44
“অ্যাই অঞ্জন্দা, এখানে বাঁশখাইল্যার সংখ্যা
যে বেড়ে যাচ্ছে তা কি আপনি খেয়াল করছেন?” – সাঈদ স্যার তাঁর সামনে রাখা সিঙাড়ার প্লেটটা
টেনে নিতে নিতে হাসিমুখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন অঞ্জন স্যারের দিকে।
অঞ্জন
স্যার একটু আগেই নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ‘এই নিয়তি, চা ঠান্ডা কেন’ বলে
নিয়তিদিকে একটি ছোটখাট ধমক দিয়েছেন। নিয়তিদি মিনমিন করে কী বললেন তা টিচার্স রুমের
এই টিফিন আওয়ারের গমগমে পরিবেশে ঠিক শোনা গেল না। কিন্তু আজিজুর রহমান স্যারের কথাটা
পরিষ্কার শোনা গেল - “সবই নিয়তি নিয়ন্ত্রিত। মানুষের হাতে আর কী আছে!”
রসায়নের
আজিজুর রহমান স্যার খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। মুখে দাড়িগোঁফ না থাকলে তাঁকে ক্লাস
টেনের ছাত্র বলে মনে হতো। পোশাক-পরিচ্ছদে তাঁর তাবলিগী তরিকা স্পষ্ট। মিতভাষী এবং মৃদুভাষী
আজিজ স্যার প্রমিত বাংলায় স্পষ্টস্বরে কথা বলেন। টিচার্স রুমের গুঞ্জনের মধ্যেও তাঁর
কথা পরিষ্কার শোনা গেল। তাঁর দ্ব্যার্থবোধক কথাগুলির সারমর্ম উদ্ধার করার আগেই সাঈদ
স্যারের কথায় চায়ের তাপমাত্রা সম্পর্কিত আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেল।
অঞ্জন
স্যার সাঈদ স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই ছোলাইমান স্যার তাঁর চায়ের কাপে একটা
সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন, “বাঁশখাইল্যারা আবার কী করলো?”
“আপনারা
সংখ্যায় বাড়তেছেন। হাফিজ ভাইও বাঁশখাইল্যা।“
“হাফিজ
ভাই শুধু বাঁশখাইল্যা না, আমার পাড়াইল্যা।“ – ছোলাইমান স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছে
নিজের গ্রামের আরেকজনকে এখানে পেয়ে তিনি মনের খুশি চেপে রাখতে পারছেন না।
হাফিজ
স্যার কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদে যোগ দিয়েছেন ক’দিন আগে। তাঁর বাড়ি যে বাঁশখালি তা আমি
জানতাম না। এখন তো দেখছি তিনি ছোলাইমান স্যারের পাড়ার মানুষ। তাঁর পদবি লাইব্রেরিয়ান
হলেও – তাঁকে স্কুলে অনেক ক্লাস নিতে হবে। এখানে তা-ই হচ্ছে। ডেমনেস্ট্রেটররা সবাই
স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন।
হাফিজ
স্যার আমার সামনের ডেস্কে বসে সাঈদ স্যারের কথায় মিটিমিটি হাসছেন। হয়তো বুঝতে চেষ্টা
করছেন – হঠাৎ বাঁশখালির লোকজনকে নিয়ে কেন কথা হচ্ছে টিচার্স রুমে।
“এখানে
বাঁশখালীর আরো কেউ আছে নাকি?” – হাফিজ স্যার অনেকটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি
কিছু বলার আগেই আলী হায়দার স্যার বললেন, “কারে জিগান? দাদা নিজেই তো বাঁশখাইল্যা।“
হাফিজ
স্যারের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হয়ে গেলো।
“সাঈদ
ভাই, শাহীন কলেজের অর্থনীতি বিভাগ বাঁশখালীর দখলে। এদিকে ছোলাইমান ভাই, আর ওদিকে একাউন্ট্যান্ট
কাদের সাহেব।“ – অঞ্জন স্যার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই করিডোরে ধুপধাপ
শব্দ। সবার চোখ চলে গেল সেদিকে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম বাইরে থেকে দেয়াল টপকে লাফ দিয়ে
বারান্দায় দাঁড়ালেন একজন লম্বা পাতলা মানুষ। চোখে রোদচশমা। তাঁর ভাবভঙ্গি অনেকটা ‘সওদাগর’
সিনেমার ওয়াসিমের মতো। বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় তাঁর জুতার শব্দে মনে হচ্ছিলো তিনি
প্যারেড করতে করতে যাচ্ছেন।
একটু
পরে দেখলাম আরো একজন বাইরে থেকে দেয়াল ধরে উঠার চেষ্টা করছেন। আমার সিট একদম কোণায়
হওয়াতে বাইরের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নতুন বিল্ডিং-এর বারান্দার দেয়ালে এখনো
রেলিং লাগানো হয়নি। দেয়ালের উচ্চতা তিন ফুটের বেশি হবে না। বাইরের দিক থেকে চার বা
সাড়ে চার ফুট হবে। এখন যিনি টপকানোর চেষ্টা করছেন তাঁর শরীরের প্রস্থ একটু বেশি হওয়াতে
খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। চেহারার কাঠিন্য দেখে মনে হচ্ছে ডিফেন্সের মানুষ।
আমার সাথে একবার চোখাচোখি হয়েছে। আমি কি বারান্দায় গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাঁকে টেনে তুলবো?
