম্ভ হল। তার দুই বছর পরে এম.এ. কোর্সও খোলা হল ১৯৫০-৫১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা বিষয়ে গর্ব করতে
পারে; সে হচ্ছে, তথ্যগণিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে B.A. Honours Course খুলবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উক্তি অনার্স
কোর্স খোলা হয়েছিল।"[6]
সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞানের এমএসসি পরীক্ষার বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ বিখ্যাত
পদার্থবিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেলে চা-চক্রের
আয়োজন করা হতো আর থাকতো সবার জন্য উন্মুক্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের আলোচনা শোনার সুযোগ
পেতেন। ১৯৩৭ সালে মেঘনাদ সাহা এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে
তিনি একটি লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি তখন আয়োনোস্ফিয়ারে বেতারতরঙ্গের প্রতিফলন
সম্পর্কিত গবেষণা করছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল যে আয়নোস্ফিয়ারে বেতার তরঙ্গের কোন
শোষণ ঘটে না। কিন্তু সেটা ছিল একটা ধারণামাত্র। মেঘনাদ সাহা সেই সভায় সবার সামনে
সত্যেন বসুকে অনুরোধ করেছিলেন এই সমস্যার একটা সার্বিক সমাধান খুঁজে বের করার
জন্য। সত্যেন বসু কয়েক মাসের মধ্যেই এই সমস্যার একটা সমাধান বের করেছিলেন। ১৯৩৭-৩৮
সালে 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' এবং 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স'-এ দুটো
গবেষণাপত্র[7] প্রকাশ করেন তিনি আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
দ্বিতীয় ভিসি জর্জ ল্যাংলির মেয়দ শেষ হয় ১৯৩৪ সালের জুন মাসে। তৃতীয় ভিসি হন স্যার
এ এফ রহমান। ১৯২১ সালে প্রফেসর হার্টগের অনুরোধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ইতিহাস
বিভাগের রিডার হিসেবে। সত্যেন বসুর সাথে তাঁর ছিল আন্তরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
১৯৩৬ সালে স্যার এ এফ রহমানের মেয়াদ পূর্ণ হবার পর চতুর্থ ভিসি হন অধ্যাপক
রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনিও ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে। সত্যেন বসুর সাথে তাঁর বন্ধুত্ব
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সত্যেন বসু সাধারণত
ছাত্রদের কোন অনুষ্ঠানে যেতেন না। ১৯৩৯ সালে তাঁকে ঢাকা হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব
দেয়া হয়। এর আগে প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন কেমিস্টির জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ।
প্রভোস্টের দায়িত্ব নেয়ার পর নিয়মানুযায়ী হলের সবগুলো অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করতে
হতো সত্যেন বসুকে। ইউনিভার্সিটির যেসব অনুষ্ঠান তিনি এড়িয়ে চলতেন রমেশচন্দ্র
মজুমদার ভিসি হবার পর সেসব অনুষ্ঠানেও তিনি সত্যেন বসুকে জোর করে নিয়ে যেতেন।
ধূতিপাঞ্জাবি পরা শ্বেতশুভ্রচুলের সত্যেন বসু যখন মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে সেসব
অনুষ্ঠানে বসে থাকতেন - দেখতে পৌরাণিক ঋষিদের মতো লাগতো তাঁকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক, ছোট-বড় সবার কাছেই তিনি ছিলেন ঋষিতুল্য। এমনকি ঢাকার সাধারণ মানুষও খুব ভালোবাসতেন তাঁর আন্তরিক নরম ব্যবহার। তিনি এমনিতে খুব নরম স্বভাবের হলেও নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। ছাত্ররা সেই সময়েও মাঝে মাঝে পরীক্ষা পেছানোর আবদার করতো। তিনি সেই আবদার হাসিমুখেই বাতিল করে দিতেন।
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ও
সামাজিক অবস্থা বদলে যেতে শুরু করেছে দ্রুত। পূর্ববাংলার অনেকেই বঙ্গভঙ্গ সমর্থন
করেছিলো। রাজনৈতিক আন্দোলনের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের
মানুষের মধ্যে একটা বিভাজন রেখা তৈরি হচ্ছিল। ব্রিটিশরা যেভাবেই পারে সাম্প্রদায়িক
উস্কানি দিচ্ছিলো তাদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির আলোকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিশ বছরের মধ্যেই একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী
দাঁড়িয়ে গেছে নিজস্ব আত্মপরিচয় ও স্বাদেশিক চেতনা নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য হিন্দু
ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস রূপান্তরিত হচ্ছিল ঘৃণায়। শুরুতে
বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে দাঙ্গা হচ্ছিলো। ১৯৪০-৪১ সালে এটা নিয়মিত ঘটনায় দাঁড়িয়ে
গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আর শান্তিপূর্ণ রইলো না।
১৯৩৮ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রফেসর সত্যেন বসুকে আহ্বান
করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে। তখন সত্যেন বসু ইতস্তত করছিলেন ঢাকা
ছেড়ে যেতে। তিনি তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানের প্রসঙ্গে অনেকগুলো শর্ত
দিয়েছিলেন এমনভাবে যেন ভিসি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বুঝতে পারেন যে তাঁর ইচ্ছে নেই
যাওয়ার। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি স্যার আশুতোষ মুখার্জির ছেলে। সে হিসেবে তাঁদের
পারস্পরিক সম্পর্কটা ছিল খুবই শ্রদ্ধার। সত্যেন বসু শর্ত দিয়েছিলেন তাঁকে স্থায়ী
পদ দিতে হবে, ঢাকায় যা বেতন পান তা দিতে হবে এবং মাসে ১৫০১ রুপি ঘরভাড়াও দিতে হবে
- কারণ কলকাতায় খরচ ঢাকার চেয়েও বেশি। সত্যেন বসু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে
লিখেছিলেন:
Physics
Laboratory
Dacca University
Dated, Ramna,
the 28th January 1938
My
dear Mr. Mookerjee,
Thank
you very much for your kind enquiry. I hope you will understand how difficult
it is for me to make up my mind finally in the matter, especially as I do not
as yet know the conditions under which the post may be offered. I hold a
permanent appointment as the head of the Department of Physics here, and I feel
it will not be wise for me to go in for change at this age, and accept any
offer which does not mean the same security of tenure, and at least the same
facilities for work. At the same time the prospect of being able to be of some
service to my own Alma Mater has a great attraction for me. If she thinks my presence
in Calcutta will be of some use to her, I feel it will be difficult for me to
resist her demands. If it be possible for the Governing Body of the Palit Trust
to offer me the same salary as I am drawing now, with an additional house
allowance of say about Rs 1501- I may accept the offer. I mention the
additional house allowance, as I fear Calcutta will be a very much more
expensive place to live in than Dacca.
