তৃতীয় অধ্যায়
উচ্চ মাধ্যমিক
মাধ্যমিক পর্যন্ত সবাইকে সব সাবজেক্ট পড়তে হতো সেই সময়। সায়েন্স আর্টস কমার্স ইত্যাদি গ্রুপ ভাগ হতো উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে ওঠার পর। সত্যেন্দ্রনাথ মাধ্যমিকে সংস্কৃত, ইতিহাস আর ভূগোলে খুবই ভালো নম্বর পেয়েছেন। সাহিত্যেও চমৎকার দখল তার। ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করেছেন প্রাইভেট টিচারের কাছে। উচ্চ মাধ্যমিকে যেকোনো গ্রুপ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন সত্যেন। আগে থেকে ঠিক করে রাখেননি যে বিজ্ঞান গ্রুপে পড়বেন।
সেই সময়টা ছিল বড় অস্থির। ১৯০৫ সালে
বঙ্গভঙ্গ আইন পাস হয়েছে। ইংরেজরা আইন করে বাংলাকে দুই ভাগ করে ফেলেছে। প্রতিবাদে
ফুঁসছে সারা বাংলার ছাত্র-জনতা। স্বদেশী আন্দোলন বেগবান হচ্ছে দিনের পর দিন।
ছাত্ররা সবাই যে যেভাবে পারে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। ভালো ছাত্রদের সবাই বিজ্ঞান
নিয়ে পড়তে আগ্রহী কারণ বিজ্ঞান পড়লে প্রত্যক্ষভাবে স্বদেশীদের সাহায্য করা যাবে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে যাচ্ছে। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী
তরুণ ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। শহীদ ক্ষুদিরাম তখন তরুণ ছাত্রদের চোখে
বীর ক্ষুদিরাম। সেই সময় বোমা তৈরির কৌশল জানার জন্যেও অনেকে রসায়ন পড়ার দিকে
ঝুঁকেছিল।
সত্যেন বসুর প্রতি তার বাবার কড়া
নির্দেশ ছিল যেন স্বদেশীদের সাথে না মেশে। সুরেন্দ্রনাথ বসু যে স্বদেশী আন্দোলন
সমর্থন করতেন না তা নয়। অন্য সব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের মতো তিনিও চাইতেন
স্বরাজ আসুক। অন্যের ছেলেরা আন্দোলন করে বিজয়ী হলে সেই আন্দোলনের ফসল নিজেও ভোগ
করবেন, কিন্তু নিজের ছেলেকে আন্দোলনে যোগ দিতে দেবেন না। সত্যেন বসু বাবার এই
নির্দেশ মেনে চলেছেন। তাই তিনি তাঁর নিজের ক্লাসের অন্য যারা স্বদেশীদের সাথে
সংযুক্ত তাদের কাছ থেকে কৌশলে দূরে থাকেন। বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ থেকে তিনি
বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই বছর তার
সাথে আরো অনেক ভালো ভালো ছাত্র ভর্তি হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজে। গিরিডি থেকে
এসেছেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বর্ধমান থেকে এসেছেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি।
সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই সতীশচন্দ্র বসু ছিলেন সত্যেন বসুর ক্লাসমেট। সত্যেন বসুর
বন্ধুত্ব ছিল শুধুমাত্র কলকাতার ছেলেদের সাথে। তাও যারা সক্রিয় স্বদেশী তাদের কাছ
থেকে দূরে থাকতেন তিনি।
চিত্র: প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র সত্যেন বসু (১৯১০-১১) |
কলেজে সত্যেন
বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হলো সহপাঠী মানিকলালের সাথে। মানিকলাল দে'র বাড়ি ছিল
সত্যেনদের বাড়ির কাছে বিডন স্ট্রিটে। সময় পেলেই সত্যেন মানিকলালদের বাড়িতে গিয়ে
ক্যারাম অথবা দাবা খেলতেন। খেলাধুলা যা করতেন সবই বুদ্ধিমত্তামূলক ইনডোর গেম।
দৌড়ঝাপ, ফুটবল কিংবা ক্রিকেট - যেখানে শারীরিক দক্ষতা দেখানোর দরকার হয় সেসব তিনি
কখনো খেলেছেন বলে জানা যায়নি। দাবা খেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতো অনেকসময়।
তারপর রাত জেগে পড়তেন সত্যেন। সেই সময় কেরোসিনের বাতির টিমটিমে আলোয় পড়তে পড়তে
চোখের অবস্থা অনেকটা খারাপ হয়ে যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন খ্যাতনামা সব
