ত্রয়োদশ অধ্যায়
রাজ্যসভায় সত্যেন বসু
ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় প্রেসিডেন্টের মনোনীত সদস্য
হিসেবে সংসদে যোগ দিয়েছিলেন সত্যেন বসু ১৯৫৪ সালে। ৩রা মে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে
শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর নিয়োগ ছিল ছয় বছরের জন্য। সংসদের অধিবেশনগুলো সত্যেন বসু খুব
একটা উপভোগ করেননি। প্রথমত তিনি রাজনীতিকদের সমস্যা সমাধানের ঘুরানো প্যাঁচানো
পদ্ধতি পছন্দ করতেন না। দ্বিতীয়ত তাঁর আদর্শের সাথে রাজনীতিকদের অনেক নীতিই মিলতো
না। তিনি সংসদ অধিবেশনে যেতেন, কিন্তু পারতপক্ষে কোন বক্তৃতা দিতেন না। ছয় বছর
মেয়াদী সদস্যপদে তিনি প্রায় পাঁচ বছর সংসদে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি মনোনীত ১২ জন
সদস্যের মধ্যে তাঁর সাথে ছিলেন অভিনেতা পৃথ্বিরাজ কাপুর, কবি মৈথিলিশরণ গুপ্ত,
নৃত্যশিল্পী রুক্মিণী দেবী, শিক্ষাবিদ কালীদাস নাগ, রাধাকুমুদ মুখার্জি প্রমুখ।
পাঁচ বছরে মাত্র চার বার
সংসদে বক্তৃতা দিয়েছেন সত্যেন বসু। এই চারবারই তিনি ধরতে গেলে তীব্র সমালোচনা
করেছেন সরকারে নীতিনির্ধারকদের।
১৯৫৫ সালের ২১ মার্চ
রাজ্যসভার অধিবেশনে তিনি ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন বিলের উপর আলোচনায় বক্তৃতা
দেন।[1] ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন গঠনের পক্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক
নেতারা ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার মানের সমালোচনার জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষক ও প্রশাসনের পক্ষে তীব্র যুক্তি তুলে ধরেন সত্যেন বসু।
সেই সময় ভারতে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সত্যেন বসু রাজনৈতিক নেতাদের বলেন যে
প্রাইমারি ও হাইস্কুলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি গুলিয়ে ফেললে তো হবে না।
তিনি সবদিক ভালোভাবে বিবেচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রান্ট কমিশনকে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাথার উপর বসিয়ে দেয়ার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
সত্যেন বসু রাজ্যসভায় দ্বিতীয় বার বক্তৃতা দেন ১৯৫৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।[2] ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে
আগত শরণার্থী সমস্যার সমাধানে সরকারের নীতির সমালোচনা করে বেশ জোরালো বক্তৃতা দেন
সত্যেন বসু। যে মানুষেরা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সবকিছু হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে
আশ্রিত হয়ে আছে - তাদের সাথে সত্যেন বসুর কেটেছে প্রায় ২৫ বছর ঢাকায়। সেই মানুষদের
সম্পর্কে যখন পার্লামেন্টের মেম্বাররা মন্তব্য করেন যে পাকিস্তানীদের বসিয়ে বসিয়ে
খাওয়ানো উচিত নয়, কিংবা এদের সমস্যা পাকিস্তানের সমস্যা - তখন তীব্র ভাষায়
প্রতিবাদ করেন সত্যেন বসু। তিনি বলেন, দেশ ভাগ করার সময় এই সমস্যার কথা ভাবা উচিত
ছিল। তারা যখন আসতে শুরু করেছে তখন তাদের দক্ষতা অনুযায়ী তাদের কাজ দেয়া উচিত ছিল।
শরণার্থীদের মধ্যে কে কী কাজ জানে - সেই পরিসংখ্যান নেয়ার কাজ সরকার করেনি। তাছাড়া
তারা সবাই পানির কাছাকাছি বাস করা সমতল ভূমির মানুষ। সরকার যদি তাদেরকে হিমালয়ের
ওদিকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে তাহলে সেটা হবে ভুল সিদ্ধান্ত।
রাজ্যসভায় সত্যেন বসুর
তৃতীয় বক্তৃতাটি ছিল প্রিভেন্টিভ ডিটেনশান অ্যাক্ট-১৯৫০ এর উপর আলোচনা উপলক্ষে।[3] ১৯৫৬ সালের ৩১ মার্চ সত্যেন বসু রাজ্যসভায় কাউকে বিনাবিচারে আটকে রাখার
বিধানের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন যে আইন বলে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা আন্দোলনের
নেতাদের বন্দী করে রাখতো আজ সেই নেতারাই স্বাধীনতার পর সংসদে বসে সেই আইনের পক্ষে
কথা বলছে - এটা লজ্জার।
রাজ্যসভায় সত্যেন বসুর শেষ বক্তৃতাটি
ছিল প্রেসিডেন্টের ভাষণের উপর ধন্যবাদ প্রস্তাব উপলক্ষে।[4] ১৯৫৭ সালের ১৯ মার্চ তিনি রাষ্ট্রপতির ধন্যবাদ
প্রস্তাব সম্পর্কিত আলোচনার অধিবেশনে সবার মনযোগ আকর্ষণ করেন ভারতের খনিজ পদার্থ
রপ্তানি করার প্রস্তাব সম্পর্কে। সংসদে প্রস্তাব করা হয় যে ভারতের খনি থেকে লোহার
আকরিক রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। সত্যেন বসু যুক্তি দেন
যে রপ্তানি করতে গেলে সবচেয়ে ভালো আকরিকগুলোই রপ্তানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে যখন
ভারত নিজেদের স্টিল মিল তৈরি হবে তখন ভালো মানের আকরিক ভারতের থাকবে না, ফলে খারাপ
মানের লোহা তৈরি হবে মিল থেকে। তখন সেই লোহা কেউ ব্যাবহার করবে না। অর্থাৎ নিজেদের
ইন্ডাস্ট্রি মার খাবে। একই কথা খাটে খনিজ কয়লার ক্ষেত্রেও।
সত্যেন বসু যেটুকু কথা বলেছেন সংসদে তার সবটুকুই ছিল যুক্তিগ্রাহ্য। ফলে সংসদের রাজনীতিবিদরা যে তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেননি তা বলাই বাহুল্য। ১৯৬০ সালের মে মাসে তাঁর রাজ্যসভার সদস্যপদের মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে তাঁকে রাজ্যসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। ১৯৫৯ সালের ১০ আগস্ট রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করেন সত্যেন বসু।
No comments:
Post a Comment