দ্বাদশ অধ্যায়
আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের 'খয়রা প্রফেসর' পদে যোগ
দিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। 'খয়রা প্রফেসর' পদটি সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯২১ সালে। স্যার আশুতোষ
মুখোপাধ্যায় ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রথমবার ভিসি থাকাকালীন সায়েন্স কলেজ স্থাপন
করেছিলেন। তারপর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি যখন
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন তখন খয়রার রাজা কুমার গুরুপ্রসাদ সিং-এর
বিরুদ্ধে তাঁর রানি বাগেশ্বরী দেবীর মামলার নিষ্পত্তি হয় ছয় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের
মাধ্যমে। রানি বাগেশ্বরী টাকাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। স্যার
আশুতোষ মুখার্জি ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে আবার
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দিয়ে ওই টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে
‘খয়রা প্রফেসর’ পদ সৃষ্টি করেন।
১৯২১ সালে সত্যেন বসু কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন দুই যুগ পর।
ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে ডিপার্টমেন্টে। গবেষণা কাজ অনেক বেড়েছে। ১৯৩০ সালে
সিভি রামনের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
আন্তর্জাতিকভাবে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। রামন কলকাতা ছেড়ে চলে গেছেন ব্যাঙ্গালোরে।
তাঁর ছাত্ররা যারা এখন শিক্ষক ও গবেষক, তাঁর শব্দবিজ্ঞানের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর আলোকবিজ্ঞানে রামন ইফেক্ট সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে
যাচ্ছেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্স বা কাল্টিভেশান
সেন্টারে। প্রফেসর দেবেন্দ্রমোহন বসু 'পালিত অধ্যাপক' পদে রামনের স্থলাভিষিক্ত
হয়েছেন। তিনি ম্যাগনেটিজম ও অ্যাটমিক ফিজিক্সে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রফেসর
শিশিরকুমার মিত্র বেতারতরঙ্গের উপর কাজ করছেন। মেঘনাদ সাহা ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ
ইউনিভার্সিটি থেকে কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছেন। তিনি এখন নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের গবেষণায় ব্যস্ত। চেষ্টা করছেন আলাদা একটি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউট
প্রতিষ্ঠা করতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ডিপার্টমেন্টে একই সাথে কাজ শুরু
করেছিলেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু সেই ১৯১৭ সালে। আটাশ বছর পর আবার তাঁরা দু'জন
একই ডিপার্টমেন্টে একই সাথে কাজ করছেন। দু'জনের জন্যই ব্যাপারটা খুব আনন্দের।
সেই সময় রিসার্চ গ্রান্ট বরাদ্দ ছিল
খুবই সামান্য। প্রতিজন প্রফেসর বছরে মাত্র ২৫০০ রুপি পেতেন গবেষণা পরিচালনার জন্য।
লেকচারাররা পেতেন বছরে মাত্র ১০০০ রুপি। এই সামান্য বরাদ্দ নিয়েও তাঁরা চেষ্টা করে
যাচ্ছিলেন উন্নতমানের গবেষণা চালিয়ে যাবার। সরকারের বোর্ড অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ থেকে রিসার্চ গ্রান্ট পাবার জন্য আবেদন করেও কিছু কিছু
গ্রান্ট পাওয়া যেতো।
'খয়রা প্রফেসর' হিসেবে 'খয়রা
ল্যাবরেটরি' পরিচালনার দায়িত্ব সত্যেন বসুর। তিনি তাঁর ল্যাবরেটরিকে একটি
প্রাণবন্ত গবেষণা-কেন্দ্রে পরিণত করলেন কিছুদিনের মধ্যেই। ফিজিক্সে ছাত্র-শিক্ষকরা
তো বটেই, অন্যান্য বিভাগের গবেষকরাও ভীড় করতেন খয়রা ল্যাবে প্রফেসর সত্যেন বসুর
সাথে আলাপ করার জন্য। সত্যেন বসু যে একজন জীবন্ত 'এনসাইক্লোপিডিয়া' তা সবাই জেনে