শিক্ষকের মেলা। রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পদার্থবিজ্ঞান
বিভাগে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, এবং সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র। গণিতে ডি এন মল্লিক,
শ্যামাদাস মুখার্জি এবং সি ই কুলিস। ইংরেজি বিভাগে ছিলেন মনমোহন ঘোষ, এইচ এম
পার্সিভ্যাল, এবং পি সি ঘোষ।
ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স,
ইংলিশের পাশাপাশি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ফিজিওলজি নিয়েছিলেন সত্যেন বসু। ফিজিওলজির
প্রফেসর ছিলেন সুবোধ মহলানবিশ। পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ছিলেন সুবোধ
মহলানবিশের ভাইপো। প্রশান্তচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যেন বসুর সিনিয়র ছিলেন।
ফাইনাল পরীক্ষায় ফিজিওলজিতে সত্যেন বসু ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বর পেয়েছিলেন।
ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন
সত্যেন বসু। ইংরেজির অধ্যাপক পারসিভ্যাল সত্যেন বসুর মধ্যে 'অরিজিনালিটি' দেখতে
পেয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, 'দিস বয় ইজ এ জিনিয়াস'। পরবর্তীতে সারা পৃথিবী
জেনেছে যে সত্যেন বসু একজন জিনিয়াস।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইন্টারমিডিয়েটে
ক্লাস নিতেন না। ইতোমধ্যেই তিনি বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবদান রেখে বিখ্যাত হয়ে
গেছেন। সত্যেন বসু যে বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন সেই ১৯০৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানে
নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে বেতার টেলিগ্রাফের জন্য। জগদীশচন্দ্র বসুকে বাদ দিয়ে
নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে গুগলিয়েলমো মার্কনি ও কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রাউন-কে। সে
কারণে বাংলার বিজ্ঞানীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সত্যেন বসু স্যার জগদীশচন্দ্র
বসুর কাছে পড়ার সুযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। সত্যেন
বসু জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে:
"১৯০৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়া স্থির করিলাম বিজ্ঞান পড়িব। জগদীশচন্দ্রের
আবিষ্কারের কাহিনী তখন বাংলা সাময়িকীতে প্রায়ই ছাপা হয়। জড়ের মধ্যে প্রাণশক্তির
অস্তিত্ব তিনি পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রমাণ করিয়াছেন। সে কাহিনীর প্রচার শুধু আমাদের
দেশে নহে, অধ্যাপক নিজে গিয়া দেশ-বিদেশে সুধীমন্ডলীর কাছে পেশ করিয়াছেন এবং
তাঁহারা সম্ভ্রমের সহিত তাহা শুনিয়াছেন।
প্রেসিডেন্সি
কলেজে ঢুকিলে প্রথমেই এক কাচের ঘর নজরে পড়ে। তাহার মধ্যে রহস্যময় যন্ত্রপাতি লইয়া
আচার্য জগদীশচন্দ্র গবেষণা করেন। কিশোর মনের বাসনা - এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর
কাছে বিজ্ঞান শিক্ষা করিতে পারিলে জীবন ধন্য হইবে।
একতলার আরেক দিকে আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্র রাসায়নিক গবেষণায় মগ্ন। এই দুই আচার্যের পায়ের কাছে বসিয়া
বিজ্ঞানের প্রথম পরিচয় শুরু হইবে - এই আশায় আমার মতো বহু ছাত্র তখন প্রেসিডেন্সি
কলেজে পড়িতে আসিল। প্রথম বৎসরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে রসায়ন শিক্ষার
সৌভাগ্য হইল। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের
কাছে পড়িবার সুযোগ আসিল আরও দুই বৎসর বাদে।"[1]
ক্লাসে মাঝে মাঝে টুকটাক দুষ্টুমি করতেন সত্যেন বসু। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র