নাকি না-দেখার ভান করে অন্যদিকের টেবিলে বসা বিমল স্যার, ফারুকী স্যার কিংবা আজিজুর
রহমান স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকবো বুঝতে পারছি না।
দেখলাম
সাঈদ স্যার হঠাৎ হাতের আধখাওয়া সিঙাড়া প্লেটে রেখে ছুটে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। দু’বার
চেষ্টায় বিফল হয়ে দেয়াল টপকানোর ইচ্ছা পরিবর্তন করে যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিকে চলে
গেলেন বাইরের স্থূল ভদ্রলোক। এত বড় গেট থাকতে এই পথ কেন তাঁরা বেছে নিলেন বুঝতে পারলাম
না। সাঈদ স্যারকে বের হয়ে যেতে দেখে অঞ্জন স্যারও বের হয়ে গেলেন। তার মানে অঞ্জন স্যার
ফিরে এলেই আমরা জানতে পারবো কী হচ্ছে।
কয়েক
মিনিটের মধ্যেই মনে হলো কলেজে হঠাৎ কিছু একটা হচ্ছে। নাসির স্যারের গলা শোনা গেল বাইরে
– “এই শংকর, সবাইকে ক্লাসে ঢুকাও। হ্যাই, সবাই ক্লাসের ভেতর ঢুক। কী কতা বোজা জায় না?”
ধুপধাপ
করে হুইসেল বাজিয়ে সবাইকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। মজিদ স্যার থাকতে ডিউটি অফিসার নামক
যে ব্যাপারটা চালু করেছিলেন – সেটা নতুন বিল্ডিং-এ এসে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন টিফিন
আওয়ারে শংকর স্যার হুইসেল নিয়ে রেডি থাকেন। আজ টিফিন আওয়ার শেষ হবার পনের মিনিট আগেই
সবাইকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তার মানে নায়ক ওয়াসিম হোমড়া-চোমড়া কেউ।
একটু
পরে অঞ্জন স্যার ফিরে এলেন ভেতরের খবর নিয়ে। এত দ্রুত এত ভেতরের খবর তিনি কীভাবে বের
করে নিয়ে আসেন কে জানে। জানা গেলো উচ্চ-প্রাচীর যিনি উচ্চ-লম্ফে অতিক্রম করে অলিন্দে
প্রবেশ করেছেন একটু আগে, তিনি অতীব উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রুপ-ক্যাপ্টেন – নতুন ওসি-এডমিন। তাঁর নাটকীয়
প্রবেশে কিছুটা অবাক হলেও ভাবিনি যে কিছুদিনের
মধ্যেই তাঁর কাজকর্মে আমাদের অবাক হবার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা বাক-রুদ্ধ হয়ে
যাবো।
সেদিন ছুটি হবার একটু আগে আমাদের জানিয়ে
দেয়া হলো আমাদের জেন্টস টিচার্স রুম নিচের তলা থেকে দোতলায় শিফ্ট করা হবে। দোতলায়
উঠে ডানদিকে গেলে করিডোরের শেষ-প্রান্তে ম্যাডামদের রুম। ম্যাডামদের রুমে যাবার আগে
আরেকবার রাইট টার্ন নিয়ে টয়লেট আর ভূগোলের পরীক্ষাগার পার হয়ে বড় রুমটাকে আমাদের টিচার্স
রুম করা হলো। এদিকের টয়লেটটা শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। এই
ব্যবস্থায় আমার বেশ ভালোই লাগলো।
জানা গেলো এই বিল্ডিং-টা প্রয়োজনে সাইক্লোন
শেলটার হিসেবেও ব্যবহার করা হবে। সাইক্লোনের ফলে জলোচ্ছ্বাস হলে নিচের তলায় পানি উঠতে
পারে। টিচার্স রুম নিচের তলায় থাকলে দরকারি ডকুমেন্ট ইত্যাদি নষ্ট হতে পারে। তাই এ
ব্যবস্থা। একদিনের মধ্যেই আমরা নিচের তলা থেকে দোতলায় উঠে গেলাম। প্রশাসনের দূরদৃষ্টির
প্রয়োগ দেখে বেশ খুশিই হলাম। নিচের তলার টিচার্স রুমে তিনি ঢুকেনওনি। এক লাফে বারান্দায়
দাঁড়িয়েছেন, এই কয়েক সেকেন্ডেই তিনি সব দেখে সিদ্ধান্তও দিয়ে দিলেন। এ তো দেখি শরৎচন্দ্রের
