45
বাস
ড্রাইডক পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে ঘাঁটির গেটের সামনে এসে থামলো। বাসের অ্যাসিস্ট্যান্ট
কালাম এক লাফে বাস থেকে নেমে গার্ডরুমের ছোট্ট দরজা দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাধারণত
সে দৌড়ে গিয়ে গেটম্যানকে গেট খুলতে বলে দৌড়ে চলে আসে। কিন্তু আজ অনেক দেরি করছে। গেটও
খুলছে না। সামনের সিটে বসা বিমল স্যার বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী রে, কী হইল?”
বিমল
স্যারের পাশে বসেছেন ছোলাইমান স্যার। তিনি মুখের ভেতর জিভ আর তালুর সংঘর্ষ ঘটিয়ে একটা
বিরক্তিসূচক শব্দ সৃষ্টি করে বললেন, “গেট খুলছে না তো।“
একটু
পর কালাম দৌড়ে এসে জানালা দিয়ে ড্রাইভারের সাথে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। ড্রাইভার
তার সিটের আশেপাশে খুঁজে একটা কুঁচকানো পলিথিনের ব্যাগ বের করে কালামকে দিলেন। কালাম
সেটা নিয়ে আবার দৌড়ে গার্ডরুমের দিকে চলে গেলো। গাড়িভর্তি ছেলে-মেয়ে এবং আমরা সবাই
আকাশী রঙের গেটটার দিকে তাকিয়ে আছি – কখন খুলবে।
কালামকে
দেখা গেলো। একটা কাগজ পলিথিনের ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বিমর্ষভাবে ফিরে এসে বললো,
“গারি ত ভিতরে যাইতে দিচ্চে না ছার। কী করব?”
“কেন?
ঢুকতে দেবে না কেন? কী হইছে?” – বিমল স্যার রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলেন।
“বলতেচে
পারমিট ঠিক নাই।“ – কালাম নির্বিকারভাবে উত্তর দিলো। কালামের বয়স খুব বেশি হলে সতের-আঠারো
হতে পারে। একটু হৃষ্টপুষ্ট শরীর, মুখে হালকা গোঁফ-দাড়ি।
“কিসের
পারমিট?” – ছোলাইমান স্যার জানতে চাইলেন।
“বলতেছে
রোড পারমিট। কাগজ দেখাইবার পরও মানতেচে না যে।“
বাস
ভেতরে ঢুকতে না দেয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে হবে কলেজে।
“তোমরা
তোমাদের কাগজপত্র ঠিক করে রাখবে না?” বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন বিমল স্যার।
তারপর হঠাৎ অঞ্জন স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী গাড়ি ঠিক করে দিছেন অঞ্জনবাবু, আজ
এটা ঠিক থাকে না তো, কাল ওটা ঠিক থাকে না।“
গাড়িটার
মালিক অঞ্জন স্যারের পরিচিত। সে হিসেবে গাড়ির ব্যাপারে সবকিছুতেই অঞ্জন স্যারকে দায়ী
করে বসেন বিমল স্যার আর ছোলাইমান স্যার। অঞ্জন স্যার কোন কিছুতেই রাগ করেন না। তিনি
ঠান্ডা মাথায় খুবই নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “সব কাগজপত্র ঠিক আছে বিমলদা। এটা কে করছে
বুঝতে পারছেন না? গতকাল মিটিং-এ এত গালাগালি শোনার পরেও বুঝতে পারছেন না?”
গতকাল
মিটিং-এ শিক্ষকদের যা যা বলা হয়েছে তা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আগুনে পোড়া ঘা-ও এক
সময় শুকিয়ে যায়, কিন্তু অপমানের ঘা কখনো শুকায় না।
“ঠিক
কথা বলেছেন অঞ্জনদা, আমাদের আরো কী কী ভোগান্তি আছে কে জানে।“ –
ম্যাডামরাও
অঞ্জন স্যারের সাথে একমত। গাড়ির রুট-পারমিট ঠিক আছে কী না তা দেখার দায়িত্ব কি এখানকার
প্রভোস্টের? নাকি এই গাড়ি ভেতরে ঢোকার জন্য যে আলাদা পাস লাগে তা ঠিক নেই? এসব তো প্রিন্সিপালের
অফিস থেকে ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। তাহলে?