রায় ইন্টারমেডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার থেকেই কেমিস্ট্রির ক্লাস নিতেন। তাঁর ক্লাসে একদিন
দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা পড়লেন সত্যেন বসু। আচার্য রায় অভিনব শাস্তি দিলেন তাকে।
আদেশ দিলেন কেমিস্ট্রি ক্লাসে তাকে বসতে হবে বক্তৃতা মঞ্চের রেলিং-এর উপর। সত্যেন্দ্রনাথ
বসু 'আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্মরণে' প্রবন্ধে লিখেছেন:
"ডাক্তার রায় তখন প্রথম বছর থেকেই ইন্টারের ছাত্রদের রসায়ন পড়াতেন।
পুরনো বাড়ীর দোতলায় উত্তর-পূর্ব কোণে গ্যালারীতে ক্লাস বসতো। সেখানে অনেক সময় অন্য
কলেজের ছাত্রেরাও এসে জুটতো ডাঃ রায়ের বক্তৃতা শুনতে। সরল ইংরেজিতে বক্তৃতা,
বাগ্মিতার কোন চেষ্টা ছিল না - বরং নানা কথা বলে হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ডাঃ রায়
চাইতেন, রসায়নের মূল কথা যাতে ছাত্রদের মনে গেঁথে যায়।
সে সময়ের হাবভাব ও
অঙ্গভঙ্গী, তাঁর কাছে যারা রসায়ন পড়েছে, তাদের চিরকাল মনে থাকবে। আণবিক আকর্ষণ বোঝাতে
গিয়ে তিনি পাশের সীতারাম বেয়ারাকে
জড়িয়ে ধরলেন - এই প্রকার আরও কত কি। এতে ক্লাশে মাঝে মাঝে হাসির অট্টরোল উঠতো,
তাতে তিনিও খুশী হতেন। গল্পচ্ছলে বলে যেতেন মহারথী বিজ্ঞানীদের কথা - লাভসিয়ার,
ডাল্টন, বার্জিলিয়স, পাস্তুর - আবার কখনো কখনো নাগার্জুনের নাম শোনা যেত। ভারতে
যারা অ্যালকেমীর চর্চা করতো, সে কথা শুনাতেন ছাত্রদের। পুরনো পুঁথির দু-চারটি
শ্লোক আওড়ালেন, আবার কখনও ইংরেজী সাহিত্য থেকে লম্বা উদ্ধৃতি হলো। এই সব মিলে সেই
২ বছরের ভাষণের স্মৃতি আমার মনের মধ্যে অপূর্ব আকার নিয়ে রয়েছে।
শান্তশিষ্ট সুবোধ বালকের
সুনাম কলেজে আমার ছিল না - তাছাড়া গুরুজনের
মুখের উপর প্রত্যুত্তর দেবার রোগে সারা জীবন ভুগছি। তাই কোনদিন বিশেষ কোন কারণে,
যা আমার এখন মনে নেই - ডাঃ রায়ের মনে হয়েছিল, ক্লাশের বক্তৃতা নিজে যথেষ্ট মনোযোগ
দিয়ে শুনছি না এবং নিকটের বন্ধুদেরও চিত্তবিক্ষেপ ঘটিয়েছি। তাতে আদেশ জারী হলো -
বক্তৃতার সময় সকলের থেকে পৃথক হয়ে বসতে হবে মঞ্চের রেলিং এর উপরে - সেখানে উপকরণ বোঝাই ক্লাসের টেবিল, যেখানে
গুরুদেব স্বয়ং দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন প্রত্যহ। শাস্তির ফল আমার পক্ষে ভালই দাঁড়িয়ে
গেল সবদিক থেকে। চোখ খারাপ, তাই কাছ থেকে এখন পরীক্ষাপর্বের প্রত্যেক অঙ্গটি
নিখুঁতভাবে দেখতে পেতাম। পিছনের খাস কামরায় আচার্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়
তখন ব্যাপৃত থাকতো যে সব
ছাত্রেরা, তাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও জমে গেল। নতুন
অনেক পরীক্ষার কথা শুনতাম, কার্যবিধি দেখতাম - অবশ্য ক্লাস শেষ হবার পরে।
সত্য বলতে কি, গুরুর
বিরাগভাজন হইনি কোনদিন - তাঁর সস্নেহ কিল
চড়-ঘুষি সর্বদাই জুটেছে!" [2]
১৯১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক
পাস করলেন সত্যেন বসু। সমগ্র বাংলায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানিকলাল দে। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান
অধিকার করেছেন যথাক্রমে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও প্রাণকৃষ্ণ পারিজা। যিনি তৃতীয় হয়েছেন
তার নামও আগে শোনেননি সত্যেন বসু কিংবা প্রেসিডেন্সি কলেজের কেউ। তিনি ঢাকা কলেজের
মেঘনাদ সাহা। বিএসসি ক্লাসে তার সাথে পরিচয় হবে সত্যেন বসুর।
উচ্চমাধ্যমিকে
পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলেন সত্যেন বসু। সেজন্য তিনি অর্জন করলেন
ডাফ স্কলারশিপ (Duff Scholarship)।
No comments:
Post a Comment