গেছেন।
তখন খয়রা
ল্যাবে সত্যেন বসুর দু'জন গবেষক-ছাত্র ছিলেন হর্ষনারায়ণ বসু ও কমলাক্ষ্য দাসগুপ্ত।
হর্ষনারায়ণ সলিড স্টেট ফিজিক্সে গবেষণা করে খড়গপুর আইআইটিতে যোগ দিয়েছিলেন। আর
কমলাক্ষ্য দাসগুপ্ত এক্স-রে স্ক্যাটারিং-এ গবেষণা করে পরে যোগ দিয়েছিলেন টেক্সাসের
অস্টিন ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকা থেকে চলে আসার সময় ঢাকায় যে গবেষক-ছাত্র ছিলেন,
শিবব্রত ভট্টাচার্য, তিনিও কলকাতায় চলে আসেন। সত্যেন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের গম্ভীর আবহাওয়াকে বেশ প্রাণবন্ত করে তুললেন কিছুদিনের
মধ্যেই।
চিত্র: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা ল্যাব (১৯৪৫) |
প্রফেসর দেবেন্দ্রমোহন বসু, শিশির
মিত্র, মেঘনাদ সাহা - সবাই ছাত্রদের সাথে এতটাই গম্ভীর থাকতেন যে কেউই সাহস করে
তাঁদের কাছে আসতে পারতো না। কিন্তু সত্যেন বসু ছিলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাঁর মুখে
একটি স্মিত হাসি লেগেই থাকতো। ছাত্ররা তাঁকে ভয় না পেয়ে ভালোবাসতে পারতো। প্রতি
শনিবার বিকেল পাঁচটার পর ছাত্রদের নিয়ে তিনি পাঠচক্রে বসতেন। যে কেউ যোগ দিতে
পারতো সেখানে। ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহা ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়ে সাপ্তাহিক
ফিজিক্স-ম্যাথমেথিক্যাল সেমিনারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে এত গম্ভীর
আলোচনা হতো যে ছাত্ররা বাধ্য হয়ে বসে থাকতো - কিন্তু কিছুই উপভোগ করতে পারতো না।
সত্যেন বসু এসে ছাত্রদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করলেন।
কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ সেই
সময়। দেশবিভাগের আগে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ঘটে গেলো স্মরণকালের ইতিহাসের
ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল
সাম্প্রদায়িক ঘৃণা নিয়ে। ঘৃণার আগুনে পরস্পরের ছুরি-তলোয়ারের আঘাতে ৭২ ঘন্টার
মধ্যে প্রাণ হারালো চার হাজার মানুষ, বাস্তুহারা হলো লক্ষাধিক। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো
নোয়াখালি, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আরো রাজ্যে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশেপাশে
ঘটেছে সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ। দাঙ্গা থামানোর জন্য ক্যাম্পাসে মিলিটারিরা ক্যাম্প
করেছে। অসাম্প্রদায়িক সত্যেন বসুর বুক ভেঙে যাচ্ছে এসব দেখে। শুধুমাত্র ধর্মের
ভিন্নতার কারণে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করবে - এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে
পারে! কিন্তু নিজে অসাম্প্রদায়িক হলেই যে কেউ সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাঁচতে
পারবে তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি
অতবাহিত করেছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পঁচিশ বছর, সেই ঢাকা আর তাঁর নিজের দেশে থাকছে
না। কলকাতায় উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। শরণার্থীরা আসছে। সত্যেন
বসু স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়া এড়িয়ে চলেছেন সযত্নে। তাঁর বাবার কড়া
নিষেধ ছিল এ ব্যাপারে। তাঁর বাবা এখনো বেঁচে আছেন এবং এখনো কঠিনভাবেই নিষেধ করছেন
৫৩ বছর বয়সী 'বদি'কে। কিন্তু সত্যেন বসুর মেনে নিতে পারছেন না যে বাঙালীরা সব এক
দেশের নাগরিক হয়ে থাকতে পারবে না আর। কিন্তু রোধ করার ক্ষমতা তো তাঁর হাতে নেই।
তাই ১৯৪৭ সালের 'স্বাধীনতা'র পর স্বাধীন
দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের নেতৃত্বে
