ষষ্ঠ অধ্যায়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম স্যেকুলার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পশ্চিমা ধারার মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানচর্চার সূচনা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেকগুলো স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজ স্থাপিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদান অর্থাৎ ক্লাস হতো এই কলেজগুলোতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার অধীনস্থ কলেজগুলোতে যে স্নাতকপর্যায়ে পড়াশোনা হয় তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতো। এভাবে চললো পঞ্চাশ বছর।
১৯০৬ সালে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ভিসি
হবার পর তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানোর জন্য বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার উদ্যোগ
নেন। বিজ্ঞান কলেজ স্থাপন করার জন্য অনেক টাকার দরকার। উপযুক্ত অধ্যাপক নিয়োগ করতে
হবে, গবেষণাগার স্থাপন করতে হবে। বিশাল অংকের টাকা এবং বিভিন্ন কাজের জন্য উপযুক্ত
মানুষ দরকার। স্যার আশুতোষ সেই সময়কার ধনী শিক্ষানুরাগী ভারতীয়দের কাছ থেকে টাকা ও
প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেষ্ট হলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতোষ। আর এই আট বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে
অনেকগুলো বিভাগ খুলতে সমর্থ হলেন তিনি।
চিত্র: স্যার আশুতোষ মুখার্জি |
১৯১৪ সালে
বিখ্যাত উকিল ও স্বদেশী আন্দোলনের নেতা তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষ
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ স্থাপনের জন্য প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা দান করলেন। সেই
টাকায় রাজাবাজারে প্রতিষ্ঠিত হলো বিজ্ঞান কলেজ। রাসবিহারী ঘোষের টাকায় 'ঘোষ
প্রফেসর' পদ সৃষ্টি হলো, আর তারকনাথ পালিতের টাকায় 'পালিত প্রফেসর'। রসায়ন বিভাগে
যোগ দিয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ
দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। গণিত বিভাগের 'ঘোষ প্রফেসর' হিসেবে যোগ দিয়েছেন
অধ্যাপক গণেশ প্রসাদ।
বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করার কিছুদিন পর
স্যার আশুতোষ মুখার্জির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নতুন ভিসি হিসেবে যোগ দেন দেবপ্রসাদ
সর্বাধিকারী। ভিসির পদ ছেড়ে দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ
কমিটিতে ছিলেন স্যার আশুতোষ। বিজ্ঞান কলেজের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক খুঁজে বের করার
দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন তিনি।
চিত্র: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজ |
বিগত কয়েক বছরের এমএসসি পরীক্ষায় যারা ভালো করেছে তাদেরকে প্রভাষক হিসেবে
নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছিলেন স্যার আশুতোষ। সেই সময় তাঁর ভাবনাকে আরো উসকে দিলেন
সত্যেন বসুর সাথে ফিজিক্স থেকে পাস করা শৈলেন ঘোষ।[1] প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করে অন্যান্যদের মতো তিনিও বেকার। কিন্তু
স্যার আশুতোষ মুখার্জির সাথে যোগাযোগ ছিল তাঁর। শৈলেন ঘোষ ছিলেন ফিজিক্সের ফার্স্ট
বয়। মাস্টার্সের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণা করেছিলেন
প্রফেসর হ্যারিসনের অধীনে। শৈলেন ঘোষ একদিন প্রফেসর হ্যারিসনকে বাধ্য করেছিলেন
ছাত্রদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে। প্রফেসর হ্যারিসন সেসব কিছুই মনে রাখেননি।
তিনি শৈলেন ঘোষের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। এমএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার
আগেই শৈলেন ঘোষের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান জার্নাল অব
অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে। মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন শৈলেন ঘোষ। স্যার
আশুতোষ মুখার্জি বাঙালি ছেলেদের গবেষণার খবর রাখতেন। শৈলেন ঘোষের গবেষণাপত্র তিনি
পড়েছিলেন এবং শৈলেন ঘোষকে ডেকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। শৈলেন ঘোষ স্যার আশুতোষের