ঘাঁটির
গেট থেকে কলেজের নতুন বিল্ডিং খুব বেশি দূরে নয়। সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম।
দোতলায় উঠে টিচার্স রুমে ঢুকার আগে প্রিন্সিপালের রুমে রাখা হাজিরা খাতায় সাইন করতে
গিয়ে দেখি নাসির স্যার আর সাঈদ স্যার মিটিং করছেন অ্যাকটিং প্রিন্সিপালের সাথে।
গতকালের
মিটিং-এ আমরা সবাই এক কাতারে বসে অপমানবাক্য সহ্য করেছি। কিন্তু নাসির স্যার আর প্রিন্সিপাল
ম্যাডামকে বসতে হয়েছিল কতৃপক্ষের কাতারে। এতে কি তাঁদের কষ্ট হয়েছে? নাকি তাঁরা আমাদের
থেকে নিজেদের আলাদা ভেবেছেন? পদমর্যাদার ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। এটা মানুষে মানুষে
বিভেদ ঘটাতে ওস্তাদ।
টিচার্স
রুমে ঢুকতেই বুঝলাম সবাই গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছেন। কাশেম স্যার বলছেন,
“আমাগো অবস্থা হইছে হেই পন্ডিতের মতো – যার কদর লাটসাহেবের কুত্তার একখান ঠ্যাং-এর
চেয়েও কম।“
বুঝতে
পারছি কাশেম স্যার কোন্ পন্ডিতের কথা বলছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত গল্প ‘পাদটীকা’।
চাচাকাহিনী’র এই গল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল
১৯৫৫ সালে। সেই গল্পের পন্ডিত মশাইর বেতন ছিল মাসে ২৫ টাকা। অথচ তৎকালীন লাট সাহেবের
তিন পা-ওয়ালা এক কুকুরের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল ৭৫ টাকা। একজন পন্ডিতের জন্য খুবই অপমানজনক
ব্যাপার ছিল এটা। কিন্তু গল্পটিতে পন্ডিতের যে স্বাধীনতা ছিল তা তো ঈর্ষনীয়। “পন্ডিতমশাই
যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বকতেন ঢের বেশি, এবং টেবিলের উপর পা দু’খানা তুলে দিয়ে ঘুমুতেন
সব চেয়ে বেশী। বেশ নাক ডাকিয়ে, এবং হেডমাস্টারকে একদম পরোয়া না করে।“
যে
লাট সাহেবের কুকুরের প্রসঙ্গে পন্ডিতমশাই ক্লাসের ছাত্রদের সাথে আলোচনা করেছেন, সেই
লাটসাহেব পন্ডিতমশাইকে যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়েছেন। “লাট সায়েব চলে গিয়েছেন, যাবার পূর্বে
পন্ডিতমশায়ের দিকে একখানা মোলায়েম নড্ করাতে তিনি গর্বে চৌচির হয়ে ফেটে যাবার উপক্রম।“
তখনকার লাটসাহেবরা শিক্ষকদের সম্মান করতেন। সত্যিকারের লাটসাহেবরা বিদায় নেবার পর আমাদের
যেসকল দেশীয় লাটসাহেবের উদ্ভব ঘটেছে তারা শিক্ষকদের কী চোখে দেখেন তা তো আর বলার অপেক্ষা
রাখে না। লাট-সাহেবের কুকুরের এক পায়ের জন্য মাসিক যে বরাদ্দ, ঠিক সেই পরিমাণ বেতন
পান পন্ডিত মশাই। পন্ডিত মশাই এই অপমানের কথা তাঁর ছাত্রদের সাথে আলোচনা করতে পেরেছেন।
“ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে – কেউ বাদ যায়নি- পন্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কি নির্মম
পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।“ আজ আমাদের কারো পক্ষে কি ক্লাসে গিয়ে
ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলা সম্ভব – যে আমাদের এভাবে অপমান করা হয়েছে? আমাদের অপমান সইতে
হয় নিরবে। ক্লাসে গিয়ে সব ভুলে যেতে হয়। আনন্দ সবার সাথে শেয়ার করা যায়। কিন্তু খুব
বেশি আপন না হলে দুঃখ শেয়ার করা যায় না। আর অপমান? খুব কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ কি
বুঝবে? ক্লাসরুমের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষকদের সেরকম কাছের মানুষ?