দত্তার নায়ক ডাক্তার নরেন মুখুয্যের মতো অনেক দূর থেকে রোগিনীকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখেই রোগ নির্ণয় করে ওষুধ লিখে দেন।
নাসির স্যার নিজে এলেন আমাদের জিনিসপত্র
সব দোতলায় ঠিকমতো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কী না দেখতে। আমাদের রুমের আলমারি সরানোর পর দেখা
গেলো সেখানে তিন চারটি ব্যাঙ। এই উভচর প্রাণিগুলি যেখানে ঢুকতে পারে – সেখানে তাদেরকে অনুসরণ করে সাপও
ঢুকতে পারে। শুনেছি ব্যাঙ নাকি কোন কোন সাপের প্রিয় খাবার। এখন দোতলায় নিশ্চয় সাপ উঠতে
পারবে না। কতৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার। নাসির স্যারকে বললাম, “আমাদেরকে উপরে তুলে দেয়ার জন্য
ধন্যবাদ স্যার।“
“বেশি
খুশি হয়ো না প্রদীপ। উপরে তুলে আছাড় দিলে ব্যথা বেশি লাগে। কিছুদিন পর টের পাবা। “– নাসির স্যারকে কেমন যেন বিষন্ন
মনে হলো। তিনি কি কোন দুঃসময়ের ইঙ্গিত করলেন?
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর শুক্রবার
ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা হলো। সপ্তাহে দু’দিন
ছুটি – আর চাই কী! সাঈদ
স্যার আর মহিউদ্দিন স্যার খুব দ্রুত রুটিন নিয়ে বসলেন। শনিবারে সবগুলি ক্লাস বাকি পাঁচ
দিনের মধ্যে এডজাস্ট করে দেয়া হলো। আগে বৃহস্পতিবার চার পিরিয়ড হয়ে ছুটি হয়ে যেতো।
অন্য দিনগুলিতে টিফিন আওয়ারের আগে চার পিরিয়ড আর পরে তিন পিরিয়ড করে প্রতিদিন সাত পিরিয়ড
ক্লাস হতো। এখন সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস। তাই প্রতিদিন আটটি করে পিরিয়ড করা হলো। টিফিনের
আগে চার, পরে চার। আগে সপ্তাহে ছয়দিনে মোট পিরিয়ডের সংখ্যা ছিল ৩৯, এখন সপ্তাহে পাঁচদিনে
মোট পিরিয়ড হলো ৪০। একটা পিরিয়ড বেড়ে গেলেও সপ্তাহে একদিন কম আসতে হবে, তাই আমরা সবাই
বেশ খুশি হয়ে গেলাম। আমাদের কর্মক্ষমতাও মনে হলো কিছুটা বেড়ে গেলো। এই কারণেই তো সরকার
সপ্তাহে দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি।
আমরাও তাহলে উন্নত হচ্ছি।
দৈনিক ক্লাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে
টিফিন আওয়ারে আমাদের বেশ তাড়া থাকে। গ্যাপও খুব একটা থাকে না। আমাকে পুরনো বিল্ডিং-এও
আসা-যাওয়া করতে হয়। এর মধ্যেই যেটুকু ফাঁক পাওয়া যায় – টিচার্স রুমে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা চলে।
টিচারদের অনেকেই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন। একদিন শুনলাম ফারুকী স্যার সিমেন্টের
দর কত জিজ্ঞেস করছেন অঞ্জন স্যারকে। আমি ভাবলাম
ফারুকী স্যার বাড়ি তৈরি করছেন। না, জানা গেল তিনি সিমেন্টের শেয়ার কিনছেন। আরো অনেক
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের মতো এই শেয়ার মার্কেট ব্যাপারটাও আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকে না।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুমন অর্থনীতির ওস্তাদ টিচার। একদিন আমাকে ধরে শেয়ার মার্কেটের
অনেক কিছু বোঝালো। কত সহজে কম টাকা বেশি টাকায় পরিণত হয়ে যায় – তা আমাকে পানির মতো বুঝিয়ে দিলো।
কিন্তু পানির মতোই তা দ্রুত বাষ্প হয়ে গেল আমার মাথা থেকে। টিচার্স রুমে শেয়ার মার্কেট