যখন কমিটি গঠিত হলো সেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখলেন সত্যেন বসু। মেঘনাদ সাহা
ছাত্রাবস্থা থেকে বিপ্লবী, তিনি তো আছেনই - এবার দেশ গঠনে সরাসরি যোগ দিলেন সত্যেন
বসুও। ১৯৪৮ সালেই মেঘনাদ সাহার 'ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স' স্থাপিত হলো।
তিনি ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর হয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। পিওর
ফিজিক্সের 'ঘোষ ল্যাবরেটরি' ও অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের ইলেকট্রিক্যাল কমিউনিকেশান
ল্যাবরেটরি এক হয়ে ইন্সটিটিউট অব রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স গঠিত হলো।
অধ্যাপক শিশির মিত্র হলেন তার ডিরেক্টর। এখন পিওর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সব
দায়িত্ব এসে পড়লো সত্যেন বসুর উপর।
সত্যেন বসু ক্রিস্টালোগ্রাফি ও
রেডিয়েশান ফিজিক্সের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন খয়রা ল্যাবে। এক্স-রে'র প্রয়োগে তিনি
নতুন নতুন গবেষণার পথ উন্মুক্ত করে চলেছেন। মৃৎ-শিল্পের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু
করলেন তিনি - বিভিন্ন ধরনের মাটিতে এক্স-রে বিক্ষেপণ ঘটিয়ে। এভাবে মাটির খনিজ
পদার্থ ও গঠন শনাক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে সত্যেন বসুর
তত্ত্বাবধানে মাটির খনিজ পদার্থের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির উপর পিএইচডি ডিগ্রি
লাভ করেছিলেন পূর্ণিমা সিংহ। ডক্টর পূর্ণিমা সিংহ ছিলেন ফিজিক্সে ডক্টরেট পাওয়া
প্রথম বাঙালি নারী।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে বারোজন তরুণ
গবেষক-ছাত্র গবেষণা করেছেন সত্যেন বসুর তত্ত্বাবধানে। প্রায় সবাই কাজ করেছেন
পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে। এক্স-রে ল্যাবরেটরিতে ক্রিস্টালোগ্রাফির কাজ করার মতো
যন্ত্রপাতি ছিল না। সত্যেন বসু তাঁর ছাত্রদেরকে নিয়ে অনেক দরকারি যন্ত্রপাতি
নিজেরাই তৈরি করেছিলেন। যেমন - বিজেনবার্গ ক্যামেরা (Weissenberg), ডিফারেন্সিয়াল থার্মাল
এনালাইজার, মাইক্রো-ফোকাস এক্স-রে টিউব, বিশেষ ধরনের পাউডার-ক্যামেরা ইত্যাদি।
এক্স-রে পরীক্ষণের সাহায্যে কেমিস্ট্রিতেও নতুন নতুন গবেষণার সম্ভাবনা তৈরি করতে
সক্ষম হয়েছিলেন সত্যেন বসু।
এর মধ্যেই তিনি ইন্ডিয়ান
ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত।
তারপর প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০
পর্যন্ত তিন বছরের জন্য।
১৯৫১ সালে ইউনেস্কোর
আমন্ত্রণে প্যারিসে যান সত্যেন বসু। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল
সেন্টার স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা সভায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯২৪-২৫ সালে
প্রায় এক বছর তিনি প্যারিসে ছিলেন। ছাব্বিশ বছর পর আবার সেখানে গিয়ে তিনি খুঁজে
বের করলেন তাঁর বন্ধু জ্যাকুলিনকে। জ্যাকুলিনের বয়স তখন ৫১। জ্যাকুলিন বিয়ে করেছেন
জ্যাক্স আইজেনমানকে। জ্যাক্স প্যারিসের সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের দুটো ছেলে এবং
একটি মেয়েও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে জ্যাকুলিনের গবেষণার মারাত্মক ক্ষতি
হয়েছে। তিনি এখন একটা কোম্পানির ডকুমেন্টেশান সার্ভিসে কাজ করছেন। এত বছর পরে
পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে স্বাভাবিকভাবেই আপ্লুত সত্যেন বসু। প্যারিস থেকে
লন্ডনে গিয়ে জ্যাকুলিনকে চিঠি লিখলেন তিনি। খুব আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি লিখেছেন:
লন্ডন
২২ জুন ১৯৫১
প্রিয় জ্যাকুলিন,
এতগুলো বছর পর আবার তোমার
দেখা পাওয়া, তোমার মিষ্টি গলা শুনতে পাওয়া, তোমার এত কাছে আসতে পারা আমার কাছে