“শনিবারের
ছুটির কথা ভুলে যান সবাই।“ – রুমে ঢুকেই ঘোষণা করলেন সাঈদ স্যার। তাঁর হাতে রুটিনের
বিশাল কাগজ। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে তাহলে এব্যাপারেই কথা হচ্ছিলো তাঁর।
“এখন
থেকে সপ্তাহে একদিন ছুটি। শনিবারে কলেজে আসতে হবে। আবার পুরনো রুটিনে ফিরে যেতে হবে।“
“কিন্তু
বেইজ তো দুইদিন ছুটি থাকবে।“
“হ্যাঁ,
সরকারি ছুটি দু’দিন তারা ভোগ করবে। আপনি তো সরকারি চাকরি করেন না ভাই। কাল এত কথা শোনার
পরেও শিক্ষা হলো না?”
শিক্ষা
শব্দটির কতরকমের অর্থ যে হয়!
মহিউদ্দিন
স্যার আর সাঈদ স্যার রুটিন ঠিক করতে বসলেন। দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করার দিন শেষ
হয়ে গেলো। অথচ কী অপরাধে এরকম করা হলো জানি না।
কলেজের
দৈনন্দিন কাজ শুরু হলো। অনেকগুলো ক্লাস নিয়ে, ওই বিল্ডিং-এর ক্লাস শেষ করে ফিরে আসতে
আসতে টিফিন আওয়ারের অর্ধেক চলে গেলো। নিজের ডেস্কে এসে বসতেই অঞ্জন স্যার খবরটা দিলেন
– “হুমায়রা ম্যাডাম রিজাইন লেটার দিয়েছেন।“
গতকালকের
মিটিং-এ শিক্ষকদের অপমানের প্রথম প্রতিবাদ এলো হুমায়রা ম্যাডামের কাছ থেকে। রিজাইন
করতে হলে দু’মাসের নোটিশ দিতে হয়। তার মানে দু’মাস পর হুমায়রা ম্যাডাম চলে যাচ্ছেন।
জুলাই মাসের উত্তপ্ত দুপুরের তীব্র রোদে ঝলমল করছে টিচার্স রুম। অথচ মনে হচ্ছে কোথায়
যেন ছোপ ছোপ কালো কালো দাগ পড়ে যাচ্ছে, ভালো লাগছে না।
দিন
চলে যাচ্ছে দ্রুত। এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার ডিউটি করতে হচ্ছে। এবার কলেজে প্র্যাকটিক্যাল
পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। আয়েশা ম্যাডামকে এক্সটার্নাল করা হয়েছে অন্য
কলেজের। আমাদের কলেজে ফিজিক্সের এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসেবে যিনি এলেন তিনি আমার
ইউনিভার্সিটির দু’ব্যাচ জুনিয়র। ‘দাদা’ ‘দাদা’ বলতে বলতে সবাইকে এত বেশি নম্বর দিয়েছেন
যে আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিলো। রেজাল্টের পর দেখা গেলো কয়েক জন ছাত্র ফিজিক্সের
তত্ত্বীয় পরীক্ষায় ১৫০ এর মধ্যে মাত্র ৪০ পেয়ে ফেল করেছে, অথচ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায়
পেয়েছে ৫০ এর মধ্যে ৫০। এরকম অন্তসারশূন্য পরীক্ষা-ব্যবস্থার সাক্ষী হওয়া যে কী পরিমাণ
লজ্জার।
এরমধ্যে
শোনা গেল কলেজে নতুন প্রিন্সিপাল নিয়োগ করা হয়েছে। আগস্টে জয়েন করবেন।
>>>>>>
“মনে
হচ্ছে খুবই ভালোমানুষ। খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ।“ – মহিউদ্দিন স্যারের গলায় উচ্ছ্বাস।
নতুন প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করে এসেছেন তিনি, অঞ্জন স্যার এবং আরো কেউ কেউ। নতুন
রাজা এসেছেন, এবার নতুন পারিষদ হবে। পারিষদ দলে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য কারো কারো ভেতর
কিছুটা চাপা চঞ্চলতাও দেখা যাচ্ছে।
জানা
গেলো আমাদের নতুন প্রিন্সিপালের নাম মোয়াজ্জেম হোসেন। ইংরেজি বিষয়ের মানুষ। মজিদ স্যারও
ইংরেজির মানুষ ছিলেন। প্রিন্সিপাল হতে গেলে কি ইংরেজি বিষয়েরই হতে হয়?