সম্পর্কিত আলোচনা অনেকদিন চললো।
এদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও রাজনীতি-সচেতন
এবং অতিসচেতন অনেকেই কথা বলেন। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান ঘটেছে। এ নিয়ে কয়েকজনের
মধ্যে খুব উচ্ছ্বাস দেখা গেলো। তাদের কার্যকলাপ আমাদের দেশের সংবাদপত্রে নিয়মিত ফলাও
করে প্রকাশিত হচ্ছে। রাস্তায় ধরে ধরে মানুষ পেটানো হচ্ছে, দোররা মারা হচ্ছে এই খবরগুলি
খুবই আগ্রহ ভরে উচ্চস্বরে পাঠ করা হয় আমাদের টিচার্স রুমে।
এর মধ্যে আমাদের প্রথম দুসংবাদ এলো।
শহর থেকে আসা-যাওয়ার জন্য বিমান-বাহিনীর গাড়ি আর দেয়া হবে না। জানা গেলো শুধুমাত্র
অফিসারের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকবে। যে অফিসারের জন্য এতদিন গাড়ি দেয়া হয়েছিল সেই
অফিসার বদলি হয়ে গেছেন। এখন আর কোন অফিসার ঘাঁটির বাইরে থাকেন না। সুতরাং নো মোর গাড়ি।
মনে হচ্ছে আমি এতদিন এতদিন একটা ভাবনার বেলুনে বাস করছিলাম। সেই ভাবনাটা ছিল এরকম – বিমান বাহিনী গাড়ি পাঠিয়ে তার
কর্মীদের এবং সাথে শিক্ষকদের সকালে নিয়ে আসেন, আবার বিকেলে দিয়েও আসেন। এখন ভাবনার
বেলুন ফেটে চুপসে গেছে। শিক্ষকরা বিমান বাহিনীর স্কুল ও কলেজে পড়ান ঠিকই। কিন্তু আসলে
বাহিনীর কেউ তারা নন। অন্য সব বেসরকারি শিক্ষকদের মতোই সাধারণ শিক্ষক তাঁরা। সরকার
যে বেতন দেয়, তার সাথে আমরা সরকারি স্কেলের ঘরভাড়াটা পাই। অন্য অনেক বেসরকারি স্কুল-কলেজ
থেকে এটুকুই আমাদের পার্থক্য। চকবাজার থেকে শহর এলাকার বাসে আসার অসহনীয় কষ্ট শুরু
হলো।
এর মধ্যে বিমল স্যার উদ্যোগী হলেন নিজেদের
মধ্যে একটা মিনিবাস ভাড়া করার জন্য। শুধুমাত্র শহর থেকে যে ক’জন শিক্ষক আসেন তাদের নিয়ে খরচে
পোষাবে না। শিক্ষার্থীদেরও সাথে নিতে হবে। আমি আর বিমল স্যার কলেজের ক্লাসে ক্লাসে
গেলাম, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললাম। রিফাৎ আরা ম্যাডাম, সংযুক্তা ম্যাডাম, আইভী ম্যাডাম,
ছোলাইমান স্যার, অঞ্জন স্যার সবাই শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার পর একটা বাস ভাড়া করার
ব্যবস্থা হয়ে গেল। অঞ্জন স্যারের পরিচিত একজনের বাস ঠিক করা হলো। শাহীন কলেজের শিক্ষকদের
উদ্যোগে প্রথম কলেজ-বাস চালু হলো। শাহীন কলেজ লেখা একটা ছোট্ট বোর্ড গাড়ির ড্যাসবোর্ডে
থাকে। প্রতিদিন সকালে চকবাজার থেকে ছাড়ে এই
বাস। আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালি, নিউমার্কেট, টাইগার পাস, দেওয়ান হাট, আগ্রাবাদ – আমাদের পরিচিত রুট। কিন্তু মাঝে
মাঝে এই গাড়িকে ঢুকতে দেয়া হয় না ঘাঁটির ভেতর। তখন আমাদের ঘাঁটির গেটে নেমে যেতে হয়।
অবশ্য গেট থেকে কলেজের নতুন বিল্ডিং-এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। এটুকু পথ হাঁটতে আমাদের
গায়ে লাগে না।
আমরা মনে হয় একটু বেশি আনন্দেই ছিলাম
কয়েক সপ্তাহ। বিশেষ করে আমরা যারা ঘাঁটির বাইরে থেকে আসি – ঘাঁটির ভেতরের কিছু পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়েনি।