এখনো স্বপ্নের মত লাগছে। আমি যে কত খুশি হয়েছি। এজন্য আমি আমার ভাগ্যের প্রতি
গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
এতগুলো বছর ধরে কোন খবর
ছিল না তোমার। আমি তো তোমাকে আর কখনো দেখতে পাবো এরকম আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাছাড়া
আরো একটা ভয় ছিল। আমরা কল্পনার মায়াজালে যেসব স্বপ্ন দেখি রূঢ় সময়ের পরিবর্তনের
নিয়মে সেসব স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে যায়। আমার সেসব ভয় কীভাবে নিমেষে উধাও হয়ে গেল
তোমাকে দেখার সাথে সাথে।
আমি এখন লন্ডনে আছি। আরো
এক সপ্তাহ থাকবো এখানে। তারপর কলকাতা ফিরে যাবো।
আশা করি এখন থেকে আবার
লিখবে তুমি।
তোমার আদরের
বোস
ইংরেজিতে লেখা চিঠিটি ছিল এরকম:[1]
London
22 June 1951
Dear Jacqueline,
It was almost a mystic experience
to see you, and hear your sweet voice and be near to you after so many years:
It has filled me with bliss, and I am deeply grateful to my destiny.
Years have elapsed with any news, and I had almost
despaired of ever meeting you again in
life: There was also a foolish fear, that under the relentless law of change
with time it was hopeless to wish to recover in reality what we cherish in memory
draped with cobweb of imagination. How all fears have melted away at your first
sight!
I am in London and shall stay here for about a week
more, and then I go back to Calcutta:
Hope you will now write again
Yours Affectionately,
Bose
চিত্র: জ্যাকুলিনকে লেখা সত্যেন বসুর চিঠি |
চিত্র: ইওরোপে সত্যেন বসু (১৯৫২) |
পরের
বছর ১৯৫২ সালে ফরাসী সরকারের আমন্ত্রণে আবার ইওরোপে যান সত্যেন বসু। তখন তিনি
ইওরোপের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেন। প্যারিসের
কাজ শেষ করে তিনি গেলেন জার্মানির হাইডেলবার্গে। প্রফেসর বোথের সাথে দেখা করতে
গিয়েছিলেন তাঁর ল্যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে বোথে কলকাতায় সায়েন্স
কংগ্রেসে এসেছিলেন। সেই সময় সত্যেন বসুর সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছিলেন তিনি।
হাইডেলবার্গে বোথের দেখা না পেয়ে তিনি বুভেরিয়াতে গিয়ে দেখা করেছিলেন প্রফেসর
বোথের সাথে। প্রফেসর অটো হানের সাথেও দেখা হয়েছিল সেই যাত্রায়। সত্যেন বসু অটো হান
স্মরণে তার স্মৃতিকথায় এই ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।[2]
আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষের
অনেক বছর বিশেষ করে আমেরিকায় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্স
স্টাডিজের বছরগুলোতে কাজ করেছেন গ্রান্ড ইউনিফাইড থিওরি নিয়ে। কিন্তু সাফল্য অর্জন
করতে পারেননি। সত্যেন বসুও তাঁর গবেষণা-জীবনের শেষের তিন বছরে অনেক কাজ করেছেন
গ্রান্ড ইউনিফাইড থিওরির উপর। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি গবেষণাপত্র
প্রকাশ করেছিলেন গ্রান্ড ইউনিফিকেশান থিওরির উপর। কিন্তু সেগুলো কোন উল্লেখযোগ্য
সমাধান দিতে পারেনি এই সমস্যার। আইনস্টাইন নিজেও সত্যেন বসুর একটি চিঠির উত্তরে
জানিয়েছেন যে এগুলো মূল সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন নতুন পথ দেখাতে সক্ষম নয়।
১৯৫২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আইনস্টাইনকে আবার চিঠি লিখেছিলেন সত্যেন বসু গ্রান্ড
ইউনিফাইড থিওরি সংক্রান্ত তাঁর সমাধানের উল্লেখ করে। আইনস্টাইন সে চিঠির উত্তর
দিয়েছিলেন ৪ অক্টোবর।
চিত্র: সত্যেন বসুকে লেখা আইনস্টাইনের শেষ চিঠি (১৯৫২) |
আইনস্টাইন
সত্যেন বসুর সাথে এক মত না হলেও তিনি এবার পেপার প্রকাশনা থেকে বিরত থাকেননি। যে