দায়িত্ব
বুঝে নেয়ার কয়েকদিন পর শিক্ষকদের সাথে প্রথম মিটিং করলেন প্রিন্সিপাল মোয়াজ্জেম হোসেন
স্যার। নবাগত অধ্যক্ষকে শুভেচ্ছা স্বাগতম জাতীয় কোন আনুষ্ঠানিকতা হলো না। তিন তলায়
কলেজের ক্লাস্রুমগুলি অনেক বড়। সেখানে একটি রুমে আমরা সবাই বসলাম। প্রিন্সিপাল স্যার
ঢুকলেন দুই ভাইস-প্রিন্সিপালের সাথে। মোয়াজ্জেম হোসেন স্যারের বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে
মনে হচ্ছে। একটু ভারী শরীর, ভারী চেহারা। কুচকুচে কালো তেলতেলে চুল, আর কালো পুরু গোঁফ।
মনে হচ্ছে কৃত্রিম রঙ লাগানো। হাতের আঙুলে বড় লাল পাথরের আংটিতে চোখ আটকে গেলো। এরকম
পাথরে বিশ্বাসী মানুষ – মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির হয়ে থাকেন বলে আমার ধারণা।
মনে
হচ্ছে প্রিন্সিপাল স্যারের প্রশাসনিক কাজে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। তিনি শিক্ষকদের পক্ষ
থেকে কিছু বলার আছে কি না জানতে চাইলেন। এরকম পরিস্থিতিতে সবার চোখ যায় রিফাৎ আরা ম্যাডামের
দিকে। আজও গেলো। কিন্তু তিনি গত মিটিং-এ শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বলার পর কর্তৃপক্ষ যেভাবে
তেড়ে বাঁশ নিক্ষেপ করেছেন আমাদের সবারদিকে – সেজন্য আজ কিছুতেই কিছু বলতে রাজি হলেন
না।
নাসির
স্যার হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “প্রদীপ, কিছু বলো।“
আমি
তো নাসির স্যারের কোন ক্ষতি কোনদিন করিনি। তিনি কেন আজ আমাকে এই বিপদের মধ্যে ঠেলে
দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। ক্লাসরুমে স্টুডেন্টদের সামনে কথা বলা আর এখানে এতগুলি শিক্ষকের
মাঝে কথা বলা তো এক কথা নয়। ভেতরে ক্ষোভ থাকলে অনেকসময় মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আমার
অবস্থাও সেরকম হলো কিছুটা। সেদিনের মিটিং-এ শিক্ষকদের যা যা বলে অপমান করা হয়েছিল –
তার সবগুলি পয়েন্ট একে একে বলে ফেললাম। সাঈদ স্যার ‘শাহীন কলেজের দেয়ালও স্পাইয়ের কাজ
করে’ – বলে অনেকবার সাবধান করেছেন এর আগে। এখন ক্ষোভের মুখে সেই সাবধানবাণী কোন কাজে
এলো না। শব্দবাণ বের হয়ে গেল একের পর এক।
প্রিন্সিপাল
স্যার চুপচাপ শুনলেন সবকিছু। আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই তৃপ্তি ম্যাডাম বললেন, “এসব
বলে কোন লাভ নেই। কর্তারা যা ইচ্ছা করবেন, তা-ই হবে।“
একদম
ঠিক কথা বলেছেন ম্যাডাম। প্রিন্সিপাল স্যার চুপচাপ শুনছেন দেখে আরো অনেকে উৎসাহী হয়ে
অনেক কিছু বললেন। মনে হচ্ছে আমাদের বাক্স্বাধীনতা ফিরে এসেছে।
প্রিন্সিপাল
স্যার বললেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের সুদিন আবার ফিরে আসছে। আমি কথা
দিচ্ছি আপনাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি আমি খেয়াল রাখবো। আপনারা যেন সম্মানের সাথে দায়িত্ব
পালন করতে পারেন, তা আমি দেখবো। আমি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।“
এটুকুতেই