সাথে দেখা করে অনুরোধ করলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের যে সব বিষয় পড়ানো হয় না
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সব বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা করতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
সায়েন্স কলেজ খোলার সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্সি
কলেজগুলো সরকারের অধীনে ভালোই চলছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স পড়ানো শুরু
হলে প্রেসিডেন্সি কলেজের আধিপত্য কমে যাবে, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় সরকারের আধিপত্য
খর্ব হবে। কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশিরভাগই স্বদেশী ভাবধারায়
উদ্বুদ্ধ। তাছাড়া সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা টাকা দিচ্ছেন তাঁরা শর্ত
জুড়ে দিয়েছেন যে তাঁদের টাকায় কেবল ভারতীয়দেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে।
স্যার আশুতোষের পরিকল্পনা তো ছিলই - তরুণ শৈলেন ঘোষের কথায় তাঁর পরিকল্পনায় গতি
সঞ্চারিত হলো। তিনি শৈলেন ঘোষের মাধ্যমে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুকে ডেকে পাঠালেন।
স্বয়ং আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে ডাক পেয়ে কিছুটা ভীত ও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লেন মেঘনাদ ও সত্যেন বসু। সে প্রসঙ্গে সত্যেন বসু লিখেছেন:
"খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পাশে লাইব্রেরিঘরে স্যার আশুতোষের খাস-কামরায় হাজির হলাম
- আমি, মেঘনাদ, শৈলেন - অবশ্য ভয়ে ভক্তিতে সকলেই বিনীত নম্র - একেবারে গোবেচারী
ভাব। আশুতোষ শুনেছেন নব্যেরা চাচ্ছে নতুন নতুন বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান হোক।
জিজ্ঞেস করলেন, 'তোরা কী পড়াতে পারবি?'
'আজ্ঞে, যা বলবেন, তাই
যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।'"[2]
বিংশ শতাব্দীর শুরুর সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলো নতুন শাখা বিস্তার
লাভ করতে শুরু করেছে। কোয়ান্টাম থিওরি, নিউক্লিয়ার থিওরি, রিলেটিভিটি,
রেডিওঅ্যাক্টিভিটি, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স সবকিছুই একসাথে বিকশিত হচ্ছে ইওরোপে। কিন্তু
ভারতবর্ষের কোথাও এইসব নতুন তত্ত্ব পড়ানো শুরু হয়নি। স্যার আশুতোষ নিজে গণিতের
পন্ডিত। তিনি নিজের আগ্রহেই খবর রাখেন বিজ্ঞানের কী কী অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু তাঁর
জানা দরকার এই সদ্য পাস করা তরুণরা কী কী পড়াতে পারবে। তারা যখন বললো যে যা পড়াতে
বলা হবে, তাই তারা পড়াতে চেষ্টা করবে - তিনি খুশি হয়ে গেলেন। চাকরির ব্যবস্থা হয়ে
গেল। মাসিক বেতন ১২৫ রুপি।
১৯১৬ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন সত্যেন বসু ও
মেঘনাদ সাহা। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিলেন শৈলেন ঘোষ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে
তাঁদের আগে পাস করা শিশির কুমার মিত্রও যোগ দিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
হবার কোন পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও সুযোগ পাওয়ার পর সত্যেন বসু বুঝতে পারলেন
অধ্যাপনা ও গবেষণাই হবে তাঁর কাজ। কাজ শুরু করার জন্য ডিপার্টমেন্টে গিয়েই
মুখোমুখি হতে হল প্রফেসর গণেশপ্রসাদের।
গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গণেশপ্রসাদ
বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঘোষ প্রফেসর'। জার্মানির প্রফেসর ক্লাইনের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি
করে এসেছেন। বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছেন
স্যার আশুতোষ। কিছু কিছু মানুষের প্রবণতা থাকে নিজেকে খুবই বড় মনে করা। নিজেকে বড়
ভাবার পাশাপাশি তারা অন্যকে ছোট ভাবতে এবং ছোট করতে পছন্দ করেন। অধ্যাপক গণেশপ্রসাদ
ছিলেন সেরকম একজন। তাঁর নামডাক শুনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাস করা অনেক ছাত্র
তাঁর কাছে এসেছিলেন উচ্চতর গবেষণা করার ইচ্ছায়। এই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ভালো
ছাত্রদের উদ্ভট অপ্রাসঙ্গিক জটিল প্রশ্ন করে অপদস্থ করতেন গণেশ প্রসাদ আর বলতেন যে