কিন্তু আমাদের সহকর্মীদের যাঁরা বারো কোয়ার্টারে এবং ষোল কোয়ার্টারে থাকেন – তাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের
কিছু কিছু সিদ্ধান্তে খুবই অপমানিত এবং অসহায় বোধ করছিলেন। কোয়ার্টারের সামনে-পেছনে
আঙিনায় শাক-সবজি চাষ করেছিলেন অনেকে। একদিন তাঁদের সবার শাক-সব্জির বাগান তছনছ করে
ফেলা হলো। কেউ কেউ মুরগি পুষতেন। সেই মুরগির খামার ভেঙে দেয়া হলো, মুরগিগুলি জব্দ করা
হলো। এর পেছনে গ্রহণযোগ্য যুক্তি কী হতে পারে সে ব্যাপারে কারোরই কোন ধারণা নেই। কেবল
এটুকু জানা গেলো – উর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষের হুকুম। আমাদের সবার দাদাভাই কাশেম স্যারকে এতটা মন খারাপ করে থাকতে আগে
কখনো দেখিনি।
কলেজের পরিবেশে কেমন যেন একটা দমবন্ধ
ভাব চলে এসেছে। এর মধ্যেই হাসিঠাট্টা যতটুকু করা যায় করছি। পুরনো বিল্ডিং-এ ক্লাস নিতে
গিয়ে হাতে সময় থাকলে টিচার্স রুমে বসে সিরাজ স্যারের সাথে আড্ডা মারি কিছুক্ষণ। সিরাজ
স্যার পরিসংখ্যান থেকে পাস করেছেন। তাঁর বেশিরভাগ ক্লাসই প্রাইমারি সেকশানে – পুরনো ভবনে। তিনি চট্টগ্রামের
নন, অথচ চট্টগ্রামের ভাষাটা এত চমৎকার বলেন যে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। অনেকগুলি শব্দের
আদিরূপ তিনি ব্যবহার করেন –
যা হঠাৎ শুনলে আদি-রসাত্মক বলে মনে হয়। তাঁর সাথে আমার সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলে সিনেমা
সংক্রান্ত। তিনিও আমার মতো প্রচুর সিনেমা দেখেন।
আজ তাঁর সাথে সিনেমার গানের প্রতিযোগিতা
শুরু হয়েছে। নিয়ম হলো- তিনি একটা গান বলবেন, আমাকে বলতে হবে কোন্ সিনেমার গান সেটা।
তারপর আমি বলবো, তিনি উত্তর দেবেন। সিরাজ স্যারের গানের গলাও চমৎকার। মাঝে মাঝে তিনি
গান গাইবার সময় উঠে দাঁড়িয়ে গানের দৃশ্যের অভিনয়ও করেন। যেমন সুর করে শাবানার মতো হাত
তুলে গাইলেন, “ওরে ও পরদেশী,
ও পরদেশী, যাবার আগে দোহাই লাগে একবার ফিরে চাও, আবার তুমি আসবে ফিরে আমায় কথা দাও।“ গানের প্রথম লাইন শুনেই এটা
যে আসামী সিনেমার গান তা বলে দেয়া যায়। কিন্তু আমি অপেক্ষা করলাম আরো কিছুদূর শোনার
জন্য। সিনেমার নাম বলার পর সেই সিনেমা আমরা কে কোন্ হলে দেখেছিলাম, রাজ্জাক কীভাবে
ঘোড়া ধরে হেঁটেছিল এসব নিয়েও কথা বললাম। আমার ধারণা ছিল আমি ছাড়া মাস্টারদের মধ্যে
আর কেউ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে না। কিন্তু সিরাজ স্যারকে নিজের দলে পেয়ে খুবই উৎসাহ লাগছে।
তাঁকে আমার জানা কোন গান দিয়েই আটকানো যাচ্ছে না। বরং তিনি আমাকে অনেক গানে আটকে দিচ্ছেন।
এবার অনেক ভেবেচিন্তে একটা একেবারে নতুন জনপ্রিয় গানের লাইন বললাম।
“তেঁতুল
পাতা তেঁতুল পাতা তেঁতুল বড় টক যে
তোমার
সাথে প্রেম করিতে আমার বড় শখ যে।
বলেন
এটা কোন্ সিনেমার গান।“
সিরাজ
স্যারের কপালের ভাঁজ দেখে বুঝতে পারছি এই সিনেমার নাম তাঁর মনে পড়ছে না।
“সুর
বলেন।“
আমি
মহা উৎসাহে গাইতে শুরু করলাম, “তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা তেঁতুল বড় টক যে, তোমার সাথে
প্রেম করিতে আমার বড় শখ যে। আ-হা আ-হা।“ লাইনের শেষের আ-হা আ-হা উচ্চারণ করার সময় এক