আমরা খুশি হয়ে গেলাম। মুক্তিযোদ্ধা নতুন প্রিন্সিপাল আমাদের সম্মান ও অধিকারের ব্যাপারে
খেয়াল রাখবেন বলে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠলাম।
মোয়াজ্জেম
হোসেন স্যারের পারিষদ দলে কিছু নতুন মুখ যোগ হলো। প্রিন্সিপালের ডেস্কের সামনের চেয়ার
দখল করে বসে থাকেন তাঁরা। তাতে আমাদের কিছুটা লাভও হচ্ছে। তা হলো অনেক খবর আমরা টিচার্স
রুমে বসেই পেয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা জানতে পারলাম হুমায়রা ম্যাডামের পদত্যাগ-পত্র নিয়ে
প্রশাসনে তোলপাড় হচ্ছে। তিনি তাঁর পদত্যাগ-পত্রে লিখেছেন কতৃপক্ষের অপমানের কারণেই
তিনি পদত্যাগ করছেন। ঘাঁটির গোয়েন্দা-বিভাগ তদন্তে নেমেছে। শিক্ষকদের কে কীভাবে অসম্মান
করেছেন তার সব তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। এর মধ্যে কতৃপক্ষের বিশেষ দূত হুমায়রা ম্যাডামের
বাসায় গিয়ে ম্যাডামকে পদত্যাগ-পত্র প্রত্যাহার করার জন্য বার বার অনুরোধ করছেন। কলেজের
নতুন প্রিন্সিপালকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ম্যাডামকে বুঝিয়ে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করানোর।
ঘাঁটির উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তারা বার বার আশ্বাস দিচ্ছেন শিক্ষকদের অসম্মান হয় এরকম কোনকিছু
আর ঘটবে না। শিক্ষার্থীরাও হুমায়রা ম্যাডামকে এত ভালোবাসে যে তারা কিছুতেই মানতে পারছে
না যে ম্যাডাম চলে যাবে। ম্যাডামের সহকর্মীরাও ম্যাডামকে যেতে দিতে রাজী নন। শেষপর্যন্ত
পদত্যাগ-পত্র প্রত্যাহার করে নিলেন হুমায়রা ম্যাডাম।
আরো
সুবাতাস? ঠিক তা নয়। কিছুদিন পর দেখা গেলো সাত জন শিক্ষককে শো-কজ নোটিশ দেয়া হয়েছে।
কারণ তাঁরা নাকি ক্লাসে ভালো করে পড়াতে পারেন না। পরিদর্শক দল এসেছিলো জুন মাসে। সেপ্টেম্বরে
এসে শো-কজ করা হলো। যাঁরা নোটিশ পেয়েছেন তাঁরা সবাই প্রাইমারি সেকশানে ক্লাস থ্রি ফোর
ফাইভে ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁরা খুবই পপুলার শিক্ষক। পপুলার টিচার হলেই
যে ভালো টিচার হবেন এমন কোন কথা নেই। কিন্তু এই শিক্ষকদের সবাই খুবই ভালো শিক্ষক। তাহলে
কীসের ভিত্তিতে বলা হলো যে তাঁরা ভালো করে পড়াতে জানেন না? এই গ্রেডিং-এর ক্রাইটেরিয়া
কী? কোন ধরনের পূর্ব-সতর্কতা ছাড়াই সরাসরি কারণ-দর্শাও নোটিশ পাঠানো? মনে হলো ব্যাপারটা
যদি আমরা নিরবে মেনে নিই – তাহলে ভবিষ্যতে প্রত্যেকেই এধরনের নোটিশ পেতে থাকবো। কারণ
‘ভালো’ কথাটা খুবই সাবজেক্টিভ। কেউ যদি আসলেই পড়াতে না পারেন, কিংবা ফাঁকি দেন, তাঁর
বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে তো সবাই ফাঁকিবাজি করবে। কিন্তু
নির্দোষ শাস্তি পাবেন – তা তো মেনে নেয়া যায় না।
আমরা
কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম প্রিন্সিপাল স্যার ও নাসির স্যারের সাথে কথা বললাম এ ব্যাপারে।