প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকরা কিছুই জানেন না বলেই সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস
পাওয়া ছেলেরাও কিছু জানে না। কোথাও চাকরি না পেয়ে সত্যেন বসুও গিয়েছিলেন অধ্যাপক
গণেশ প্রসাদের কাছে গবেষণা করার জন্য। যে সত্যেন বসু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কোন
পরীক্ষাতে সেকেন্ড হননি তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিলেন গণেশ প্রসাদ। সেই অপমান
নিরবে সহ্য করেছিলেন সত্যেন বসু। কিন্তু গণেশ প্রসাদ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের
সম্পর্কে বাজে কথা বলতে শুরু করলেন তখন আর সহ্য করতে পারেননি। প্রতিবাদ করে চলে
এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন সত্যেন বসু জানতেন না যে বছর খানেক পরে গণেশ প্রসাদের
ডিপার্টমেন্টেই তাকে যোগ দিতে হবে।
মেঘনাদ সাহা আগে গণেশপ্রসাদের কাছে না
গেলেও সত্যেন বসুর বন্ধু এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হওয়ার কারণে গণেশপ্রসাদের
আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হলেন। গণেশপ্রসাদের কারণে কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়লো তাঁদের।
অধ্যাপক গণেশপ্রসাদ মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুকে যখন-তখন অপমান করেন। বলেন, ‘পরীক্ষায় অনেক
অনেক নম্বর পেয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর যোগ্যতা হয়ে যায় না
কারো। আশুবাবু কিছু না বুঝেই দুটো বাচ্চা ছেলে ধরে এনেছেন’।
এত অপমান সহ্য করা যায় না। সত্যেন্দ্রনাথ
ও মেঘনাদ আবার গেলেন স্যার আশুতোষের কাছে। সব শুনে তিনি বললেন পদার্থবিজ্ঞান
বিভাগে যোগ দিতে। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ যোগ দিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে
তাঁদের আগে যোগ দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র।[3]
পদার্থবিজ্ঞানের অনার্স বা মাস্টার্স না
হয়েও পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হয়ে বিরাট দায়িত্বের মুখোমুখি পড়ে গেলেন
সত্যেন্দ্রনাথ। প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিলেন, তবে খুব
বেশি নয়। এখন পড়তে পড়তে শিখতে শিখতে পড়াতে হবে। তখনো মাস্টার্সে ছাত্রভর্তি হয়নি।
প্রস্তুতির জন্য বছরখানেক সময় পাওয়া গেল। শক্ত গাণিতিক বুনিয়াদ তো আগেই ছিল - এখন
পদার্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করতে তেমন কোন অসুবিধে হলো না।
অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার বলতে তেমন কিছুই শুরুতে ছিল না। তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় সবচেয়ে বড় গবেষণাগার হিসেবে কাজ করেছে প্রেসিডেন্সি
কলেজের লাইব্রেরি।
পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে
কাজ চলছে ইওরোপে। বিশেষ করে জার্মানিতে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি রচিত হচ্ছে।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে ১৯১৬ সালে।[4]
মেঘনাদ সাহার উপর ভার পড়লো
কোয়ান্টামতত্ত্ব পড়ানোর। আর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উপর ভার পড়লো আইনস্টাইনের থিওরি অব
রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পড়ানোর। তাঁরা দুজনই স্বীকার করে এসেছেন যে এক
বছরের মধ্যে তৈরি হবেন। কিন্তু বই কোথায় পাওয়া যাবে? রিলেটিভিটির কিছু বই ইংরেজিতে
ছিল। সেগুলো জোগাড় করা গেল। কিন্তু বোল্টজম্যান, কার্শফ, প্ল্যাংক - এঁদের
গবেষণাপত্র জার্মান ভাষায় লেখা। কোথায় পাওয়া যাবে সেসব লেখা? হঠাৎ সত্যেন বসুর মনে
পড়লো ড. ব্রুহলের (Bruhl) কথা।
ড. ব্রুহল তখন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে
পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। সেখানে ব্রুহলের ল্যাবে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে যা
প্রেসিডেন্সি কলেজেও নেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে যারা ফিজিক্সে মাস্টার্স পড়তেন -
তাদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেয়ার জন্য যেতে হতো শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং
কলেজে। প্রফেসর ব্রুহল অস্ট্রিয়াতে থাকতে ছিলেন উদ্ভিদবিদ্যার কৃতী ছাত্র। কিন্তু
সেখানে অসুস্থ হয়ে তাঁর ফুসফুসে প্রদাহ হয়ে গেল। ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন কিছুদিন