I hope
this will help you in arriving at a definite decision. With kindest regards,
I
remain
Yours
sincerely
S.N.Bose
কিন্তু ১৯৩৮ সালে সত্যেন বসু যেভাবে ভেবেছিলেন পরিস্থিতি সেরকম রইলো না। দিনে দিনে ঢাকার অবস্থা এত খারাপ হচ্ছিলো যে
তাঁর এবং তাঁর পরিবার ঢাকায় আর নিরাপদ মনে করছিলেন না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের
দাবি উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই চলে
যাচ্ছিলেন কলকাতার দিকে। সত্যেন বসুকেও তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই
বোঝাচ্ছেন তাঁর কলকাতায় ফিরে যাওয়া উচিত।
এর মধ্যেই ১৯৪২ সালে
ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সাব-কমিটির সদস্য মনোনীত
হয়েছেন। পরের বছর বাংলার প্রাদেশিক সরকারের ওয়েট্স অ্যান্ড মেজার্স কমিটির
চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। পরের দু'বছরে সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন এবং বেঙ্গল
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ কমিটির মেম্বার নিযুক্ত হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের
পথে। বিশ্বযুদ্ধের পরেই ব্রিটিশ সরকারের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিয়ে দেবে ভারত ও
পাকিস্তান এই দুটো রাষ্ট্রে ভাগ করে। ঢাকা হবে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। ইতোমধ্যে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে 'খয়রা অধ্যাপক' বিধুভূষণ রায়ের
মৃত্যুতে পদটি খালি হয়। সত্যেন বসুকে সেই পদে যোগ দেয়ার আহ্বান করা হয়। সত্যেন বসু
রাজি হয়ে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ সত্যেন বসুকে কিছুতেই হারাতে চায়নি। সেই সময় ভিসি ছিলেন ডক্টর মাহমুদ
হাসান। তিনি সত্যেন বসুর অবসরের তারিখ পিছিয়ে দেয়াসহ মাসিক ১৫০০ রুপি বেতনের
প্রস্তাব দেন। কিন্তু সত্যেন বসু তো টাকার জন্য ঢাকা ছাড়ছেন না। দেশ যে ভাগ হয়ে
যাচ্ছে - এ সমস্যার সমাধান তো তাঁর হাতে নেই।
[1] Susil Chandra Biswas and S. N.
Bose, Measurements of the Decomposition Voltage in Non-aqueous Solvents, English translation of Z Phys Chem 125, pp. 442- 451,1927 (Johnson
Reprint Corporation, NY).
[2] S. N.
Bose and S. K. Mukherjee, Beryllium Spectrum in the Region l = 3367-1964. Phil Mag Ser 7,7, pp. 197-200,1929 (Taylor and Francis,
London).
[3] Kameshwar C
Wali, Chandra: a biography of S Chandrashekhar, Penguin Books, Delhi
1991, p. 260.
[4] কে এস
কৃষ্ণান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন প্রদীপ দেবের "উপমহাদেশের
এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী", মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬।
[5] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, 'পুরনো দিনের স্মৃতি', জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অক্টোবর, ১৯৬৬। রচনা সংকলন,
বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃষ্ঠা ২২৭-২২৮।
[6] ড. কাজী
মোতাহার হোসেন, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে যেমন দেখেছি, ত্রৈমাসিক
লোকসাহিত্য পত্রিকা, ১৯৮৫। সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্মারকগ্রন্থে পুনপ্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪২-৪৩।
[7] S. N. Bose and S. R. Khastgir,
Anomalous Dielectric Constant
of Artificial Ionosphere, Sci. & Cult. 3, pp. 335-337 (1937).
S. N.
Bose, On the Total Reflection of Electromagnetic Waves in the Ionosphere, Ind. J. Phys. 12, pp.
121-144 (1938).