প্রিন্সিপাল স্যার শুরুতে মিটিং-এ বসতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে রাজি হলেন। মিটিং-এ আমরা
খোলাখুলি বললাম যে এই শো-কজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেয়া হয়নি। তাই এগুলো প্রত্যাহার করতে
হবে। প্রিন্সিপাল স্যার আশ্বাস দিলেন যে তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন। প্রিন্সিপাল
স্যার হয়তো কথা বলেছিলেন। শো-কজের ব্যাপারে এর পর আর কিছু হয়েছিল কি না আমি জানি না।
>>>>>>>
প্রিন্সিপাল
স্যার আসার পর পুরাতন বিল্ডিং-এ যাবার সময় খুব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ রিকশাটা প্রায়
সময়েই প্রিন্সিপাল স্যারের কাজে ব্যবহৃত হয়। সকালে তাঁকে তাঁর বাসা থেকে আনতে যায় এই
রিকশা। রিকশায় চড়ে তিনি যখন আসেন – তখন মাঝে মাঝে ক্লাস শুরু হয়ে যায়। কলেজের প্রিন্সিপালের
জন্য একটা গাড়ি থাকতে পারতো। কিন্তু নেই। রিকশা দিয়েই গাড়ির কাজ চলছে। প্রিন্সিপাল
স্যার ঘাঁটির অধিনায়ক কিংবা প্রশাসনিক অধিকর্তার সাথেও মিটিং করতে যান এই রিকশা নিয়ে।
তাতে সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের – যারা পুরনো বিল্ডিং-এ গিয়েও ক্লাস নেন, এবং ফিরে এসে
আবার নতুন বিল্ডিং-এও ক্লাস নিতে হয়। থার্ড ও ফোর্থ পিরিয়ডে পুরনো বিল্ডিং-এ ক্লাস
নেয়ার জন্য আমাকে সেকেন্ড পিরিয়ডে রওনা দিতে হয়। দেখা যায় সেই সময় রিকশা গিয়ে বসে আছে
প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায়। বিষয়টা নিয়ে নাসির স্যারের সাথে কথা বললাম।
“দেখো,
আগামী বছর থেকে এই সমস্যা আর থাকবে না। ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ এই বিল্ডিং-এ চলে আসবে।
আর কয়েকটা মাস কোন রকমে চালিয়ে নাও।“
“প্রিন্সিপাল
স্যারের জন্য আরেকটা রিকশার ব্যবস্থা করলেই তো হয়ে যায় স্যার।“
“দেখি
কী করা যায়।“
নাসির
স্যার ঠিক কী ব্যবস্থা করলেন জানি না। দেখা গেলো পরদিন যথাসময়ে রিকশা পাওয়া গেলো। শাহ
আলম রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। আমি রিকশা নিয়ে চলে গেলাম পুরনো বিল্ডিং-এ। কিন্তু
ফোর্থ পিরিয়ডের পর রিকশার আর দেখা নেই। ফিফ্থ পিরিয়ডে আমার নতুন বিল্ডিং-এ ক্লাস।
দেখা গেলো ম্যাডামরাও হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। রিকশার কী হলো? হাঁটতে হাঁটতে নতুন বিল্ডিং-এ
এসে দেখি শাহ-আলমের রিকশা দাঁড়িয়ে আছে এখানে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শাহ-আলমকে বলেছিলাম
টিফিন আওয়ার শুরু হবার আগেই ওই বিল্ডিং-এ চলে যেতে। অথচ সে যায়নি। গেলো কোথায় সে? দোতলায়
উঠে দেখলাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে বারান্দায় কান ধরে বসে আছে শাহ-আলম। টিফিন
আওয়ার চলছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রীর ভীড় এখানে। তাদের সামনে লজ্জায় কুঁকড়ে কান ধরে বসে
আছে দরিদ্র যুবক রিকশাওয়ালা শাহ-আলম। এরকম শাস্তি দেয়ার মতো নিষ্ঠুর মানুষ কে আছেন
এখানে?