গরমের দেশে কাটিয়ে আসতে। একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে ব্রুহল বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন দেশের উদ্ভিদ ও গাছপালার বৈচিত্র্য
নিরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ ও নমুনা সংগ্রহ করতে করতে পৌঁছে যান দানিয়ুব নদীর তীরে। সেখান
থেকে তুর্কিদের শহর কনস্টান্টিনোপোল। পরে সাগর পার হয়ে এশিয়ায়। তুর্কি সাম্রাজ্য
পার হয়ে পারস্য দেশের মধ্যদিয়ে পৌঁছেছেন করাচি। সেখান থেকে স্টিমারে করে কলকাতা।
সেই সময় বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে অনেক ইওরোপিয়ান বিজ্ঞানী আসতো। ব্রুহল ভালোবেসে
ফেললেন কলকাতা, কলকাতার মানুষ। ভালোবেসে বিয়েও করে ফেললেন একটি বাঙালি মেয়েকে। তার
নিজের দেশের সরকার এতে রেগে গিয়ে তার স্কলারশিপ বাতিল করে দিল। তারপর ব্রুহল আর
নিজের দেশে ফিরে যাননি - এদেশেই রয়ে গেলেন। ব্রুহল ছিলেন আপাদমস্তক বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানের সব বিষয়েই পারদর্শী। ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে হয়ে
গেছেন ফিজিক্সের প্রফেসর। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল বিজ্ঞানের বইতে ভর্তি।
সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা প্রফেসর ব্রুহলের কাছ থেকে অনেকগুলো বই ধার নিয়ে এলেন
যেখানে ছিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও
রিলেটিভিটি থিওরি। জার্মানি থেকে ফেরার সময় দেবেন্দ্রমোহন বসুও কিছু বই
নিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের জন্য।[5] ম্যাক্স
প্লাংকের থার্মোডায়নামিক্সের বই, ব্র্যামস্টারলাং এক্স-রে সম্পর্কিত বই,
আইনস্টাইনের পেপার ইত্যাদি। ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে তরতাজা বিষয়গুলো
সম্পর্কে জানতে শুরু করলো সাহা ও বসুর কাছ থেকে।
১৯১৭ সালে
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন
সি ভি রামন। ১৯০৭ থেকে তিনি ইন্ডিয়ান ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসে কাজ করার পাশাপাশি
ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স-এ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের এত বড় চাকরি ছেড়ে
অর্ধেকেরও কম বেতনের প্রফেসর পদে যোগ দিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার
আগে থেকেই সি ভি রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য দক্ষিণ ভারতের অনেক ছাত্র
কলকাতায় চলে আসতে শুরু করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ
কেউ রামনের কাছে গবেষণার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন।
মেঘনাদ সাহাও আগ্রহী হয়ে গিয়েছিলেন
রামনের কাছে। কিন্তু পরীক্ষামূলক কাজে মেঘনাদের দক্ষতা নেই দেখে রামন তাঁকে মুখের
উপর বলে দিয়েছেন যে তাঁর দ্বারা পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞান হবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে
এসেছেন মেঘনাদ। সত্যেন বসুও আর গেলেন না রামনের দিকে। মেঘনাদের সাথে তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা শুরু করলেন। সত্যেন বসুর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯১৮
সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে মেঘনাদ সাহার সাথে যৌথভাবে।[6]
পরের বছর কলকাতা ম্যাথমেটিক্যাল
সোসাইটির বুলেটিনে আরো দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন সত্যেন বসু। এই দুটো
গবেষণাপত্র ছিল বিশুদ্ধ গাণিতিক সমস্যা সংক্রান্ত।[7]
১৯১৭-১৮ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার
বিশেষ তত্ত্ব, সার্বিক তত্ত্বসহ ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রধান
গবেষণাপত্র মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজ সম্পন্ন করলেন মেঘনাদ সাহা
ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রিন্সিপল্স
অব রিলেটিভিটি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয় এ অনুবাদ। বইয়ের ভূমিকা
লিখেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। এই বই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সর্বপ্রথম
ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭৯ সালে
আইনস্টাইনের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয় যে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম
অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী
চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান। তিনি জানতেন সাহা ও বসুর অনুবাদের কথা। তিনি
বিজ্ঞানীদের জানালেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসুর অনুবাদের কথা। সুব্রাহ্মনিয়ানের
চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পাওয়া গেলো। সাহা ও বসুর
অনুবাদ এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে রাখা আছে। এই অনুবাদের
মাধ্যমেই আইনস্টাইনের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয় সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের।
১৮৫ পৃষ্ঠার এই অনুবাদ-বইতে ১৯০৫ সালে
প্রকাশিত আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি'র প্রথম পেপার, ১৯০৯ সালে প্রকাশিত
মিনকাউস্কির পেপার মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মেঘনাদ সাহা। ১৯১৬ সালে
প্রকাশিত আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি পেপার মূল জার্মান থেকে
ইংরেজিতে অনুবাদ করেন সত্যেন বসু।
সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহার অনুবাদ বইটি
বিশ্বে ঐতিহাসিকভাবে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম ইংরেজি অনুবাদ হলেও এর গুণগত মান
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ব্রিটিশ গবেষকরা। ১৯২২ সালে বিখ্যাত ন্যাচার জার্নালে এই
অনুবাদের সমালোচনা করা হয় এভাবে:[8]
The translation cannot be called a good one. In a work this kind we expect a fairly literal
translation, but in the present book there are numerous errors in translation, and the choice of English equivalents for German words in frequently unfortunate. In many
instances the mathematics is faultily reproduced. The numbering of the pages is not
continuous, but recommences at the beginning of section 4, and the omission of the footnotes from the
originals is regrettable. Provided it is studied with care, the translation will nevertheless be of service to those who are unfamiliar with German, and
wish to grapple with the pioneer works on this subject, some of which are rather inaccessible.
সত্যেন বসুর
তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতে হতে মেঘনাদ সাহা ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস জমা দিয়েছেন ডক্টর অব সায়েন্স (ডিএসসি) ডিগ্রির জন্য। ১৯১৮
সালে মেঘনাদ ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করার পর ইওরোপে পড়াশোনা করার জন্য 'প্রেমচাঁদ
রায়চাঁদ স্টুডেন্টশিপ' এবং 'গুরুপ্রসন্ন ঘোষ' বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৯ সালে ইওরোপে
চলে গেলেন মেঘনাদ সাহা। ফিজিক্সের শৈলেন ঘোষ 'পালিত স্কলারশিপ' নিয়ে চলে গেছেন
আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। কেমিস্ট্রির জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ
মুখার্জিও 'পালিত স্কলারশিপ' নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে ইওরোপ গেছেন। যোগেশ মুখার্জিও
পেলেন সেই বৃত্তি।
সত্যেন বসুর
বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন থেকে। অনেকেই যখন স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন
ভাবলেন তিনিও তো একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তিনি ভাবলেন বৃত্তিটা পেলে ভালো
হয়, বিদেশ যাওয়াও হয় আর উচ্চশিক্ষাও হয়। স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছে এই কথা
তুলতেই তিনি হেসে বললেন, “বিয়ে করেছো যে।"
ব্যাচেলর
ছাত্র-গবেষকদের জন্যই ‘পালিত স্কলারশিপ’। তারকনাথ
পালিত - যিনি এই বৃত্তিটা চালু করেছিলেন, ভাবতেন বিবাহিত ছাত্ররা বৃত্তির টাকায়
বিদেশে গেলে সব টাকা পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে খরচ করবে না। টাকা জমিয়ে দেশে পাঠাবার
চেষ্টা করবে, স্ত্রী ও সন্তানদের মনোরঞ্জন করতে চাইবে। তাই তিনি বিবাহিতদের ‘পালিত
স্কলারশিপ’ পাবার অনুপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই এখানেও ব্যর্থ