ধরনের তরল ভঙ্গী থাকে। যেটা আলাদাভাবে শুনলে অন্য কিছুর শব্দ বলে মনে হতে পারে। রবীন্দ্রসঙ্গীতভক্তরা
এই ভঙ্গী শুনলে তেড়ে মারতে আসবেন। আমি খুবই উৎসাহ সহকারে আ-হা আ-হা করতে করতে দেখলাম
সিরাজ স্যার সিরিয়াস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে গেছেন। টিচার্স রুমের দরজার দিকে মুখ করে
বসেছিলেন তিনি। আমি ‘আ-হা’ থামিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম বারান্দায় ওসি এডমিন স্যার তাঁর
স্থূলদেহী সহকারীর সাথে দাঁড়িয়ে আছেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। মনে হচ্ছে রাজদুলারী
সিনেমার ওয়াসিম আর জসিম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তলোয়ার-যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যে দূরত্বে
দাঁড়িয়েছেন সেখান থেকে আমার ‘আ-হা আ-হা’ না শোনার কোন কারণ নেই। ঐদিন
তাঁর জুতার যেরকম জোরালো খট খট শুনেছিলাম – আজ এত নিঃশব্দে কীভাবে এলেন! তাঁদের সাথে
কলেজের কেউ নেই। তার মানে তিনি কাউকে না জানিয়ে এসেছেন এখানে কী হচ্ছে তা দেখতে। আমার
সঙ্গীত প্রতিভার বিকশিত রূপ দেখে তিনি নিশ্চয় খুশি হননি। ‘আ-হা, আ-হা’ শব্দ-যুগল যে
গানেরই অংশ, অন্য কিছু নয় – তা কি বিনীতভাবে বলে দেবো? তেঁতুল পাতার টক তো আমার সব
শখের দফারফা করে দিলো আজ। হঠাৎ মনে হলো – তিনি আমার গান শুনেছেন, আমার চেহারা তো দেখেননি।
রুমের ভেতর না এলে আমাকে দেখতেও পাবেন না। চুপচাপ বসে থাকা যাক।
কয়েক
সেকেন্ড পরেই সিরাজ স্যারের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জানালা দিয়ে দেখলাম ওয়াসিম
স্যার তাঁর সহকারী জসিমকে নিয়ে মাঠের ঘাস মাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন অন্যদিকে। তাঁরা কী পরিকল্পনা
করছেন তা আমার না জানলেও চলবে। আমাকে ক্লাসে যেতে হবে।
পুরনো
ভবনের ক্লাস শেষ করে বের হয়ে দেখি রিকশা গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আজ শাহ-আলম লুঙ্গির বদলে
প্যান্ট পরে এসেছে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি রিকশা-ওয়ালার লুঙ্গির উপরও পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ
নেই। ফিফ্থ পিরিয়ডে জানানো হলো সিক্সথ, সেভেন্থ ও এইটথ পিরিয়ড ক্লাস-মনিটরদের দায়িত্বে
দিয়ে আমরা সবাই যেন তিন তলায় সেকেন্ড ইয়ারের খালি রুমে বসি। ওসি-অ্যাডমিন শিক্ষকদের
সাথে জরুরি মিটিং করবেন। আমি একটু উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলাম। তিনি কি মিটিং-এ শিক্ষকদের বাগান
করা, মুরগি পালার মতো গান করাও নিষিদ্ধ করে দেবেন?
পুরনো
বিল্ডিং থেকেও সব শিক্ষকরা চলে এলেন মিটিং-এর জন্য। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত এমনিতেই এসময়
ছুটি হয়ে যায়। বাকি দুই ক্লাস সেখানেও মনিটরদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আয়া-পিয়নরা আছে।
ডায়াসের
উপর চারটি চেয়ার এনে বসানো হয়েছে ক্লাসের বড় টেবিলের পেছনে। আমরা সবাই চুপচাপ বসে আছি।
ম্যাডামরা সবাই উপস্থিত। জোরে কথাও বলছেন না কেউ। আমি পেছনের দিকের একটা বেঞ্চে সিরাজ
স্যারের পাশে বসলাম। সিরাজ স্যার ফিসফিস করে বললেন, “গানটা কোন্ সিনেমার?”