পাঁচটি পেপার তিনি প্রকাশ করেছিলেন সেগুলো হলো:
- Note of S. N. Bose, presented by L. de Broglie, The Identities of
Divergence in the New Unitary Theory [English translation of] Comptes rendus
de L 'Academie des Sciences 236, pp. 1333-1335 (1953).
- S. N. Bose, A Unitary Field Theory with [English translation of] Le Jour de Phys
et le Radium (Paris), 14, pp. 641-644 (1953).
- S. N. Bose, Certain Consequences of the Existence of the Tensor g
in the Affine Relativistic Field [English translation of] Le Jour de
Phys et le Radium (Paris), 14, pp. 645-647 (1953).
- S. N. Bose, The Affine Connection in Einstein's New Unitary Field
Theory, Ann. Math. USA 59, pp. 171-176 (1954) (Princeton University,
NJ)
- S. N. Bose, Solution of a Tensor Equation Occurring in the
Unitary Field Theory [English
translation of] Bull. Soc. Math. 83, pp. 81-88 (1955).
১৯৫৫
সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর সত্যেন বসু আরো প্রায় বিশ বছর বেঁচে থাকলেও আর একটা
গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেননি।
১৯৫৩ সালে বুদাপেস্টে
বিশ্বশান্তি ও নিরস্ত্রীকরণ সংস্থার উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফর জেনারেল
ডিসআর্মামেন্ট অ্যান্ড পিস-এ যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে আবার ইওরোপে যান সত্যেন বসু।
ইওরোপের বিভিন্ন জায়গায় যান তিনি। জুরিখে দেখা করেন পাউলির সাথে। আর ডেনমার্কের
কোপেনহেগেনে গিয়ে দেখা করেন নিল্স বোরের সাথে। সেই সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন
ভ্রমণের জন্য সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণ পান এবং রাশিয়া ভ্রমণ করেন। পরে তিনি
আমেরিকা যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করলে আমেরিকান সরকার সত্যেন বসুকে ভিসা দেননি
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেছেন এই অজুহাতে। আমেরিকাতে সেই সময় কমিউনিস্ট বিরোধী
অভিযান চলছিলো।
চিত্র: কোপেনহেগেনে নিলস বোরের সাথে সত্যেন বসু (১৯৫৩) |
১৯৫৪ সালে ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রীয় সম্মান -
পদ্মবিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করা হয় সত্যেন বসুকে। এর কয়েক মাস পর ৩ মে রাজ্যসভার
সদস্য মনোনীত হন প্রফেসর সত্যেন বসু, পদ্মবিভুষণ। ভারতের রাজ্যসভা হলো সংসদের
উচ্চকক্ষ; সমগ্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিষদ। ভারতীয়
সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যসভার মোট সদস্য সংখ্যা ২৫০, যার মধ্যে ২৩৮ জন বিভিন্ন রাজ্য
থেকে নির্বাচিত সদস্য, বাকি ১২ জন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সদস্য। রাষ্ট্রপতি
সারা দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে শিক্ষাবিদ, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক
কিংবা সমাজসেবীদের মনোনয়ন দেন রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে। সত্যেন বসুকে মনোনয়ন
দিয়েছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ। রাজ্যসভার সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছর।
১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত
হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। লোকসভা হলো ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ। লোকসভার মেয়াদ পাঁচ
বছর। রাজ্যসভার অধিবেশনে সত্যেন বসুর ভূমিকা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো
পরের অধ্যায়ে।
১৯৫৪ সালে প্যারিসের