হলেন সত্যেন বসু।
চিত্র: ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহা ইংল্যান্ডে যাবার আগে বিজ্ঞান কলেজে তোলা ছবি।
(বাম থেকে ডানে) দাঁড়ানো: এইচ মিত্র, জি দত্ত, ডি ডি ব্যানার্জি, এস কে মিত্র, এস কে আচার্য, এ সি সাহা, এ এন মুখার্জি, বি বি রায়। বসা: এস এন বোস, পি এন ঘোষ, সি ভি রামন, এম এন সাহা, ডি এম বসু, বি এন চক্রবর্তী, জে সি মুখার্জি। |
মেঘনাদ সাহা ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইওরোপে যাওয়ার আগেই সত্যেন বসুর
সাথে আরেকটি গবেষণাপত্রের কাজ শেষ করে গিয়েছিলেন। ১৯২০ সালে ফিলোসফিক্যাল
ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সেই গবেষণাপত্র On The
Equation of State.[9] ১৯২০
সালে সত্যেন বসুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য পেপার প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল
ফিলোসফিক্যাল জার্নালে। On the Deduction of Rydberg's Law from the Quantum Theory of
Spectral Emission গবেষণাপত্রটি[10] ইওরোপিয়ান বিজ্ঞানীদের
নজর কাড়ে।
কিন্তু
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে খুব একটা ভালো লাগছিল না সত্যেন
বসুর। তাঁর সাথে যারা ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন সবাই কোন না কোন স্কলারশিপ নিয়ে
বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করছে। সিভি রামনের নেতৃত্বে প্রচুর গবেষক ছাত্র এসে ভীড় করছে
সারা দেশ থেকে। ল্যাবোরেটরিতে জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। তাছাড়া স্যার আশুতোষ
মুখার্জির সাথেও সামান্য ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা দিয়েছে। আশুতোষ মুখার্জি
গণিতজ্ঞ। মাস্টার্স পরীক্ষার একটা পেপারের প্রশ্নপত্র সেট করেছিলেন তিনি। সেই
প্রশ্নের কেউই উত্তর দিতে পারেনি। তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন
শিক্ষার্থীদের মান সম্পর্কে এবং প্রশ্ন তুলেছিলেন শিক্ষকদের পাঠদান সম্পর্কে। সত্যেন
বসু স্যার আশুতোষ ব্যানার্জির মুখের উপর বলেছিলেন যে তাঁর সেট করা প্রশ্নটি ভুল
ছিল। তাই ওটার সমাধান কেউ করতে পারেনি। সত্যেন বসু ঠিকই বলেছিলেন। স্যার আশুতোষও
নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে সত্যেন বসুকে কিছু না বললেও সত্যেন
বসুর মনে হচ্ছিল কোথাও যেন তাল কেটে গেছে। অন্য কোথাও চলে যাবার সুযোগ খুঁজছিলেন
সত্যেন বসু। সেই সুযোগ এসে গেল। নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেলেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন সত্যেন বসু।
[1] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃ: ২৩৪-৩৫।
[2] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, আমার বিজ্ঞানচর্চার পুরাখন্ড, সাপ্তাহিক বসুমতী (শারদীয়), ১৩৭৪। বঙ্গীয়
বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত 'সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন'-এ পৃষ্ঠা ২৩৪।
[3] দেবেন্দ্রমোহন
বসু ও শিশিরকুমার মিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন প্রদীপ দেবের 'উপমহাদেশের
এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী', মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪।
[4] প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৬,
২০১২।
[5] D. M. Bose, Meghnad
Saha Memorial Lecture, 1965.
Proceedings of the National Institute of Sciences of India, 1967.
33A(3 & 4): p. 111-132.
[6] Megh Nad
Saha and Satyendra Nath Basu, On the Influence
of the Finite Volume of Molecules on the Equation
of State, Phil. Mag. Ser. 6, 36,
pp. 199-203 (1918).
[7] Satyendranath
Basu, The Stress-Equations of Equilibrium, Bull Cal Math Soc 10, pp.
117-121, (1919) (Calcutta Mathematical Society).
Satyendranath Basu, On the Herpolhode, Bull.
Cal. Math. Soc. 11, pp. 21-22 (1919).
[8] Nature, Volume 110, 26 August 1922, London.
[9] M. N. Saha and S. N. Basu, On
The Equation of State, Phil. Mag. Ser.
6, 39, p. 456 (1920).
[10] S. N. Basu, On the Deduction of Rydberg's Law
from the Quantum Theory of Spectral Emission, Phil. Mag. 40, pp. 619-627
(1920).
No comments:
Post a Comment