“কোন্
গান?”
“তেঁতুল
পাতা তেঁতুল পাতা”
“নাম
বলে দেবো? নাকি আরো চিন্তা করবেন?”
“নাম
বলতে হবে না। কে কে আছে বলেন।“
“সালমান
শাহ, তার সাথে একটা নতুন নায়িকা – বৃষ্টি, আলীরাজ, তমালিকা”
“কোন্
তমালিকা? টিভিতে যে নাটক করে?”
“হ্যাঁ,
তমালিকা কর্মকার।“
“তাহলে
তো এটা রিসেন্ট সিনেমা। তাইতো মনে পড়ছে না। এই সিনেমা আমি দেখি নাই।“
আমি
কিছু বলার আগেই সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। রুমে ঢুকলেন অ্যাকটিং প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, ওসি
এডমিন এবং তাঁর হৃষ্টপুষ্ট সহকারী, এবং তাঁদের পেছনে ডায়েরি হাতে নাসির স্যার। এরকম
মিটিং-এ তিনি নোট নেন।
ডায়াসের
উপর রাখা চারটি চেয়ারে তাঁরা চারজন বসলেন। তারপর আমরা সবাই বসলাম। ওসি অ্যাডমিনের সাথে
শিক্ষকদের এটাই প্রথম মিটিং। তাঁর চেহারার সাথে নায়ক ওয়াসিমের অনেক মিল। সরু গোঁফ,
মেদহীন শক্ত চোয়াল। কথা বলার সময় মুখে একটা হাসি-হাসি ভাব ধরে রাখেন। ঠান্ডাভাবে কথা
শুরু করলেন তিনি।
“বিমান
বাহিনী পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ সবাই পায় না। আপনারা সেই সুযোগ
পেয়েছেন, সেই কারণে আপনাদের খুব খুশি থাকার কথা। আমি কিছু বলার আগে আপনাদের কাছ থেকে
শুনতে চাই। আপনাদের কারো কিছু বলার থাকলে আগে বলেন।“
গোঁফের
ফাঁকে হাসি ঝুলিয়ে আমাদের সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। তাঁর সহকারী জসিমও পুষ্টমুখে
তাকিয়ে আছেন। অ্যাকটিং প্রিন্সিপাল ম্যাডাম,
ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার – সবাই তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। কেউ কোন কথা বলছেন না।
“বলুন,
আপনারা কেউ একজন, যদি আপনাদের কিছু বলার থাকে।“ – তিনি আবার বললেন। তাঁর গলায় অনুরোধ
নয়, অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুর। বাঘের সাথে কথা বলার মতো বাঘ আমাদের একজনই আছেন – রিফাৎ
আরা ম্যাডাম। তিনি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। এমন গম্ভীর পরিস্থিতিতে হাসতে পারা চাট্টিখানি
কথা নয়।
“স্যার
ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে বলবো?” – রিফাৎ আরা ম্যাডাম প্রশ্ন করলেন। যাঁকে প্রশ্নটা করা
হয়েছে তিনি যদি প্রশ্নের ভেতরের হিউমারটা ধরতে পারতেন তাহলে হো হো করে হেসে উঠতেন।
কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। সেন্স অব হিউমার যাদের থাকে না – তাদের হাতে অতি উন্নত মানের
হিউমারেরও মৃত্যু ঘটে।
“বলেন,
কী বলতে চান।“
“স্যার,
আমাদের তো বলার আছে অনেক কিছুই। আমাদের প্রত্যেকের এত বেশি ক্লাস নিতে হয়, তার উপর
ক্লাস টেস্ট, পপ টেস্টের খাতা দেখা, পরীক্ষার খাতা দেখা। অন্যান্য স্কুল-কলেজে পরীক্ষার
খাতা দেখার জন্য আলাদা সম্মানী দেয়া হয়। আমাদের চিকিৎসা-ভাতা মাত্র একশ’ টাকা। মাতৃত্বকালীন
ছুটি মাত্র এক মাস। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। …” রিফাৎ আরা ম্যাডাম অনেক
কিছুই বললেন যা আমাদের সবার মনের কথা। ওসি এডমিন স্যার নির্বিকারভাবে শুনলেন। তারপর
ঠান্ডা গলায় বললেন, “আর কিছু বলবেন?”