দেখলাম অফিস রুম থেকে দ্রুত পায়ে বের
হলেন গাউস সাহেব। তিনি তর্জনি উঁচিয়ে শাহ-আলমকে বললেন, “খবরদার কান ছাড়বি না।“
গাউস সাহেব শাস্তি দিচ্ছেন শাহ-আলমকে?
জিজ্ঞেস করলাম, “গাউসভাই,
কী হয়েছে?”
“প্রিন্সিপাল
স্যারকে আনতে যায়নি সকালে। প্রিন্সিপাল স্যারের মিটিং ছিল ওসিএডমিনের সাথে। স্যারের
মিটিং-এ যাইতে দেরি হয়ে হয়েছে এর জন্য। তাই প্রিন্সিপাল স্যার শাস্তি দিচ্ছেন।“
“এজন্য
যে আমরা শাস্তি পাচ্ছি। ওই বিল্ডিং-এ রিকশা যাওয়ার কথা। আমাদের তো হেঁটে যাওয়া-আসা
করতে হচ্ছে।“
“সেটা
আমি জানি না স্যার। প্রিন্সিপাল স্যার আদেশ করেছেন একে এভাবে সারাদিন কান ধরে বসায়
রাখতে।" - গাউস সাহেবের মুখ হাসিহাসি। মনে হচ্ছে তিনি খুব আনন্দ পাচ্ছেন শাহ-আলমকে
এভাবে সবার সামনে অপমানিত হতে দেখে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে শাহ-আলম বিনাদোষে শাস্তি
পাচ্ছে। প্রিন্সিপাল স্যারকে যে সময়ে আনতে যাবার কথা, সেই সময়ে সে আমাকে নিয়ে পুরাতন
ভবনে গিয়েছিল। সে তো ডিউটি করছিলো। হয়তো নাসির স্যার বলেছিলেন তাকে এখানে ডিউটি করতে।
নাসির স্যারের রুমে ঢুকলাম। তিনি তাঁর
চেয়ারে নেই। এখন উপায়? শাহ-আলমের শাস্তি রদ করবে কে? রান্না ভালো হয়নি – এই অপরাধে ডেকসি মাথায় নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল অফিসার্স মেসের কুকদের। দেখেছিলাম অপমানে কালো হয়ে গিয়েছিল তাদের
মুখ। এখানে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল রিকশাওয়ালাকে শাস্তি
দিচ্ছেন সবার সামনে কান ধরে বসিয়ে রেখে! শাহ-আলম দোষ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। কিন্তু
সেই শাস্তি তো এরকম অপমানজনক শারীরিক শাস্তি হতে পারে না। আমি যদি আমার কর্তব্যে অবহেলা
করি প্রিন্সিপাল স্যার কি আমাকেও এভাবে কান ধরিয়ে বসিয়ে রাখবেন? নিজেকে শাহ-আলমের জায়গায়
ভাবতেই কেমন যেন লাগলো।
“এই
শাহ-আলম, উঠো। অনেক হয়েছে।“
শাহ-আলম তখনো কান ধরে আছে। গাউস সাহেব
ছুটে এলেন আবার। আমি বললাম, “গাউস
ভাই, প্রিন্সিপাল স্যার জিজ্ঞেস করলে বলবেন –
আমি শাহ-আলমকে ছেড়ে দিয়েছি। শাহ-আলম তুমি যাও।“
শাহ-আলম কোন রকমে উঠে মাথা নিচু করে
কোন দিকে না তাকিয়ে চলে গেলো নিচে।
শাহ-আলমকে আর কখনো দেখিনি কলেজে। সে
কি অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজেই চলে গেছে, নাকি তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে আমি জানি
না। জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি কারো কাছে।
ক’দিন
পরেই দেখা গেলো আরেকজন শাহ-আলম এসে রিকশার হ্যান্ডেল ধরলো। এই শাহ-আলম দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ।
No comments:
Post a Comment