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিস্টালোগ্রাফি কনফারেন্সে যোগ দেন সত্যেন বসু। সেখানে তিনি তাঁর
ল্যাবে তৈরি স্পেকট্রোফটোমিটারের কার্যাবলি প্রদর্শন করেন। পরে ইওরোপের অনেক
ল্যাবে তাঁর এই ফটোমিটার ব্যবহৃত হয়।
১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে
নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক চার মাসের জন্য ভারত সফরে আসেন। তাঁকে
নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন বিজ্ঞানী হোমি ভাবা। সত্যেন বসু পল ডিরাককে বোম্বে থেকে
আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। ডিরাক বোসন কণার নাম দিয়েছেন, পদার্থবিজ্ঞানে
সত্যেন বসুর নাম চিরস্থায়ী করেছেন। সত্যেন বসু পল ডিরাককে কলকাতার বিভিন্ন দর্শনীয়
স্থান দেখান। ডিপার্টমেন্টে পল ডিরাক একটি সেমিনার লেকচার দেন। পল ডিরাক খুবই
রিজার্ভ টাইপের মানুষ। খুব বেশি মানুষের সাথে তিনি একসাথে মিশতে পারেন না।[3] কিন্তু সত্যেন বসুর সাথে ছিল তাঁর আলাদা শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সত্যেন বসু তখনো
রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাননি শুনে খুবই অবাক হন পল ডিরাক। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে
গিয়ে রয়েল সোসাইটিতে সত্যেন বসুর ফেলোশিপ পাবার ব্যাপারে সুপারিশ করেন।
চিত্র: পল ডিরাক ও সত্যেন বসু (১৯৫৪)
আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের ৫০ বছর পূর্তি ১৯৫৫ সালে। ১৯০৫
সালে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে একটি প্যাটেন্ট অফিসে কাজ করার সময়ে আইনস্টাইন
তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। ইওরোপের বিজ্ঞানীরা সুইজারল্যান্ডের তাই
বার্ন শহরে এই তত্ত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনের
আয়োজন করেন। পৃথিবীর সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। সত্যেন
বসুও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কথা ছিল জুলাই মাসের এই সম্মেলনে আইনস্টাইন নিজেও যোগ
দেবেন। ১৯৩৩ সালে জার্মানি ছেড়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আইনস্টাইন আর কখনো ইওরোপে
আসেননি। কথা ছিল নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে এবার আসবেন তিনি। কিন্তু
সম্মেলনের তিন মাসে আগে ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আইনস্টাইনের মৃত্যু হয়। সত্যেন বসু
গুরু হারানোর ব্যথা অনুভব করেন। আইনস্টাইনকে তিনি গুরু মানতেন। আইনস্টাইনের
রিলেটিভিটি থিওরির ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয় আইনস্টাইনকে ছাড়াই। সত্যেন বসু সেই
সম্মেলনে গিয়ে তাঁর পরিচিত প্রায় সব পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলার সুযোগ পান।
১৯৫৬ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে
যান ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্সের বিশেষ অধিবেশনে যোগদানের
আমন্ত্রণ পেয়ে।
১৯৫৬ সালে ৬২ বছর বয়সে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
[1] Kameshwar
C. Wali (editor), Satyendra Nath Bose His Life and Times Selected Works, World
Scientific, USA, 2009. page xxx
[2] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, 'অটো হান স্মরণে', জ্ঞান ও বিজ্ঞান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৬৮। রচনা সংকলন,
বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃষ্ঠা ২৪০-২৪৬।
[3] পল ডিরাক
সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন প্রদীপ দেবের 'কোয়ান্টাম ভালোবাসা',
মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪।
No comments:
Post a Comment