তাঁর
গলায় এমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল – যা যে কারো উৎসাহ নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
“আপনাদের
কথা শুনলাম। এবার আমার কথা শোনেন। আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনারা সবাই এখানে মাগনা
কাজ করেন। আপনারা যে বেতন পান, তা অন্য যে কোন স্কুল-কলেজের চেয়ে বেশি। আপনারা যে ঘরভাড়া
পান – তা আর কোন্ বেসরকারি কলেজে দেয়? এরকম একটা প্রেস্টিজিয়াস কলেজে চাকরি করেন আপনারা।
অথচ আপনাদের কলেজের প্রতি সেরকম কোন ডেডিকেশান আমি দেখছি না। আমি চার্জ নেবার পর থেকে
আপনাদের সবার কাজকর্ম ওয়াচ করেছি। কারোরই কোন ডেডিকেশান নাই। আপনারা শিক্ষক। অথচ আমি
দেখলাম আপনারা গরু পালেন, ছাগল পালেন, হাসমুরগি পালেন। গরু-ছাগল-হাস-মুরগির পেছনে সময়
দেন, অথচ বলেন খাতা কাটার সময় পান না। খাতা কাটার জন্যও আলাদা করে পয়সা দিতে হবে আপনাদের?
আপনাদেরকে থাকার জন্য বাসা দেয়া হয়েছে। আপনারা সেখানে শাক-সব্জির খামার করে ফেলেছেন।
আপনারা তো চাষী না। আপনারা শিক্ষক। শিক্ষা বাদ দিয়ে চাষবাস করলে মাস্টারি করতে এসেছেন
কেন? মাস্টার হয়েছেন, মাস্টারের মতো থাকবেন। ডেডিকেশান দিয়ে মাস্টারি করবেন। ক্লাসে
ঠিকমত পড়াবেন না, অথচ ব্যাচের পর ব্যাচ প্রাইভেট পড়াবেন। এটা তো চলতে দেয়া যায় না।
প্রাইভেট পড়ানোর জন্য আপনারা সপ্তাহে দুইদিন ছুটি করে নিয়েছেন। আর কী যেন বললেন – ও
মেটারনিটি লিভ। একমাসের বদলে তিন মাস করলে তো আপনারা বছর বছর সন্তান জন্ম দেবেন, আর
মেটারনিটি লিভ নিতে থাকবেন।“
অপমান
করার নির্লজ্জ ক্ষমতা আছে এই মানুষটির। এরপর আরো অনেককিছু বলেছেন তিনি, যার প্রত্যেকটি
শব্দ অপমানজনক। বলছেন – পোষালে থাকেন, নইলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান, আপনাদের কেউ বেঁধে
রাখেনি এখানে।
তাঁর
প্রত্যেকটি কথার প্রতিউত্তর দেয়া যায়। দু’দিন ছুটির সিদ্ধান্ত কি আমরা মাস্টাররা নিয়েছি?
সরকারি সিদ্ধান্ত শাহীন কলেজের সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সব শাহীনেই
দু’দিন ছুটি। তারপরও আমাদের শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে বেশি ক্লাস পাচ্ছে। এত নিবেদিতপ্রাণ
হয়ে কাজ করার পরেও যদি আমাদের এই মূল্যায়ন হয়, এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে! মিটিং
থেকে বের হয়ে আমরা কেউই কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ছুটির পর যখন সবাই বাসে উঠছি
– মনে হচ্ছে কোন শবযাত্রায় অংশ নিচ্ছি। মাথার ভেতরটা অপমানের যন্ত্রণায় ভোঁতা হয়ে গেছে।
বাসে
এখন অনেক ছাত্র-ছাত্রী। সিট ভর্তি হয়ে অনেককে দাঁড়িয়েও যেতে হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য
তারা সামনের সিট ছেড়ে দেয়। আমি অনেক সময় তাদের ডিস্টার্ব না করে পেছনের খালি সিটে গিয়ে
বসি। আজও একটু ভেতরের দিকে বসেছি জানালার পাশে। বাস বন্দরটিলা বাজারে জ্যামে আটকে আছে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার সামনের সিটে বসা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে দুটোর একজন আরেকজনকে বলছে
– দ্যাখ দ্যাখ, প্রদীপ স্যারের সেলুন। তারপর দুজন একসাথে হেসে উঠল।
দেখলাম
রাস্তার পাশের একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে - প্রদীপ হেয়ার কাটিং সেলুন। আহা, ইহার চেয়ে
হতেম যদি…
No comments:
Post a Comment